ভালবাসার গল্প (শেষাংশ)
লিখেছেন লিখেছেন দীপু সিদ্দিক ০১ আগস্ট, ২০১৬, ০৭:৫১:০৩ সন্ধ্যা
বি.এ. পাশ করে সরকারী চাকুরী শুরু করলাম। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকতার পদ। বন্ধুরা খুব বাহবা দিলো। মাকে নিয়ে ঢাকায় এসে রামপুরায় খুব সুন্দর একটা বাড়িতে উঠলাম। বাড়িটার সামনের দিকে অনেক বড় বারান্দা। তার সামনে সুন্দর একটা বাগান।
কাজের খুব চাপ। সারাদিন অফিসে কাজ করেও বাসায় এসে পরেরদিনের কাজের পরিকল্পণা করতে হতো। তবে হাজার ব্যাস্ততার মাঝেও নুড়িকে মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারছিলাম না। প্রতি সন্ধ্যায়’ই যেন ভীষণ রকম মন খারাপ করতে চাইত। মাকে কষ্ট না দেয়ার জন্য কিছুতেই উপরে উপরে এসবের কিছুই পাত্তা দিতে চাইতাম না।
শত হলেও মায়েদের মন। কিছুতেই এড়ানো যায় না। তার উপরে মা আমার ভীষণ শক্ত মা। প্রতি দিনই সন্ধ্যার আধো অন্ধকার বারান্দায় নিরব হেটে মা আমার পাশের চেয়ারে এসে বসত। বলতো, ‘কিরে, তোকে চা করে দেবো ছোটন?’ মা জানত আমি চা খাবো না, তাও বলতো।
‘না, মা।‘ দুজনেই কিছুটা নিরব থাকতাম আমরা।
‘মা’ আমিই প্রশ্ন করতাম নিরবতা ভেঙ্গে।
‘হু!’
‘কি কি করলে আজকে?’
‘এইতো ঘরদোর গোছালাম। তোর জন্য রান্না করলাম। কাচা আমের আচার করেছি তোর জন্য। এনে দেবো? খাবি?’
‘না, মা। এখন আর দরকার নাই।’
‘তোর কি শরীর খারাপ বাবা?’
‘না, মা।’ আমি মৃদু হেসে বললাম। ‘শরীর খুবই ভাল। অফিসের কাজ নিয়ে চিন্তা করছি একটু।’
মা জানতো আমার মন খারাপ। কিন্তু মা আমাকে কোন দিনও বলেন নি যে ‘বাবা মন খারাপ করিস না’। অথবা জিজ্ঞেস করেন নি আমার মন খারাপ কি না। মা কখনোই এ প্রসঙ্গে কিছু বলত না। পাছে আমি কষ্ট পাই ভেবে আমায় মনে করিয়ে দিতে চাইতো না।
প্রায়ই আপুর বাসাতে যাওয়া আসা হতো আমাদের। আপুও আমাদের বাসাতে মাঝে মাঝেই আসত। ঢাকায় মাকে নিয়ে আসার পর আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য আপু তোড় জোড় শুরু করলো। দেখা হলেই ও মাকে বলত ‘মা ছোটনকে বিয়ে দিয়ে দাও প্লিজ! তুমি আর কত কষ্ট করবে। এবার ঘরে একটা লক্ষী বউ আনো প্লিজ।’ মা ওকে কিছু বলতো না। শুধু শুকনো মুখে আমার দিকে তাকাতো। কিছুই বলতো না।
মাঝে মাঝে আপু এসে বলতো ‘মা মগবাজারে একটা মেয়ে দেখতে যাব। ছোটনের সাথে মানাবে ভালো। এবারই বি.এ. পাশ করলো। ছোটনকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে চলো। মেয়েটাকে দেখে আসি।’
‘ছোটনকে আগে বলে দেখ, ও রাজি আছে কি না।’ মা দ্বিধা:স্বরে বলতো।
মায়ের মত আপুও যেন বিয়ের ব্যাপারে আমাকে কিছু বলতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলো। ইতস্তত করে বলতো ‘তুমি শুধু ওকে আমাদের সাথে যেতে বল মা। তুমি বললেই ও রাজি হয়ে যাবে।’
আমার মা আর আপু এটুকু পর্যন্ত করেই হাল ছেড়ে দিত। মাঝে মাঝে মা দুর থেকে বড় বড় দীর্ঘস্বাস ফেলত। আপু মায়ের ঘরে বসে নিচুস্বরে কাঁদত আমার কথা বলে বলে।
এর মাঝে আপুর ছেলে মেয়ে হলো। আমাদের বাড়িতে ওর আসা যাওয়ার পরিমাণও কমে যেতে লাগল। সময়ের ব্যাবধানে আপুর কান্না কমতে শুরু করলো আর আমার মায়ের দীর্ঘস্বাস বাড়তে লাগল।
আমার মনের ভেতরেও যেন অস্থীরতা আরো বাড়তে লাগল। ক্রমাগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাইরের দিক থেকে শরীরটা যেন আরো কুঁকড়ে যেতে লাগল, আরো বেশি স্থীর, শান্ত হতে লাগল।
মনের অস্থীরতাটা অসুস্থতার পর্যায়ে চলে গেল মাকে হারানোর পর। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হত সব সময়ে। মনে হত মা আমার মনে আনেক কষ্ট নিয়ে চলে গেলো।
কাজে তেমন মন বসাতে পারতাম না। কাগজ কলমের কাজের মধ্যে ক্রমাগত মানুসিক চাপ বাড়ছিলো। দিনে দিনে বিষন্নতা বাড়ছিলো। আপু আমাকে বিয়ে করানোর জন্য রাখ ঢাক না রেখে এবার সরাসরি আয়োজন শুরু করল। আপুর এই বিয়ে নিয়ে তোলপাড়ের বিষয়টা যেন আমার বিষন্নতাকে আরো বিষিয়ে তুলল। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিলো দেশ ছেড়ে চলে যাই। অথবা কুমিল্লায় নুড়ির কাছে চলে যাই। গিয়ে ওর সাথে ঝগড়া করে মনের ঝাল মেটাই। অথবা খুনোখুনি করে ফেলি।
একদিন অবুঝের মতই একটা পাগলামি করলাম। আজিমপুরের ‘আহসানিয়া এতিমখানা’য় গিয়ে এতিম বাচ্চাগুলোর সাথে একটা দিন কাটাতে মন চাইল। কিছু চকলেট চানাচুর নিয়ে চলে গেলাম। ওখানে গিয়েই মনে হলো এসব বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে থাকলে কেমন হয়?
চাকুরীটা ছেড়ে দিলাম। বন্ধুবান্ধবেরা কেউ কেউ অবাক হলো। হাসাহাসি করলো। কেউ কেউ আমাকে পাগল বললো। কেউ কেউ আবার দু একটা ভাল কথা বলল, সাহায্য করতে চাইলো। একটা ট্রাস্ট করলাম। প্রথম ৫ বছরের মধ্যেই একটা থেকে দুইটা ‘অরফান হাউজ’ বানালাম। ৩৫ জন অনাথ শিশু নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলাম। ৫ বছর শেষে ৭৩৮ এতিম বাচ্চা বড় হতে লাগল আমার সাথে।
জীবনের এই পর্বে আমি এখন ৫৩ বছরের একজন মানুষ। চুল দাড়িতে ভাল রকমের পাক ধরেছে। চারদিকের হাজার রকম কাজ কর্মের চাপে জীবনের ভালমন্দ ভাবার আর সময় হয় না।
গত সপ্তাহে রতন ফোন করেছিলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। অনেক গর্ব নিয়ে জানালো, সে প্রথম বর্ষের পরিক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। আমাদের অরফান হাউজে, আমার সাথে বড় হওয়া সেই রতন।
ঢাকার ছোটখাট পত্রিকার উঠতি সাংবাদিকরা আমাকে নিয়ে, আমাদের অরফান হাউজ নিয়ে প্রতিবেদন লেখে। শুনি, ভাগ্নে ভাগ্নিরা আমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করে। এতিম অনাথ শিশুদের জন্য নাকি তাদের মামা নিজের জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছে, চিরকুমার থেকে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আপুর বাসায় যাই। ভাগ্নে ভাগ্নিরা আমাকে সম্মান দেখায়। আদর করে চেয়ার টেনে দেয়। আপু কিছুই বলে না। আমার দিকে করুণ চোখে তাকায়।
মাঝে মাঝেই মনে হয়, কৈশরের সেই কারণহীন, যুক্তিহীন ভালবাসার কি কোন প্রয়োজন ছিলো আমার জীবনে? মাঝে মাঝে যে সন্দিহান হয়ে পড়িনা, তা নয়। তবু মন মানতে চায় না। কত কিছুই তো দেখলাম। কই, জীবনে প্রয়োজনের বাইরেতো কিছুই হয় না।
খবরে আসে কেউ কেউ ৩০ বছর আগের ভালবাসার মানুষকে খুজে বের করেছে। কেউ কেউ আবার বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করছে। নুড়িওতো আমার জীবনে এসেছিলো ৩৬ বছর আগে। আমি কি পারবো নুড়িকে খুজে নিয়ে নতুন সংসার করতে? অথবা নুড়ি কি পারবে সেটা? ভরসা পাই না।
নুড়িতো কোনদিন আর আমার খোজও নেয়নি। কোনদিন হয়তো খোজ কররেও না। ভাবতে পারিনা আর। মুখ বন্ধ হয়ে আসে। সবে ৫৩ বছর বয়স আমার। বয়োবৃদ্ধ হওয়ার অনেক দেরি। তবুও মনে হয় মরণ আমার মাথার উপর ঝুলে আছে। মনের ক্ষতটা ক্যান্সার হয়ে সারা শরীরে ছেয়ে গেছে। নিশ্চিত মনে হয়, অচীরেই মরণ আমায় মুক্তি দিবে এই তিক্ত বিষন্নতা থেকে। মনে মনে উপহাস করি নিজেকে। বলি, নুড়ি তোমাকে অনেক বছর আগেই ভুলে গেছে ছোটন।
অথবা নুড়ি এসে যদি বলে ‘আমি এসেছি ছোটন, চলো দুজনে মিলে সংসার শুরু করি’। তখন কি হবে? মন সায় দেয় না। মনকে বলি, সেই নুড়ি আর নেই। সে নিশ্চয় এখন অন্যরকম, অন্য মনের নুড়ি। পৃথিবীতে নুড়িরা একই রকম থাকতে রাজি নয়।
তবু মন মানেনা। কিছুতেই মানতে চায় না যেন।
বারান্দায় শেষ বিকেলের আবছা অন্ধকারে মনে হয় আমি মফস্বলে করম চাচার অন্ধকার চায়ের দোকানের কোনটাতে পুরনো কাঠের চেয়ারটায় বসে আছি। আমার সামনে বসা সেই আমার 'সাধাসিধে' নুড়ি। আমায় ফিস ফিস করে বলছে ‘ছোটন, তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও?’
প্রথমাংশ-এর লিংক: http://www.desh-bd.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/78529
দ্বিতীয়াংশ-এর লিংক: http://www.desh-bd.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/78539
বিষয়: সাহিত্য
২৪৬২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অথচ নুড়ি আপনাকে পরে মনেও রাখে নি । ঠিকই সে সংসারী হয়েছে, বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করেছে । আপনার সেই ক্যাপাবিলিটিও ছিল ।
আপনজনের চেয়ে এমন কেউ যদি আপনার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে যে আপনার ফিলিংসকে একটা পর্যায়ে যাবার পর আর মনেই রাখে না - এরকম জীবনে কখনই শান্তি আসবে না ।
আপনার উচিত ছিল ক্যাডার হবার পর মা আপুর চেষ্টা মোতাবেক সংসারী হওয়া । আপনি সেটা পারেন নি , নুড়ি পেরেছে ।
সুন্দর আর অতি গোছানো মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ থাকলো।
খুব সুন্দর হয়েছে আপনার লিখা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন