ভালবাসার গল্প (মধ্যাংশ)

লিখেছেন লিখেছেন দীপু সিদ্দিক ৩১ জুলাই, ২০১৬, ০৯:৩৯:৩৩ রাত

তিতুমীর কলেজে পড়াশুনাটা আমার ভালই চলছিলো। বাড়ি থেকে আসা নগদ টাকা আর অবসর সময়ে দু’একটা টিউশানি মিলিয়ে ভালই কাটছিলো আমার ছাত্র জীবন। নিয়মিত পড়াশুনা আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা। ক্রমাগত মফস্বলের চেয়ে ঢাকার জীবনকে ভাল লাগতে শুরু করল।

নুড়িকে চিঠি লিখতাম নিয়মিত। সপ্তাহে অন্তত একটা। চিঠি পাঠাতাম ওর কাছের বান্ধবি সোনালী’র ঠিকানায়। নুড়ি না বলে ওকে নাম দিয়েছিলাম ‘পদ্ম’। ছোটন না লিখে ও আমাকে লিখত ‘টগর’ বলে। প্রেমপত্রের সাংকেতিক ভাষা। সহজে ধরা পড়ার ভয় থাকে না। হা! হা!

ডাকপিয়ন ভদ্রলোক আলী আহমেদ। দু মাসের মধ্যেই আমার খুব পরিচিত ও আপনজনের মত হয়ে গেলো। প্রতি সপ্তাহে দেখা হতো ওনার সাথে। পঞ্চাশোর্ধ শুকনা মানুষটা আমাকে দেখে প্রতি সপ্তাহেই স্মীত হেসে বলত ‘ছোটন, দেখো বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে’। ব্যাস্ত সময়ের মধ্যেও মাঝে মাঝেই আমার সাথে খানিক বসত। টুকটাক গল্প করতাম আমরা। আমার বাড়ির গল্প। রাজশাহীতে পড়ুয়া ওনার বড় ছেলের গল্প।

প্রতি মাসেই মা আমাকে চিঠি লিখত। আপুও লিখত মাঝে মাঝে। তবে বেশিরভাগ সময়েই দেখতাম নুড়ির চিঠি। সেই গুটি গুটি হাতের লেখায় যত্নকরে লেখা আমার নাম ঠিকানা। সবার চিঠিতেই যেন বিষয়বস্তুর খুব একটা পার্থক্য থাকতো না। নিত্যদিনের আবেগ, উপদেশ আর খবরাখবর। ‘শরীরের দিকে যত্ন নিও!’ ‘খাওয়া দাওয়ার কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো?’ ‘প্রতিদিন একটা করে মুরগীর ডিম খেও!’ ‘আমাদের পাড়ার দর্জি হারুন চাচা পরশু মারা গেছেন। মাত্র ৪২ বছর বয়স। এলাকার সবার মন খারাপ।‘ ‘তোমার বন্ধু তারেকের অসুখ কি সেরে উঠেছে?’ ‘অপরিচিত লোকদের সাথে তেমন মিশতে যেও না!’ ‘গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে একটা দু:স্বপ্ন দেখেছি, খুব সাবধানে থেকো!

কিন্তু তার পরেও কেন যেন নুড়ির চিঠিগুলোকে অন্য চিঠিগুলোর তুলনায় বড় আপন আপন মনে হত। দুপুরের প্রচণ্ড গরমের পরে পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় বন্ধুরা মিলে রামপুরার দিকে ঘুরতে যেতাম। খোলা মাঠে হাটতে হাটতে নুড়ির কথা, নুড়ির চিঠির কথা ভাবতে ভালো লাগত।

পড়াশুনা শেষে নুড়িকে নিয়ে ঢাকায় সংসার পাতার পরিকল্পণা করা ছিলো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। এমনকি ‘এই বাসা ভাড়া দেওয়া হইবে’ সাইনবোর্ড লাগানো বাড়ির মালিকদের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে কথাও বলতাম মাঝে মাঝে।

তিতুমীর কলেজে আমার কাছের বন্ধুরা সবাই নুড়িকে চিনত। সময়ে অসময়ে মেয়েদের প্রসঙ্গ আসলে নুড়ির কথা তুলতাম বলেই হোক, অথবা চেনা অচেনা মেয়েদের সাথে নুড়ির তুলনা করতাম বলেই হোক, ওরা নুড়িকে ভাল করেই চিনত। সবাই এমনই জানত যে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বছর ঘুরতেই আমি ওকে ঢাকা নিয়ে আসছি।

এর মাঝে আপুর বিয়ে হয়ে গেলো। দুলাভাই ঢাকায় ব্যাবসা করেন। বেশ সম্ভ্রান্ত আর বনেদি ঘরের ছেলে। বিয়ের পর আপু ঢাকায় চলে আসায় বাড়িতে মা একা হয়ে গেলো। সংসারের কাজে সাহায্যের জন্য ঘন ঘন বাড়িতে যেতে হতো আমার।

নুড়ির সাথেও ঘন ঘন দেখা হতে লাগল। মফস্বলের বন্ধুদের সাথে আমরা বিকেলে একসাথে আড্ডা দিতাম। ফুচকা খেতাম। হাজার রকমের হাসি ঠাট্টা আর গল্প করতো সবাই। আর আমি ক্ষণে ক্ষণে নুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতাম। ওকে দেখে প্রতিবারই মুগ্ধ হতাম। নুড়িকে নিয়ে নিকট ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলোর পরিকল্পণা করতে আমি তখন খুবই উৎসাহী ছিলাম।

মাকে নুড়ির কথা বলতে প্রথমে মা রাজি হলো না। মন খারাপ করল। নুড়ির মত একটা সাদাসিধে মেয়ে কিছুতেই মায়ের মন ভরাতে পারছিলো না। মা তার ঢাকায় পড়ুয়া রাজপুত্রের জন্য অনেক সুন্দরি রাজকন্যা ধরে আনার স্বপ্ন কিছুতেই ভাঙ্গতে রাজি নয়।

মায়ের হাত ধরে হেসে বললাম ‘নুড়ি’ই আমার অনেক সুন্দরি রাজকন্যা মা। আমি জানি, নুড়িকে নিয়ে আমি অনেক সুখে থাকব।‘

মা আমার দিকে মমতা নিয়ে তাকালো এবং রাজি হয়ে গেলো। বলল ‘কালকে নুড়িকে আমাদের বাড়িতে একবার আসতে বলতো। আমি ভালমন্দ কিছু রান্না করি।‘ বলেই মা আমাদের কাজের ছেলে হাসানকে ডাকল আর পাকের ঘরে বুয়াকে নিয়ে জিনিসপত্রের ফর্দ তৈরি করতে লেগে গেল।

নুড়ি চিঠিতে লিখেছিলো ‘মায়ের জন্য চিন্তা করো না। আমি মাঝে মাঝেই মায়ের কাছে যাই। উনি খুব ভাল আছেন। খুব খুশির একটা খবর আছে। মা আমাকে বলেছেন- শিঘ্রই আমাদের বাড়িতে লোক পাঠাবেন। বাবা-মাকে দাওয়াত দিবেন। বিয়ের জন্য তৈরি হও’।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। নুড়িকে বিয়ে করার জন্য আমার আর তৈরি হওয়া হয় নি।

গল্পটা খুব একটা বড় নয়। মাসখানেক নুড়ির কোন চিঠি আসছিলো না। একদিন হঠাৎ-ই নুড়ির বেয়ারিং চিঠি। ‘বাবা আমাকে বিয়ে দেবার আয়োজন করেছেন। তাড়াতারি বাড়ি আসো। হয় জলদি আমাকে বিয়ে করার ব্যাবস্থা কর, না হয় এই বিয়ে বন্ধ কর। আমি এখন মরে যাবার অবস্থায় আছি।‘

আপু-দুলাভাই নুড়িদের বাড়িতে গেলো। মা নুড়ির বাবা মা’কে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনলো। কথা বললো। সমাজে আমি একজন সাধারণ ছাত্র, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা নাই। সমাজে পারিবারিক মর্যদা থাকলেও এরকম একটা ছেলের আশায় নিজেদের আদরের মেয়ের ভবিষ্যত অনিশ্চিত করতে কে’ই বা চায়। সরকারি কর্মকর্তার মত একজন যোগ্য পাত্রকে ওরা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

নুড়ির বিয়ে হয়ে যায় আমার বি.এ. পড়ার মাঝামাঝি সময়েই।

আমার সামনে ও কোন কান্নাকাটি করেনি। আমাকে চিঠি লিখে কোনো আবেগী কথাও লেখেনি। সত্যি বলতে কি, এর পর ও আমাকে আর কোন চিঠীই লেখেনি। নুড়ি আমাকে গোপনে বিয়ে করার প্রস্তাবও দেয়নি। অথবা আত্মহত্যারও কোন চেষ্টা করেনি।

মা বলেছিলো বিয়ের দুইদিন আগে নুড়ি আমাদের বাড়িতে এসেছিলো। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি মায়ের সাথে বসেছিলো। মা নাকি ওকে অনেক কথা বলেছিলো, এ কথা ও কথা জানতে চেয়েছিল, শান্তনা দিয়েছিলো। ও তেমন কোন উত্তর দেয়নি, অনুরোধ করেনি অথবা কাঁদেনি। চুপকরে মায়ের পাশে বসেছিলো আর ক্ষণে ক্ষণে মায়ের মুখ দেখছিলো। (চলবে)



প্রথমাংশ-এর লিংক: http://www.desh-bd.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/78529

শেষাংশ-এর লিংক: http://www.desh-bd.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/78563

বিষয়: সাহিত্য

১৮৪৭ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

375670
০১ আগস্ট ২০১৬ রাত ০২:৩৮
কুয়েত থেকে লিখেছেন : নুড়ির বিয়ে হয়ে যায় বি.এ. পড়ার মাঝামাঝি সময়েই ভালো অনেক ভালো ধন্যবাদ
০১ আগস্ট ২০১৬ বিকাল ০৫:১৫
311510
দীপু সিদ্দিক লিখেছেন : আপনার মন্তব্য পেয়ে সত্যিই ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
০৩ আগস্ট ২০১৬ রাত ০৮:৪২
311624
কুয়েত থেকে লিখেছেন : সত্যিই ভাল লাগল। ধন্যবাদ।Good Luck
375681
০১ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৯:৪২
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : আপনিও এবার ভাল একটি বউমা আপনার মাকে উপহার দিন।
০১ আগস্ট ২০১৬ বিকাল ০৫:১৬
311511
দীপু সিদ্দিক লিখেছেন : দেখাযাক, ছোটন কি করে? তবে সত্যি বলতে কি, 'ভালো একটি বউমা' সবার ভাগ্যে হয় না।
375682
০১ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৯:৪৬
হতভাগা লিখেছেন : সমবয়সী প্রেম করার এই একটা ঝামেলা ।

মেয়েদের হাত পা বড় হয়ে গেলেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায় । ছেলেদের পায়ের নিচের মাটি আগে শক্ত করতে হয় - এতে সময়ও লাগে ঢের।
০১ আগস্ট ২০১৬ বিকাল ০৫:১৭
311512
দীপু সিদ্দিক লিখেছেন : ঠিকই বলেছেন। জটিল দুনিয়ার মারপ্যাচে হিসেব, তাই না?
375734
০১ আগস্ট ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৩১
আফরা লিখেছেন : ভাইয়া আপনার লিখা পড়া কি এখনো শেষ হয়নি ? যদি হয়ে থাকে তাহলে দেরী না করে বিয়েথা করে ফেলেন তাহলেই এসব ভেবে আর মনে খারাপ না ।
০১ আগস্ট ২০১৬ রাত ০৮:১০
311533
দীপু সিদ্দিক লিখেছেন : সুপ্রিয় আফরা, আপনার পরামর্শ খুবই উপযোগী। তবে, দুশ্চিন্তা করবেন না প্লিজ। আমার মন খারাপ নেই। এটা আমার লেখা একটা গল্প মাত্র। Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File