মানুষের প্রথম ঘর: পাহাড়ের গুহা (পর্ব ০৪)

লিখেছেন লিখেছেন দীপু সিদ্দিক ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:৩১:০১ সন্ধ্যা

বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করা হতো প্রত্নপ্রস্তর যুগের সকল মানুষই পাহাড়ের গুহায় বসবাস করত। কিন্তু বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে সকল প্রত্নতাত্ত্বিকরাই স্বীকার করেন যে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের বেশিরভাগই গুহায় বসবাস করতো না। একারণে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের মধ্যে অল্প সংখ্যক যারা গুহায় বসবাস করত, প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে কেবল তারাই ‘গুহামানব’ হিসেবে পরিচিত। তবে মজার ব্যাপার হল প্রত্নপ্রস্তর যুগের সকল মানুষকেই এখনও পৃথিবীব্যাপি ‘গুহামানব’ হিসেবে ডাকা হয় বা সব প্রাগৈতিহাসিক মানুষকেই গুহামানবের সমান মনে করা হয়।

যাইহোক, ঐ সময়ের গুহাবসতির ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা ছিল যে, পৃথিবীর সকল স্থানে পাহাড় বা পাহাড়ের গুহা ছিল না। যেসব অঞ্চলেও ছিল সেখানকার বেশিরভাগ গুহাই ছিল অত্যাধিক ঠান্ডা, অন্ধকার ও বহুদিনের পরিত্যক্ত অবস্থার জন্য ভীষণ রকম বদ্ধ। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেতো যে, এগুলোতে বসবাসকারী বাঘ (যাকে গুহাবাঘ বলা হয়), ভাল্লুক, গুহাসিংহ, গুহাহায়েনা প্রভৃতির মত হিংস্র প্রাণি বসবাস করত। ফলে ঐ সময়ে গুহায় বসবাস করাটাও মানুষের জন্য খুবই প্রতিকূল ছিল। কারণ মানুষ ঐ সময়ে স্থায়ীভাবে কোন এক স্থানে খাদ্যের প্রয়োজনেই থাকতে পারে নি। কোন স্থানে কয়েকদিনের জন্য গিয়ে ওখানকার গুহায় আগে থেকে বসবাসকারী হিংস্র প্রাণির দলকে তাড়ানো বা হাজার বছর যাবত অন্ধকার ও বদ্ধ গুহাকে বসবাসযোগ্য করার বিষয়টি এত সহজ ছিল না। সে কারণে বেশিরভাগ সময়েই প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের বাইরের খোলা আকাশের নিচে, গাছের ডালে অথবা নিজেদের তৈরিকরা অস্থায়ী আশ্রয়ে বেচে থাকতে হয়েছিল। অবশ্য আগুনের আবিষ্কার হওয়ার পর এই কাজটা কিছুটা সহজ হয়েছিল।

ফ্রান্সের ‘গটে দ্যু ভালোনেট’ গুহাটির কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানুষের গুহা ব্যাবহারের নমুনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া উদাহরনের মধ্যে এটিই সবচেয়ে পুরোনো। প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে গুহাটিকে মানুষ ব্যাবহার করেছিল। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় গুহাটিতে পাথরের হাতিয়ার, যেসব প্রাণি মানুষ এখানে খেয়েছিল যেগুলোর নমুনা প্রভৃতি পাওয়া গেছে, তবুও এমন কোন প্রমাণ মেলেনি যে এখানে মানুষ বসবাস করেছিল। অর্থাৎ ঐ সময়ের ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশের কোন এক সময়ে হয়ত মানুষ একদিন বা কিছু সময়ে গুহাটিকে ব্যাবহার করেছিল এবং এই সময়ের মধ্যেই এসব নমুনা রেখে গিয়েছিল। তবে খন্ডকালীন বা কোন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে বসবাস করার জন্য মানুষ ঐ গুহাটিকে ব্যাবহার করে নি।

এর প্রায় আড়াই লক্ষ বছর পর অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৭.৫ লক্ষ বছর আগের একটি গুহায় প্রথম মানুষের বসবাসের উদাহরণ আমরা পাই। বর্তমান চীনের বেইজিং-এর ‘ঝৌকোদিয়ান গুহামালা’র গুহাগুলোতে আমরা বিভিন্ন সময়ের ও বিভিন্ন প্রকারের মানুষের বসবাসের উদাহরণ পাই। এসব উদাহরণের মধ্যে পিকিং মানব (হোমো ইরেকটাস পেকিনেন্সিস) এবং আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স) পৃথিবীব্যাপি পরিচিত।

প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে দেখা যায় ‘নিয়ান্ডারথাল’ মানুষের আনাগোনা। এই সময়ে এই অঞ্চলের গুহাগুলোতে নিয়ান্ডারথাল মানুষেরা যে বিস্তৃতভাবে বসতিস্থাপন করেছিল তা বর্তমানে সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত। পরবর্তী পর্যায়ে এই অঞ্চলের নিয়ান্ডারথাল মানুষের সাথে সাথে ‘ক্রো-ম্যাগনন’ মানুষের উদাহরণ পাওয়া যায়। আজ থেকে ৩৫ হাজার বছর আগ থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমরা ‘ক্রো-ম্যাগনন’ মানুষের নমুনা পাই। ঐ সময়কালের বিভিন্ন ঋতুতে ও সময়ের ব্যাবধানে তারা গুহাগুলোতে শুধু বসবাসই করেনি বরং অনেক সময়ে দেখা গেছে গুহা মুখের সামনে তাবুর মত স্থাপত্য তৈরি করে তারা বসবাস করেছে এবং গুহা ও এর ভেতরের অন্ধকার আবহকে বিভিন্ন বিশ্বাস ও উৎসবের প্রধান আশ্রয়স্থান হিসেবে ব্যাবহার করেছে। শেষের দিকে এসে ক্রো-ম্যাগনন মানুষেরা গুহাগুলোর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের চিত্রকলার বিকাশ ঘটিয়েছিল। মানব ইতিহাসের প্রথমদিকের চিত্রকলার এই অপূর্ব উদাহরণ আজও অবিকৃতভাবে টিকে আছে ফ্রান্স, স্পেন, ইটালি, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশের প্রাগৈতিহাসিক গুহাগুলোতে।

অবশ্য গুহাচিত্রের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বিষয় উল্লখ্য। আমরা আজ পর্যন্ত গুহাচিত্রের যেসব উদাহরণ পাই, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হল বর্তমান ‘দক্ষিণ আফ্রিকা’র ‘ব্লমবোস’ গুহা। এই গুহায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে বিভিন্ন ধরনের ছবি এঁকেছিল। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া বিভিন্ন রং-এর মাধ্যমে আঁকা ছবিগুলো এতই বিস্তৃত ছিল যে, প্রাকইতিহাসবিদরা এটিকে চিত্রশিল্পের কেন্দ্র বা কারখানা হিসেবে ব্যাখা দেন। যাইহোক, এই গুহাটিতে প্রচুর পরিমানে গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও এখানে যে মানুষ বসবাস করেছিল এধরণের কোন উদাহরণ আমরা পাই না। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, সম্ভবত এখানে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ বসবাস করত না বরং বিভিন্ন সময়ে এসে তারা গুহার ছবিগুলো এঁকেছিল। (চলবে)।

প্রথম পর্বের লিংক:

http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/24607

দ্বিতীয় পর্বের লিংক:

http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/24703

তৃতীয় পর্বের লিংক:

http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/7022/dipusiddiq/24715

বিষয়: বিবিধ

১৪৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File