মানব জাতির শান্তি ,অশান্তি

লিখেছেন লিখেছেন বেদূঈন পথিক ১৬ জুন, ২০১৪, ০১:৩১:১৮ রাত

ইসলাম ও তার ভারসাম্যপূর্ণ বিধিবিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারনে আজ মানবজীবনে চরম অশান্তি নেমে এসেছে। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সর্বত্রই অশান্তি। আল্লাহ তায়ালা বলেন :

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ

“অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের কারনে।”

মানুষ শান্তির উপকরন তথা ধনসম্পদকে শান্তি মনে করে তার পিছনে হন্য হয়ে ছুটছে । এই ধন-সম্পদের জন্য কত মায়ের বুক শূন্য হচ্ছে কত সন্তান ইয়াতীম হচ্ছে, কত নারী বিধবা হচ্ছে। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কচ্ছেদ করছে। পরকিয়ার শিকার হয়ে হাজারো সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের বিষাক্ত ছোবলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিলুপ্ত হয়ে রাষ্ট্রের অধিকাংশ সম্পদ অল্প কিছু লোকের কাছে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। জান মাল ও ইজ্জত আব্র“, নিরাপত্তা সোনার হরিনে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র ঘুষ, দূর্নীতি, অনিয়মের জয়জয়কার চলছে, জনগণের নিরাপত্তাদানকারীদের হাতেই তারা নিপীড়িত হচ্ছে।

যাদের দূর্নীতি দমনে নিয়োজিত করা হয় তারাই আরো বেশী দূর্নীতি করে। মানুষ আল্লাহকে ভুলে গেছে তাই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেছেন। ফলে মানুষ জীবনে সস্তি খুজে পাচ্ছে না। তাদের নিদ্রা হারাম হয়ে গেছে। ফলে পাশ্চাত্যের ৭০% মানুষ ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমায়। একসময় ঘুমের বড়িও আর কাজ করে না। তখন কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় আর কেউ আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করে। আমেরিকার ৫ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ স্নায়ুবিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত। আব্দুল্লাহ আযযাম বলেন, সুইডেন থেকে আমার এক আত্মীয় এসে বলল, এদের যুবতী মেয়েদের দেখি রাস্তার পাশে উদভ্রান্তের মত শুয়ে আছে। মিলিয়ন পতি অনেক যুবতীকে দেখবে ট্রেনের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করছে। কাউকে দেখবে ঘোষনা করছে আমি অমুক দিন আত্মহত্যা করবো। তারপর একটি উঁচু ব্রীজের শীর্ষে উঠে সেখান থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করছে। এভাবে দিনের পর দিন তাদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়েই চলেছে। ফলে বাধ্য হয়ে সুইডেনের আইন পরিষদের সদস্যরা আত্মহত্যার জন্য হাসপাতাল তৈরী করেছে। তারা বলছে আমাদের সন্তানরা এভাবে মৃত্যুবরণ করবে তা আমরা চাই না। বরং তারা মরতে চাইলে আমরা তাকে ইনজেশন দিয়ে মেরে ফেলবো।

মুক্তির উপায়।

নিঃসন্দেহে মানব জীবনের এই চরম সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলামের দিকে ফিরে আসা। ইসলামই মানুষকে তাকওয়া শিক্ষা দেয় দুনিয়ার প্রতি নিস্পৃহ এবং আখেরাতের চিন্তায় বে-চাইন ও বে-ক্বারার করে তোলে। আর এই তাক্বওয়া ও পরকালেই চিন্তাই সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে সকল জুলুম-অত্যাচার, দূর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রক্ষা করতে পারে। ইসলামই পারে মানুষের অন্তরে শান্তির স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন :

بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

‘‘শুনে রাখো একমাত্র আল্লাহর স্মরণের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।”

ইসলামে দারিদ্রদের জন্য রয়েছে যাকাত, সদকা গণীমত ও মালে ফাই এর এক পঞ্চমাংশের বিধান ফলে সম্পদ অল্প কিছু লোকের নিকট কুক্ষিগত হয়ে পড়ে না। আল্লাহ তায়ালা মালে ফাই এর বিধান দেওয়ার পর বলেন:

كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ

আল্লাহ তায়ালা এ বিধান এজন্য দিয়েছেন ‘‘যেন সম্পদ তোমাদের ধনীদের মাঝে আবর্তন না করে ”

হায় যদি আজ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি নেসাবের অধিকারী ব্যক্তি যাকাত আদায় করতো তাহলে যাকাত গ্রহণকরার মত উপযুক্ত কোন ব্যক্তি খুজে পাওয়া যেত না যেমনটা ঘটেছিল দুই উমর অর্থাৎ উমর ইবনে খাত্তাব (রাযি) ও উমর ইবনে আব্দুল আযীযের শাসনামলে হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাযি) মুয়াজ (রা) কে ইয়ামানের গভর্নর করে পাঠালেন। এক বৎসর পর তিনি ইয়ামানবাসীদের যাকাতের দুই-তৃতীয়াংশ মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। উমর এত সম্পদ দেখে বিস্মিত হয়ে লিখে পাঠালেন ‘‘হে মুয়াজ আমি তোমাকে ধনসম্পদ কুড়িয়ে মদীনায় পাঠানোর জন্য প্রেরণ করিনি। আমি তো তোমাকে এ মর্মে প্রেরণ করেছি যে তুমি ধনীদের সম্পদ নিয়ে গরীবদের মাঝে বিতরণ করবে। সুতরাং ইয়ামানের দরিদ্র লোকেরা ধনী হওয়ার আগ পর্যন্ত মদীনায় কোন সম্পদ পাঠিয়ো না।

দ্বিতীয় বৎসর মুয়াজ যাকাতের অর্ধেক এবং তৃতীয় বৎসর যাকাতের সমুদয় সম্পদ মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন ইয়ামানে কোন দরিদ্র লোক বাকী রইলো না।

উমর ইবনে আব্দুল আযীয ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদকে আফ্রিকায় যাকাতের অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন তিনি যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করার পর মানুষের মাঝে একমাস পর্যন্ত ঘোষনা দিলেন কারো যাকাতের অর্থের প্রয়োজন হলে যেন আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু গোটা আফ্রিকার কেউ যাকাতের মাল নিতে এলো না।

ইসলাম মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের শিক্ষা দেয়। রাসূল (সা) বলেন: ………………………….. ‘‘ অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই তবে খোদাভীতি ছাড়া। ”

রাসূল (সা) আরো বলেন :

لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا

‘‘ তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনবে এবং তোমরা ঈমান আনবে না যতক্ষণ না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে। ”

রাসূল (সা) আরো বলেন:

وَلَا تَقَاطَعُوا، وَلَا تَدَابَرُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا

‘‘তোমরা পরস্পর সম্পর্কছিন্ন করো না এবং একে অপরের পিছনে পড়ো না এবং একে অপরকে ঘৃণা করো না বরং তোমরা ভাই ভাই হয়ে সকলে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। ”

চিন্তা করার বিষয়, যে সমাজে কেউ কাউকে তুচ্ছ মনে করবে না। বরং একে অপরকে ভালোবাসবে। তার সুখ দুঃখে সঙ্গ দেবে সে সমাজ কতটা সুখময় হবে। রাসূল (সা) বলেন :

…………………………………… ‘‘ মুসলমানরা তো এক দেহের ন্যায়। যখন তার কোন অঙ্গ ব্যাথা অনুভব করে তখন পুরো দেহই ব্যথা অনুভব করে। ”

ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে কুরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী জিহাদই হলো ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন :

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ

‘‘তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি যাদের উত্থান হয়েছে মানবজাতির কল্যানার্থে, তোমরা সৎকাজের আদেশ কর অসৎ কাজ থেকে বারণ করো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো।”

মুফাস্সীরে কেরামের মতে, উম্মতে মুহাম্মাদীকে অন্যান্য উম্মতের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এ কারনে যে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতিতে আর তা হলো জিহাদ। কেননা সৎকাজের আদেশ অন্তর, জিহ্বা ও হাতের দ্বারা হয় আর এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো হাতের দ্বারা সৎকাজের আদেশ করা। আর সবচেয়ে বড় সৎকাজ হলো ঈমান আর সবচেয়ে মন্দ কাজ হলো কুফর। আর যেহেতু জিহাদের আদেশ অন্যান্য ধর্মের তুলনায় ইসলামেই সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে এসেছে তাই তা এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হয়েছে।

ইমাম রাযী ক্বাফফাল (রহ) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন; জিহাদের উপকারিতা কোন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না। কেননা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে নিজ ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনে এবং যে সকল দলীলাদি তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয় তারা সেগুলো নিয়েও চিন্তা ভাবনা করে না। কিন্তু যখন তাদেরকে যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয় তখন তারা ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর তাদের অন্তরে বাতিল ধর্মের ভালোবাসা কমতে থাকে এবং সত্য ধর্মের ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সে বাতিল থেকে হক্বের দিকে এবং চিরস্থায়ী শাস্তির অনুপযুক্ত হওয়া থেকে চিরস্থায়ী শান্তির উপযুক্ত হওয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করেন।

ইমাম রাযী আরো বলেন : ইতিহাস অনুযায়ী জিহাদই হলো ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। জিযিয়ার উদ্দেশ্য এই নয় যে কাফেরদের তাদের কুফরীর উপর বহাল রাখা হবে। বরং জিযিয়া এ জন্য নেওয়া হয় যে যখন কাফেররা লাঞ্চিত হয়ে জিযিয়া আদায় করবে তখন তারা চিন্তা করবে যে, ইসলাম সত্য হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ না করার কারণে তাদেরকে লাঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। তখন তারা ইসলাম গ্রহণ করাকেই ভালো মনে করবে।

আল্লামা তাক্বী উসমানী বলেন : মানুষ সাধারণত শক্তিশালী জাতির আদর্শই গ্রহণ করে” যেমন এখন সারা দুনিয়ার মানুষ আমেরিকার আদর্শ গ্রহণ করেছে এ কারনেই আমরা দেখি মক্কা বিজয় সময় যেখানে ২০ বছরে মাত্র আট হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল সেখানে মক্কা বিজয়ের পর যখন কাফেরদের শক্তি খর্ব হয়ে গেলো তখন মাত্র দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় বিদায় হজ্বের সময়ে সোয়ালাখ সাহাবা কেরাম উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া মুসলমানরা যে দেশই বিজয় করেছে সেখানেই লোকেরা ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে যেমন: সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালার আয়াত এ দিকে ইঙ্গিত করে। আল্লাহ বলেন :

إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ

‘‘যখন আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও বিজয় এসে যায় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখেন তখন আপনি আল্লাহর তাসবীহ ও হামদ পাঠ করুন।”

তদপুরি বিজয় আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেই দিবেন যারা তার নেক্কার বান্দা হবে আল্লাহ তায়ালা বলেন :

وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

‘‘আর আমি লিখে দিয়েছি যাবূরে উপদেশ প্রদানের পরে যে আমার নেক্কার বান্দার জমীনের উত্তরাধীকারী হবে। ”

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ

‘‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে আল্লাহ তাদের সাথে এ ওয়াদা করেছেন যে, আমি তাদেরকে যমিনে কর্তৃত্ব দান করবো।”

আর যখন নেক্কার বান্দারা কোন দেশ জয় করবে তখন মানুষ তাদের আদল, ইনসাফ, আখরাক ও চরিত্র দেখেও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে। হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রা) হিমান দখল করেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করেন। কিন্তু কোন এক কারণে তিনি সেই শহর ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তখন তিনি সেই জিযিয়ার অর্থ ফেরত দেন এবং বলেন আমরা এই অর্থ তোমাদের হেফাযতের জন্য গ্রহণ করেছিলাম সুতরাং এখন যেহেতু তোমাদের হেফাযত করতে পারছি না তাই তোমাদের তা ফিরিয়ে দিলাম। মুসলমানদের এমন অভিনব চরিত্র দেখে সেখানকার অধিবাসীরা অভিভূত হলো। খ্রীস্টানরা বললো আমরা আমাদের জন্য আপনাদের শাসনকে রোম সাম্রাজ্যের শাসন থেকে উত্তম মনে করি। ইয়াহুদী আলেমরা তাওরাত হাতে নিয়ে শপথ করে বললো, আমরা কিছুতেই রোমীদেরকে আমাদের শহরে প্রবেশ করতে দিবো না। আপনারাই ফিরে এসে আমাদের শাসনভার গ্রহণ করবেন।

বিষয়: বিবিধ

১৩০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File