যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করেছে
লিখেছেন লিখেছেন কিংফারুক ০৫ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:৩৩:১৪ রাত
পাবনার সাঁথিয়া বনগ্রামে ফেসবুকে কুরআনের অবমাননা ও রাসূল সা:-কে নিয়ে কটূক্তিকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, দোকানপাট ভাঙচুরের পর এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। গোটা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। এ দিকে ফেসবুকের এই ঘটনা আসলে প্রকৃত ঘটনা নয়। বাবুল সাহার স্কুলপড়–য়া ছেলে রাজিব সাহা ফেসবুকে যে কটূক্তি করেছে বলে প্রচার করে তাদের বাড়িসহ ওই এলাকার হিন্দুদের বাড়ি লুটতরাজের ঘটনার অন্তরালে রয়েছে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। আর এসব চাঁদাবাজির সাথে জড়িত যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। বাবুল সাহার কাছে চাঁদা না পেয়ে অন্যের একটি ভুয়া আইডি থেকে রাসূল সা:-এর কুরআন অবমাননা ও রাসূল সা: সম্পর্কে কটূক্তিসংবলিত একটি কাগজ প্রিন্ট করে বনগ্রামে হাটের দিন ছড়িয়ে দেয় ওই চাঁদাবাজেরা। আর এই ঘটনাকে পুঁজি করে বাবুল সাহাসহ হিন্দু সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার জন্যই এই তাণ্ডবের পথ বেছে নেয়া হয়। এই প্রতিবেদক সারা দিন ওই এলাকার হিন্দু-মুসলমান গ্রাম প্রধান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে প্রকৃত এই তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি থেকে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নেয়ার জন্য সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সোমবার বিকেলে যাকে নিয়ে এই ঘটনা তার সাথে আতাইকুলা থানায় বসে এই সাংবাদিকের কথা হয়। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে বলেন, বনগ্রাম এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী প্রায় দুই মাস আগে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের সময় তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেয়ায় তাকে প্রায়ই হুমকি দেয়া হচ্ছিল। প্রাণের ভয়ে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে তিনি চেনেন। কিন্তু নাম বলতে পারবেন না। তিনি আরো বলেন, এটা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে। আমার জীবনের বিনিময়েও যদি বনগ্রাম এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে এটাই আমার কাম্য। তার দশম শ্রেণীর পড়–য়া ছেলের একটি কম্পিউটার বাড়িতে থাকলেও কোনো ইন্টারনেট কানেকশন বা কোনো মোবাইল কোম্পানির মডেম ছিল না। এমনকি তার ছেলে এটা ব্যবহারও করতে পারে না। তার মেধাবী ছেলে প্রায় দুই মাস হলো ওই কম্পিউটারে হাতই দেয় না। আমি নিজে বাসায় থেকে তার লেখাপড়ার তদারকি করি। তাই তার পক্ষে ফেসবুক ব্যবহার করা কখনোই সম্ভব নয়। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, চাঁদা না দেয়ার কারণেই তার পরিবার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এই নির্যাতন নেমে এসেছে। এক প্রশ্নের জবাবে বাবুল সাহা সুস্পষ্টভাবে বলেন, ঘটনায় বিএনপি, জামায়াত-শিবির জড়িত নয়। কেউ যদি রাজনৈতিকভাবে এই ঘটনাটি অন্য দিকে নিয়ে যা তাহলে আমার বলার কিছুই নেই। সাংবাদিকসহ কেউ যাতে তার সাথে যোগাযোগ করতে না পারে এ জন্য তার মোবাইলও পুলিশ ছিনিয়ে নিয়েছে বলে জানান তিনি। তার ছেলে কোথায় আছে, কিভাবে আছে কিছুই জানেন না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বনগ্রাম বাজারসংলগ্ন বাবুল সাহার ক্ষতিগ্রস্ত দ্বিতল ওই পাকা বাড়িতে বিকেল সাড়ে ৪টায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান গেটটি ডিবি পুলিশ প্রহরায় বন্ধ রেখে ভেতরে পাবনা জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর গেটটি বিকেল ৫টার দিকে খুলে দিলে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় তদন্ত কমিটি বাবুল সাহার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার রণজিৎ কুমার সাহা এবং বাবুল সাহার স্ত্রী সিবালী সাহাসহ তার নিকটাত্মীয়দের সাথে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা নিচ্ছিল। একপর্যায়ে সিবালী সাহার সাথে এই প্রতিবেদক কথা বললে তিনি জানান, গত শনিবার সাড়ে ১১টার দিকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক তার বাড়ির দিকে আসছে এই খবরটি আগেই অন্যের মাধ্যমে জেনে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। অন্যত্র থেকে তার বাড়িতে আগুন ও লুটতরাজের খবর জানতে পারে। কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারা জড়িত তা আমি কিছুই বলতে পারব না। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বিএনপি, জামায়াত-শিবির জড়িত কি না তা-ও তিনি বলতে পারেন না। রণজিৎ কুমার সাহাকে ওই দিনের ঘটনা এবং কারা বা কোনো মহল এর সাথে জড়িত এই ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন এটি কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। তবে কে বা কারা করেছে এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তার ভাই বাবুল সাহা একজন নিরীহ ব্যবসায়ী। তার সাথে কারো শত্রুতা আছে বলে আমি জানি না। তার ভাতিজাকে নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের জঘন্য হামলার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার দাবি জানান। এ দিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছেন প্রায় দেড় মাস আগে বনগ্রাম গার্লস হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক গোপাল চন্দ্র ঘোষের কাছে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এই চাঁদার এক লাখ ৭০ হাজার টাকা তাদের দেয়া হয়। অবশিষ্ট টাকার জন্য বারবার ওই প্রধানশিক্ষককে হুমকি দেয়া হয়। এরই একপর্যায়ে ওই প্রধানশিক্ষক গোপাল চন্দ্র ঘোষকে তার স্কুল চলাকালে (১১টার সময়) প্রকাশ্য দিবালকে স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফজলুর রহমান, ফজলু মুন্সি, মামুন, মান্নান, বিল খোকন, বাবু, মানিকসহ আরো সহযোগীদের সাথে নিয়ে অফিস কক্ষ থেকে স্কুলের শিক্ষক-ছাত্রদের সামনে হাতুড়ি দিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন প্রতিবাদ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকাবাসী। গত শনিবারের ঘটনায় ওই সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ চক্র নেতৃত্ব দিয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে জানান। তাদের নামে মামলা হলেও তারা এ পর্যন্ত কেউই গ্রেফতার হয়নি। এরা স্থানীয় আতাইকুলা ইউনিয়নের জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধির ক্যাডার বাহিনী বলে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। এ ব্যাপারে আতাইকুলা থানার ওসি রেজাউল করিমকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই ঘটনার সাথে প্রকৃতপক্ষে কারা জড়িত তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখনই বলা যাবে না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সাথে যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরো জানান, ওই দিনের ঘটনায় আতাইকুলা থানায় দু’টি মামলা হয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এসআই নাজমুল হোসেন বাদি হয়ে ৪২ জনকে আসামি করে একটি এবং বাবুল সাহা বাদি হয়ে ২০ জনকে আসামি করে অন্য একটি মামলা করা হয়েছে। তবে বাবুল সাহাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত আমি কোনো মামলার বাদি হইনি। পুলিশ বাদি হয়ে একটি মামলা করেছে বলে পুলিশের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। আতাইকুলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান কুরবান আলীর মোবাইলে ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি দুই ধরনের কথা বলেন, একবার বলেন, জামায়াত-শিবিরের লোকজন এই ঘটনা ঘটিয়েছে আবার পরক্ষণে বলেন যারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তবে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে কি না তা এখনো বলা সম্ভব নয়। সাঁথিয়া উপজেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ফিরোজ হোসেন বলেন, আমরা হিন্দু ভাইদের আপন ভাইয়ের মতো দেখি। তাদের কোনো ক্ষতি আমাদের কর্মীদের দ্বারা ঘটা দূরের কথা উল্টো আমাদের কর্মীরা তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। কোনো নিরীহ জনগণ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ২০১১ সালে যখন বনগ্রামে অগ্নিকাণ্ডে ১৫টি দোকান পুড়ে গিয়েছিল তখন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এসে নিতাইপদ ঘোষ, হরিপদ সাহা, পাঁচ জন হিন্দুসহ ১৫ জন ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করেন। আমরা অতীতে সব সময় হিন্দু ভাইদের বিপদআপদে পাশে দাঁড়িয়েছি। বর্তমানেও আমরা কোনো ক্ষতি হোক তা চাই না। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান তোতা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, আমরা তদন্তপূর্বক সঠিক বিচার দাবি করছি। এই ঘটনা নিয়ে যেন কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। তিনি এই ঘটনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য আজ পাবনা প্রেস কাবে ১৮ দলীয় জোটের উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন করবেন। এ দিকে পাবনা জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি চন্দন কুমার ঠাকুর এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, সারা দেশে যারা হিন্দুদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে তারাই বনগ্রামের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা এর সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তির দাবি জানাই। এ দিকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৯ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা অধিকাংশ স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
১৩০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন