বিষণ্ণ তারুণ্য, মুগ্ধ কৈশোর
লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ান ০২ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:২৯:২২ দুপুর
সাহিত্য টাইপের আলাপ করিনা এখন। অথচ সাহিত্য যেন একসময় রীতিমতন পানির সাথে গুলেই খেতাম। শরৎবাবুর উপন্যাস নিয়ে অনেকগুলো রাতে ঘুমাতে গেছি, বহুদিন শ্রীকান্তের সাথে লম্বা লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছি। পথের দাবী পড়তে গিয়ে অনেকবার প্রতিবাদী হয়ে সমাজকে সমান করে দেবার স্বপ্ন দেখেছি। মেজদিদির চোখের জল মুছে দিয়েছি মনে মনে অনেকবার, কেঁদেছি বড় দিদির জন্য -- সে-ই আমার কৈশোর! সেই কিশোর মুগ্ধ আত্মায় ক্যাপটেন হ্যাটেরাসের সাথে মেরু অভিযানে গিয়েছে, ক্যাপটেন নিমোর সাথে সাগরতলে গিয়েছে, লাবন্য আর অমিতের চিঠি-কবিতায় উদাস হয়ে অমিত হয়েছে। কল্পনার লাবন্যকে কতশত চিঠি যে কেবল লিখে খসড়া হয়েছে তার হিসেব নেই। নৌকাডুবির হেমনিলিনীর কথা ভেবেও কষ্ট লাগে এখনো। লা মিজারেবলের জাঁ ভালজার কথা পড়ে কেঁদে বইয়ের পাতা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। রবিনসন ক্রুসোর সাথে দ্বীপে আমি মানুষখেকোদের আতঙ্কে লুকিয়ে থেকেছি একটানা অনেকদিন গুহার ভেতরে।
আমার কৈশোর ছিলো মুগ্ধতায় ভরপুর। জুলভার্নের সাথে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করেছি, কখনো হুমায়ূন আহমেদ, কখনো শরতচন্দ্র, কখনো রবীন্দ্রনাথের কবিতা, কখনো জীবনবাবুর সাথে ধানখেতের পাশে বকের ওড়াওড়ি, জোনাকপোকার জ্বলে যাওয়া, কখনো আর্থার কোনান ডয়েলের জগতে ওয়াটসন আর শার্লক হোমসের সাথে গিয়েছি রহস্য সমাধান করতে। এসব অনুভূতিদের সেই আবেগ অকৃত্রিম, মানবিক, ভালোবাসার ছিলো।
সেই কৈশোর বিদায় নিয়েছে অনেক বছর হলো। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বয়সানুযায়ী সময়ের পার্থক্যগুলো বলো। ধারণা পেয়েছিলাম, ১২ থেকে ১৮-১৯ মনে হয় কৈশোর। ২৫ অবধি তারুণ্য। যৌবন এর পরেই। যৌবন মানেই জীবনের শেষ দিকে পদার্পণ। অর্ধাংশ শেষ। প্রৌঢ় পুরুষ তার সন্তানের ভরণপোষণের ব্যবস্থায় জীবন ব্যয় করে, বার্ধক্যে গুণে মৃত্যুর প্রহর...
মানুষের জীবনপ্রবাহ এমন অনেকটাঃ
শৈশব --> বাল্য --> কৈশোর --> তারুণ্য --> যৌবন --> প্রৌঢ় --> বার্ধক্য
শৈশবের পরে কৈশোরে এসেই যেন সেই পড়ার জগত হারিয়ে গেলো। আমার সেই বইয়ের পাতাগুলোতে আর রোদের আলো পড়েনা, হাতের স্পর্শও পড়ে না। তখন থেকে জীবনে বড় বড় পরীক্ষা এলো। মানুষ হতে হবে, বড় হতে হবে তাই মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে পড়তে গেলাম। শারীরিক যন্ত্রণায় নিজেকে কখনই নিজের মতন পেতাম না। পাপকে চিনতে শিখলাম, পাপাসক্তদের পাশে থেকে পাপাচারী হতে শিখলাম। কোথায় সেই শুভ্রতার ভালোবাসা, জীবন তো হারিয়েই গেলো। কেউ বুঝেনি তারপর, কেউ না। সবাই বিচার করে, স্কেল ধরে আমাকে মাপতে বসে। আমি আমার পুরোনো আমিকে হারিয়ে ফেলি।
অনেক জোর করে বছর দুই যাবার পর বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম হাতে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এবারের যাত্রা আমার হবেই, দীপঙ্করের সাথে সেই রেলের চাকুরি করতে গিয়েছিলাম। তার সাথেই রেলের কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করেছিলাম। টার্ম ফাইনাল চলে এলো, স্যারের ঘৃণ্য নোংরা বাক্যগুলো বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। কড়ি দিয়ে কিনলাম ফিরিয়ে রেখে এলাম। বিষণ্ণ তারুণ্যে আমার পাশে কেউ ছিলনা। বিষণ্ণ আমি তখনো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম। লাল-নীল-ধূসরের রঙের বৈচিত্র্য আমার বিরক্তির কারণ দেখিনা। সেদিন আমার বোন যখন বললো, আকাশ দেখো, আকাশে আজ অনেক আলো, ভরা পূর্ণিমা। প্রচন্ড বিরক্তিতে বমি বমি ভাব উঠে এলো। আমার বইয়ের তাক ভরে থাকা সেই শত-শত পাতার বইগুলোকে আমি বড় অগ্নিকুন্ডে ফেলে দিতে পারব। এই জীবনযুদ্ধের সাথে এইসব সাহিত্যমাখা স্বপ্নের যোগসূত্র নেই। আশাও করিনা।
আমি নাহয় বললাম কৈশোর মুগ্ধতার, তারুণ্য বিষণ্ণ, আর যৌবন? যৌবন আমার ঘৃণার। প্রতিটি দিনে অজস্রবার নিজেকে ঘৃণা করি। নিজের সীমাবদ্ধতা আর অসহায়ত্বকে ঘৃণা করি। পত্রিকার শিরোনামে চেয়ে ঘৃণা করি দেশের মাথার লোকদের। বাসে উঠতে গিয়ে পেছনের পকেটের মানিব্যাগে প্রায়ই হাতের স্পর্শ পাই, নিজের হাত ওতে চেপে ধরে ঘৃণা করি লক্ষ মানুষের দারিদ্রকে। আকন্ঠ ঘৃণায় ডুবে থেকে বেঁচে থাকি। জ্ঞানহীন মূর্খ অথর্ব অভিভাবকগুলোকেও ঘৃণা করি -- যারা সন্তানদের বড় করে জীবন পার করে দেন, বড় সব সিদ্ধান্ত নিতে ইতরের মতন গোঁ ধরে বসে থাকেন। সমাজ আর বংশের ট্রেডিশন রক্ষার নামে সন্তানদেরকে তাদের অগোচরের কুত্তা বানিয়ে ছেড়ে দেন, ওইরকম কুকুর আমি অনেক চিনি। শত শত জীবন্ত লালাঝরা কুকুর। ওইসব কুকুরকেও ঘৃণা করি আমি। আমার ঘৃণা হয় বিলবোর্ডের পেছনের ব্যবসায়ীদেরকে। ভ্যাসলিন বেচতে যারা ধবল নারীর কোমলতাকে প্রদর্শন করতে টপস পরিয়ে ১০০ গুণ বর্ধিত করে পথের ধারে টাঙ্গিয়ে দেন। একদিন তো তার স্ত্রী কন্যারাই বিবস্ত্র হবে রাস্তার ধারে, হবেই -- এটা আবশ্যক পরিণতি!
ঘৃণা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাই পুরোনো স্মৃতিতে। আমার শৈশবে, ফেলে রেখে যাই ভালোবাসার কৈশোরকে। শৈশবের একটা স্মৃতি আছে। মরহুম নানীজানের ঘরে সন্ধ্যা হলেই চলে যেতাম। তার লেপের নিচে জায়গা পেতে মামাত ভাই আর আমার মাঝে প্রতিযোগিতা হত। ঢাকা থেকে যাবার কারণে, ক্লাসের ফার্স্ট থাকার কারণে সেইসময় জিতে যেতাম। অমন জয়ের পরিমাণ আমার জীবনে খুব কম। ভালোবাসা পেতে আমি চিরকাল পরাজিত। তবু নানীজানের আদরমাখা জড়িয়ে ধরা একটা সন্ধ্যার কথাই মনে পড়ে। তিনি যেদিন অজানার জগতে চলে আমাদের ছেড়ে যান, গ্রামের এমাথা ওমাথার সবাই কেঁদেছিল। অনাত্মীয় একজন ভাইকে হাউ-মাউ করে কাঁদতে দেখেছিলাম বড় খালামনিকে দেখে, খালামনির সাথে নানীর চেহারার অনেক মিল। সেই নানী এমনই মানুষ ছিলেন, কারো খেতে কষ্ট হলে তারা দুপুরে বিকালে তার হেঁশেলের পাশে এসে বসে পড়ত। নিজের খাবার দিয়ে দিয়ে না খেয়ে থেকেছেন বলে মেজ ছেলের বৌ তাকে অনেক বকা দিয়েছিল বলে গল্প শুনেছি।
আমি শীতের সময় গ্রামে যেতাম, ভোরের কুয়াশায় আম্মু বের হবার আগে সুয়েটার পরিয়ে দিতেন, কান ঢাকার একটা টুপি। আমি পায়ে রুপসা চপ্পল লাগিয়ে পেছনের দিকে চলে যেতাম বাড়ির। গরুর গাড়ির চাকার পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল খড়ের গাদাগুলো দেখতাম, একেক বাড়িতে একেক উপায়ে সাজিয়ে রাখা হত। যেটা উচু করে সাজানো হত, যেন একটা ছোট টিলার মতন --- সেইগুলো আমার বেশি ভালো লাগত। এই স্মৃতিচারণগুলোই আমার ঘৃণার মাঝে ভালোবাসার বাতাস বইয়ে দেয়। কেবল তখনই মনে হয়, হাবিব মামা আমাকে তেমনই এক সকালে ডেকে রোকেয়া মামির হাতে বানানো ভাপাপিঠা খাইয়ে ফেরত দিয়েছিলেন। আম্মু খুঁজতে এসে বকা দেয়ার মতন হতে মামা আমার হয়ে কথা বলেছিলেন। সেইসব স্মৃতিগুলো শুধুই নিখাদ ভালোবাসা। হাবিব মামা বদলে গেছেন, পরে রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, উপজেলার নানান শত্রুতার খপ্পরে পড়ে অনেক বয়স নেমে এসেছে তার জীবনে। শেষবার দেখে কষ্ট লেগেছিল আমার। সেই শক্তপোক্ত মামাটি আর নেই।
নিখাদ সেই ভালোবাসার স্মৃতিরাই আমাকে মনে করিয়ে দেয় -- জগতে এখনো অনেক ভালোবাসা হয়ত আছে, তারা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি দেখতে পাইনা, আমার উপরে সেই ভালোবাসা এসে পড়ে না। তাই এই ঘৃণাময় যৌবনকেও আমি ঘৃণা করি। এসময়ে যৌবন কখনই সুন্দর কিছু না। এই পৃথিবীর এই সময়ে যৌবন হলো চিরন্তন ভোগান্তির পথের দরজা। কাম-ক্রোধ-ঘৃণা-অশ্লীলতা-মিথ্যা জড়িয়ে ধরে থাকে প্রতিটি যৌবনকে। আমরা সেই নোংরা যৌবনের প্রাণী। ঘুমানোর আগে মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে মনে আসে রুনি আপুর কথা, বাবু ভাইয়ার কথা। তাদের কোলে আমি কয়েকবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম -- শৈশবে। সেই স্নিগ্ধ স্পর্শের অকলঙ্ক ভালোবাসারা হয়ত আজো আছে পৃথিবীতে, আমি জানিনা। আমি হয়ত হতভাগা...
বিষয়: সাহিত্য
১৭৭৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার চমৎকার উপস্থাপনা।
স্মরণ করিয়ে দিলেন শৈশব-কৈশোর-আরো কত্তো কিছু-
আসলেই মানুষ বড্ড স্মৃতিকাতর,
আর বয়সের সাথে সাথে এ রোগটাও বেড়ে চলে
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
অগ্রীম শুভেচ্ছা- কুরবানী ও ঈদ মোবারক
ব্যক্তি ও সমাজ জীবন ত্যাগের আলোকে উদ্ভাসিত হোক
জগতে এখনো অনেক ভালোবাসা হয়ত আছে, তারা আমাকে স্পর্শ করে না। আমি দেখতে পাইনা, আমার উপরে সেই ভালোবাসা এসে পড়ে না। তাই এই ঘৃণাময় যৌবনকেও আমি ঘৃণা করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন