একজন কিংবদন্তীর কথা বলছি

লিখেছেন লিখেছেন সাফওয়ান ১০ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:৪০:৫৭ রাত



রবীন্দ্র উত্তর আধুনিক কালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 'সোনালী কাবিন' কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। কবি আল মাহমুদের হাতে জন্ম নিয়েছে 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো', 'বখতিয়ারের ঘোড়া'র মতন অসামান্য কিছু কাব্যগ্রন্থ। শিশুদের জন্য তার কাব্যগুলোও নান্দনিক আর সর্বজন সমাদৃত।

আল মাহমুদ একজন মৌলিক কবি। তিনি বাংলা কবিতায় সৃষ্টি করেছেন এক ভিন্নমাত্রা। একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে । আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে।

এমনই এক ছবি পাই আমরা 'কালের কলস' কাব্যগ্রন্থে :

"এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না

হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?

লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে

এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল

কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?"

[কালের কলস]

'সোনালী কাবিন' সনেট গুচ্ছে কবি উপমার যেই নান্দনিক ব্যবহার করেছেন, তা বাংলা কবিতার জগতকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ইতিহাসকে তিনি নিয়ে এসেছেন অবলীলায়, তাকে প্রবেশ করিয়েছেন অনুভূতির মাঝে, তার সৌন্দর্যময় শব্দচয়নে --

"এ তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেল সুন্দরী,

মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়।

ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি

কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।"

[সোনালি কাবিন-১]

বাংলা কবিতা কী, তাতে কী খুঁজে পাওয়া যায়, সেকথা বুঝতে হলে আল মাহমুদের কবিতায় ফিরে যাই আমরা --

"কবিতা কি ?

কবিতা তো শৈশবের স্মর্তি

কবিতা চরের পাখী , কুড়ানো হাসের ডিম , গন্ধভরা ঘাস

স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর

কবিতাতো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার ।"

[কবিতা এমন]

তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মান করেছেন। দেশজ চেতনা, লোককাহিনী আর ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ট কর্ম 'সোনালী কাবিন ' এ মাতৃভুমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় অনুসঙ্গ। এতে তিনি শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসজম প্রবেশ করিয়েছেন যা 'সোনালী কাবিন ' সনেট গুচ্ছকে করেছে অনুপম সৌকর্যময় --

"প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,

চিরস্থায়ী লোকালয় কোনো যুগে হয়নি তো গড়া

পারেনি ঈজিপ্ট, গ্রীস, সেরাসিন শিল্পীর আঙুল।

কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর

কষ্টকর তার চেয়ে নয় মেয়ে কবির অধর। "

[সোনালি কাবিন -৫]

শুধু তাই নয়, কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাস। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কথাও স্মরণ করেছেন, আর সেই মৃত্যুচিন্তার অনুভূতিগুলো ফুটে উঠেছে বিদগ্ধ শব্দচয়নে -

"স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক

অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?

কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?

নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!

আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার

যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।"

[স্মৃতির মেঘলাভোরে ]

এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন স্রষ্টার বিশ্বাসে আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃপ্ত বিশ্বাস আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শংকা। তারই অনবদ্য সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে শব্দ দিয়ে মালা গেঁথে তিনি লিখেছেন -

"আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।

উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনদিনই বিহবল করতে পারেনি।

আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,

আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।

পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত,

তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাসবায়ু।

আমাদের হাতে একটি মাত্র গ্রন্থ আল কুরআন,

এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়, কোন তৌহীদবাদীকে থামতে দেয়নি।

আমরা কি করে থামি ?

আমাদের গন্তব্য তো এক সোনার তোরণের দিকে যা এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই।"

[আমাদের মিছিল]

নিভৃতচারী কবি আল মাহমুদ আজো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। কবির অসংখ্য গুণমুগ্ধের মাঝে আমিও একজন। আজ কবির পুরনো অনেক লেখা সংকলন করে এই লেখাটি শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ প্রকাশ করছি অজস্র পাঠকদের মাঝে। কবি সুস্বাস্থ্য আর সুন্দর মন নিয়ে আমাদের মাঝে বেচে থাকুন আরো অনেকদিন।



কবি আল মাহমুদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি। একুশ বছর বয়স পর্যন্ত এ শহরে এবং কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত জগৎপুর গাঁয়ের সাধনা হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এসময়েই লেখালেখি শুরু। ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে ১৯৫৪ সাল থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুস্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাসে লেখালেখির সুবাদে ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এসময় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি কবিতা ছাপা হলে সমসাময়িক কবি-মহলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় তখন তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশদশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে আল মাহমুদ নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। সমালোচকগণ তাঁকে জসীমউদদীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার এক নতুন কবি প্রতিভা বলে উল্লেখ করতে থাকেন।

এ-সময় লোক-লোকান্তর, কালের কলস প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কারে ভূষিত হন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আল মাহমুদ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

‘৭১-এ বিজয়ীর বেশে কবি দেশে ফিরে এসে ‘গণকণ্ঠ’ নামক একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং দেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে সমর্থন দানের অপরাধে গ্রেফতার হন। তাঁর আটকাবস্থায় সরকার গণকণ্ঠ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়।

১৯৭৫-এ আল মাহমুদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’র গবেষণা বিভাগের সহ-পরিচালকের পদে যোগদান করেন। পরে ওই বিভাগের পরিচালকরূপে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তিনি অবসর নেন।

কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে আল মাহমুদের বইয়ের সংখ্যা তিরিশের বেশি। তিনি বহু পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন।

কবির শখ বইপড়া ও ভ্রমণ। তাঁর দেখা শহরগুলোর মধ্যে ভারতের কলকাতা, দিল্লী, ভোপাল, বাঙ্গালোর, আজমির। সৌদি আরবের মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা। আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, শারজাহ ও বনিয়াস। ইরানের তেহরান, ইস্পাহান ও মাশহাদ। যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, ব্রেডফোর্ড ও ওল্ডহাম অন্যতম।

আল মাহমুদ রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার একুশে পদকসহ বেশ কিছু সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ফিলিপস সাহিত্য পুরষ্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরষ্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরষ্কার, সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরষ্কার, হরফ সাহিত্য পুরস্কার ও জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরষ্কার অন্যতম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বীরগাঁও গ্রামের সৈয়দা নাদিরা বেগম কবির সহধর্মিণী। তাঁদের পাঁচ পুত্র ও তিন কন্য।

তার লেখা সেরা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা।

শিশুদের জন্য লেখা তার কাব্যগ্রন্থ হলো ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’।

Good Luck কবি আল মাহমুদের আনঅফিশিয়াল ফেসবুক পেজ

Good Luck আল মাহমুদের উপরে কিছু সংগ্রহ : একজন কিংবদন্তীর কথা

Good Luck আল মাহমুদের কবিতা সংগ্রহ

তথ্যসূত্রঃ

- আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র পুস্তকের ভূমিকা।

- উইকিপিডিয়াঃ আল মাহমুদ

- বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিন

বিষয়: বিবিধ

১৫২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File