গোলাম মাওলা রনি এমপির ইতিহাস রচনা
লিখেছেন লিখেছেন শেখ মিঠুন ০৯ আগস্ট, ২০১৩, ১০:৪১:০৭ রাত
গত ২৭/০২/১৩ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় জনাব গোলাম মাওলা রনি এমপি ‘ মোঘল হেরেমে দুনিয়া কাঁপানো প্রেম’ শিরোনামে মোঘল শাসনের মহিয়সী নারী মেহেরউন্নিসা তথা নুরজাহানের জবানীতে একটুখানি ইতিহাস লিখেছেন। যদিও নুরজাহান নিজে কোন আত্মজীবনী লেখেন নি। অতএব রচনাটিকে ইতিহাস থেকে কিছু সত্য-মিথ্যা ঘটনা নিয়ে গল্প ফাঁদা বলা যেতে পারে। নুরজাহান বহু কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর কবরের গায়ে তাঁরই লেখা ফার্সী শ্লোক আছে, কবি সত্যেন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন সে শ্লোক: ‘গরীব
'গোরে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে-
শামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।’
এরকম বহু বিখ্যাত কবিতা আছে তাঁর। সে ক্ষেত্রে তিনি একজন উচ্চমানের কবি, কিন্তু আত্মজীবনী লেখার মত সাহিত্যিক ছিলেন না অথবা সে সময়ও তাঁর হয়ে ওঠেনি। অথচ তাঁরই জবানীতে ইতিহাস থেকে চয়ন করেছেন গোলাম মাওলা রনি। একজন পরম শ্রদ্ধেয়, প্রেরণাদাত্রী এবং চিরস্মরণীয় মহিয়সী নারীর আত্মজবানীতে তাঁর প্রেম সংক্রান্ত্ বিষয়ে লিখতে গেলে অবশ্যই লেখককে সেই নারীর সম্মানের দিকটা খেয়াল রাখা উচিৎ। নইলে এ প্রজন্মের পাঠকদের অন্তরে সেই মহিয়সী নারীর ইমেজটা একটা লজ্জাহীনা বিকৃত যৌনাচারী মহিলারূপে প্রতিভাত হতে পারে। জনাব রনির রচনা পড়ে অনেক পাঠকের হয়েছেও তাই। যদিও তাঁর ইতিহাস আশ্রিত গল্পে কোন সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। বরং জনাব রনির ভাষা ও শব্দ চয়নে সাহিত্যমানের উৎকর্ষ থাকলেও লেখককে কখনো কখনো যৌন বিকারগ্রস্ত মনে হয়েছে। যেমন পত্রিকার পাতায় স্বামী মারা যাবার পর নুরজাহানকে আগ্রায় নিয়ে আসা হলে তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে একটা বর্ণনা ছিল, যা অন লাইন পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। অথচ অন-লাইন পত্রিকার পাঠকের আগেই প্রিন্ট পত্রিকার পাঠক তা পড়ে ফেলেন। বর্ণনাটি যেমন অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক তেমনি অশ্লিল এবং একজন মহিয়সী নারীর জন্য অবমাননা কর। এই বর্ণনাটি লেখক হিসেবে জনাব রনি বিকৃত যৌনতার দায় এড়াতে পারেন না।
ইতিহাস ভিত্তিক গল্প তৈরি বা কবিতা রচনা করতে গিয়ে বহু কবি ও লেখক চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুসলিম মনীষীদের চরিত্র বিকৃত করেছেন। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং সম্রাটকন্যা জেবুন্নেসার চরিত্র বিকৃত করেছেন। নবীনচন্দ্র সেন, শ্রী সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত কবি লেখকরা নবাব সিরাজুদ্দৌলার চরিত্র কলঙ্কিত করেছেন। এর প্রমাণ চাইলে ১৯৪৬ সালের ২৪ পরগণার স্কুল বুকবোর্ডের ইতিহাস খুঁজে নিয়ে বর্তমান কালের পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়োজিত ইতিহাসবিদ শ্রী বিনয় ঘোষের ইতিহাস মিলিয়ে দেখতে পারেন। ‘৪৬ সালের ইতিহাসে মুসলিম মনীষীদের চরিত্র উন্নত দেখানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই একই চরিত্রকে কলঙ্কিত করে দেখানো হচ্ছে। যাই হোক, এবার আসা যাক জনাব রনির রচনায়। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে আমি জনাব রনির লেখার উদ্ধৃতি না দিয়ে বিশেষ কিছু স্থানের উল্লেখ করছি। আশা করি জনাব রনি এবং পাঠকবৃন্দ সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারবেন।
নুরজাহান সম্পর্কে প্রায় ২৯ টি গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ভারতীয় লেখক ‘সুকন্যা’ তাঁর রচিত ‘নুরজাহান’ বইতে নুরজাহানের জন্মকালীন সময়ের কথা লিখেছেন,‘ শিশুটির কাছে গিয়ে গিয়াস চমকে পিছিয়ে এলেন, শরীর মন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো- একটা বিষধর কালো সাপ শিশুটির চারদিকে কুন্ডলী পাকিয়ে রয়েছে, ........সাপটি তার ফণা গুটিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল......।’ জনাব রনির লেখায় আছে বাঘ। রবার্ট কাউন্টার সাহেবের লেখা ইতিহাস থেকে। তিনি তো এখানে নুরজাহানের মাকে মেরে ফেলেছেন। এ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ কাফি খাঁ, এলফিনস্টোনও লিখেছেন, তারা মাকে মারেন নি। কারো লেখার সাথে কারো লেখা হুবহু মেলে না। তবে মেহেরউন্নিসার পরিবারে ডাকাতি হয়েছে, ক্ষুধা-পিপাসা, কষ্ট, পরিশ্রম এ বিষয়গুলি যুক্তিযুক্ত, এসব বিশ্বাস করা যায়। ‘কপালে রাজটিকা’ দেখেছিলেন মালিক মাসুদ এ বিষয়টি কোন ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেন নি। বিষয়টি হিন্দু শাস্ত্রমতে ঠিক আছে। এটা মুসলিম শাস্ত্রমতে বাজে একটা ধারণা।
আনার কলি একটা কাল্পনিক চরিত্র। যা বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কে, আসিফ তার মোঘলে আযম চলচ্চিত্রে তৈরি করেছেন। নুরজাহানের বর্ণনায় আনারকলির নামটি তাই কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া কোন ইতিহাসবিদ আনারকলি সম্পর্কে কিছুই লেখেননি।
জনাব রনি হাম্মামখানায় নুরজাহানের জবানীতে বান্ধবীদেরসহ উলঙ্গ হয়ে গোসল করার একটা বিবরণ দিয়েছেন । যা সাধারণত পিন-আপ পত্রিকার লেখকরা লিখে থাকেন। এতে লেখকের আত্মমর্যদা নষ্ট হলেও হয়ত কিছু যায় আসে না কিন্তু ইতিহাসখ্যাত নারীসমাজের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে নুরজাহানের আত্মমর্যাদা ছোট হয়, নষ্ট হয়।
শের আফগানের সাথে বাসর ঘরের যে বর্ননা জনাব রনি দিয়েছেন তা পিন-আপ বইয়ের লেখকরাও লিখতে লজ্জা পাবেন। বর্ণনাটি একটা নির্লজ্জ পতিতাও বলতে সংকুচিত হবে। কি জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত মুসলিম নারী নুরজাহানকে নিয়ে এবং নুরজাহানেরই জবানীতে। এই সম্পর্কে সর্বজন স্বীকৃত বিখ্যাত ইতিহাসবিদরা বলছেন,শের আফগান-মেহেরউন্নিসার দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে ইতিহাস নিরব। আমাদের কল্পনায় এ দুটি চরিত্র ভেসে ওঠে...’’
সেই কল্পনার কথা ইতিহাসবিদরা অত্যন্ত শালীন ভাষায় যা বর্ণনা করেছেন তা হলো, বীর, সিংহ-হৃদয় শের আফগান মেহেরউন্নিসাকে যেমন ভালোবেসেছিলেন, মেহেরউন্নিসাও স্বামীকে অন্তর থেকে ভালোবেসেছিলেন।
শের আফগানকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনাব রনি অনেক বানোয়াট মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি নুরজাহানকে আফিমখোর বানিয়েছেন। পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হিসেবে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ পূর্বে জাহাঙ্গীরের সাথে মেহেরউন্নিসার নাকি প্রেম ছিল। তাঁরই অনুরোধে নাকি জাহাঙ্গীর কুতুবউদ্দীন কোকোকে পাঠিয়ে শের আফগানকে হত্যা করান। অথচ সত্য ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা।
‘নুরজাহান’ বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘‘জাহাঙ্গীরের উপর সব চাইতে প্রামাণিক গ্রন্থ লিখেছেন ডক্টর বেণীপ্রসাদ। জাহাঙ্গীর-মেহেরউন্নিসার প্রাকবিবাহ প্রেমকে তিনি একবারে নিরাসক্তভাবে বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঐ যে আলিকুলির সঙ্গে বিয়ের আগে মেহেরউন্নিসার রূপে সেলিম পাগল হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন, আর মেহেরউন্নিসার দিক থেকেও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সমর্থন ছিল- ওটা একেবারে বাজে কথা।’’ অন্যত্র বেণীপ্রসাদ স্পষ্টভাষায় লিখেছেন,‘জাহাঙ্গীর-নূরজাহানের মধ্যে কোন পূর্ব-অনুরাগ ছিল না। তিনি বলেছেন,‘সমসাময়িক ফার্সী এবং বিদেশী কোন বিবরণেই এই রোমান্সের উল্লেখ নেই, এর উল্লেখ রয়েছে পরবর্তী যুগের বিবরণীতে।”
দ্বিতীয়ত: শের আফগানকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। আকবরের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বহুবার নানা বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের মনমালিন্য ও সংঘাত হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে শের আফগান কখনো জাহাঙ্গীরকে সমর্থন করেন নি। বরং আকবরের পাশে থেকেছেন। বাংলায় পাঠান শক্তি ও বারো ভূঞাদের শক্তির উপস্থিতি ছিল প্রবল। জাহাঙ্গীর জানতে পেরেছিলেন তখনকার বর্ধমানের সুবেদার শের আফগান রাজবিদ্রোহী এবং ষড়যন্ত্রকারী। জাহাঙ্গীর তাঁর দুধভাই কুতুবউদ্দীন কোকোকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান এবং শের আফগানকে দিল্লিতে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু শের আফগান দিল্লি যেতে রাজি না হওয়ায় সংঘাত হয় এবং শের আফগান নিহত হন। জাহাঙ্গীর যদি হত্যা করতে বলতেন তবে স্বামী হত্যাকারীকে নূরজাহান কখনো বিয়ে করতেন না, ঘৃণাই করতেন। আর যদি জেনেশুনে স্বামী হত্যাকারীকে বিয়ে করেন তবে নূরজাহান বহু আপরাধে অপরাধী হন। পরকীয়া প্রেম, স্বামী হত্যার সাহায্যকারী ইত্যাদি। জনাব রনি হয়তো এই মহিয়সী মুসলিম নারীকে সেই ভাবেই অপরাধী হিসেবে সাব্যাস্ত করতে চেয়েছেন। এই বিষয়টাকে জনাব রনি সম্পূর্ণ একটা পরকীয়া প্রেমের রঙ চড়িয়ে মেহেরউন্নিসার কপালে কলঙ্কের টিপ পরিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে অপরাধী সাব্যাস্ত করতে চেয়েছেন। একটা আবর্জনার স্তুপ থেকে মানুষ ভালো এবং প্রয়োজনীয় বস্তুগুলো আহরণ করে থাকে কিন্তু জনাব রনি খুটিয়ে খুটিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত বাজে বস্তুগুলো কুড়িয়ে তাঁর রচনায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
এমনকি নুরজাহানের মত মহীয়সী নারীকে দিয়ে স্বামীকে মেয়ে সাপ্লায়ার বানিয়েছেন।
শের আফগান নিহত হবার পর তাঁকে দিল্লি দরবারে আনা হয়। কারণ দিল্লির রাজপ্রাসাদ ছিল তাঁর শিশু কৈশোরের আবাসস্থল। এখানে জাহাঙ্গীরের সৎমা অতি প্রভাবশালিনী মহিলা আকবরের বিধাবা পতিœ সালিমা বেগমের কাছেই দীর্ঘ চার বছর থাকার পর জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু ইতিহাসবিদরা এই চার বছরে জাহাঙ্গীরের রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে লিখেছেন। অন্দর-মহলে মেহেরউন্নিসা সম্পর্কে তারা নিরব হলেও জনাব রনি এই চার বছর মেহেরউন্নিসার কিভাবে কেটেছে এবং তিনি কিসের চিকিৎসা করিয়েছেন তা বর্ণনা করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি বিষয়টুকু পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিন্তু অন-লাইন থেকে ছেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমি দু:খিত আমার কলম দিয়ে সেই অশ্লিল অনৈতিক অমর্যাদাকর বর্ণনা অসম্ভব।
মনে রাখা দরকার জাহাঙ্গীরের ক্ষমতা আরোহনের সময় তাঁর দরবারে বিদেশীরা গিজগিজ করতো। পর্তুগীজ, ফরাসী, বৃটিশ ব্যবসায়ীরাই শুধু নয় পাদ্রী এবং ডাক্তারদেরও অবাধ যাতায়াত এবং কদর ছিল রাজ দরবারে। তারা মুখিয়ে থাকতেন সদর-অন্দরের কোন রঙিন খবরের জন্য। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এবং তাদের পরপরই অনেকে ইতিহাস রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা নুরজাহানের চরিত্র আঁকতে গিয়ে তাঁকে মহিমান্বিত করেছেন, তেজোদৃপ্ত এবং মহিয়সী করেছেন। যেমন, স্মিথ, রবার্ট কাউন্টার, এলইফনস্টোন প্রমূখ এবং এর পরপরই ইতিহাসে রঙ চড়ানো শুরু হয়। কিন্তু কোন ইতিহাসবিদ যদি যুক্তিবাদী হন, সত্যান্বেষী হন এবং তাঁর যদি বিশ্লেষনী ক্ষমতা থাকে তবে অনায়াসে তিনি ইতিহাস থেকে সত্য খুঁজে বের করে আনতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি। সত্যান্বেষী, সৎ এবং মানব কল্যাণে নিবেদিত কোন ব্যক্তির উচিৎ নয় কোন মহৎ এবং অনুসরনীয় চরিত্রকে কলংকিত করা।
বিষয়: বিবিধ
৩১৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন