মানবজাতির বর্ত্তমান অবস্থা
লিখেছেন লিখেছেন জাতগোক্ষুর ৩০ আগস্ট, ২০১৩, ০১:০৬:৩৬ রাত
১৪০০ বছর আগে আল্লাহর শেষ রসুল আমাদের এই সময় সম্বন্ধে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলি কোরে গেছেন আজ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হোচ্ছে। পৃথিবীতে একটা টুকরো মাটি বা পানি নেই যা দাজ্জালের (ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার, Judeo-Christian Technological Civilization) শক্তি ও প্রভাব বলয়ের বাইরে (দাজ্জালের পরিচিতি অধ্যায়ের ১৩ নং ও ১৪ নং হাদীস)। মানবজাতির কাছে দাজ্জাল (Dajjal) দাবি কোরছে যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেন তাকে রব (প্রভু, প্রতিপালক) বোলে মেনে নেয়, অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পরিত্যাগ কোরে মানুষের সার্বভৌমত্বকে মেনে নেয়। মানুষের সার্বভৌমত্বের যে কয়টি ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদিকে পরাজিত কোরে বর্ত্তমানে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রই জয়ী এবং এর সার্বভৌমত্বই মেনে নেয়ার দাবি দাজ্জালের। দাজ্জালের এই দাবির কাছে মানবজাতি আজ আত্মসমর্পণ কোরেছে। যে এসলামের ভিত্তিই হোচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (তওহীদ), যে সার্বভৌমত্ব ছাড়া এসলামই নেই, সেই এসলামের দাবিদার, ‘মোসলেম’ বোলে পরিচিত জনসংখ্যাটিও ভুল আকীদার কারণে প্রায় সম্পূর্ণটাই ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সাবভৌমত্ব মেনে নিয়েছে, অর্থাৎ দাজ্জালের পায়ে সাজদায় প্রণত হোয়েছে। দাজ্জালের শিক্ষা-ব্যবস্থায় শিক্ষিতরা তো বটেই, দাজ্জালের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ইত্যাদিতে (এ বিষয়ে পাঠকের কৌতুহল হোলে তাকে আমার লেখা “এ ইসলাম ইসলামই নয়” বইটি পড়তে অনুরোধ কোরছি), যেখানে দাজ্জালের তৈরী করা এসলামের আলেম ওলামা, আল্লামা, মাশায়েখরাও দাজ্জালের দেয়া মানুষের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার কোরে নিয়েও ভাবছেন তারা মো’মেন, মোসলেমই আছেন।
এই মোসলেম জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা কোরছে। এই ক্ষুদ্র অংশটিরও এসলাম সম্বন্ধে সঠিক আকীদা নেই। মানুষ সৃষ্টি কোরে এই পৃথিবীতে তাকে তাঁর খলিফা, প্রতিনিধি নিযুক্ত কোরে (কোরান- সুরা বাকারা, আয়াত ৩০), মানুষের মধ্যে তাঁর নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়ে (কোরান- সুরা হেজর, আয়াত ২৯; সুরা সাজদা, আয়াত ৯; সুরা সা’দ, আয়াত ৭২), তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে (কোরান- সুরা বাকারা, আয়াত ৩৬), মানুষের দেহ-আত্মার মধ্যে এবলিসকে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে (কোরান- সুরা বনী এসরাঈল ৬৪), তারপর আবার নবী-রসুল পাঠিয়ে মানুষকে হেদায়াহ অর্থাৎ দিক নির্দেশনা দিয়ে (কোরান- সুরা বাকারা, আয়াত ৩৮) তার উদ্দেশ্য কি, এক কথায় এসলাম কী এ সম্বন্ধে তাদের সঠিক আকীদা (Comprehensive Concept) নেই। অথচ তারা আল্লাহকে, তাঁর রসুলকে ও দীনুল এসলামকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন, আর তাই তারা দাজ্জালের দাবি গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্বকে মানতে রাজী নন, তারা চান পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। দুর্ভাগ্যক্রমে এরা জানেন না সত্যদীন (দীনুল হক) কী, এবং এর প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়া কী। এরা খৃষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় খৃষ্টানদের তৈরী করা এক প্রাণহীন এসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য ভুল পথে, ভুল প্রক্রিয়ায় চেষ্টা কোরছেন। দাজ্জালের পৃথিবীব্যাপী মহাশক্তির বিরুদ্ধে এরা অসহায়। দাজ্জালের প্রযুক্তি (Technology), অসংখ্য বোমারু বিমান, অসংখ ট্যাঙ্ক, যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে তাদের কিছুই নেই। তাই তারা মরিয়া হোয়ে এখানে ওখানে বোমা মেরে, পর্যটন কেন্দ্রে হামলা কোরে দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রতিহত কোরতে চাইছেন। আল্লাহ, রসুল ও এসলামের জন্য এরা এমন উৎসর্গীকৃত যে তারা শরীরে বোমা বেঁধে তা ফাটিয়ে শত্রু হত্যা কোরতে চেষ্টা কোরছেন। তারা বুঝছেন না দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রতিরোধ, সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠার এগুলো সঠিক পথ নয়, সমস্ত পৃথিবী যার হাতে, ‘মোসলেম’ নামসর্বস্ব জনসংখ্যাসহ সমস্ত মানবজাতি যার পায়ে সাজদায় প্রণত সে মহাশক্তিধর দানবের এতে কিছুই হবে না। কিছু তো হবে না-ই বরং তার লাভ হবে এবং হোচ্ছে। এদের ‘সন্ত্রাসী’ (Terrorist), ‘মৌলবাদী’ (Fundamentalist), ‘চরমপন্থী’ (Extremist), ‘জঙ্গী’ (Militant) ইত্যাদি বহুবিধ নামে আখ্যায়িত কোরে, ‘মোসলেম’ জনসংখ্যাসহ সমস্ত মানবজাতিকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত কোরে দিয়েছে। এই মোসলেম জনসংখ্যার মহা-মুসুল্লীগণও যারা দাজ্জালের পায়ে সাজদায় পোড়ে আছেন তারা এই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, তাদের তারা ঘৃণা করেন।
দাজ্জালের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এই অতি ক্ষুদ্র দলকে বুঝতে হবে দাজ্জাল (Dajjal)কে প্রতিরোধের এই পথ ভুল। তাদের বুঝতে হবে এসলাম অর্থাৎ সত্যদীন (দীনুল হক) কী এবং এর প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়া কী। তাদের বুঝতে হবে এবং উপলব্ধি কোরতে হবে যে পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র সঠিক নীতি, পথ ও প্রক্রিয়া হোচ্ছে শুধু সেইটা যেটা আল্লাহর রসুল নিজে কোরেছেন এবং আমাদের শিখিয়ে গেছেন। ঐ পথ ছাড়া আর কোনও পথে, কোনও প্রক্রিয়ায় তারা আল্লাহর সাহায্য পাবেন না, তারা সফলও হবেন না এবং হোচ্ছেন না।
দাজ্জালের রব হবার দাবীর বিরুদ্ধে আজ যে ক্ষুদ্র জনসমষ্টি দাঁড়িয়েছে, যাদের দাজ্জাল (Dajjal) নাম দিয়েছে ‘সন্ত্রাসী’, তারা পৃথিবীর কোথাও ঐ মহাশক্তিধর দানবের সাথে পেরে উঠছেন না। কারণ তাদের জন্য আল্লাহর কোন সাহায্য নেই। আল্লাহর সাহায্য নেই তার প্রধান কারণ দু’টো। প্রথমত- তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রকৃত অর্থ বোঝেন না, তারা ‘লা এলাহা এল্লা আল্লাহ’ এই কলেমার এলাহ শব্দের ভুল অর্থ করেন। তারা এলাহ শব্দের অর্থ করেন মা’বুদ অর্থাৎ যাকে উপাসনা করা হয়। এলাহ শব্দের প্রকৃত অর্থ হোল- যার হুকুম, আদেশ, নির্দেশ শুনতে ও পালন কোরতে হবে, আনুগত্য কোরতে হবে অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব। আর মা’বুদ শব্দের প্রচলিত অর্থ হোল- যাকে উপাসনা করা হয়, সেখানে সামগ্রিক জীবনে যার আদেশ নির্দেশ পালন করার, আনুগত্য করার প্রয়োজন নেই (মা’বুদ শব্দের প্রকৃত অর্থ জানার জন্য ‘প্রকৃত এবাদত’ অধ্যায় দেখুন)। এই ভুল অর্থের পরিণাম আজ এই হোয়েছে যে সমস্ত মানবজাতি, এই তথাকথিত ‘মোসলেম’ জনসংখ্যাসহ, মহাসমারোহে বিরাট বিরাট কারুকার্য্যময় অতি সুদৃশ্য মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জায়, সিনাগগে ও প্যাগোডায় আল্লাহর উপাসনা করে, এবাদত করে, কিন্তু তাদের সমষ্টিগত জীবনে, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, বিচার ফায়সালায়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে আল্লাহকে, তাঁর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার কোরে মানুষের সার্বভৌমত্বের আনুগত্য করে, আর দাজ্জাল (Dajjal) মানবজাতির কাছে ঠিক এটাই চায়। যে কলেমার ভিত্তির উপর দীনুল হক অর্থাৎ সত্য জীবন-ব্যবস্থার এমারত দাঁড়িয়ে আছে সেই কলেমার ভুল অর্থের আরেক পরিণাম এই হোয়েছে যে প্রকৃত, সঠিক এসলাম আজ হারিয়ে গেছে এবং বর্ত্তমানের ‘লা মা’বুদ এল্লা আল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই’ কলেমার বিকৃত এসলামটাকেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ঐ ক্ষুদ্র দলটি কোরে যাচ্ছেন, কোথাও সফল হোচ্ছেন না এবং হবেনও না কারণ আল্লাহ বিকৃত এসলামকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সাহায্য কোরবেন না। দ্বিতীয়ত- এরা যে এসলামটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম কোরছেন এবং যে সংগ্রামে তাদের জানমাল উৎসর্গ কোরছেন সেটা প্রকৃত এসলামই নয়। শুধু যে প্রকৃত এসলামই নয় তাই নয়, সেটার আকীদা এবং পথ রসুলের মাধ্যমে প্রেরিত এসলামের একেবারে বিপরীত।
দাজ্জাল (Dajjal)কে ভালোভাবে বুঝতে গেলে সার্বভৌমত্ব কি তা আগে বুঝতে হবে। মানুষ সামাজিক জীব, কাজেই একটা জীবন-ব্যবস্থা ছাড়া সে পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস কোরতে পারে না। এবং সেই জীবন-ব্যবস্থা হোল দীন। সুতরাং সেই জীবন-ব্যবস্থা বা দীনে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজবিধি, সবই থাকতে হবে। অবশ্য অবশ্যই থাকতে হবে এবং এর একটা সার্বভৌমত্বও অবশ্যই থাকতে হবে; সার্বভৌমত্ব ছাড়া তা চোলতেই পারবে না। কারণ যখনই আইন, দণ্ডবিধি অর্থনীতি বা যে কোন ব্যাপারেই কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তখনই একটা সার্বভৌমত্বের প্রয়োজন হবে। উদাহরণ- সমাজে অপরাধ দমনের জন্য নরহত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত কিনা। কিম্বা সমাজের সম্পদ সঠিক এবং সুষ্ঠু বিতরণের জন্য অর্থনীতি সুদ ভিত্তিক হওয়া সঠিক কিনা? সমাজের নেতারা যদি ঐ সব বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ, যুক্তি-তর্ক করেন তবে তা অনন্তকাল ধোরে চোলতে থাকবে- কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না, কারণ এইসব বিষয়ে প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। একদল বোলবেন- নরহত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড আইন না কোরলে সমাজে নরহত্যা থামবে না, বাড়বে; আরেক দলের মত এই হবে যে মৃত্যুদণ্ড বর্বরোচিত, নৃশংসতা, এ কখনো আইন হোতে পারে না; আরেক দল হয়তো এই মত দেবেন যে একটি নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে একাধিক নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড আইন করা হোক। একাধিক অর্থে কয়টি নরহত্যা কোরলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, দুইটি না একশ’টি তাও প্রশ্ন হোয়ে দাঁড়াবে। এবং এ বিতর্ক অনন্তকাল চোলতে থাকবে।
অনুরূপভাবে সমাজের অর্থনীতি সুদভিত্তিক হওয়া সঠিক না লাভ লোকসান ভিত্তিক হওয়া উচিত এ নিয়ে বিতর্কের কোনদিন অবসান হবে না যদি না সিদ্ধান্ত নেবার মত একটা ব্যবস্থা না থাকে। কাজেই যে কোন জীবন-ব্যবস্থায়ই শেষ সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটি স্থান থাকতেই হবে। অন্যথায় জীবন-ব্যবস্থার যে কোন ব্যাপারে পরামর্শ আলোচনায় বসলে তা অনন্তকাল চোলতে থাকবে। এই শেষ সিদ্ধান্ত নেবার ও দেবার কর্ত্তৃত্ব ও অধিকারই হোচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এই সার্বভৌমত্ব হোতে পারে মাত্র দুই প্রকার। যিনি সৃষ্টি কোরেছেন তাঁর, স্রষ্টার; কিম্বা সৃষ্টের অর্থাৎ মানুষের। স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের জন্য একটা জীবন-ব্যবস্থা দিয়েছেন যাকে তিনি বোলেছেন দীন, সুতরাং তিনি নিজেই সেটার সার্বভৌম। ঐ দীনের মধ্যেই তিনি মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, এক কথায় ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি যে কোন পর্যায়ে অবিচার, অশান্তি, অন্যায়, অপরাধহীন একটা সমাজ গঠন কোরে সেখানে বাস করার জন্য তার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন। মানুষ যদি স্রষ্টার ঐ সিদ্ধান্ত অর্থাৎ আদেশগুলি মেনে নিয়ে সেই মোতাবেক তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন পরিচালিত করে তবে সে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে নিলো। আর যদি সে আল্লাহর দেয়া সিদ্ধান্তগুলিকে অস্বীকার করে, তবে তাকে অতি অবশ্যই অন্য একটি জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ দীন তৈরী কোরে নিতে হবে, কারণ একটা জীবন-ব্যবস্থা ছাড়া মানুষ পৃথিবীতে বাস কোরতে পারে না, তা অসম্ভব। এই নতুন জীবন-ব্যবস্থা তৈরী কোরতে গেলেই সেখানে অতি অবশ্যই একটি শেষ সিদ্ধান্তের স্থান, অধিকার থাকতে হবে; এবং যেহেতু স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে ত্যাগ করা হোল, সেহেতু এই শেষ সিদ্ধান্তের স্থান, কর্ত্তৃত্ব অধিকার (Authority) হোতে হবে সৃষ্টির অর্থাৎ মানুষের।
সমগ্র মানবজাতি, ‘মোসলেম’ বোলে পরিচিত ১৫০ কোটির এই জনসংখ্যাসহ, আজ স্রষ্টার, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ্) ত্যাগ কোরে মানুষের সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ কোরেছে। এই দুই সার্বভৌমত্ব বিপরীতমুখী, একটি স্রষ্টার, অন্যটি সৃষ্টের; এ দু’টি সাংঘর্ষিক। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ওপরই এসলাম প্রতিষ্ঠিত, এই সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোন এসলাম নেই। আল্লাহর এই সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাজ্জাল (Dajjal) আজ দাঁড়িয়েছে সৃষ্টির অর্থাৎ মানুষের সার্বভৌমত্বের প্রতিভূ, প্রতিনিধি হোয়ে। হওয়ার কথা ছিলো এই যে ‘লা এলাহা এল্লা আল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসের দাবীদার ‘মোসলেম’ বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যা নিজেদের সর্বপ্রকার বিভেদ ভুলে যেয়ে মানুষের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধি দাজ্জালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। দুর্ভাগ্যক্রমে তা তো হয়ই নাই বরং এই ‘লা এলাহা এল্লা আল্লাহ’ যিকরকারী, মোসলেম হবার দাবীদার জনসংখ্যার প্রায় সবটাই হয় গণতন্ত্র, না হয় রাজতন্ত্র, না হয় সমাজতন্ত্র, না হয় একনায়কতন্ত্রের কোন না কোনটা মেনে নিয়ে দাজ্জালের পায়ে সাজদায় প্রণত হোয়ে আছে।
দাজ্জাল (Dajjal), অর্থাৎ ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা, পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে, একাধিকবার দিয়েছে যে সে সমস্ত পৃথিবীতে গণতন্ত্র অর্থাৎ মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কোরবে। এ কাজ সে অনেক আগে আরম্ভ কোরেছে এবং তা বহুমুখী; পৃথিবীব্যাপী প্রচার মাধ্যমে (Media), শিক্ষা-ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং শক্তি প্রয়োগ কোরে। দাজ্জাল (Dajjal) ভালো কোরে জানে যে তার সম্মুখে প্রধান বাধা এসলাম বোলে দীনটি যার বুনিয়াদ, ভিত্তিই হোল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ্) অর্থাৎ যার সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কারোও সিদ্ধান্ত অস্বীকার করা। তার সম্মুখে আর কোন বাধা নেই, কারণ পৃথিবীর বাকি জাতিগুলি মানুষের সার্বভৌমত্বকে ইতোমধ্যেই মেনে নিয়েছে। প্রচার (Media) ও শিক্ষা-ব্যবস্থার ফলে মোসলেম বোলে পরিচিত এ জনসংখ্যার নেতৃত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাগ দাজ্জালের পায়ে সাজদায় প্রণত হোয়ে গেছে। বাকি শুধু একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা যারা দাজ্জাল (Dajjal)কে ‘দাজ্জাল (Dajjal)’ বোলে না বুঝেও শুধু সে মোসলেম বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যাকে তার হুকুমের দাসে পরিণত করার চেষ্টা কোরছে, এইটুকুর জন্য এই মহাশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
দাজ্জালের ইহুদী-খৃষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে আছে বিরাট বিশাল সামরিক শক্তি, এবং আছে প্রভূত পার্থিব সম্পদ। দাজ্জাল (Dajjal)বিরোধী এই ক্ষুদ্র সংখ্যার কাছে ওসব কিছুই নেই, তাদের পার্থিব সম্পদ, তেল গ্যাস ইত্যাদিও তাদের হাতে নেই, সেগুলো তাদের সরকারগুলোর হাতে, যারা ইতোমধ্যেই দাজ্জালের পায়ে সাজদায় প্রণত হোয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে কার্য্যতঃ অস্বীকার কোরে দাজ্জালের অর্থাৎ মানুষের সার্বভৌমত্বকে তাদের এলাহ বোলে স্বীকার কোরে নিয়েছে। সুতরাং মরিয়া হোয়ে তারা ভুল কাজ কোরছেন। তারা এখানে ওখানে বোমা ফাটাচ্ছেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলি ধ্বংস কোরছেন। তাতে দাজ্জালের কোন ক্ষতি না হওয়ায় তারা শরীরে বোমা বেঁধে আত্মঘাতি হোচ্ছেন। এতে দাজ্জালের কী ক্ষতি হোয়েছে? ধরতে গেলে কিছুই না। টুইন টাওয়ার গেছে তাতে দাজ্জালের কী হোয়েছে? এখন ঐ স্থানেই সেই টুইন টাওয়ারের চেয়েও বড় টাওয়ার তৈরী কোরছে। বরং দাজ্জালের এতে লাভ হোচ্ছে। পৃথিবীর মানুষকে সে বোলছে যে- দ্যাখো! এরা কি রকম সন্ত্রাসী। এরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষ, স্ত্রীলোক, শিশু হত্যা কোরছে আত্মঘাতি বোমা মেরে। এদের ধর, মার, জেলে দাও, ফাঁসি দাও। পৃথিবী দাজ্জালের এ কথা মেনে নিয়েছে এবং দাজ্জালের নির্দেশ মোতাবেক তাই কোরছে, কারণ ইংরাজি প্রবাদ বাক্য Might is right অর্থাৎ মহাশক্তিধরের কথাই ঠিক।
এ প্রবাদ বাক্য যে সত্য তা এ থেকেই প্রমাণ হয় যে পৃথিবীর মানুষ টুইন টাওয়ারের দুই আড়াই হাজার মানুষ হত্যার জন্য দাজ্জালের আখ্যায়িত ‘সন্ত্রাসীদের’ ঘৃণা করে, কিন্তু হিরোশিমা নাগাসাকির কয়েক লক্ষ নর-নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হত্যার জন্য দাজ্জাল (Dajjal)কে ঘৃণাতো করেই না বরং তার পায়ে সাজদায় প্রণত হোয়ে আছে, তার একটু কৃপা পেলে নিজেদের ধন্য মনে করে। টুইন-টাওয়ারে শুধু কার্য্যক্ষম নরনারী ছিলো, কিন্তু নাগাসাকি হিরোশিমাতে নর-নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, হাসপাতাল ভর্ত্তি রোগী, স্কুল, কলেজ, সবই ছিলো এবং ঐ সবই দাজ্জাল (Dajjal) এটম বোমা মেরে কয়েক মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন কোরে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধোরে দাজ্জাল (Dajjal) (তদানিন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নসহ কারণ সোভিয়েট ইউনিয়নও মানুষের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী) আফগানিস্তানে এবং ইরাকে প্রায় প্রতিদিন বেসামরিক মানুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পঙ্গু, রোগী হত্যা কোরে চোলেছে। এগুলোর মোট সংখ্যা ‘সন্ত্রাসীদের’ বোমা এবং আত্মঘাতি হামলায় বেসামরিক নর নারী শিশুর হত্যার সংখ্যার হাজার গুণ বেশী। এ কাজের জন্য কেউ দাজ্জাল (Dajjal)কে সন্ত্রাসী বলে না, তাকে ঘৃণাও করে না, তার তাবেদারি কোরতে পারলে গদ গদ চিত্ত হোয়ে যায়। কেন? ঐ প্রবাদ বাক্য- Might is right, শক্তিই হোল ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড।
মহাসত্য হোচ্ছে এই যে- আল্লাহর রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যায়ন হোচ্ছে এই যে, দাজ্জাল (Dajjal) হোচ্ছে বর্ত্তমানের ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতা, তার বাহন হোচ্ছে যান্ত্রিক প্রযুক্তি (Scientific Technology), যে বাহনের হাতে, শরীরে অজস্র যুদ্ধাস্ত্র, বোমারু বিমান, যুদ্ধ-জাহাজ, ট্যাঙ্ক, কামান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং আণবিক বোমা ইত্যাদি। এই অস্ত্রের শক্তিতে মহাশক্তিধর হোয়ে সে মানবজাতিকে বোলছে, তোমরা আমাকে প্রভু (রব) বোলে স্বীকার করো, আমার আদেশ পালন করো, এবং তোমরা স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ্) ত্যাগ কোরে মানুষের সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করো। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অনেক পুরানো ব্যাপার, ওটা অকেজো হোয়ে গেছে। তবুও তোমরা যার যার ধর্ম পালন করো কোন সমস্যা নেই। মুসলমান, তোমরা যত খুশি লম্বা দাড়ি রেখে, মোছ কেটে ফেলে, পাজামা হাঁটু পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে মসজিদে দৌঁড়াও, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নামায পড়ো, আমার কোন আপত্তি নেই; খৃষ্টান, তুমি লম্বা জোব্বা পোরে, গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে, গীর্জায় যেয়ে যত খুশি নীতিবাক্য, বক্তৃতা কোরতে চাও করো, আমার কোন আপত্তি নেই; বৌদ্ধ, তুমি গেরুয়া বসন গায়ে দিয়ে, মাথা ন্যাড়া কোরে, ভিক্ষা কোরে খাবার সংগ্রহ কোরে প্যাগোডায় যেয়ে বুদ্ধের মুর্ত্তির সামনে বোসে যত খুশি ‘বুদ্ধং স্বরণং গচ্ছামী, সংঘং স্বরণং গচ্ছামী’ গাও কোন আপত্তি নেই; হিন্দু, তুমি নামাবলি গায়ে দিয়ে কপালে সিঁদুর আর চন্দনের ফোটা দিয়ে তোমাদের হাজারো রকম মন্দিরের যেটায় খুশি যেয়ে হাজারো রকম মুর্ত্তির সামনে বোসে ঘণ্টা বাজাও, কোন আপত্তি নেই; ইহুদী, তোমরা লম্বা আলখালা গায়ে দিয়ে মাথায় উঁচু টুপি পোরে, বুকে ডেভিডের স্টার ঝুলিয়ে সিনাগগে যেয়ে প্রার্থনা করো, কোন আপত্তি নেই। আপত্তি তো নেইই, বরং এগুলো তোমরা যত বেশি কোরবে আমি তত খুশি হবো; কারণ তোমরা ওগুলো নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে আমি তত নিরাপদ হবো।
কিন্তু সাবধান! কখনো সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলো না, ও ব্যাপারে ফায়সালা হোয়ে গেছে। আমি মানবজাতিকে বাধ্য কোরেছি আমাকে প্রভু (রব) বোলে মেনে নিতে; অর্থাৎ আমার উপদেশ মেনে নিতে। আমার উপদেশই আমার আদেশ। এবং তাদের সামষ্টিক জীবনে অর্থাৎ রাষ্ট্র, আর্থ-সামাজিক জীবনে মানুষকে সার্বভৌম (এলাহ্) বোলে মেনে নিতে বাধ্য কোরেছি। যদি কোনও ব্যক্তি বা দল আমার উপদেশ অর্থাৎ আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে তবে সেই ব্যক্তি বা দল যেই রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেই রাষ্ট্রের সরকারকে আমার অসন্তুষ্টি জানিয়ে দিলেই আমার মেজাজ খুশি রাখার জন্য সেই রাষ্ট্রের সরকার তার সর্বশক্তি নিয়ে সেই ব্যক্তি বা দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পোড়ে সেটাকে ধ্বংস কোরে দেয়; আমার কিছুই কোরতে হয় না। আর যদি কোন রাষ্ট্র আমার আদেশ মানতে গড়িমসি করে বা অমান্যই করে তবে প্রথমত আমি সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ কোরি। যেহেতু পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রই আমার প্রভুত্বকে (রবুবিয়াহ্) ও মানুষের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার কোরে নিয়েছে, সেহেতু তারা আমার উপদেশ (আদেশ) অনুযায়ী সে রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ বন্ধ কোরে দিয়ে সেটাকে প্রচণ্ড অসুবিধার মধ্যে নিক্ষেপ করে। তাতে যদি কাজ না হয় তবে আমি সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরোধ (Embargo) স্থাপন কোরি। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সেটার সমস্ত রকম সম্পর্ক কেটে দিয়ে সেটাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ কোরে দেই।
এতেও যদি সে রাষ্ট্র আমার প্রভুত্ব ও মানুষের সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণ না করে তবে আমি সেটাকে সামরিকভাবে আক্রমণ কোরে সে রাষ্ট্র দখল কোরে নিয়ে সেখানে আমার আনুগত্য ও মানুষের সার্বভৌমত্ব স্বীকারকারী সরকার স্থাপন কোরি। এই প্রক্রিয়ায় ঐ রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, কামানের হামলায় নিহত হয়। কোটি কোটি শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পঙ্গু, বিকলাঙ্গ হয়। সে দেশের সমস্ত স্থাপনা ধ্বংস হয়। এ সত্ত্বেও আমাকে তা কোরতে হবে কারণ সমস্ত পৃথিবীতে আমার প্রভুত্ব (রবুবিয়াহ্) ও স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে (উলুহিয়াহ্) হটিয়ে মানুষের সমষ্টিগত জীবনে মানুষেরই সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা আমার অঙ্গীকার, আমার ক্রুসেড (Crusade)। এ ক্রুসেডে আমি ইতোমধ্যেই সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে বিশ্বজয়ী হোয়েছি। মানুষের সার্বভৌমত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠা হোয়েছে। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ্) আর কোথাও নেই। কিন্তু আমার প্রভুত্বকে (রবুবিয়াহ্) এখনো কিছু কিছু রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে অস্বীকার কোরছে। তাদের মধ্যে দু’টি রাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ কোরে ও পরে অবরোধ কোরেও বাগ মানাতে না পেরে তাদের সামরিকভাবে আক্রমণ কোরে পরাজিত কোরে আমার অবাধ্য সরকার ভাগিয়ে দিয়ে সেখানে আমার একান্ত অনুগত সরকার ক্ষমতায় বোসিয়েছি। আরও যদি কোন রাষ্ট্র আমার প্রভুত্ব মানতে রাজি না হয় তবে তাদেরও দশা ঐ দুই রাষ্ট্রের মতই হবে।
দাজ্জালের এই দাবী, এই হুকুমের বিরুদ্ধে বলার বিশেষ কিছুই নেই। বাস্তবতাকে (Reality) স্বীকার কোরে নিয়ে হিসাব কোরলে দেখা যায় যে স্রষ্টা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ, লা এলাহা এল্লা আল্লাহ) ও মানুষের সার্বভৌমত্বের দ্বন্দ্বে ইতোমধ্যেই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব পরাজিত হোয়ে গেছে। কারণ অতি সরল- যার সঙ্গে দাজ্জালের দ্বন্দ্ব অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের রক্ষাকারী মোসলেম বোলে পরিচিত জনসংখ্যাটি, ‘লা এলাহা এল্লা আল্লাহ’ কলেমার ভুল অর্থ কোরে এলাহ শব্দের অর্থকে একমাত্র হুকুমদাতার বদলে একমাত্র উপাস্য বোলে রূপান্তর কোরে সমষ্টিগত, জাতীয় জীবনে আল্লাহর প্রতিটি আদেশকে প্রত্যাখ্যান কোরে, ইহুদী-খৃষ্টানদের আদেশ প্রতিপালন কোরে, পৃথিবীময় লক্ষ লক্ষ চাকচিক্যময় মসজিদ তৈরী কোরে তাতে মহা-ধুমধাম কোরে এবাদত কোরে দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে মেনে নিয়ে তার পক্ষ হোয়ে গেছে। এই জনসংখ্যাটি যে এমন কোরবে তা আল্লাহর রসুল বহু পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী কোরে গেছেন (পরিচিতি অধ্যায় ১২ নং হাদীস এবং ঐ অধ্যায়ের শেষে ক এবং খ হাদীস), এমন কি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কেন্দ্র ও তাঁর নবীর মদিনার অভিভাবক রাজশক্তিটি পর্যন্ত দাজ্জালের পায়ে সাজদায় অবনত হোয়ে গেছে, তার আদেশ প্রাণপণে পালন কোরে চোলেছে। না কোরলে দাজ্জালের আদেশে তার সিংহাসন হারাবার ভয় আছে। অনুরূপ অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলি রাজতন্ত্র ও আমীরতন্ত্রের। এ তন্ত্রগুলিও মানুষের সার্বভৌমত্বের অঙ্গীভুত। এরা সব এখন দাজ্জালের শক্তি বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ। এর বাইরে যে মোসলেম নামের জনসংখ্যা রোয়েছে সেগুলির শাসকশ্রেণী মানুষের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ দাজ্জালের অনুসারী।
তাহোলে কি সব আশাই শেষ? না; তা নয়। তা যে নয় তার কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হোল এই যে, আল্লাহ তাঁর কোরানে তাঁর শেষ রসুলকে রহমাতুল্লিল আ’লামিন বোলেছেন (কোরান- সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)। অর্থাৎ শেষ নবী মোহাম্মদ (দঃ) সমস মানবজাতির জন্য আল্লাহর প্রেরিত রহমত। যারা তাঁকে এবং তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত দীন, জীবন-ব্যবস্থা মেনে নিয়ে সেটাকে তাদের জীবনে কার্য্যকর কোরবে শুধু তাদের জন্যই তিনি আল্লাহর রহমত। আল্লাহ বোলেছেন তিনি তাঁর রসুলকে সমস্ত মানবজাতির জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ কোরেছেন- কাজেই এক সময় সমস্ত মানবজাতি তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নিয়ে তার মাধ্যমে পাওয়া দীনুল হক (সঠিক জীবন-ব্যবস্থা) তাদের জীবনে কার্য্যকর, প্রতিষ্ঠা কোরবে। তা না হোলে আল্লাহর দেয়া রহমাতুল্লিল আ’লামিন উপাধি অর্থহীন হোয়ে যায়। তা অসম্ভব।
দ্বিতীয় কারণ- আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী কোরেছেন- আল্লাহ যতদিন চান ততদিন তোমাদের মধ্যে নবুয়াত থাকবে (অর্থাৎ তিনি স্বয়ং)। তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর হবে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত; যতদিন আল্লাহ চান ততদিন তা থাকবে, তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর আসবে মুলকান (রাজতন্ত্র); যতদিন আল্লাহ চান ততদিন থাকবে, তারপর আল্লাহ তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর আসবে জাবারিয়াত (শক্তি প্রয়োগ, জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন)। তারপর আসবে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত (দালায়েলুম নবুয়াত- বায়হাকী, মুসনাদ- আহমদ বিন হাম্বল, মেশকাত)। রসুলাল্লাহর এই ভবিষ্যদ্বাণীর অধিকাংশ নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত হোয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় অংশতো বিতর্কের বাইরে। তারপর তৃতীয় অংশ ইতিহাস। উমাইয়া যুগে খেলাফতের পদ্ধতি বদলিয়ে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হোল, যদিও রাজনৈতিক কারণে ও মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নাম খেলাফতই রোইলো। সমস্ত পৃথিবীতেই তখন রাজতন্ত্র চালু ছিলো; এসলামের খেলাফত তখন তাদের সামিল হোয়ে গেলো। পৃথিবীময় ঐ রাজতন্ত্র চললো কয়েক শতাব্দী। তারপর ৪৭৪ বছর আগে দাজ্জালের জন্ম হবার পর ধীরে ধীরে পৃথিবীর রাজতন্ত্রগুলি লোপ পেয়ে সেখানে দাজ্জালের অনুসারী বিভিন্ন তন্ত্র, বাদ, ইযম্ (-ism), ক্রেসি (-cracy) ইত্যাদি আসীন হোল। আরম্ভ হোল রসুল বর্ণিত জাবারিয়াত, শক্তির শাসন, Might is right-এর শাসন, দাজ্জালের শাসন এবং এখন এটাই চোলছে। সুসংবাদ এই যে এর অবসান ঘোটবে এবং এর পর এনশা’আল্লাহ আসছে নবুয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত। এবং সেটা আসছে ঈসার (আঃ) হাতে দাজ্জালের ধ্বংসের পর।
তৃতীয় কারণ- আল্লাহর রসুল একদিন বোললেন- সুসংবাদ দাও, সুসংবাদ দাও। আমার উম্মাহর উদাহরণ এমন এক বৃষ্টির মত, যার প্রথম ভালো না শেষ ভালো বলা যায় না। ... এই উম্মাহ ধ্বংস হবে কেমন কোরে যার প্রথমে আমি, মধ্যে মাহ্দী এবং শেষে ঈসা; কিন্তু এর মধ্যখানে আছে বিভ্রান্তরা; তারা আমার কেউ নয়, আমিও তাদের কেউ নই (হাদীস- আনাস (রাঃ) থেকে তিরমিযি; জাফর (রাঃ) থেকে রাযিন)।
আল্লাহর রসুলের এই কথা থেকে বোঝা যায় যে আখেরী যমানায়, শেষ যুগে, বাইবেলের ভাষায় Last hour-এ এই উম্মাহর মানুষ আবার এমন মানুষে পরিণত হবে যারা রসুলের যুগের মানুষের মতই হবে। এবং এই উম্মাহর দুই প্রান্তের মানুষের এমনই মিল হবে যে উম্মাহর স্রষ্টা স্বয়ং রসুলের পক্ষেই বলা মুশকিল হবে কোনটা ভালো। শোকর আলহামদোলেল্লাহ। আল্লাহর রসুলের এই হাদীস থেকে পরিষ্কার হোয়ে যাচ্ছে আরেকটি সত্য, যে সত্যটি আমরা অর্থাৎ হেযবুত তওহীদ বারবার বোলে আসছি এবং সত্যটি বলার জন্য, মানুষকে বোঝাবার চেষ্টার জন্য আমরা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হোচ্ছি, বিশেষ কোরে বর্ত্তমান বিকৃত এসলামের আলেম শ্রেণীর কাছ থেকে অপমানিত হোচ্ছি, নিগৃহিত হোচ্ছি; সে সত্য হোচ্ছে এই যে আল্লাহর রসুলের ৬০/৭০ বছর পর থেকে ভবিষ্যতে মাহ্দী (আঃ) পর্যন্ত যে সময় অর্থাৎ বর্ত্তমানের মোসলেম নামধারী এই জনসংখ্যা রসুলের কেউ নয়, এবং রসুলও তাদের কেউ নন। আল্লাহর রসুল যাদের কেউ নন, এবং যারা রসুলের কেউ নয় তারা কি মোসলেম বা মো’মেন বা উম্মতে মোহাম্মদী? অবশ্যই নয়। এই জন্য নয় যে রসুল ও মাহ্দীর অন্তর্বর্ত্তিকালীন মোসলেম নামধারী বর্ত্তমানের এই জনসংখ্যাটি আল্লাহর অস্তিত্বকে, তাঁর একত্বকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাঁর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার কোরে দাজ্জালের অর্থাৎ জুডিও-খৃষ্টান সভ্যতার, যে সভ্যতার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর নয়, মানুষের, তা মেনে নিয়ে তার আনুগত্য কোরছে।
ঠিক এই অবস্থা ছিলো আরবের মানুষের চৌদ্দশ’ বছর আগে যখন আল্লাহ তাঁর রসুলকে সেখানে পাঠালেন। তখনকার ঐ আরবরা আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বে তেমনি বিশ্বাস কোরতো যেমন আজ আমরা কোরি; তিনি যে স্রষ্টা, প্রতিপালক, সব কিছুর নিয়ামক, তিনি যে সর্বশক্তিমান এ সব কিছুই তারা বিশ্বাস কোরতো (কোরান- সুরা যুখরুফ, আয়াত ৯; সুরা আন্কাবুত, আয়াত ৬১ ও ৬৩; সুরা লোকমান, আয়াত ২৫)। তারা এবরাহীমকে (আঃ) আল্লাহর নবী বোলে বিশ্বাস কোরতো; নিজেদের মিল্লাতে এবরাহীম বোলে বিশ্বাস কোরতো; এবরাহীম (আঃ) দ্বারা পুনর্নির্মিত কাবাকে আল্লাহর ঘর বোলে বিশ্বাস কোরতো; কাবার দিকে মুখ কোরে এবরাহীমের (আঃ) শেখানো পদ্ধতিতে সালাহ (নামায) কায়েম কোরতো; কাবাকে কেন্দ্র কোরে বছরে একবার হজ্ব কোরতো; কাবা তওয়াফ (পরিক্রমা) কোরতো; সেখানে যেয়ে আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানী কোরতো; বছরে একমাস, রমাদান মাসে সওম (রোযা) পালন কোরতো; এমন কি প্রত্যেকে এবরাহীমের (আঃ) শেখানো খাত্না কোরতো। তারা প্রতি কাজে আল্লাহর নাম নিতো, দলিল ইত্যাদি লিখতে, বিয়ে-শাদীর কাবিন লিখতে তারা প্রথমেই ওপরে আল্লাহর নাম লিখে আরম্ভ কোরতো। আমরা যেমন এখন লেখি বেসমেল্লাহের রহমান আর রহিম, তারা লেখতো বেসমেকা আল্লাহুম্মা; একই অর্থ। তাহোলে যাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আসলেন তাদের সাথে বর্ত্তমানের মোসলেম বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়? যদি বলেন যে তারা মুর্ত্তিপূজা কোরতো তবে তার জবাব হোচ্ছে এই যে ঐ মোশরেক আরবরা ঐ মুর্ত্তিগুলোকে আল্লাহ বোলে বিশ্বাস কোরতো না, তাদের স্রষ্টা বোলেও বিশ্বাস কোরতো না, তাদের প্রভু (রব) বোলেও বিশ্বাস কোরতো না। একটু আগেই কোরানের যে আয়াতগুলির উদ্ধৃতি দিয়েছি যেগুলোয় আল্লাহ তাঁর রসুলকে বোলছেন তাদের প্রশ্ন কোরতে, মোশরেকদের জবাব থেকেই, যে জবাবগুলি আল্লাহ স্বয়ং দিচ্ছেন মোশরেকদের পক্ষ থেকে তা থেকেই পরিষ্কার হোয়ে যায়। তাহোলে আরবদের কাছে ঐ মুর্ত্তিগুলি কী ছিলো? তাদের কাছে ঐ মুর্ত্তিগুলি আল্লাহ ছিলো না, তারা বিশ্বাস কোরতো ওগুলি আল্লাহর নিকটবর্ত্তী, ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন। তারা ওগুলির পূজা কোরতো দু’টো কারণে- এক) যেহেতু ওগুলো আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সেহেতু তারা পূজারীদের পক্ষ হোয়ে কোন ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সুপারিশ কোরলে আল্লাহ তা মঞ্জুর কোরবেন। যেমন রোগ-শোক থেকে মুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য, কোন বিপদ থেকে উদ্ধার ইত্যাদি। এ কথার প্রমাণ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ বোলছেন- তারা আল্লাহ ব্যতীত যার এবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও কোরতে পারে না, উপকারও কোরতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’ (কোরান- সুরা ইউনুস, আয়াত ১৮)। দুই) তারা বিশ্বাস কোরতো যে যেহেতু ঐ মুর্ত্তিগুলি, ঐ দেব-দেবীগুলি আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় কাজেই তাদের পূজা কোরে তাদের সন্তুষ্ট কোরতে পারলে তারা পূজারীদের আল্লাহর সান্নিধ্য (কুরবিয়াহ্) এনে দেবে। এ ব্যাপারেও আল্লাহ বোলেছেন- যারা আল্লাহর পরিবর্ত্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই কোরি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে’(কোরান- সুরা যুমার, আয়াত ৩)। দেখা যাচ্ছে- আরব মোশরেকদের মুর্ত্তিপূজার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য ছিলো, একটি দুনিয়াদারী, অন্যটি আখেরাত। ঐ মুর্ত্তিগুলিকে আরবের মোশরেকরা কখনই আল্লাহর স্থানে বসায় নাই।
তাহোলে প্রশ্ন হোচ্ছে- আজ মোসলেম বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি (কোন উম্মাহ নয়) যে দীনটাকে পালন কোরে নিজেদের মো’মেন, মোসলেম ও উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে এবং মৃত্যুর পর জান্নাতে অর্থাৎ বেহেশতে যাবার আশা করে ঐ জনসংখ্যাটি এবং আরবের ঐ মোশরেকদের জাতিটি যার মধ্যে তাদের হেদায়াহর জন্য আল্লাহ তাঁর রসুল প্রেরণ কোরলেন এ দু’টোর মধ্যে প্রভেদ কোথায়? কথাটা আরও পরিষ্কার কোরছি। বর্ত্তমানের এই দীন পাঁচটি রোকনের (স্তম্ভ) ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এ কথায় কোন সন্দেহ আছে কি? অবশ্যই নয়; এবং সেগুলি হোলো- ১) কলেমা, ২) সালাহ (নামায), ৩) যাকাহ, ৪) হজ্ব, ৫) সওম (রোযা)। যারা এগুলির ওপর বিশ্বাস স্থাপন কোরে ওগুলি পালন করেন তাদের বলা হয় মো’মেন, মোসলেম ও উম্মতে মোহাম্মদী। এখন দেখা যাক তদানিন্তন আরবদের সাথে অমিল কোথায়।
বিষয়: বিবিধ
২৪৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন