বিপদ যখন সৌভাগ্যের প্রতীক
লিখেছেন লিখেছেন জাতগোক্ষুর ২৭ আগস্ট, ২০১৩, ১১:২৭:২৮ রাত
আমাদের আশেপাশে এমন অনেকে আছে, যারা সামান্য বিপদে পড়লে হায় হায় করে কপাল চাপড়ে বলতে থাকে আল্লাহ কি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখল না!!
ছোটখাট দুর্ঘটনায় ঘাবড়ে গিয়ে আবোল তাবোল বলা আমাদের অনেকের নিত্য অভ্যাস। অথচ কেউ যদি এর প্রকৃত রহস্য ও ফলাফল জানতো, তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।
আমরা সবাই মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি ভাল মন্দ সবকিছু আল্লাহপাকের নিয়ন্ত্রণে। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই হয়ে থাকে। তার ইশারা ছাড়া কিছুই হতে পারেনা। আর তিনি মানুষের জন্য যখন যা নির্ধারণ করেন- তা অবশ্যই তার জন্য মঙ্গলজনক- যদিও কিছুসময়ের জন্য বাহ্যিকভাবে তা কষ্টকর বলে মনে হয়।
মূলত এসব দিয়ে তিনি আমাদের ঈমান ও ধৈর্যকে একটু যাচাই করতে চান।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) বলেছেন, বিপদ মুসীবত যত বড়, এর প্রতিদানও তত বড়, আর আল্লাহ পাক যখন কাউকে ভালোবাসেন তখন তাকে পরীক্ষা করেন। এ পরীক্ষায় যে খুশী থাকে তার জন্য আল্লাহ পাকও খুশী হয়ে যান, আর যে রাগান্বিত হয়, তার জন্য তিনিও রেগে যান। (তিরমিযী)
এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, বিপদ আপদ রোগব্যাধি যা কিছুই হোক না কেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ। এ পরীক্ষায় টিকতে পারলে পরিণতি শুভ হয়, আর হেরে গেলে পরিণতি মন্দ হয়। এই একটি হাদীসই বিপদগ্রস্তদের সান্তনার জন্য যথেষ্ট।
সামান্য বিপদের জন্য সামান্য সওয়াব, আর কঠিন ও জটিল সমস্যার জন্য অনেক অনেক সওয়াব ও প্রতিদান। মূলত আল্লাহ পাক এসব দিয়ে তার বান্দার ভেতরের ঈমানকে পরীক্ষা করে দেখেন- এর ভিত কতখানি মজবুত।
যে আল্লাহ তাকে এত ভালোবেসে এতদিন সুখে রাখলেন, তারই তরফ থেকে সামান্য বিপদের পরীক্ষায় সে কি সত্যিই খুশী থাকে নাকি আবোল তাবোল বকে রাগ হয়ে বসে থাকে।
প্রতিটি মানুষের ভাগ্যে সুখ-দুঃখের মিশ্রণ রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমরা এর যে প্রতিদান আশা করতে পারি- অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত। কারণ এ বিপদ শুধু আমাদের গোনাহগুলো মাফ হওয়ার কারণ নয়, বরং এর সাথে সাথে আমাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি হয়। পূণ্যের খাতায় যোগ হয় অনেকগুলো নেকি, যা হয়তো সাধারণভাবে আমল করে অর্জন করা সম্ভব হতো না।
ইবনে মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, কোন মুসলমানের সামান্যতম কষ্ট হলেও, চাই তার পায়ে একটু কাঁটা ফুটুক বা এর চেয়েও ছোট কিছু হোক, এর বিনিময়েও আল্লাহ পাক তার গোনাহগুলোকে মাফ করে দেন যেভাবে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে। (বুখারী)
আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসুল বলেছেন, আল্লাহ পাক যখন কোনো বান্দার ভালো চান- তখন তাকে দুনিয়াতে কিছু কষ্ট দিয়ে দেন (যাতে পরকালে সে এসব কষ্ট থেকে মুক্ত থাকে), আর যার জন্য তিনি ভালো চান না- তার থেকে সব বিপদ আপদকে সরিয়ে রাখেন, যাতে কেয়ামতের দিন এগুলো দিয়ে তাকে প্রতিদান দেওয়া হয়। (তিরমিযী)
প্রখ্যাত তাবেয়ী ও বুযুর্গ হযরত হাসান বসরী বলতেন, ‘বিপদাপদ ও মুসীবতকে তোমরা অপছন্দ করো না, অনেক বিষয় যা তোমাদের অপছন্দ- তাতেই হয়তো তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে, আর কোনো বিষয় হয়তো তোমাদের কাছে ভালো মনে হচ্ছে অথচ এর মধ্যেই অকল্যাণ লুকিয়ে আছে।’
আরেক মনিষী ফযল বিন সাহল বলতেন, ‘অনেক বিপদ ও কষ্ট এমন রয়েছে যেগুলো মূলত বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার। এসব কষ্টের মাধ্যমে গোনাহ মাফ হয়, ধৈর্য ধরার সওয়াব পাওয়া যায়, উদাসীনতা থেকে সজাগ করে দেয়, সুস্থতা ও শান্তির মূল্য বোঝা যায়, তওবার জন্য সতর্কতা এবং দান সদকা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়।’
আর এজন্যই মুসলমানদের জীবনে ও মরণে কোনো কাজেই তার জন্য ক্ষতি নেই।
রাসুল সা. বলেছেন, মুমিন ব্যক্তির ভাগ্য কতই না ভাল, সবকিছুতেই তার জন্য রয়েছে কল্যাণ। মুমিন ছাড়া এমন ভাগ্য আর কেউ পায়নি। মুমিন ব্যক্তি সুখে থাকলে শোকর আদায় করে, এতে তার জন্য পূণ্য লেখা হয়, আর অসুখে থাকলে সে ধৈর্য ধরে, এতেও তার জন্য পূণ্য লেখা হয়। (মুসলিম)
তাই জীবনে চলার পথে যে কোনো পর্যায়ে বিপদ আপদ কিংবা অসহনীয় যে কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে হা হুতাশ না করে বরং এ অবস্থায়ও আল্লাহমুখী হয়ে অবনত হওয়া প্রকৃত মুসলমানের কাজ। কারণ ভাগ্যে যতটুকু লেখা আছে তা তো হবেই, কাজেই ধৈর্য ধরলে এখানেও সে পূণ্যের ভাগীদার হল, আল্লাহ পাকও তার ওপর খুশী হলেন। আর আবোল তাবোল বললে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হল, পরিস্থিতি আরও জটিল হল।
পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ ও মহাপ্রতিদানের কথা এসেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন, তারাই ধৈর্যশীল, যারা বিপদগ্রস্ত হলে বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য, আর আমরা তো তার কাছেই ফিরে যাবো) এসব লোকদের জন্য তাদের রবের পক্ষ থেকে দোআ ও রহমত, এরাই সরলপথপ্রাপ্ত।’
নামাজ রোযার ধার ধারেনা, ধর্মকর্ম থেকে উদাসীন এমন অসংখ্য লোককে আমরা খুব সুখে শান্তিতে বাস করতে দেখি। আমরা হয়তো ভাবি, আহা! ওরা কতইনা ভাগ্যবান, নামাজ না পড়লেও কত সুখে আছে।
এসব অমূলক ধারণার জবাব দিয়ে হাদীসের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে, মুমিন মুসলমানের উদাহরণ হল ছোট চারাগাছের মতো, চারাগাছ যেমন সবসময় বাতাসে এদিক ওদিক হেলেদুলে থাকে, তেমনি ছোট খাটো কষ্ট আর বিপদ মুমিন ব্যক্তির জীবনে লেগেই থাকে। যাতে সে সবসময় আল্লাহমুখী থাকে এবং অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হতে পারে। আর আমলছাড়া ব্যক্তির উদাহরণ শক্ত গাছের মতো, সামান্য বাতাস তার গায়ে লাগেনা, কিন্তু যেদিন ঘূর্ণিঝড় হবে, সেদিন শেকড় থেকে সে উপড়ে পড়বে।
কাজেই আজ থেকে আর অযথা ভাগ্য কিংবা বিপদ আপদ নিয়ে গালমন্দ ও হতাশা নয়, সর্ববস্থায় নিজেকে মহান দয়াময় স্রষ্টার হাতে সঁপে দিয়ে খুশী থাকার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি ও সফলতা এবং এটাই পরম সৌভাগ্যবানের আলামত।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন