ঝাড়খান্ডে কিশোরী বিক্রির ব্যাবসা, সব শ্রেণীর মানুষ জড়িত
লিখেছেন লিখেছেন মৃনাল হাসান ০৮ মার্চ, ২০১৫, ০৯:৪১:২১ রাত
( ভারত আধুনিক বিশ্বের এক বৈচিত্রময় দেশ। দেশটি মহাকাশ গবেষনার জন্য মঙ্গল গ্রহে নভোযান পাঠায়, অথচ, সে দেশে কৃষকেরা আত্মহত্যা করে দেনার দায়ে। কানসহ বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নারী স্বাধীনতা ও নারী উন্নয়নের প্রতীক হয়ে লাল গালিচার উপর হাটেন ভারতের নায়িকারা। অথচ, এই দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ নারী পাচারের শিকার হয়।ভারতের বিভিন্ন শহরে এইসব নারীরা যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলোতে নারী পাচার হয় ভারত থেকে। এ নিয়ে সমাজের কোন মাথা ব্যাথা নেই, কারন, সব শ্রেণীর মানুষ এই ব্যাবসায় জড়িত। সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমস এর সাংবাদিক বি বিজয় মুর্তি ও সৌরভ রায় ভারতের অনুন্নত, পশ্চাদপদ রাজ্য ঝাড়খান্ড এর তিনটি জেলা ঘুরে নারী ও শিশু পাচারের করুনচিত্র তুলে ধরেছেন। হিন্দুস্তান টাইমস এর ২ মার্চ তারিখের প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করা হল।)
ভারতের ঝাড়খান্ড রাজ্যের সিমডেগা জেলার গারজা কেন্দাতলি আদিবাসী গ্রামের ১৩ বছর বয়সী রিতা কুমারী (আসল নাম নয়) তার পাঁচজন জুনিয়র সহোদর ও অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে তাদের খড়ের কুঁড়ে ঘরের বাইরে খেলাধুলা করে।কিন্তু যখনই কেউ দিল্লির কথা বলে তখনই তার হাস্যোজ্জল মুখের উপর এক খন্ড কালো মেঘ ছায়া বিস্তার করে।
যখন সে শোনে সফররত হিন্দুস্তান টাইমস এর টিম সে দেশের জাতীয় রাজধানী দিল্লির কথা বলছে, তখন চুপিসারে বলে ‘ আমি কখোনই দিল্লি যাব না’।
প্রতি বছর ঝাড়খান্ড থেকে হাজার হাজার কিশোরী পাচার হয়, রিতা তাদের একজন এবং দিল্লি তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়েছিল। গতবছর প্রজাতন্ত্র দিবসে যখন সে দিল্লির একটি মার্কেটে ঘুরতেছিল, তখন সে দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলার কথায় প্রলুব্ধ হয়, তারা তাকে ভাল কাপড় ও অনেক টাকা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল।
একসময় তাকে একজন এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং সে গৃহ পরিচারিকার কাজ পায়, যেখানে সে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। রিতা পালায় এবং তার পিতা তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পুর্বে দুই মাস একজন মহিলার আশ্রয়ে সে ছিল।
রিতা সৌভাগ্যবানদের একজন।প্রতি বছর আন্তঃরাজ্য পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং গোয়া সহ বিভিন্ন মেট্রো শহর ও প্রদেশে হাজার হাজার নারী পাচার হয়, সাধারন ভাবে কোন আলামত ছাড়াই তারা গায়েব হয়ে যায়।
অধিকাংশ কিশোরীই বন্দী শ্রমিক হিসাবে কাজ করে এবং তাদের নিয়োগকর্তা ছাড়া অন্যকারো সাথে যোগাযোগের অনুমতি তাদের নেই।যাদের ভাগ্য খুব খারাপ তাদেরকে হতে হয় যৌনদাসী অথবা গর্ভভাড়াদানকারী মাতা এবং অঙ্গ প্রত্যংগ দাতা।
উদ্ধার হওয়া কিছু কিশোরীর মারফতে বেরিয়ে আসছে, ঝাড়খান্ডের পশ্চাদপদ আদিবাসী অঞ্চলে আধুনিক যুগের এই দাসত্বের বাড়ন্ত মানব পাচারের অবৈধ ব্যাবসার সুসংঘবদ্ধ চক্রের সাথে পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, স্থানীয় রাজনীতিক এমনকি এন জি ও গুলো জড়িত।
আন্তঃপ্রদেশিক নেটওয়ার্ক
২০১৩ সালে মাদক ও অপরাধের উপর করা জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে ঝাড়খান্ডকে নারী ও শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়, বেশিরভাগ নারী পাচার হয় নিয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে যারা প্রকৃতপক্ষে সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র
[i]ঝাড়খান্ডের শিশু পাচারের করুনচিত্রঃ
■ ভারতে প্রতিবছর ৫ লাখ নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয়।
■এন জি ও গুলোর মতে ঝাড়খান্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড় থেকে প্রতিবছর ২০ হাজারের অধিক শিশু পাচার হয়।
■ঝাড়খান্ডের পশ্চাদপদ আদিবাসী এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী হারিয়ে গেছে যার কোন রেকর্ড নাই।
■ঝাড়খান্ড, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলো বেশী অরক্ষিত।
■পাচার কারীদের ৩৫ জন মুল হোতার মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো বলছে- রাজ্য সরকারের নজরদারী বৃদ্ধিতে চতুর পাচারকারী চক্রগুলোর আন্তঃরাজ্য নেটওয়ার্ক এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে দ্রুত মুভ করে, যাতে সমস্যা আরও শোচনীয় ।পাচারকারীদের একটি কুটকৌশল হচ্ছে তারা কিশোরীদের দিল্লির মত শহরে পাঠানোর পুর্বে প্রথমে আসামের মত দুর কোন স্থানে নিয়ে যায়, যেখানে পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি থাকেনা।
নোবেল বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থীর বাচপান বাঁচাও আন্দোলন (BBA)পুর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে শিশু পাচারের ট্রানজিট হিসাবে আসামের রঙ্গিয়া রেলস্টেশনকে চিহ্নিত করেছে।গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসামের ডবকা থেকে প্রায় ৫৮ জন কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়, যার ১৮ জন লোহারদাগা জেলার।
গুমলা, লোহারদাগা, খুন্তি ও সিমডেগা জেলা থেকে কিশোরীদের ছত্তিশগড় বা উড়িষ্যাতে নিয়ে গিয়ে এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়,যারা তাদের অন্য গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়। BBA আরও লক্ষ্য করেছে যে, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লির এজেন্টরা একত্রে কাজ করে। BBA এর Victim assistance এর পরিচালক রাকেশ সেনগার বলেছেন- দিল্লিভিত্তিক এই একই সিন্ডিকেটের অধীনে পুর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের এজেন্টরা যৌথভাবে কাজ করছে।
দারিদ্রতা সুযোগ নেয়
এই চক্র ভারতের পুর্বাঞ্চলে ক্ষুধা ও দারিদ্র কবলিত গ্রামগুলোতে শিকড় গেড়ে বসেছে। গত দুই দশক ধরে নারীপাচার বিরোধী ক্যাম্পেইনে জড়িত, সিমডেগা জেলা পরিষদ সদস্য নিল জাস্টিন বেক দারিদ্রতা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলাকে এর জন্য দায়ী করেন। বেক বলেন, গুমলা, খুন্তি ও সিমডেগা জেলার গ্রামাঞ্চলে শিশুদের চেয়ে পশুরা বেশী দামী।লোকেরা এতই দরিদ্র যে তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া শিশুদের চাইতে গবাদী পশুদের জন্য বেশী উদবিগ্ন থাকে। এই উদাসীনতার কারনে, গত তিন দশকে এই তিন জেলা থেকে হাজার হাজার কিশোরী হারিয়ে গেছে, কিন্তু তাদের পরিবার এবং প্রশাসন তাদের খুজে বের করতে সমর্থ হইনি। বেক বলেছন- এমনকি যতদুর জানা যায় সিমডেগার কিশোরীরা মধ্যপ্রাচ্যেও পাচার হয়।
অধিকার কর্মীরা দাবি করছে- এমন কিছু গ্রাম আছে, যেখানে কোন টিন এজার বিশেষ করে কিশোরী নাই। হয় তারা কাজের খোজে অন্যত্র চলে গিয়েছে, নয়তো পাচার হয়র গেছে। তারা বলছেন, গুমলা জেলার পালকট ব্লকের পাঁচ শতাধিক কিশোরী গত পাঁচ বছরে হারিয়ে গেছে।
আত্মীয়দের দ্বারা এ কাজ হয়
অনেক কিশোরী তাদের আত্মীয়দের মাধ্যমে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি হয়েছে। ১২ বছর বয়সী সোমওয়ারি (আসল নাম নয়) লোহারদাগা জেলার নোভাতলি গ্রামের বাসিন্দা, তার প্রতিবেশী চাচার সম্পর্কে তার ধারণা ছিলনা, সেই চাচা তাকে কয়েকশ রুপীতে বিক্রি করেছে।
(ঝাড়খান্ডে শিশু পাচারঃ কারা, কেন এবং কি পরিমান?
পাচারকারী> অধিকাংশই কিশোরীদের আত্মীয়, যারা টাকা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।
টাকা> স্থানীয় এজেন্টরা কিশোরী প্রতি ১০০০০- ২৫০০০০ রুপী আয় করে।
অপারেশন> পাচারকারীরা গ্রামের হাট ও গির্জা থেকে কিশোরীদের অনুসরন করে ও চিহ্নিত করে।
কারণ> অতি কম আয় উপার্জন যেসব এলাকাতে, বেশীরভাগ নারী পাচার সেসব এলাকাতে হয়। আরও একটি উঠতি কারন হচ্ছে, হরিয়ানার মত যেসব রাজ্যে কন্যা শিশুর ভ্রুন হত্যা করা হয়, সেসব রাজ্যে কিশোরীদের চাহিদা রয়েছে।)
মেলায় যাওয়ার কথা বলে চাচা তাকে একটি অটো রিক্সায় করে ছত্তিশগড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, যে তাকে ট্রেনে করে দিল্লি নিয়ে যায়। মুক্তা কুমারী (২০) উপনাম ললা, তার চাচাত ভাই গোয়ার এক এজেন্টের কাছে তাকে বিক্রি করে। দুই বছর পরে সে উদ্ধার হয়। দিব্য সেবা সংস্থান নামের একটি বেসরকারী সংস্থার সদস্য বৈজনাথ কুমার বলছেন- বেকার পুরুষ, নারী, এমনকি গ্রাম প্রধানের কাছে, কিশোরীদের সহজে প্রতারণা করা এবং তাদেরকে পাচারকারী এজেন্সির কাছে বিক্রি করা, উপার্জনের একটি নতুন পেশায় পরিনত হয়রছে।
গুমলার বাংরু গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী লদি খাদিয়া তার ভগ্ন কুড়ে ঘরের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে কিশোরীদের অন্য রাজ্যে মাইগ্রেশনকে চাকরি হিসাবে ন্যায্যতা দেন।
‘ NMREGA এর আওতায় আমাদের কোন BPL কার্ড নাই, বয়স্ক ভাতা বা কোন চাকরিও নাই। গ্রীষ্মকালে আমরা বেরি ফল খেয়ে বেচে থাকি। তারা যেখানেই থাকনা কেন, আমি নিশ্চিত অন্ততপক্ষে তারা খাওয়ার মত ভাল খাবার পায়’। বলছিলেন সেই বৃদ্ধ, যার চার কন্যা কয়েক বছর আগে অন্যরাজ্যে অভিবাসী হয়েছে, আর ফিরে নাই। তিনি তাদের জন্য চিন্তিত নন। তার প্রতিবেশী ভন্দী দেবী বলছেন- হারিয়ে যাওয়া অনেক কিশোরী তাদের সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে এসেছিল, কিন্তু কখনোই বলতে পারেনি কারা তাদের পিতা।
কঠোর আইন স্বত্তেও ঝাড়খান্ড থেকে শিশু পাচার অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে। BBA বলছে, সংগঠনটি সারা ভারত থেকে প্রায় ৮০০০০ শিশুকে উদ্ধার করেছে, যার ১৫%-২০% বিহার ও ঝাড়খান্ডের। পুলিশের মহাপরিদরশক (সংঘবদ্ধ অপরাধ) সাম্পাত মিনা জানিয়েছেন, ফুলে ফেঁপে উঠা পাচার চক্রের অবৈধ ব্যাবসা গুড়িয়ে দিতে ঝাড়খান্ড, বিহার ও ছত্তিশগড়ের পুলিশ একত্রে কাজ করবে। দিল্লি ভিত্তিক এনজিও ‘শক্তি বাহিনীর’ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ঋশীকান্ত বলেছেন- এই অবৈধ বানিজ্যের সমাপ্তি আনতে হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর পুলিশ বিভাগের সমন্বয় থাকা আবশ্যক।‘
বিষয়: বিবিধ
১৩৪২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন