ইতিহাসের পুনর্মুল্যায়ন হওয়া দরকার। মৃনাল হাসান

লিখেছেন লিখেছেন মৃনাল হাসান ০৬ আগস্ট, ২০১৩, ১০:১৪:২৭ রাত

অনেকে বলেন – ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু যারা ইতিহাস রচনা করেন, ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে যারা উত্তর প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করেন, ঐতিহাসিক ঘটনার বিশ্লেষণে তারা যদি নিরপেক্ষতার আশ্রয় না নেন, তাহলে জাতির বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে।কেউ আমার সাথে একমত হতেও পারেন, নাও পারেন, তবে আমি মনে করি বাঙ্গালি জাতিও তেমনি এক অনিবার্য বিভক্তির গ্যাড়াকলে খাবি খাচ্ছে।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া একযুদ্ধ, যে যুদ্ধে বাঙ্গালীকে লড়তে হয়েছিল বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর সাথে। নিরস্ত্র বাঙ্গালীর প্রতিরোধের মুখে সেই শক্তিশালী সেনাবাহিনী পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছিল। এজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনন্য গৌরবের অধিকারি। এই গৌরবের যুদ্ধে বাংলাদেশের কিছু মানুষ এবং সংগঠন চরম ভুল করেছিল। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বি্রোধীতা করেছিল। জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ, নেযামে ইসলাম, পুর্বপাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি ( যার নেতৃত্বে ছিল কমরেড আব্দুল হক, আরও ছিল বিমল বিশ্বাস, বর্তমান মন্ত্রী দিলিপ বড়ুয়াসহ অনেকে) চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার ত্রিদিব রায় এবং ব্যাক্তিগত ভাবে অনেকেই( যার মধ্যে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টির অনেকেই ছিল) পাকিস্তানের বিভক্তি ঠেকাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে। এসব ব্যাক্তি ও সংগঠনের সবাই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একমাত্র জামায়াত ছাড়া। তাই জামায়াত নিয়েই আলোচোনা করতে চাই। তারা মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিভক্তি চায়নি। বিশেষ করে ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতা লাভে বাঙ্গালী মুসলমানেরা তাদের স্বাধীনতা ও মুসলিম জাতিস্বত্বার স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা, এমন একটি সন্দেহ থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল। আমি যতদুর জানি, জামায়াতের দাবি উপরোক্ত সন্দেহের কারনেই তারা বিরোধীতা করেছিল। পাকিস্তান ছিল অনেক সাধের, অনেক স্বপ্নের। ব্রিটিশ ভারতে যে মুসলমানরা ছিল অস্পৃশ্য, মুসলিম জাতিস্বত্বার পরিচয় যারা বিলিয়ে দিতে চাইনি, বিশেষ করে যারা ছিল নির্যাতিত, তারাই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। আমার পুর্বপুরুষের অনেকের থেকে শুনেছি- হিন্দু জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে যাওয়ার নিয়ম ছিলনা, জুতা পায়ে দিয়ে যাওয়া যেত না। যে জমিদারের বাড়ি নদীর কাছে ছিল, সে জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে কোন মুসলমানের নৌকা পালতুলে যেতে পারত না, গুন টেনে যেতে হত। এই সাবহিউম্যান অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতেই মুসলমানেরা পাকিস্তানের দাবি করেছিল, যেখানে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকবে। আমাদের পুর্বপুরুষের এই মানুষ হিসাবে বেচে থাকার অধিকারের আন্দোলনকেই সাম্প্রদায়িকতা নাম দিয়ে এদেশে অনেক ইহিহাসের বই রচিত হয়েছে।যাহোক, জামায়াত ইসলামের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতা ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে আমার মনে হয়- জামায়াতের প্রতি আমরা যতটা ঘৃণা পোষণ করি, হয়তো এতো বেশি ঘৃণা তাদের প্রাপ্য নয়। কিন্তু আমাদের ইতিহাস রচয়িতাগণ, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবি ও শুশীল সমাজ এই দলটি ও তার তরুণপ্রজন্মের প্রতি এতো বেশি ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে, এই ঘৃণার বিষবাষ্পে সমগ্র জাতি আজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। এমনকি যারা ৭১ এর রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারাও এই ঘৃণা থেকে রেহাই পাইনি।খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও বামপন্থী আদর্শের বিষবৃক্ষের তলে আশ্রয় নেইনি, তাদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। যার অনিবার্য পরিনতি জাতি আজ দুই ভাগে বিভক্ত।

কিন্তু এভাবেতো চলতে পারেনা।ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হওয়া দরকার।হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় হিন্দুদের কাছে রাবণ ছিল খলনায়ক। রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরন করে রাবণ অপরাধী হয়েছে। সেই রাম যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে লঙ্কা দখল করেছে। যদিও লঙ্কা রাবণের স্বদেশভূমি, তবুও সেই খলনায়ক। কিন্তু সেই হাজার বছরের মিথকে ভেঙ্গে দিলেন বাঙ্গালী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনিই প্রথম বললেন- রাবণ একজন দেশপ্রেমিক, সে তার স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন। মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প আমরা সবাই জানি। রাখাল তার জাতিকে বলল – এই বনে বাঘ আছে, সে আমাকে তাড়া করেছে। তার জাতির লোকেরা তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বাঘ খুজে পেলনা। রাখাল বলল- আমি বাঘ দেখিনি, তোমাদের সতর্ক করার জন্য বাঘ বাঘ বলে চিতকার করেছি। সবাই বাড়ি চলে গেল। দ্বিতীয়বার রাখাল একই কাজ করল।এবং তার জাতির লোকেরা আবার বোকা হয়ে ফিরে গেল। একদিন সত্য সত্য বাঘ আসল এবং রাখালের চিতকারে কেউ সারা দিলনা। বাঘের হাতে জীবন দিতে হল তাকে। এই হল মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প।সমাজে প্রচলিত এই মিথকে একদিন ভেঙ্গে দিল আমাদের কবি আল মাহমুদ। তিনি বললেন- ঐ রাখাল ছিল তার জাতির জন্য সতর্ককারি, সম্ভাব্য বিপদ থেকে সে তার জাতিকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু তার জাতি তাকে চিনতে পারেনি। তার প্রশ্ন-ওই রাখাল যদি মিথ্যাবাদীই হবে তাহলে ঐ বনে বাঘ আসল কিকরে? বনে বাঘ ছিল এটাই সত্য এবং রাখালও সত্য্ সে মিথ্যাবাদি নয়।

এভাবেই আমাদের সমাজের প্রচলিত মিথসমূহ ভেঙ্গে গেছে, পুনর্মূল্যায়ীত হয়েছে। তেমনি আমি আশা করি, জামায়াত ইসলামী সম্পর্কেও একদিন ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হবেই।বিশেষকরে, জামায়াতের যেসব কর্মী স্বাধীনতার পরে জন্মেছেন, তাদের দেশপ্রেম একদিন মুল্য পাবেই। তাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, সেই ঘৃণা আদৌ তাদের প্রাপ্য নয়, এটা একদিন সবাই বুঝতে পারবে। সেদিন জাতির প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে।

বিষয়: রাজনীতি

১৫৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File