পশ্চিমা বিশ্ব ইসলাম ও মানবাধিকার (র্পব-১)

লিখেছেন লিখেছেন ইজহারুল ইসলাম ৩১ জুলাই, ২০১৩, ১১:৩৭:৫১ সকাল

ইজহারুল ইসলাম

মানব অধিকারের ইতিহাসঃ

সৃষ্টিকুলের মাঝে মানুষের অবস্থান সবার উর্ধ্বে। যখন থেকে ভূ-পৃষ্ঠে মানুষের পদচারণা ঘটেছে, তখন থেকেই মানুষ নিজের বুদ্ধি এবং মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মধ্যে সাম্য-শান্তিা ও ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে মগ্ন হয়েছে। কখনও এ প্রতিষ্ঠা ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক, আবার কখনও তা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ নিজের অধিকার অর্জনের জন্য একদিকে যেমন প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, অন্য দিকে নিজেদের মধ্যে তৈরি করেছে বিভিন্ন সামাজিক চুক্তি

মানব শিশু জন্মের পর থেকেই তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে সে কখনও পিছিয়ে থাকে না। দুর্লঙ্ঘ পাহাড়, অথৈ সাগর পাড়ি দিয়ে সে মহাকালকে করেছে সমৃদ্ধ। নিরন্তার প্রচেষ্টার ফলে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই তিলোত্তমা মূর্তি।

প্রাচীন ভগ্নাংশ গবেষণা থেকে মানুষ যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে তার আলোকে রচিত হয়েছে মানব জীবনের বিবর্তনের ইতিহাস। পুরাতত্ত্ব গবেষণা থেকে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তার ইতিহাস সুপ্রাচীন।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৮০ থেকে ২৩৬০ পর্যন্ত মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia) এর Legash (লিগ্যাশ) শহরের শাসক ছিলেন ইউরোকাগিনা । রেকর্ডকৃত মানব ইতিহাসে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

[en.wikipidia.org/wiki/Urukagina]

তিনি তার শাসনামলে মৌলিক অধিকার রক্ষায় নি¤েœর পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেন,

 বিধবা ও এতীমদের কর রহিত করেন ।

 ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ধনীদের কে রৌপ্য ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেন।

 কোন দরিদ্র ব্যক্তি যদি তার সম্পদ বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে সম্পদশালীরা তাকে বাধ্য করতে পারবে না।

[The Reforemes of Urukagina,History-world.org.Retrieved 2009-02-17]

 তিনি সুদ-ঘুষ, চুরি, হত্যা ও অন্যায়ভাবে কোন কিছু লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধের বির”দ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

 প্রচলিত polyandry (পলিয়্যান্ড্রী অর্থাৎ মহিলা কর্তৃক বহু- বিবাহ বা বহুগামীতা ) নিষিদ্ধ করেন। তাঁর লিখিত সংবিধান মতে “বহু- গামীকে পাথর মেরে হত্যার প্রত্যাদেশ জারি করা হয়।

[The Powers p-40 ,by Walter Wink-1992]

প্রাচীন গ্রিসে মানব অধিকারঃ

পাশ্চাত্যের সমস্ত দর্শনের উৎস হল প্রাচীন গ্রিক ও রোম। আজকের পশ্চিমা বিশ্বের ধ্যান-ধারণা গ্রিক দর্শনেরই প্রতিফলন।

প্লেটো আর এরিস্টটলের যুগকে মৌলিক মানবাধিকারের সূচনা যুগ মনে করা হয়। বাস্তবতা হল প্লেটো বা এরিস্টটল কারও দর্শনেই সাম্যের ভিত্তিতে অধিকারের কোন ধারণা নেই। তারা অবশ্য আইনের রাজত্ব ও নাগরিকের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তা সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার জবঢ়ঁনষরপ (রিপাবলিক) গ্রন্থে সমাজকে নিচের চার ভাগে বিভক্ত করেন ,

 দার্শনিক

 সৈনিক

 কৃষক

 দাস

শাসন ক্ষমতা অর্জনের অধিকার তিনি শুধু দার্শনিকদের দিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন,

“নাগরিকরা! তোমরা একে অপরের ভাই। কিন্তা সৃষ্টিকর্তা তোমাদেরকে বিভিন্ন অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের মধ্যে কারও রাজত্ব করার অধিকার আছে। এদেরকে ¯্রষ্টা সোনা দিয়ে বানিয়েছেন। কাউকে তৈরি করেছেন র”পা দিয়ে। এরা পূর্বোক্তদের সাহায্যকারী। মর্যাদাগত অবস্থানে এরপরেই রয়েছে কৃষক ও মজুর শ্রেণী। আর এদেরকে তৈরি করা হয়েছে লোহা দিয়ে।

[Morris Stockhammer Plato Dictionary,Philosophical library,New York 1903

p.32]

আইনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে প্লেটো লিখেছেন,

“আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তার চর্চাকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা বা তাদের সন্তুষ্টি বিধান করা”

[Morris Stockhammer Plato Dictionary,Philosophical library,New York 1903

p.৫৬]

তিনি নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদ রেখা টেনে বলেন,

“সৎ কাজের ব্যাপারে নারীদের প্রকৃতি পুরুষদের তুলনায় হীনতর।”

[Morris Stockhammer Plato Dictionary,Philosophical library,New York 1903

p.২৮০]

এর মাধ্যমে মানবতায় বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রায় একই ভাবধারায় পরিচালিত ছিলেন প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল।

তিনি লিখেছেন,

“গরীব লোকেরা জন্মগতভাবে ধনীদের গোলাম। সে, তার স্ত্রী ও সন্তানেরাও।”

[Thomas P.kierman,Aristotle Dictionary,Philosopical Library,New York 1662,p.288]

মানুষ ও মানবতা সে সময় ততটা মুখ্য ছিল না, যতটা ছিল ধনী বা রাজন্যবর্গের অধিকার। দরিদ্র বা সমাজে যারা মানবেতর জীবন যাপন করে, তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল, তারা হচ্ছে তাদের মনিবের সম্পদ। রুশোর সেই কালজয়ী উক্তি,“মানুষ স¦াধীন হয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও, সে আজ সর্বত্র পরাধীনতার শৃংখলে বন্দী” সমাজের পরতে পরতে ছিল এর করুণ বাস্তবতা।

প্লেটো আর এরিস্টটলের সে সময়কার সমাজের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে রবার্ট এ.ডেবি লিখেছেন,

“তিন লাখ ক্রিতদাস এবং নব্বই হাজার নামমাত্র স্বাধীন নাগরিকদের শহরে বসে প্লেটো কত মহত্বপূর্ণ বাক্যে স্বাধীনতার গুণ গেয়েছেন!”

[R.E.deewey freedom ,The Macillan Co.London 1970,p.347]

এভাবেই কালের পর কাল মানবতা আহত হয়ে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টের জন্ম পর্যন্ত গ্রিকদের যে ইতিহাস রয়েছে, তাতে ন্যায়-নীতি বা সাম্য ছিল অভিজাতদের জন্য। সাধারণ মানুষের অবস্থান ছিল সেখানে অমানবিক। আর যদি কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রীকরা কখনও মৌলিক অধিকার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেও, তবে তা তাদের জাতীয়তাবাদের গ-ি অতিক্রম করে নি।

“এটা মোটেও বিস্ময়কর নয়, গ্রীসের লোকেরা জাতীয়তাবাদী ধ্যানÑধারণায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিল। বিজ্ঞানী লেকী স্বীকার করেন এবং বলেন, সক্রেটিস ও Anaxagorias যে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণার কথা কখনো কখনো ব্যক্ত করেছেন, গ্রীসে তা কখনোই জনপ্রিয় ধারণা ও মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি এবং সেখানে তাদের কোন সমর্থকও ছিল না। এরিস্টোটলের System of Ethics তথা নৈতিক বিধি-ব্যবস্থা গ্রীক ও অগ্রীক এর ভেদ রেখার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। দার্শনিক ও পতি মহলের সম্মিলিত চেষ্টায় নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণাবলীর যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তার শীর্ষে ছিল দেশপ্রেম। এরিস্টোটল তো এতদূর পযন্তগিয়ে পৌঁছেছিলেন যে, গ্রীসের লোকেরা বিদেশীদের (অর্থাৎ যারা গ্রীক নগর রাষ্ট্রের অধিবাসী নয়) সাথে সেই রূপ ব্যবহার ও আচরণ করবে, যা তারা পশু ও জীব-জন্তুর সাথে করে। এ জাতীয় চিন্তা-ধারা গ্রীসের লোকদের ভেতর এমন বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল এবং এর প্রভার এতদূর জেঁকে বসেছিল যে, যখন জনৈক দার্শনিক বললেন, আমার সহানুভূতির পরিধি কেবল আমার নিজের দেশের মধ্যেই সীমিত নয় বরং সমগ্র গ্রীসব্যাপী আবর্তিত, তখন লোকে তাঁকে বিস্ময়ভরে দেখতে লাগল”।

History of Europian Morals, London 1809,vol.p.243

গ্রীক দর্শন ও চিন্তাাধারার উপর গড়ে উঠেছিল রোমক সভ্যতা। সেখানে মানবতা চর্চা সেভাবেই হত, যেভাবে গ্রীক সমাজে প্রচলিত ছিল। তাদের মধ্যে মানবীয় সাম্য তো দূরে থাক, যতটুকু অধিকার তারা মানুষের জন্য স্বীকার করেছিল তা ছিল শুধু রোমকদের জন্য। মুহাম্মাদ আসাদIslam at the Crossroad (সংঘাতের মুখে ইসলাম) নামক বইতে লিখেছেন,

. ....the underlying idea of Roman Empire was the conquest of power and the exploitation of other nations for the benefit of the mother country alone.To promote better for a privileged group, no violence was the for Romans too bad,no injustice to base.The famous ‘Roman Justice’ was justice for Romans alone.

“রোম সা¤্রাজ্যের ওপর যেই বিশেষ ধারণা আসন গেড়ে বসেছিল তা ছিল শুধুই ক্ষমতা লাভের দুর্নিবার বাসনা, কেবলই রাজ্য ও রাজত্ব লাভ, অপরাপর দেশ ও জাতিগোষ্ঠীকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে নিজ দেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধন, ওলট-পালটের মাধ্যমে স্বজাতির সম্পদ স্ফীতকরণ। রোমক নেতৃবর্গ, আমীর-উমারা ও উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের প্রাচুর্য ঘেরা ও বিলাসী জীবন যাত্রার প্রয়োজনীয উপায়-উপকরণ সংগ্রহের জন্য কোন প্রকার জুলুম ও নিষ্ঠুর আচরণকেই দূষণীয় মনে করত না। রোমকদের ন্যায়-বিচার ও ইনসাফের যে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, তা ছিল কেবল রোমকদের জন্যই নির্দিষ্ট।”

Muhammad Asa`d: Islam at the Crossroad, p.38

নেতৃবর্গ ও উচ্চশ্রেণীর নির্যাতনের এ ইতিহাস আপন গতিতে মানবতাকে পিষ্ট করছিল। কেউ যদিও বা কোন শান্তির কথা বলেছে বা দর্শন পেশ করেছে তা বাস্তবতার মুখ দেখে নি। তখনকার সমাজে শান্তিা প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার ছিল অভিজাত শ্রেণীর, অথচ তাদের নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হত সমগ্র মানবতা। বাস্তবতা হল, কিছু দার্শনিকতত্ত্ব যেমন সমাজে শান্তিাপ্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ঠ নয়, তেমনি র্কাযকরী পদক্ষেপ ছাড়া সমাজে মানবতার উত্তরণ সম্ভব নয়।

[চলবে]

বিষয়: বিবিধ

৯৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File