আউটসোর্সিংয়ে একটি সফলতার গল্প

লিখেছেন লিখেছেন ব্লগার ইবনে হাসান ০৩ আগস্ট, ২০১৩, ০৬:৪৯:৪৩ সকাল

২০০৮ সাল এর শেষের দিক

অণি জানতে পেরেছে অনলাইনে আয় করাটা খুব সোজা এবং খুব সম্মানের। একদিন কোথাও এক বিজ্ঞাপণ দেখলো যে ক্লিক করে করে আয় করা যায়। যেটাকে আউটসোর্সিং (!) বলা হয়ে থাকে। অণি যোগাযোগ করলো বিজ্ঞাপণদাতার সাথে। ওরা জানালো ৫ হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করার মাধ্যমে সে প্রতিদিন মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় দিয়ে এক ডলার করে আয় করতে পারবে, এভাবে কয়েকটা একাউন্ট থেকে সে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারবে অনায়াসেই; তবে প্রতিটা একাউন্টের জন্য তাকে বাৎসরিক ৫ হাজার টাকা করে পে করেতে হবে।

অণির কাছে সেই টাকা নেই যে ৫ হাজার টাকা ব্যায় করে একটি একাউন্ট কিনবে। অণির পরিচিত কয়েকজন আয় করছে এই প্রক্রিয়ায়। প্রতিমাসে একাউন্টে জমা হচ্ছে ৩০ ডলার কিংবা প্রায় ২৪০০ টাকা। কেউ কেউ টাকাও উত্তোলন করছে।

যেদিন থেকে অণি গুগলকে ঠিক ভাবে বুঝতে পারলো সেদিন থেকেই গুগলের সাহায্যে অনুসন্ধান চালানো শুরু করে দিল কীভাবে কোন সব সাইট থেকে ক্লিক করে আয় করা যায়। খুঁজতে খুঁজতে কয়েকটি সাইট পেয়ে গেলো, যে সাইট গুলোতে বিণামূল্যে একাউন্ট তৈরী করে ক্লিক করে আয় করা যায়। কোন কোন সাইট থেকে দৈনিক ২-১০ ডলার (!!) আবার কোন কোন সাইট থেকে মাসে ২-১০ ডলার আয় করার ব্যবস্থা রয়েছে। গুগলে অনসন্ধান চালালে যে কোন তথ্যই খুব সহজেই পাওয়া যায়, হোক তা ক্রাইমের কাতারে পরে। সুতরা গুগলে সার্চ করে অণি পেয়ে গেল কিছু ওয়েব সাইট যে গুলোকে বলা হয়ে থাকে পিটিসি কিংবা পিপিসি সাইট এবং এই সাইট গুলোতে বিণামূল্যে একাউন্ট খুলে অণি শুরু করে দিলো তার আউটসোর্সিং এবং স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিলো খুব কয়েকদিনের মধ্যে সে হয়ে যাবে কোটিপতি। অণিকে আর ঠেকায় কে!

এই রকম প্রায় শ’খানেক সাইট খুঁজে পেলো সে, যে গুলোতে বিণামূল্যে একাউন্ট তৈরী করার মাধ্যমে খুব বেশি বেশি আয় করা যায়। তবে সমস্যা একটাই, প্রতিটি কম্পিউটার থেকে একটি সাইটের একটার বেশি একাইন্ট চালানো যায়না। নো প্রবলেম! প্রায় শ’খানেক সাইটের প্রতিটি সাইটে একটি করে একাউন্ট তৈরী করে আয় শুরু করে দিলে অনেক আয় হবে।

মিশন শুরু! অণির আয় হচ্ছেই হচ্ছে। অনেক আয় হয়ে গেছে। অণির পরিচিত জনরা টাকা দিয়ে একাউন্ট তৈরী করে যা আয় করছে তারও বেশি আয় করছে অণি। মাঝে মধ্যে অণি নিজেকে খুব অন্যরকম মনে করে। একদল টাকা দিয়ে একাউন্ট তৈরী করে আয় করছে সামন্য কিছু আর অণি কোন প্রকার পুঁজি ছাড়াই আয় করছে অনেক অনেক টাকা। অণির কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নটা খুব জোড়ালো হচ্ছে। অণির কোটিপতি হতে আর খুব বেশি দেড়ী নয়।

কয়েক মাস হয়ে গেলো। নীতিমালা ভঙ্গের অজুহাতে কয়েকটি সাইট থেকে অণিকে বহিষ্কার করা হলো। যে গুলোতে অণি শত শত ডলার আয় করেছিলো। অণির ইচ্ছা ছিলো এই শত শত ডলার সে ডিপোসিট করবে এবং কিছু সাইটের প্রিমিয়াম একাউন্ট কিনবে, কেননা কিছু কিছু সাইট ডিপোসিট করলে আয়ের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় আবার কিছু কিছু সাইটে প্রিমিয়াম একাউন্ট কিনলেও আয়ের পরিমাণ খুব খুব বেশি বাড়িয়ে দেয়।

কিছুদিন আগে অণি খবর পেলো তার পরিচিতজনরা প্রতারিত হচ্ছে। যারা ৫ হাজার কিংবা ৩ হাজার কিংবা এই রকম কিছু টাকার বিনিময়ে একাউন্ট কিনে আয় করতো তাদের অনেকেই প্রতারিত হচ্ছে। প্রথমত কিছু পেমেন্ট পেতো কিন্তু এখন তো আর পায়না! পাবে কীভাবে কোম্পানীতো এখন উধাও!

অণির খুবই চিন্তায় আছে! এতো টাকা সে আয় করলো কিন্তু টাকাতো আর তুলতে পারছে না! কোন সাইট থেকেই সে পেমেন্ট পাচ্ছে না। খুবই চিন্তার ব্যাপার! আউটসোর্সিং (?) করেই যাচ্ছে কিন্তু টাকা হাতে আসছে না।

গেলো আরো মাসখানেক! অণি ব্যাপক ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিচ্ছে। কারণ, অণি বিশ্বাস করে সবুরে মেওয়া ফলে। সাইট গুলো পেমেন্ট দিবে দিবে বলে দিচ্ছে না। কোন কোন সাইট বলছে অণিকে তার প্রাপ্য পেমেন্ট দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অণি তো কোন পেমেন্টই পায়নি!

এতো কষ্টের আয়! কিন্তু সাইট গুলো কি অণির সাথে প্রতারণা করছে! অণি কি প্রতারিত হচ্ছে, যেভাবে তার পরিচিত জনরা প্রতারিত হয়েছে এবং হচ্ছে! অণির মনে প্রশ্নের পাল্লা ভারী হতে লাগলো! উত্তর পেতে অণি গুগলের সাহায্য নিয়ে অনুসন্ধার চালানো শুরু করলো, জবাব পেলো এই সব আসলে ধোকা ছাড়া আর কিছুই না। ক্লিক করে আয় করতে গিয়ে অণি হতাশ ।

নাহ্! সব প্রতারণা! অণি বুঝতে পারলো সব প্রতারণা! ক্লিক করে আসলে আউটসোর্সিং করা যায় না। অণি পরিষ্কার বুঝতে পারলো ক্লিক করে আউটসোর্র্সিং হয়না। এতো দিনে অণি নিজের একটা প্লান ঠিক করে ফেলেছে। হৃদয়ের গহীনে গুপ্ত উল্লাস যেভাবেই হোক অণিকে সফল হতেই হবে। অণিকে প্রকৃত আউটসোর্সার কিংবা ফ্রীল্যান্সার হতেই হবে।

ক্লিক করে আয় করার লালসা মুক্ত অণি শুরু করলো তার নতুর পথচলা। সে এবার প্রকৃত ফ্রীল্যান্সার হবে। পরামর্শ নেয়ার মতো তেমন কেউ নেই আশে পাশে। তবুও আশার আলো দেখে অণি। কোন হতাশা নয়! অনুসন্ধানে সে খুঁজে পেলো সমাধান। তাকে আগে বিশেষ কোন সেক্টরে এক্সপার্ট হতে হবে, তারপর সে আউটসোর্সিংয়ে সফল হতে পারবে। অণি ঠিক করলো সে ওয়েব এক্সপার্ট হবে। শুরু হলো তার শেখার পালা।

২০১১ সাল

ব্যক্তিগত কিছু কারণে অণিকে মাঝপথে থামতে হয়েছিল প্রায় একটি বছরের জন্য। আবার নতুন করে পথচলা। অণি এখনো শিখতে লাগলো ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ইন্টারনেট মার্কেটিং এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন।

২০১১ সালের শেষের দিক

আউটসোর্সিং মার্কেটপ্লেসে অণি তার প্রথম কাজ পেলো। ৪ ঘন্টার একটি কাজ করে অণির আয় হলো ২০ ডলার, তারপর সোস্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের আরো দুইটা কাজ করে কয়েকদিনে অণির আয় হলো ৩৯ ডলার। ২০১২ তে অণির ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা, সুতরাং আয়ের চিন্তা আপাতত বন্ধ। পরীক্ষা শেষ হোক, আবার কাজ শুরু করা যাবে।

২০১২ সাল

পরীক্ষা শেষ করে অণি এখন পুরোপুরি কাজ করার জন্য তৈরী। অণি অনুভব করলো তাকে আরেকটু এক্সপার্ট হতে হবে। শুরু হলো অনলাইন ঘাটাঘাটি। এই অনলাইনই অণিকে এই সব কিছু শিখতে সাহায্য করেছে। বস্তুতঃ অণির কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক নেই, গুগলের সাহায্যে অনুসন্ধান করে করে খুব পরিশ্রম করে সব কিছু শিখতে হয়েছে অণিকে। অণি আজ অবধি নতুন নতুন জিনিস শিখে যাচ্ছে।

২০১৩ সাল

অণিকে এখন আর পিছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়না। এখন সে একজন প্রকৃত ফ্রীল্যান্সার। প্রত্যাশার চেয়েও ভালো আয় হচ্ছে তার। ক্লায়েন্টরা তার কাজে সন্তুষ্ট। কাজ করতে গিয়ে ক্লায়েন্টদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। যে ক্লায়েন্ট তাকে দিয়ে একটি কাজ করিয়েছে সে পুণঃরায় অণির কাছে ফিরে আসছে। প্রথম প্রথম একটি কাজ পেতে কয়েকটি কাজে বিড করতে হতো, এখন আর তা করতে হয়না। একটি আমেরিকান মার্কেটিং কোম্পানীর সাথে তার চুক্তি হয়েছে, সেই কোম্পানীর প্রায় ৫ হাজারের বেশি ওয়েব সাইট তৈরীর দায়িত্ব অণির এবং সেই কোম্পানীর সকল আয়ের একটা অংশ অণির। সেই কোম্পানীর অর্থায়নে ইন্টারনেট মার্কেটিংয়ের উপর অনলাইনে একটি এডভান্স কোর্স করেছে অণি। সেই কোম্পানী থেকে প্রতি সপ্তাহে কিংবা দশ দিন পর পর পেমেন্ট পাচ্ছে সে। কাজের চাপ বেড়ে চলেছে। অণি এখন আর কাজ খুঁজে না, তার সাথে কাজ করার জন্য কর্মী খুঁজে। দেশীয় মার্কেটে সৃজনশীল কিছু করার জন্য অণি প্রতিষ্ঠা করেছে তার ভার্চুয়াল কোম্পানী আইটি সেবা লিমিটেড। এই কোম্পানীর অধীনেই অণি নতুন কর্মীদের নিয়োগ দিচ্ছে। তার নগরী কুমিল্লাতে সে গড়ে তুলেছে টেকসেবক নামক একটি প্রতিষ্ঠান, ওয়েব এক্সপার্ট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য টেকসেবকের সকল সদস্যদের বিণামূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সে। অণির স্বপ্ন, কুমিল্লা হবে ফ্রীসন্সারদের নগরী।

তার যে সব পরিচিতজনরা টাকা দিয়ে একাউন্ট তৈরী করে ক্লিক করার মাধ্যমে আয় করার আশায় বিভোর থাকতো এতদিনে তাদের দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গেছে। তারাও বুঝলো ক্লিক করে আসলে আউটসোর্সিং হয়না। অণির মতো তারাও ছুটছে প্রকৃত আউটসোর্সিংয়ের দিকে, তারাও হবে ফ্রীল্যান্সার আর কুমিল্লা হবে ফ্রীল্যান্সারদের নগরী।

(বিঃ দ্রঃ অণি একটি ছদ্মনাম)

বিষয়: বিবিধ

২৮৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File