গোলাম আযমের মৃত্যু ও কিছু কথা ।

লিখেছেন লিখেছেন শারমিন হক ০৪ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:০৬:২৯ রাত

কিছুদিন যাবত বাম ও সুবিধাবাদী মিডিয়া এবং তাদের সমর্থিতরা একটি বিষয় খুব জোরালো করে তুলে ধরার চেষ্টা করে ছিল। মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী তাঁর ফেইসবুক ওয়ালে পোস্ট করা একটি স্ট্যাটাসের ভিত্তিতেই এ আলোচনা। এতে তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুতে বিএনপির নীরবতার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশের সাথে কিছু কথা তুলে ধরেছেন। ওখানে তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, "বিএনপির মনে রাখা উচিত জামায়াতের সাপোর্ট ছাড়া বিএনপি কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সুতরাং জামায়াতের ‘প্রতিষ্ঠাতা আমীর এবং আধ্যাত্মিক গুরু’র মৃত্যুতেও বিএনপির শোক প্রকাশ করা কর্তব্য"।

এই হলো আব্দুল্লাহ আযমীর দেয়া স্ট্যাটাসের সারসংক্ষেপ। এ নিয়ে প্রচার প্ররোচনায় লক্ষ্য করলাম অনলাইনের পাশাপাশি মিডিয়াও গুরুদায়িত্ব পালন করেছে।

প্রথমত, আব্দুল্লাহ আযমী শোকাক্রান্ত, তাঁর বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। এ সময়ে তিনি কি বললেন আর না বললেন তা নিয়ে মাতামাতির কিছু দেখছি না। মনের কষ্ট সামাল দিতে গিয়ে হয়ত তিনি এ কথাগুলো বলে ফেলেছেন। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল অনলাইন-যুদ্ধ; সাথে মিডিয়াও পিছিয়ে থাকল না।

যেই কথা সেই কাজ -

৭১ টিভিতে তাঁকে অংশগ্রহণ করানো হল। অনুষ্ঠানটি দেখে মনে হচ্ছিল - যারা ওখানে এসেছেন তাঁরা নির্ঘাত এক ঝামেলা না পাকিয়ে ছাড়বেন না। আব্দুল্লাহ আযমীকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীদের মত জেরা করা হচ্ছিল। কিন্তু, আব্দুল্লাহ আযমী তাঁর দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে সব কিছু স্পষ্ট করে দিলেন। তিনি তাঁর মন্তব্যকে নিজের ব্যক্তিগত বক্তব্য, যার সাথে তাঁর পিতার দলের সম্পর্ক নেই, এবং তারপরও কেউ যদি 'মানসিকভাবে আহত হয়ে থাকেন' তাঁর প্রতি দুঃখপ্রকাশ করে চমৎকার এক দৃষ্টান্তের সৃষ্টি করলেন। আমান আযমী যদি তাঁর বক্তব্যের উপর অটল থেকে তাঁর বীরত্ব জাহিরের চেষ্টায় থাকতেন তবে এতে সব থেকে বেশি লাভবান এবং সফল হতো - ফসল তুলতো আওয়ামী লীগ।

দ্বিতীয়ত, আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি বিএনপি এবং জামায়াত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ বটে, কিন্তু আদর্শগত দিক থেকে এক নয়।

একটি দলের গঠনতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে - ধর্ম যার যার দেশ সবার এবং সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আর অন্য দলের মূল ভিত্তি হচ্ছে - আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। জামায়াতে ইসলামীর এ নীতি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক দেখিয়ে তাঁদের নিবন্ধন পর্যন্ত বাতিল করে দেয় আদালত। দু’টি দলের গঠনতন্ত্রে যেখানে এত পার্থক্য সেখানে দু’টি দল সব বিষয়ে একমত পোষণ করবে তা আমরা ভাবি কি করে!

তাছাড়া, অধ্যাপক গোলাম আযমের উপর আনা হয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ - এককথায় - যুদ্ধাপরাধ। স্বাধীনতা-বিরোধী, মানবতা-বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধ এক বিষয় নয়। ‘৭১-এ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও তিনি ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয় অগ্রগামী। ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় বসতে না দেয়াতে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। অবিলম্বে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁকে ঐ প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা-বিরোধী বলাটি বিতর্কিত হতে পারে তবে কোনক্রমেই তিনি মানবতাবিরোধী কিংবা যুদ্ধাপরাধী নন। পাকিস্তানের অখণ্ডতায় দেয়া তাঁর বক্তব্যকে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের এভিডেন্স হিসেবে নেয়া হয়েছে - বিষয়টি নেহায়েত হাস্যকর। কেননা, সেই বক্তব্য ছিল তখনকার সময়ে দেয়া রাজনৈতিক বক্তব্য।

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনিত এ অভিযোগের বিষয়টিও বিএনপি তাঁর জানাজায় না আসার একটি কারণ হতে পারে। তাঁরা হয়তো ভেবেছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাঁরাও অভিযুক্ত হতে পারেন। অন্যদিকে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছিল এটিও একটি কারণ হতে পারে।

যদিও অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর মৃত্যুর অনেক আগেই মানুষকে ‘৭১ ইস্যুতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকার ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করে গিয়েছেন। তিনি কেন পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে ছিলেন তা ২০১৩ সালে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেছেন। যার মূল বিষয় ছিল - বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য বিস্তার। বাস্তবে কিন্তু তার ব্যতিক্রম ঘটে নি কিছুই। ভারতের কাছে বাংলাদেশের মানুষদেরকে প্রতিনিয়ত হেনস্তা হতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারির ভোটার বিহীন নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে - যেখানে ভারতের উদ্দেশ্যমূলক ও অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল এক ‘ওপেন-সিক্রেট’।

অধ্যাপক গোলাম আযম তো স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন নি। তিনি স্বাধীনতাকে স্বীকার করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিজেকে সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে তুলে ধরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তাঁর জানাজায় লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিই প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে তাঁদের হৃদয়ের কতটা গভীরে স্থান দিয়েছে।

তাঁর নামের পূর্বে অধ্যাপক যুক্ত করলেই কি! আর না করলেই বা কি! তিনি যা ছিলেন তা থেকে একটু বেশি, কম হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি তো চেতনা-ধারীদের মত কারো লেখা কিংবা আবিষ্কার চুরি করে খ্যাতি অর্জন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি। তিনি যা করেছেন, যা পেয়েছেন সবই নিজের অর্জন, নিজের সফলতা।

বর্তমান এই সঙ্গিন সময়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে - জাতীয় উন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও মানুষের ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, পছন্দসই নেতৃত্ব বেছে নেয়ার স্বাধীনতা তথা আত্মসম্মান, যে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে দরকার - বিভেদ নয়, সার্বজনীন ঐক্যের। এজন্যই স্বৈরাচারপন্থীদের বড় লোভনীয় টার্গেট হলো ঐ ঐক্যে ফাটল ধরানো - সে লক্ষ্যেই এই ইস্যুতে তাদের এত আগ্রহ। এ কথাটি মুক্তিকামী-সংগ্রামীদের বুঝতে হবে - ধৈর্য্যের সাথে ধারণও করতে হবে। না হয় ক্ষতিটা ষোলআনায়ই হবে নিজেদের - পিছিয়ে পড়বে, ব্যাহত হবে বাংলার আপামর মানুষের অধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলন। কাজেই, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যের সুস্থ্যতা এবং কার্যকরভাবে চলমান থাকা এই সময়ের এক অন্যতম প্রধান দাবী।

পরিশেষে, ধন্যবাদ জানাই আমান আযমীকে তিনি আওয়ামী লীগের পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে বেশ করেছেন।

বিষয়: রাজনীতি

১১৮৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

281296
০৫ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:২১
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : আমি গোলাম আযম হতে চাই ।
281416
০৫ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪০
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : জাজাকাল্লা খায়রান। অনেক সুন্দর লিখেছেন।
282211
০৮ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৪৭
শেখের পোলা লিখেছেন : মরহুম গোলাম আযম বাংলার মুমিনদের কাছে অমর হয়েই প্রেরণা জোগাবেন৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File