মক্কায় মহানবী (স) এবং বৃটেনের মুসলমান Written by ফরীদ আহমদ রেজা

লিখেছেন লিখেছেন আকবার১ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৯:৩৩:৩২ সকাল



মহানবী (স)’র সাথে আমাদের সম্পর্ক কী তা এক কথায় বলা যায় না। ঈমানের সাথে সেখানে সীমাহীন ভালবাসা ও অফুরন্ত শ্রদ্ধা মিশ্রিত রয়েছে। অমুসলমানদের পক্ষে তাঁর প্রতি আমাদের ভালবাসার পরিমাপ করা অসম্ভব। আমাদের মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এবং পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে তাঁর প্রতি ভালবাসা বেশি না হলে ঈমান পূর্ণতা পায় না। তিনি আমাদের দুনিয়া এবং আখেরাতের সকল প্রকার সাফল্যের উৎস।

যারা তাঁকে বিশ্বাস করেনি তাদের জন্যেও তিনি ছিলেন রহমতের প্রতীক। আল্লাহ পাকের এক পরিচয় হলো তিনি রাব্বুল আলামিন, বিশ্ব-জাহানের রব। আর মহানবী (স)’র এক পরিচয় তিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন, বিশ্বজাহানের জন্যে রহমত। গাছ-পালা, তরু-লতা, জীব-জন্তু এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যে তিনি রহমত। তাঁর উপর ঈমান না এনেও কেউ যদি তাঁর দেখানো নিয়ম-পদ্ধতি মেনে জীবন-যাপন করে তা হলে সে পার্থিব জীবনে প্রভূত কল্যাণ লাভ করবে। তবে পরকালের কল্যাণ শুধু ঈমানদারদের জন্যে নির্দিষ্ট।

বিলাতের বুকে বসে আমরা আমাদের প্রিয় নবী (স)’র জীবন নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছি, এটা আমাদের জন্যে অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। বাংলাদেশ এবং মক্কা-মদিনা থেকে বহুদূরে অবস্থিত এ দেশ। মুসলমানরা যে দেশে বাস করেন সে দেশকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ইতিহাসে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। বৃটেনই এখন আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের স্বদেশ। এ দেশে নবী-রাসুল বা সাহাবায়ে কেরাম এসেছেন বলে কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্যেক মুসলমান নিজেকে এ দেশে মহানবী (স)’র প্রতিনিধি, ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে মনে করেন।

এ দেশের মানুষ কুরআন-হাদিস পড়ে না। নবী-রাসুলের কথা জানে না। যারা জন্মগত ভাবে খৃস্টান বা ইহুদি তারা নীতিগত ভাবে নবী-রাসুল, বেহেশত-দোযখ, আখেরাত ইত্যাদি বিষয় জানার কথা। কিন্তু বর্তমান যুগে নানা কারণে নিজেদের ধর্মের ব্যাপারে তাদের জানাশোনা এবং আগ্রহ খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। আদমশুমারির হিসেবে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ খৃস্টান। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা অনেকে কোন ধর্মের অনুসারী নয়। অনেকে সংশয়বাদী, আবার অনেকে নাস্তিক।

এ দেশে চলাফেরা এবং জীবন-যাপন করতে গিয়ে অনেক মানুষের সাথে আমাদের দেখা, কথাবার্তা এবং লেনদেন হয়। আমরা না বললেও আমরা যে মুসলমান তা তারা অধিকাংশ সময় সহজেই বুঝে নিতে পারে। তারা কুরআন না পড়লেও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রতিনিয়ত মুসলমানদের পাঠ করে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে তারা ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে অনেক কিছু শোনে এবং পাঠ করে। মুসলমানদের সাথে দেখা হলে জানা জিনিসকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তাই এ সমাজে মুসলমানদের উপস্থিতি কোন ছোট ব্যাপার নয়। ইসলাম কী রকম মানুষ সৃষ্টি করে তা আমরা চলাফেরা, জীবন-যাপন, কথাবার্তা, লেনদেন, লেখালেখি এবং বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে তাদের জানান দিচ্ছি।

বিলাতের সমাজে আমাদের জীবন-যাপনকে মহানবী (স)’র মক্কী জীবনের সাথে তুলনা করা চলে। অবশ্য বিলাতের মাল্টিকালচারেল গণতান্ত্রিক পরিবেশের কারণে মহানবী (স)’র মক্কী জীবনের তুলনায় এখানে আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারছি। মুসলমানরা বিলাতে মসজিদ-মাদ্রাসা কায়েম করেছেন। নামাজ-রোজা করেন এবং ঈদ, ঈদে-মিলাদুন্নবী, মহররম, শবেবরাত ইত্যাদি পালন করেন। আমরা যে সকল ইবাদত করি সেগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহর সাথে বান্দাহর সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন এবং তা গভীর থেকে গভীরতর করা। যারা মুসলমান নয় তারা এটা বুঝার কথা নয়। অন্যান্য মানুষের সাথে আমাদের আচার-আচরণ, লেনদেন, চলাফেরা ইত্যাদির মাধ্যমে অমুসলমানরা ইসলামের সৌন্দর্য অনুধাবন করার সুযোগ পায়।

হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত মহানবী (স) মক্কা শহরে জীবন যাপন করেন। জন্মের পর কিছুদিন মা হালিমার গৃহে কাটান। চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। ওহি নাজিলের পূর্বে মক্কায় তিনি ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। মুখ দিয়ে কোন কথা না বললেও তাঁর পূত-পবিত্র জীবন-যাপন ছিল জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ চ্যালেঞ্জ। তাঁর নিরবতা ছিল আমাদের হাজার-কন্ঠের বজ্র-নিনাদের চেয়ে অনেক উচ্চকন্ঠ। নবুয়ত লাভের আগে সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা এর সাক্ষ্য বহন করছে। নীতি-নৈতিকতাহীন জাহিলিয়াতের সমাজ তাঁকে আল-আমিন উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ভোটের মাধ্যমে কারো সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এ উপাধি তিনি অর্জন করেননি। তাঁর সততা ও চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে মক্কার মানুষ তাঁকে এ উপাধি প্রদান করে। এক শতাব্দীর অধিককাল থেকে মুসলমানরা বৃটেনে বাস করছেন। আল-আমিন’র অনুসারীরা কয়জন নিজেকে আল-আমিন বা বিশ্বস্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, আমাদের এ প্রশ্নের অন্বেষণ করা দরকার।

তরুণ বয়সে মহানবী (স) হিলফুল ফুযুল নামক একটি সংগঠনের সাথে জড়িত হন। তদানীন্তন আরবের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে হিলফুল ফুজুল নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা কোন ছোট ঘটনা নয়। আরবে দীর্ঘমেয়াদী ও রক্তক্ষয়ী ফুজ্জার যুদ্ধের পর দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও কর্তব্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে মক্কার এক বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিত্ব আব্দুল্লাহ বিন জাদাআন আত-তামিমি’র বাড়িতে এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মহানবী (স) সেখানে অংশ নেন। বৈঠকে বনু হাশিম ও বনু আব্দুল মুত্তালিবের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আসাদ বিন আব্দুল উজ্জা, জাহরা বিন কালিব এবং তামিম বিন মুররা। সিদ্ধান্ত হয়, তারা সবাই মিলে সন্ত্রাস দমন এবং গরীব ও দুর্বলদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করবেন। ইতিহাসে এ চুক্তি বা সংগঠন হিলফুল ফুযুল নামে পরিচিত। পরবর্তী সময় এ চুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মহানবী (স) বলেন, ‘আমি আব্দুল্লাহ বিন জাদাআনের বাড়িতে চুক্তি সম্পাদনের সময় উপস্থিত ছিলাম। এ চুক্তি এক পাল লাল উটের চেয়েও আমার কাছে অধিক মূল্যবান। আজ ইসলামের আবির্ভাবের পরও সে চুক্তির ব্যাপারে ডাকে এলে আমি তাতে ইতিবাচক ভাবে সাড়া দেবো।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)

মহানবী (স)এর এ মন্তব্য থেকে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। এ চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস এবং জুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ইসলামের সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ কী তা পরবর্তী পর্যায়ে কুরআন এবং মহানবী (স)এর কার্যক্রম থেকে আমরা জানতে পারি। তা হচ্ছে জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করা এবং ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করা। আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। যারা এ বৈঠকের আয়োজন করেন এবং চুক্তিবদ্ধ হন, মহানবী (স) ছাড়া তাদের কেউ মুসলমান বা ইসলামপন্থী ছিলেন না। এর পরও মহানবী (স) সেখানে শুধু উপস্থিত ছিলেন তা-ই নয়, পরবর্তীতে সে চুক্তির ডাকে সাড়া দেবার উৎসাহ ব্যক্ত করেছেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, জনকল্যাণ মূলক কাজ অথবা ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যে কোন মানুষ বা জনগোষ্ঠীর সাথে মুসলমানদের কাজ করা উচিত। হিলফুল ফুজুলের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বা কর্মসুচীতে ইসলামের কোন কথা ছিল না।। সেখানে ছিল সন্ত্রাস দমন এবং গরীব ও দুর্বলদের সাহায্য করার অঙ্গীকার। এটা এমন একটা বিষয় যার উপর যে কোন মানব-গোষ্ঠীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল। মানুষ হিসেবে কোন মুসলমানের পক্ষে এটা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই । এ জন্যে মহানবী (স) পরবর্তী জীবনেও এর ডাকে সাড়া দেয়ার উৎসাহ প্রকাশ করেছেন।

মহানবী (স)’র মক্কী জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণের সময় ঘটেছে। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন হবার পর তা যথাস্থানে কে স্থাপন করবে তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। হাজরে আসওয়াদ তুলে নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করার সম্মান লাভের বাসনা প্রত্যেকেরই প্রবল হয়ে উঠে। এ নিয়ে গোত্রগুলো সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এ সময় সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনুল মুগীরা একটি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আসে। সে বলে, আগামীকাল সকালে কা’বা মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই আমরা এই বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব প্রদান করবো। উপস্থিত সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। অতঃপর দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, এতো আমাদের আল আমীন (পরম বিশ্বস্ত) মুহাম্মাদ, তাঁর ফায়সালা আমরা মাথা পেতে নেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাদমান লোকদের কাছাকাছি গিয়ে উপনীত হলে সবাই তাঁকে তাদের বিবাদের বিষয়টা জানালে তিনি বললেন, ‘আমাকে একখানা কাপড় দাও।’ কাপড় দেয়া হলে তিনি তা বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদ উক্ত কাপড়ের মধ্যস্থলে স্থাপন করে বললেন ‘প্রত্যেক গোত্রকে এই কাপড়ের চারপাশ ধরতে হবে।’ সবাই তা ধরলো ও উঁচু করে যথাস্থানে নিয়ে রাখলো। অতঃপর তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে যথাস্থানে রাখলেন ও তার উপর গাঁথুনি দিলেন।’ মহানবী (স) নবুয়ত লাভের আগেই এ ভাবে একটি সুন্দর ও ইনসাফ-ভিত্তিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে মক্কা শহরকে করেন।

প্রথম ওহি লাভের পর মহানবী (স)’র প্রিয়তমা স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা)’র বক্তব্য থেকে মহানবী (স)’র নবুয়ত-পূর্ব জীবন সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুরা আলাক্ব’র প্রথম কয়টি আয়াত নাজিলের পর মহানবী (স) হেরা গুহা থেকে ঘরে ফিরে আসেন। তাঁর বুক ধুকধুক করছিল। হযরত খাদিজা (রা)কে বললেন, আমাকে চাদর গিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। বিবি খাদিজা মহানবী (স)কে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। এরপর হজরত খাদিজা (রা)কে সব কথা খুলে বললেন। আরো বললেন, ‘আমার কি হয়েছে? নিজের জীবনের আমি আশংকা করছি।’ হজরত খাদিজা (রা) তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করেন। সত্য কথা বলেন। বিপদগ্রস্থ লোকদের সাহায্য করেন। অক্ষম লোকদের উপার্জন করে দেন। মেহমানদারী করেন। আমানত আদায় করেন। সৎ কাজে সাহায্য করেন। আপনার চরিত্র মহান।’

বিয়ের আগে মহানবী (স )কে হজরত খাদিজা (রা) মহানবী (স)কে ভালো করেই চিনতেন। তিনি ব্যবসার কাজে হজরত খাদিজা (রা)’কে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাথে যখন মহানবী (স)’র বিয়ে হয় তখন মহানবী (স)’র বয়স ২৫ বছর। পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবন মোটেই কম সময় নয়। মহানবী (স)কে সান্তনা দেয়ার জন্যে হজরত খাদিজা (রা) যা বলেছেন তা নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কথা। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, ওহি নাজিলের আগেই মহানবী (স) কী কী গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। জাহিলিয়াতের অন্ধকারের মধ্যে জন্ম গ্রহণ এবং প্রতিপালিত হবার পরও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবিবকে এ সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দান করেন। এর ফলে মক্কার সমাজে তাঁর নিছক উপস্থিতি-ই আল্লাহর দ্বীনের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

মহানবী (স)’র মক্কী-জীবনের মতো বিলাতের মুসলমানরা এখানে সংখ্যালঘু। আমরা সংখ্যালঘু হলেও আমরা এখানে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে পারছি। এ দেশের আইন অনুসারে সকল প্রকার সামাজিক এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করছি। ইকুয়াল অপরচুনিটিজ বা সম-অধিকারের দাবিতে নিজেদের অধিকার আদায় ও রক্ষার জন্যে দেন-দরবার করতে পারছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিনাপয়সায় প্রাইমারী, সেকেন্ডারি এবং হাইয়ার সেকেন্ডারি শিক্ষা লাভ করছে। ইউনিভার্সিটির বাধ্যতামূলক গ্রান্ট বন্ধ হয়ে গেলেও ‘টিউশন ফিজ’ আদায়ের জন্যে বাধ্যতামূলক ঋণ-সুবিধা পাচ্ছে। ছেলেমেয়ে, বয়স্ক, নিন্মবিত্ত এবং বেকার লোকেরা বিনাপয়সায় প্রেসক্রিপশন ও ঔষধ পাচ্ছি। অন্যান্য কর্মজীবীরা বিনা পয়সায় প্রেসক্রিপশন এবং হাসপাতালের চিকিৎসা লাভ করছি। বেকার-ভাতা এবং নিন্ম-আয়ের জন্যে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশের তুলনায় বৃটেনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বিচার ব্যবস্থা বহুগুণ উন্নত। এখানে আমরা ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ মা-বাবা এবং অনেক অকর্মণ্য আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে জীবন যাপন করতে পারছি। এ সকল সুযোগ-সুবিধা উপভোগের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, আমরা মুসলমানরা আল্লাহর শোকর গোজারী করবো। এর সাথে সাথে কথায় ও কাজে বিলাতের জনগণ এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। এ দেশকে আরো উন্নত ও অধিকতর শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার আমাদের থাকতে হবে। এ দেশে বসবাসকারী বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মত ও পথের মানুষকে ইহকালীন এবং পরকালীন কল্যাণের পথ প্রদর্শন করার মহান দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।

মহানবী (স) মক্কার প্রতিকুল পরিবেশে বাস করে নিজের চরিত্র এবং কর্মের মাধ্যমে উন্নত জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। সে তুলনায় আমরা এ দেশের হাজারো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি। এ দেশের সকল মানুষ আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্বের কথা কুরআন এবং হাদিসে অনেক তাগিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর বন্দেগী করো। তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। বাপ-মার সাথে ভালো ব্যবহার করো। নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো।’ [সুরা ৪, নিসা: ৩৬]

কুরআনে ব্যবহৃত ‘আত্মীয় প্রতিবেশী’ এবং ‘অনাত্মীয় প্রতিবেশী’ শব্দ-দুটি এ প্রসঙ্গে খুব তাৎপর্যবহ। এখানে মুসলমান প্রতিবেশী এবং অমুসলমান প্রতিবেশীর মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। আত্মীয়-স্বজন পাশাপাশি থাকলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি সম্পর্ক থাকে। কিন্তু প্রতিবেশী অমুসলমান হলেও তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। হাদিসে এ ব্যাপারে খুবই তাগিদ দেয়া হয়েছে।

ইবনে উমার ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জিবরাইল আমাকে সব সময় প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করে থাকেন। এমনকি আমার মনে হল যে, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারেস বা উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।” ( বুখারী ও মুসলিম) আবু যার (রাঃ) বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে আবু যার! যখন তুমি সুপ রান্না করবে, তখন তাতে পানির পরিমান বেশী কর। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর বাড়িতে রীতিমত পৌছে দাও। (মুসলিম) আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আল্লাহর কসম, সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম, সে ব্যক্তি মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি, হে আল্লাহর রসুল? তিনি বললেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না। (বুখারী) মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে থাকে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বিলাতে আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী অমুসলমান। আমাদের নামাজ-রোজা, বিয়ে-শাদী, আনন্দ-উৎসব, চলাফেরা ইত্যাদি যাতে প্রতিবেশীদের কষ্ট বা বিরক্তির কারণ না হয় সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

মক্কায় মহানবী (স)’র ক্ষমতা বা শক্তি-সামর্থ্য ছিল না বললেই চলে। অমুসলিম চাচা আবু তালিব জীবিত থাকতে মহানবী (স) তাঁর নিরাপত্তায় জীবন-যাপন করেছেন। সে সময়ও তিনি মানুষের বিপদে সাহায্য করেছেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হজরত খাদিজা (রা)’র সাক্ষ্য থেকে আমরা তা জানতে পারি। ‘আত্মীয় স্বজনের হক আদায়’, ‘বিপদগ্রস্থ লোকদের সাহায্য করা’, ‘অক্ষম লোকদের উপার্জন করে দেয়া’, মেহমানদারী করা’, ‘আমানত আদায় করা’, ‘সৎ কাজে সাহায্য করা’ ইত্যাদি কাজ মহানবী (স) নবুয়ত লাভের পূর্বেও সম্পন্ন করতেন। সিরাতে ইবনে হিশাম এবং মহানবী (স)’র অন্যান্য জীবনী-গ্রন্থে এ ধরণের অনেক ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে।

একবার আরাশ গোত্রের একজন লোক কিছু উট নিয়ে মক্কায় এলো। আবু জেহেল তার উটগুলো কিনে নিলো। যখন সে দাম চাইলো তখন আবু জেহেল টালবাহানা করতে লাগলো। আরাশী ব্যক্তি বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন কা’বার হারামে কুরাইশ সরদারদেরকে ধরলো এবং প্রকাশ্য সমাবেশে ফরিয়াদ করতে থাকলো। অন্যদিকে হারাম শরীফের অন্য প্রান্তে নবী (স) বসে ছিলেন। কুরাইশ সরদাররা তাকে বললো, ‘আমরা কিছুই করতে পারবো না। দেখো, ঐ দিকে ঐ কোণে যে ব্যক্তি বসে আছে তাকে গিয়ে বলো। সে তার কাছ থেকে তোমার টাকা আদায় করে দেবে।‘ আরাশী নবী (স)’র দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কুরাইশ সরদাররা পরস্পর বলতে লাগলো, ‘এবার মজা হবে।’

আরাশী গিয়ে নবী করীমের (স) কাছে নিজের অভিযোগ পেশ করলো। তিনি তখনই উঠে দাঁড়ালেন এবং তাকে নিয়ে আবু জেহেলের গৃহের দিকে রওয়ানা দিলেন। সরদাররা তাদের পেছনে একজন লোক পাঠিয়ে দিল। আবু জেহেলের বাড়িতে কি ঘটে তা সে সরদারদেরকে জানাবে। নবী (স) সোজা আবু জেহেলের দরজায় পৌঁছে গেলেন এবং শিকল ধরে নাড়া দিলেন।

সে জিজ্ঞেস করলো ‘কে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘মুহাম্মাদ।’

সে অবাক হলেও বাইরে বের হয়ে এলো।

তিনি তাকে বললেন, ‘এ ব্যক্তির পাওনা দিয়ে দাও।’ সে কোন দ্বিরুক্তি না করে ভেতরে চলে গেলো এবং উটের দাম এনে তার হাতে দিল।

এ অবস্থা দেখে কুরাইশদের প্রতিবেদক হারাম শরীফের দিকে দৌড়ে গেলো এবং সরদারদেরকে সমস্ত ঘটনা শুনাবার পর বললো, আল্লাহর কসম, আজ এমন বিস্ময়কর ব্যাপার দেখলাম, যা এর আগে কখনো দেখিনি। হাকাম ইবনে হিশাম (অর্থাৎ আবু জেহেল) যখন গৃহ থেকে বের হয়ে মুহাম্মাদকে দেখলো তখনই তার চেহারার রং সাদা হয়ে গেলো এবং যখন মুহাম্মাদ তাকে বললো, ‘তার পাওনা দিয়ে দাও’, তখন এমন মনে হচ্ছিল যেন হাকাম ইবনে হিশামের দেহে প্রাণ নেই। (ইবনে হিশাম, ২ খন্ড ২৯-৩০ পৃঃ)

অমুসলিমদের সাথে মহানবী (স)’র ব্যবহার সম্পর্কে জীবনী গ্রন্থসমূহে অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। জনৈক ইহুদীর কাছে রাসুল (সা) এর কিছু ঋণ ছিল। লোকটি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধের জন্য তাড়া দিতে লাগলো। সে একবার মদিনার এক রাস্তায় রাসূল (সা)’র মুখোমুখি হয়ে বললো, ‘তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরেরা সময়মত ঋণ পরিশোধ কর না।’ হযরত ওমর (রা) তাঁর এই আচরণ

দেখে রেগে গিয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি অনুমতি দিন, ওর গর্দান কেটে ফেলি।’ রাসুল (সা) বললেন, ‘হে ওমর, আমার এই ইহুদীর জন্য অন্য রকম আচরণের প্রয়োজন ছিল। তুমি বরং ওকে উত্তম পন্থায় ঋণ ফেরত চাইতে বল, আর আমাকে উত্তম পন্থায় ঋণ পরিশোধ করতে বল।’

অতঃপর তিনি ইহুদীর দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি কালকেই তোমার দেয়া ঋণ ফেরত পাবে।’ এদিকে রাসূল(সা)’র ব্যবহারে ইহুদীর মনে ভাবান্তর দেখা দিল। সে এগিয়ে এসে বললো, ‘আমি আসলে আপনার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলাম। তাওরাতে শেষ নবীর এ রকম আলামতই লেখা আছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল।’ এ বলে সে ইসলাম গ্রহণ করলো। আলোচ্য ঘটনাটি মহানবী’র মাদানী জীবনে ঘটেছে। ঘটনাটি একজন ইহুদী ধর্মাবলম্বীর সাথে হয়েছে বলে এর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। মদিনায় ইসলাম বিজয়ী বেশে ছিল। এর পরও অমুসলিম ঋণদাতার দুর্ব্যবহারের জবাবে মহানবী (স)’র ব্যবহার লক্ষণীয়। দুঃখের বিষয়, আমরা নিজ ধর্মের লোকদের সাথেই আমরা সুন্দর ব্যবহার রপ্ত করতে পারিনি।

বিলাতে মহানবী (স)’র অনুসরীদের অন্যতম বড় সমস্যা হলো নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ। কুরআন-হাদিস মুসলমানদের পারস্পরিক সমঝোতা ও ঐক্যের ব্যাপারে সীমাহীন তাগিদ দেয়ার পরও আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। ৬৫ মিলিয়ন মানুষের দেশ বিলাতে আমরা তিন মিলিয়ন মুসলমান বাস করছি। আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করি এবং লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তা মিটিয়ে দেয়ার জন্যে অমুসলিমদের শরণাপন্ন হই। মহানবী (স) অমুসলিমদের সাথে শান্তি ও সমঝোতার প্রয়োজনে অনেক বড় বড় বিষয় ছাড় দিয়েছেন। আমরা মুসলমান ভাইদের সাথেই বেশিদিন মানিয়ে চলতে পারি না। কারো সাথে কোন ব্যাপারে বিরোধ বা মতপার্থক্য হলে সামান্য ছাড় দিতে রাজি হই না। ঈদ ও রোজার ব্যাপারে অনৈক্য এবং মসজিদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করে অমুসলিমদের কাছে আমরা বিলাতের মুসলসানরা হাসির পাত্র হয়ে আছি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমাদের অনৈক্যের আসল কারণ সাধারণ মুসলমানরা নয়। অধিকাংশ বিরোধমূলক বিষয়ের নেতৃত্বে তারাই থাকেন যারা কুরআন-হাদিস সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন।

কুরআনের নির্দেশ, ‘মুসলমানরা ভাই-ভাই। তোমরা ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে নাও।’ [হুজরাতঃ ৪৯ঃ ১০] ‘যারা নিজেদের দ্বীনকে বিভক্ত করে দিয়েছে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে, (হে নবী) নিশ্চয়ই তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।’ (আনআমঃ ৬ঃ ১৫৯)

মহানবী (স) বলেছেন, ‘সাবধান, আমার পর তোমরা কাফের হয়ে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়ো না।’[বুখারী] তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, স্নেহ-মমতা এবং হৃদ্যতাপূর্ণ আচার-আচরণ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে।দেহের কোন অঙ্গ যদি অসুস্থ হয় তা হলে সমস্ত শরীরে অনিদ্রা ও জ্বর এসে যায়।’ [বুখারী ও মুসলিম]

সবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল কর্তৃক মহানবী (স)কে একটি সতর্কতা এবং উপদেশ উল্লেখ করে লেখা শেষ করছি। এ হাদীসটি ইমাম তিরমিজি, ইমাম দারেমি এবং ইমাম বায়হাকি উল্লেখ করেছেন। হজরত আলী (র) বর্ণনা করেন, মহানবী (স) বলেছেন, ‘আমার কাছে জিবরিল আসেন এবং বলেন, হে মুহাম্মাদ, আপনার পর আপনার উম্মাত মতভেদে লিপ্ত হয়ে পড়বে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরিল, এ থেকে মুক্তির উপায় কী? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলার কিতাব।’

আল্লাহ আমাদের সবাইকে এক এবং নেক হবার তওফিক দিন। আল্লাহর রজ্জু কুরআনকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাবার তওফিক দিন।

বিষয়: বিবিধ

১২৯৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

360012
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ০১:৪৪
আফরা লিখেছেন : আল্লাহ আমাদের সবাইকে এক এবং নেক হবার তওফিক দিন। আল্লাহর রজ্জু কুরআনকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাবার তওফিক দিন । আমীন
360033
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৫৫
আকবার১ লিখেছেন : আমিন।
360040
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৫৩
আবু জান্নাত লিখেছেন : সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহ খাইর

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File