রাজাকার ও মু্ক্তিযোদ্ধ :Written by firozkamal

লিখেছেন লিখেছেন আকবার১ ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:৪৬:০০ রাত



কলুষিত ইতিহাস

দেশে দুর্নীতি বাড়লে দেশের ইতিহাসও দুর্নীতির শিকার হয়।তখন লড়াই শুরু হয় ইতিহাসের উপর দখলদারি নিয়ে। কারণ ইতিহাসের পাতায় বিশাল ভাবে বাঁচার খায়েশটি স্বৈর শাসকদের কম নয়। একারণেই দুর্নীতি কবলিত বাংলাদেশে বিস্তর দুর্নীতি ঢুকেছে একাত্তরের ইতিহাসে। ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে স্রেফ এক পক্ষের গুণকীর্তন। কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা নেই। উল্লেখ আছে স্রেফ ভিলেন রূপে। চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানের দালাল রূপে। কিন্তু দালালের কর্মে থাকে অর্থপ্রাপ্তির লোভ, তাতে মনের সম্পর্ক থাকে না।প্রাণদানের স্পৃহাও জাগে না। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ রূপে দাড়িয়েছিল পাকিস্তানের নিষ্ঠাবান নাগরিক রূপে। কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে রাজাকারের সে পরিচয়টি আলোচিত হয়নি। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেনই বা বাঙালী হয়েও তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? এগুলো তো এ্যাকাডিমিক প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলি শুধু আজকে নয়,শত শত বছর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সে প্রশ্নের উত্তর নেই।

রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা –উভয় পক্ষই একাত্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার। যে কোন খেলার ন্যায় একটি যুদ্ধেও দুটি পক্ষ থাকে। ইতিহাসের অর্থ স্রেফ একটি পক্ষের ধারাবিবরণী নয়। একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল রাজনীতির দুটি বিপরীত ধারা ও দর্শনের সংঘাত। প্রতি দেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সে মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণ নিয়ে সবাই একই ভাবে ভাবে না। বিপরীত মুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু কোন একটি পক্ষের পরাজয় বা বিদায় হলে সে পক্ষের ইতিহাসকে বিলুপ্ত করা যায় না। তাদের জন্যও ইতিহাসে স্থান ছেড়ে দিতে হয়।১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ জিতেছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে তারা হেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পড়লে মনে হয় দেশটির ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ থেকে, বড় জোর ১৯৫২ সাল থেকে। এ ইতিহাসে ১৯৪৭সালের নায়কদের জন্য স্থান রাখা হয়নি। কারণ তা হলে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ,নবাব সলিমুল্লাহ, খাজা নাযিমুদ্দীন, আল্লামা ইকবাল, হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দী,মাওলানা আকরাম খাঁ,নূরুল আমীনের ন্যায় বহু ব্যক্তিকে ইতিহাসে স্থান দিতে হয়। আর সেটি হলে শেখ মুজিবের ন্যায় ১৯৭১’য়ের নায়কদের জন্য স্থান কিছুটা হলেও কমে যায়। মুজিবের অনুসারিগণ সে ছাড় দিতে রাজী নয়। মুজিবের অনুসারিদের লড়াই স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল নিয়ে নয়, বরং ইতিহাসের দখলদারি নিয়েও। স্বৈরাচারি রাজনীতির এ হলো আরেক কুফল।

বাংলাদেশে পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে ভারতের সাহায্যপুষ্ট একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ। ইতিহাস রচনার নামে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে বিপক্ষীয় নেতাদের গায়ে কালিমা লেপন। ফলে রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে; এবং নিজেদেরকে চিত্রিত করেছে দেশের সমগ্র ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন,ধর্ষণ, গৃহ-লুট বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। হাজার হাজার বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থিদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি,ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন ঘুর্ণিঝড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। ইতিহাস তো এভাবেই কলুষিত হয় এবং আস্তাকুর্ড়ে গিয়ে পড়ে।প্রতিটি ব্যক্তির রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন-জগত নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে চরম দুর্দিনে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। ভিলেন রূপে নয়, রাজাকারদেরকে তাদের দর্শনসহ ইতিহাসে হাজির করলে সে উত্তরটি পাওয়া যেত।

দর্শনের লড়াই

১৯৭১’য়ে বাংলাদেশে দু’টি প্রবল দর্শন কাজ করেছিল। একটি হলো প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন- এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। এটিই হলো রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার দর্শন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার উৎস হলো এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষনে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং ঘটনার মূল্যায়নে সামনে রাখতে হবে। নইলে বিচারে প্রচণ্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্ম,আচরণ,রুচীবোধ ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই -খাদ্য-পানীয়,শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ পানাহার ও জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে শত শত বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে।

ব্যক্তির চরিত্র, চেতনা ও রাজনৈতিক নীতিমালার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো একটি জীবন-দর্শন। আর দর্শন তো বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। আর সেটি যদি হয় ইসলামী দর্শন,তবে তা তো মৃত্যুহীন। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলামের। সে দর্শন থেকেই তারা পেয়েছিল প্যান-ইসলামি চেতনা; পেয়েছিল মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গিকার। ফলে রাজাকারদের রাজনীতিতে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতা গুরুত্ব পায়নি। ফলে একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন রাজাকারগণ সে লড়ায়ে যোগ দেয়নি। বরং সে সময় বহু হাজার বাঙালী রাজাকার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে, মুজিব সরকারের জেল খেটেছে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। তাদের ত্যাগের পিছনে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের যে দর্শনটি কাজ করেছিল তা নির্মূল করে ভাষা, ভূগোল ও বর্ণভিত্তিক বিভেদের প্রাচীর। এমন দর্শনে বিশ্বাসীরা সে দর্শনে শুধু বিশ্বাসই করে না, সেটির প্রতিষ্ঠায় অর্থ, শ্রম ও রক্তও দেয়। তাই মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছে এমন ইসলামি চেতনা গণ্য হয় সাম্প্রদায়ীকতা রূপে। মুক্তিবাহিনীর বাঙালী সদস্যদের কাছে অবাঙালী মাত্রই যেখানে “ছাতুখোর” শত্রু এবং ঘৃণার যোগ্য –এমনকি হত্যাযোগ্য বিবেচিত হয়েছে, রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। যেমন সাতচল্লিশে মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। আজ যে বহু লক্ষ অবাঙালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে বস্তিতে বসানো হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়সম্পদকে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি তো নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধের উগ্র বাঙালী চেতনা। ইসলামে এমন কর্ম শুধু হারামই নয়, শাস্তিযোগ্য জঘন্য ফৌজদারি অপরাধ। সেটি অপরাধ আন্তর্জাতিক সভ্য আইনেও।

মহান আল্লাহতায়ালা ব্যক্তিকে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উপরে উঠতে নির্দেশ দেন।পবিত্র কোরআনে বহু বার ঘোষিত হয়েছে সে নির্দেশ। ঈমানদার হওয়ার গভীর দায়বদ্ধতা হলো সে নির্দেশ মেনে চলা।ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার পরিচয়ে বিভক্তি গড়া ইসলামে মহাপাপ –এ পাপ ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুণে নেয়। নামে মুসলিম হলেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জীবনে সে ঈমানী দায়বদ্ধতা ছিল না,বাঙালী হওয়াটিই তাদের কাছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপর দিকে রাজাকারর জীবনে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের ইসলামি চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল সাতচল্লিশ থেকেই। সে সময় এ চেতনাটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমের জীবনে এতটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অবাঙালী মুসলিমদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহু নগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। তখন বাঁধনটি ছিল ঈমানের, ভাষা,বর্ণ বা ভূগোলের নয়। ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অসহায় অবাঙালীদেরকে সাহায্য করাকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। তেমন একটি মানবিক আচরণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে দেখা যায়নি। বরং তারা নেমেছে অবাঙালীদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে এ হলো ইসলামি চেতনার এক গভীর অধঃপতনের দিন। কোরআনের প্যান-ইসলামি দর্শন সেদিন মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছে।

বিদ্রোহ কোরআনি অনুশাসনের বিরুদ্ধে

মুসলিম শুধু ঈমান ও নামায-রোযার ন্যায় ইবাদত নিয়ে বেড়ে উঠে না,তাকে বেড়ে উঠতে হয় পারস্পারিক মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন নিয়েও। ভাতৃত্বের সে বন্ধনের কারণেই অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমও তার কাছে ভাই গণ্য হয়। এটি ঈমানের আলামত। যার মধ্যে সে ভাতৃত্ব নাই বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করার অর্থ মুসলিম উম্মাহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহ তাই শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না,ছিল মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষিত নির্দেশমালার বিরুদ্ধেও। সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বড় সাফল্য শুধু এ নয় যে,পাকিস্তান ভেঙ্গে তারা বাংলাদেশে গড়তে পেরেছে। বরং বড় সাফল্য হলো,প্যান-ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্রোহটি সফল করতে পেরেছে । ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার মাটিতে এটিই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনে ঘোষিত প্যান-ইসলামি নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ।

ইসলামী চেতনার কারণেই বাঙালী মুসলিমের কাছে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ,আল্লামা ইকবাল, নবাব লিয়াকত আলী খানের মত অবাঙালী নেতারা ১৯৪৭ সালে আপন জন মনে হত। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদে তেমন ভাতৃত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল।বরং তাদের প্রতি যারা শ্রদ্ধা পোষন করে আজও তাদেরকে রাজাকার গণ্য করে। সাতচল্লিশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে অভিন্ন চেতনার -সেটি বুঝতে তারা আদৌ ভুল করেনা। একারণেই মুক্তিযোদ্ধরা শুধু নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ৪৭-য়ের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। অন্যদিকে তাদের কাছে অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, জেনারেল ম্যানেক শ' ও জেনারেল অরোরা। এমন এক চেতনার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল এবং ইকবাল হল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে মহান কবি আল্লামা ইকবালের নাম। অথচ বাংলার মানুষ যদি সাতচল্লিশে কায়েদে আজম, ইকবাল, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই হত না।কাশ্মীরী মুসলিমদের ন্যায় তাদেরও তখন হত্যার শিকার হতে হত এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিতা হতে হত। এবং হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হত গরু কোরবানী ও গরুর গোশতো ভক্ষণ। শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে একটি চেতনা যে মানব মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হলো তার নজির। এ চেতনার ফলে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা দাড়ী-টুপিধারী বাঙালী যুবকটিও মুক্তিবাহিনীর কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

ভারতীয় হিন্দুগণ পাকিস্তানে বিভক্তি আনতে যুদ্ধ করলেও নিজেদের মধ্যে ঐক্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে শুধু নয়, দলটির পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলনকে সমর্থণ করতে ভারত যুদ্ধে নেমেছিল। কিন্তু তারা কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দিতে রাজী নয় ।জনসংখ্যায় হিন্দুরা শতকোটির বেশী। বাংলার মত প্রায় এক ডজন ভাষা রয়েছে ভারতে। সে ভাষাগুলি নিয়ে ভারতে বাংলাদেশের মত ১০টি বাংলাদেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন ধারণা ভারতীয় হিন্দুদের মাথায় স্থান পায়নি। ১৯৪৭’য়ে যেমন নয়, আজও নয়।নানা ভাষার হিন্দুরা ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একটি মাত্র রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। বাঙালী মুসলিমগণ সেটি পারেনি। তাদের ঘাড়ে চাপে ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর হওয়ার বাসনা। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু কোরআন পাঠ,নিছক নামাজ-রোযা পালনও নয়। সেটি ভাষা, বর্ণ, ও ভৌগলিকতার উর্ধ্বে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমদের সাথে একাত্ব হয়ে মুসলিম উম্মাহ গড়ার সামর্থ্য। এমন একতা গড়া ইসলামে ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। বিজয় ও ইজ্জত আসে তো এরূপ একতার পথেই। নইলে শক্তি লোপ পায়, বিলুপ্ত হয় ইজ্জতও।মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত এবং শক্তিহীন ও ই্জ্জতহীন করার এজেণ্ডা তো ইসলামের শত্রুপক্ষের। একাত্তরে শত্রুর সে অভিন্ন এজেণ্ডা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর পিছনে ভারতে অর্থদান, অস্ত্রদান ও প্রশিক্ষণদানের মতলবটি বুঝতে হলে ভারতের এজেণ্ডাকেও তাই বুঝতে হবে। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে ভারতের সে এজেণ্ডাকে আদৌ তুলে ধরা হয়নি।

শেষ হয়নি একাত্তরের যুদ্ধ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলত দু'টি চেতনার। একাত্তরে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে এ দুটি চেতনারাই প্রবল প্রকাশ পেয়েছিল।বহু বাংলাদেশী বিষয়টি না বুঝলেও ভারত সেটি ষোলআনা বুঝে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরে ভারতের প্রতি সেবাদাস চরিত্র নিয়ে যে প্রবল বাঙালী সেক্যুলার পক্ষটি গড়ে উঠেছিল ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেক্যুলার বাংলাদেশীগণ চায় সেটি চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে। বাঙালী সেক্যুলারদের কাছে সেটিই হলো একাত্তরের চেতনা। বাংলাদেশের শিল্পে কোন বিনিয়োগ না করলে কি হবে, তারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এ চেতনা বাঁচাতে। ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনীতি বাঁচানোর এ বিশাল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দল এবং এনিজিওকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি,শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়ার ময়দানে নামিয়েছে। সে লক্ষ্যপূরণে শত শত পত্র-পত্রিকা, বহুশত নাট্যদল,বহু সাংস্কৃতিক দল, বহু টিভি চ্যানেল এক যোগে কাজ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত এসব এজেন্টদের সংখ্যা এজন্যই অধিক। উপরুন্ত ভারত থেকে আমদানী করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ও বই-পুস্তক। দেশের অভ্যন্তরে ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তারাই। একাত্তরের বন্দুক যুদ্ধ থেমে গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এজন্যই থামেনি। যুদ্ধের প্রচণ্ড উত্তাপ তাই দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে।ভারতের একাত্তরের যু্দ্ধের এটিই হলো ধারাবাহিকতা। শত্রুর যুদ্ধ তো এভাবেই যুগ যুগ নানা স্ট্রাটেজী নিয়ে নানা রণাঙ্গনে বেঁচে থাকে। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় লাগে না। সে যুদ্ধ সফল ভাবে লড়ার জন্য তাদের ট্রোজান হর্সরাই যথেষ্ট।

গর্ব যাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি নিয়ে

ব্যক্তির ঈমানদারি তো ইসলামের বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে কতটা হিতকর বা কল্যাণকর -সেটি প্রমান করায়।ঈমানদারকে তাই প্রতি মুহুর্তে বাঁচতে হয় এ ভাবনা নিয়ে যে সে কীভাবে ইসলামের বিশ্বব্যাপী বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে অধীক কাজে লাগতে পারে। এমন ভাবনা নিয়েই সে জিহাদে যায়। সে ভাবনা নিয়ে বিখ্যাত তুর্কী বীর ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের বাংলার বুকে ছুটে এসেছিলেন।এভাবে বাংলার কোটি কোটি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করেছিলেন তিনি। নইলে গরু-বাছুর, শাপ-শকুন, নদ-নদী,পাহাড়-পর্বত ও মুর্তি পুঁজায় জীবন কাটিয়ে নিশ্চিত জাহান্নামের যাত্রী হতে হতো। মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে অকল্যাণকর বা অহিতকর হওয়া তো শয়তানের কাজ। প্রশ্ন হলো,ইসলাম ও মুসলিমের কোন কল্যাণ কর্মের এজেণ্ডা গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী? ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণ কি ভারতের গর্ভে বা ভারতের সাহায্য নিয়ে হয়? প্রশ্ন হলো,ভারতের মত একটি আগ্রাসী হিন্দু দেশ মুসলিমের কল্যাণের যুদ্ধ করবে বা মুক্তিবাহিনীর ন্যায় একটি বাহিনী গড়ে তুলবে -সেটি কি ভাবা যায়? আজ পর্যন্ত কোথায়ও কি ভারত তেমন কর্ম করেছে? সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র –যা এখন বেঁচে থাকলে লোক সংখ্যাটি হতো ৩৫ কোটি। পলাশীর পরাজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর ঘটনাটি হলো সে পাকিস্তানের বিভক্তি। আর সে বিভক্তির কারণ বাঙালী সেক্যুলার নেতৃত্ব ও তাদের পরিচালিত মুক্তিবাহিনী। এ বিভক্তির ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে সামরিক ভাবে পঙ্গু এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতের অধিকৃত এক দেশে।অথচ উপমহাদেশের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি নিয়েই আওয়ামী-বাকশালী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অহংকার!

রাজাকারের চেতকনায় প্রবল ভাবে যা কাজ করেছিল তা হলো ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও সামরিক আগ্রাসন থেকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচানোর প্রেরণা। ভারতীয় প্রচার বিপুল সংখ্যক মানুষকে সেদিন বিভ্রান্ত করতে পারলেও রাজাকারদের বিভ্রান্ত করতে পারিনি। ভারতের মুসলিম বিরোধী ভূমিকাকে তারা ১৯৪৭য়ে যেমন দেখেছে, তেমনি ১৯৭১’য়ে এবং একাত্তরের পরও দেখেছে। পাকিস্তানের অকল্যাণই ছিল তাদের নীতি। ভারত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই শুধু বিরোধীতা করেনি, বিরোধীতা করেছে দেশটির বেঁচে থাকার বিরুদ্ধেও। সে শত্রুতা যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরদ্ধেও। পূর্ব পাকিস্তানকে মরুভূমি করতেই তারা নির্মাণ করেছে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের আগ্রাসী আচরণটি দেখা গেছে কাশ্মীর,হায়দারাবাদ, মানভাদর ও সিকিমে। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় কাজ করেছিল এমন আগ্রাসী ভারতকে আপন রূপে বরণ করায়। কিন্তু রাজাকারেরা দেশটির শত্রুসুলভ আচরণ দেখেছে যেমন ১৯৪৭ ও ১৯৬৫য়ে, তেমনি ১৯৭১য়েও। ভারতও যে মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করতে পারে সেটি তারা বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, মুসলিম কল্যাণে ভারতের কিছু করার আগ্রহ থাকলে সেটির শুরু হওয়া উচিত ছিল কল্যাণকর কিছু করার মধ্য দিয়ে; একাত্তরের যুদ্ধ, সে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও একটি রাষ্ট্রের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নয়।

রাজনৈতিক জালিয়াতি

রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়। একাত্তরে তাদের সে মিশনটি ছিল, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর। পাকিস্তানে অবিচার ছিল, বঞ্চনা ছিল, জুলুমও ছিল। রাজনৈতিক অনাচারও ছিল। তবে সমাধান যে ছিল না তা নয়। দেহ থাকলে যেমন রোগব্যাধীও থাকে। তেমনি বৃহৎ রাষ্ট্র থাকলে তাতে নানাবিধ সমস্যাও থাকে। দেহের যক্ষা বা ভাঙ্গা হাড্ডি সারাতেও সময় লাগে। রাষ্ট্রের রোগ সারাতে সময় আরো বেশী লাগে। বহু দেশে এমন সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে। যেমন পাকিস্তানের বয়সের চেয়ে অধিক কাল ধরে চলছে ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা। কয়েক যুগ ধরে চলছে সূদানের দারফোরের সমস্যা। ভারত কাশ্মীরের সমস্যা বিগত ৬৫ বছরেও সমাধান করতে পারেনি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির দাবীটি একাত্তরের কয় মাস আগেও কেউ মুখে আনেনি। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনেও এটি কোন ইস্যু ছিল না। শেখ মুজিব ও তার লাখ লাখ শ্রোতা মুক্তিযুদ্ধের শুরু মাত্র কয়েক মাস আগেও নির্বাচনী জনসভাগুলোতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে অভিযোগ -সেটির অস্তিত্ব মার্চের ১৯৭১-য়ের মার্চের একমাস আগেও ছিল না। অথচ এমন একটি অভিযোগ পাশ্ববর্তী মায়ানমারে দেড় দশক ধরে চলছে। সেদেশে ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী অং সাঙ সূচীর হাতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাঁকে গৃহবন্দী করে। কিন্তু তার জন্য কি দেশে গৃহযুদ্ধ নেমে এসেছে? এ অপরাধে কেউ কি দেশ ভাঙ্গার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে? বরং সেদেশের স্বৈরাচারি সামরিক জান্তাদের সাথে ভারতের আচরণটি লক্ষ্য করার মত। মায়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে ভারত শুরু থেকেই সদ্ভাব ও সহযোগিতা বজায় রেখেছে এবং পুরাদস্তুর বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তার দোসররা নির্বাচন পরবর্তী সে সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানকে আদৌ সময় দিতে রাজী ছিল না। সেটিকে বাহানা বানিয়ে দেশটির বিনাশে হাত দেয়। এটি ছিল অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে অতিশয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এটিই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জালিয়াতি।

রাজাকারের ভূমিকা

দেশ বাঁচলেই দেশের রাজনীতি বাঁচে। বাঁচে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠার স্বাধীনতাও। একাত্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল চিহ্নিত শত্রুর পরিকল্পিত হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকে বাঁচানোর দায়বদ্ধতা। এ দায়বদ্ধতাটি ছিল দেশের প্রতিটি ঈমানদারের উপর ।তেমন এক ঈমানী দায়বদ্ধতায় নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে প্রাণপনে ময়দানে নেমে আসে হাজার হাজার আত্মত্যাগী তরুণ। এরাই পাকিস্তানের এবং সে সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজাকার নামে পরিচিত। তাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বহু হাজার ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। অনেকে ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসে বাংলাভাষী মানুষ নিজ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এভাবে কাফের সেনা বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে সে ইতিহাস খুব একটা নেই। বরং ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী যখন বাংলা দখল করে নেয় তখন বাংলার কোন তরুণ একটি তীরও ছুড়েনি। কেউ প্রাণ দিয়েছে সে নজিরও নেই। বরং অনেকে মুর্শিদাবাদের রাস্তার দুই পার্শ্বে হাজির হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর বিজয় উৎসব দেখতে। মহান মুজাহিদ হাজী তিতুমীরের প্রতিরোধ এসেছে অনেক পরে। একাত্তরের বহু হাজার রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার –এ দুই পক্ষের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছে এবং নির্যাতীত হয়েছে এই রাজাকারেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যা কিছু হয়েছে তা লড়াইয়ের মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে। কিন্তু রাজকারদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে একাত্তরের পরও। বরং তাদের উপর লাগাতর হামলা হচ্ছে বিগত ৪৪ বছর ধরে। সেটিকে অব্যাহত রাখারও অবিরাম চেষ্টা চলছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুধু গালিগালাজই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার মুসলিমদের কল্যাণে তাদেরও যে একটি রাজনৈতিক কৌশল বা স্ট্রাটেজী ছিল -সে সত্যটিকে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। রাজাকারদের অধিকার দেয়া হয়নি তাদের চেতনা ও দর্শনের কথাগুলো লোক-সম্মুখে তুলে ধরার। অথচ সেটিও বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ।

রাজাকারের দর্শন ও মুক্তিযোদ্ধার দর্শন

রাজকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মুল পার্থক্যটি ভাষা বা বর্ণের নয়। সেটি দর্শনের। রাজাকারের চেতনাটি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের;ফলে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের বিবেচনায় আসেনি। তাদের কাছে যেটি গুরুত্ব পেয়েছিল সেটি হলো ভাষা ও অঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধিতে কাজ করা। পাকিস্তান ছিল বহু ভাষাভাষি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতীক। তাই সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাকে ফরজ দায়িত্ব ভেবেছে। তাদের আদর্শ শেখ মুজিবের বাঙালী জাতীয়তাবাদের আদর্শ ছিল না। ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বা প্রীতিলতার আদর্শও নয়। তাদের সামনে অনুকরণীয় মডেল ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম -যাদের শতকরা ৬০ ভাগ শহীদ হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী উম্মাহ গড়ায়। মুসলিমের কল্যাণ বাঙালী রূপে বেড়ে উঠায় নয়, সেটি ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকার নিয়ে বেড়ে উঠায়। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দিতে হবে ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণে কার কি অবদান সেটির। তাঁর মহান আদালতে কার কি ভাষা বা বর্ণ -সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। তাই ভাষার নামে রাষ্ট্র গড়ায় কোন কল্যাণ নেই। ইসলামে এটি ফরজ নয়, নবীজীর সূন্নতও নয়। এমন রাষ্ট্র গড়ায় প্রাণ দিলে কেউ শহীদ হয় না।শহীদ হতে হলে লড়াইটি নির্ভেজাল আল্লাহতায়ালার দ্বীন পালন ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হতে হয়। হতে হয় মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়।অথচ মুক্তিবাহিনী যে পথ ধরেছিল সেটি ছিল মুসলিম রাষ্ট্রকে ছোট করার তথা ক্ষতি সাধনে এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশের বুকে ভারতের আধিপত্য বাড়ানো।তাই মুক্তিবাহিনীর গঠনে,প্রশিক্ষণে ও তাদের অস্ত্রদানে ভারত এতটা আগ্রহী ছিল। ভাষা বা বর্ণ-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে সাহাবায়ে কেরাম প্রাণ দান দূরে থাক, সামান্য শ্রম, সময় বা অর্থ দান করেছেন -সে প্রমাণ নেই। মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি নবীজী (সাঃ)র সূন্নত হলে হাজার বছর আগেই অখণ্ড খেলাফত ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় পঞ্চাশটিরও বেশী স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারতো।

একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরে ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ),কম্যিউনিষ্ট পার্টি -মূলত এ তিনটি সেক্যুলার দল। ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের কোন অঙ্গিকার ছিল না। পাকিস্তানকে তারা সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি মনে করতো। তারা দেশটির ভাঙ্গার লড়ায়ে ভারতের সহযোগী ছিল। এ দলগুলির ছিল নিজ নিজ ছাত্র সংগঠন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিল এসব দলের ছাত্রসংগঠনেরর সদস্যরা। অপর শিবিরের দলগুলো হলো মুসলিম লীগের তিনটি মূল উপদল, জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষম-শ্রমিক পার্টি এবং জামায়াতে আহলে হাদীস। এছাড়াও আরো কিছু ছোট দল ছিল। রাজাকারগণ মূলত আসে এসব দলগুলি থেকে। রাজাকারদের মাঝে বহু নির্দলীয় ব্যক্তিও ছিল।তারা ছিল বিভিন্ন পীরের মুরীদ। তাদের সবার কাছে পাকিস্তান ছিল স্বপ্নের দেশ।

১৯৪৭’য়ের পূর্বে শেখ মুজিব নিজেও কতকাতায় থাকা কালে প্যান-ইসলামি দর্শনের স্রোতে কিছু কাল ভেসেছেন।কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর স্রোত কমে যাওয়ায় তিনি সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের আটকা পড়েন। এভাবে ছিটকে পড়েন পাকিস্তান সৃষ্টির মূল মিশন থেকে এবং যোগ দেন পাকিস্তানের শত্রু শিবিরে।যাদের মাঝে ইসলামি দর্শনের বলটি প্রবল,একমাত্র তারাই ইসলামের পক্ষে প্রবল স্রোত সৃষ্টি করে এবং সে স্রোতে অনেককে ভাসিয়েও নেয়।আর ইসলামি দর্শন তো অমর। ফলে প্যান-ইসলামী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে ফেলবে -সেটি মুসলিম সন্তানেরা মেনে নেয় কি করে? ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্ট ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য কম্যিউনিষ্ট, নাস্তিক, বাঙালী জাতীয়তাবাদী, ভারতীয় এজেন্ট ও সেক্যুলারগণ মেনে নিলেও কোন রাজাকার মেনে নেয়নি। মুক্তিযু্দ্ধের চেতনাধারিদের থেকে রাজাকারদের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই।

ভিন্নতা শত্রু-মিত্র নির্বাচনে

কে শত্রু আর কে মিত্র –মানুষ সে ধারণাটি পায় তার দর্শন থেকে।তাই ইসলাম যাদেরকে শত্রু বা মিত্র রূপে চিহ্নিত করে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র তা করে না। মুসলিমের শত্রু বা মিত্র আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের শত্রু বা মিত্র তাই এক নয়।এজন্যই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে বন্ধু রূপে গৃহীত হয় নাস্তিক কম্যিউনিস্ট এবং পৌত্তলিকরা। ফলে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল ভারতের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের সাথে কোয়ালিশন গড়াটিও। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারতীয় হিন্দু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, শিখ জেনারেল অরোরা, পারসিক জেনারেল মানেক শ’,ইহুদী জেনারেল জ্যাকব অতিশয় আপনজন মনে হয়েছে। এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমনকি নিজ দেশ, নিজ ধর্ম ও নিজ ভাষার নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাটিও বীর-সুলভ মনে হয়েছে। ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার নিরস্ত্র রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে তো এমন এক চেতনাতেই।

প্রতারণার স্বার্থে অতি দুর্বৃত্তদেরও ফেরেশতা সাজার আয়োজন দেখা যায়। সেটি যেমন তাদের কথাবার্তা ও বক্তৃতায়,তেমনি সাজগোজে।তবে ব্যক্তির মনের গোপন অভিলাষ ও তার আসল চরিত্রটি বুঝার মোক্ষম উপায়টি হলো তার নিকটতম বন্ধুদের দিকে তাকানো। কারণ বন্ধু নির্বাচনে সবাই তার মন ও মতের অতি কাছের লোকটিকে বেছে নেয়। তাই শেখ মুজিব বা তার বাঙালী জাতীয়তাবাদী সহচরদের চরিত্র ও তাদের রাজনীতির মূল এজেণ্ডা বুঝতে হলে ভারতীয় নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র ও এজেণ্ডা বুঝতে হবে। এজন্য মুজিবের লম্বা লম্বা বক্তৃতা শোনার প্রয়োজন নেই। রাজাকারগণ তাই মুজিবকে চিনেছিল তার ঘনিষ্টতম বন্ধু ভারত সরকারের আগ্রাসী আধিপত্যবাদ ও মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস থেকে। একাত্তরের পর ভারতের অবাধ লুণ্ঠন, তলাহীন ঝুলির অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষে মৃত্যু এবং বাংলাদেশের অধিকৃত রাজনীতির মধ্য দিয়ে তাদের সে ধারণা শতভাগ সঠিকই প্রমাণিত হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমদের ব্যর্থতাও প্রচুর। বড় ব্যর্থতাটি হলো,ভয়ংকর প্রতারকদের চিনতে না পারা। মানুষকে শুধু বিষাক্ত পোকামাকড় ও হিংস্র পশুদের চিনলে চলে না। রাজনীতির ভদ্রবেশী প্রতারকদেরও চিনতে হয়। নইলে দেশ অধিকৃত হয় ও তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হয়। দুর্ভিক্ষও নেমে আসে।গণতন্ত্রের বদলে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়।সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমগণ চিনতে পারিনি সত্যিকার বন্ধুদেরও। রাজনীতির যে পক্ষটি ১৯৪৭’য়ে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে স্বাধীনতা এনে দিল তাদেরকে বরং শত্রু মনে করেছে। পাশে আশ্রয় নেয়া অবাঙালী মুসলিমদের ভাই রূপে গ্রহন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। বিভাজন গড়েছে স্রেফ ভাষার ভিত্তিতে।অবিঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণাবোধে। অথচ এমন বিভক্তি ও ঘৃণাবোধ ইসলামে হারাম। বিভক্তির এ পাপ আযাব ডেকে আনে। পাকিস্তানে ৩০ লাখ আফগাণ আশ্রয় পায়, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লেবাননের জনসংখ্যার প্রায অর্ধেক হলো রিফিউজী। অথচ বাংলাদেশে কয়েক লাখ বিহারীর বসবাসের স্থান হয় না। তাদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে তাদেরকে নর্দমার পাশের বস্তিতে পাঠানো হয়।সাগরে ভাসা প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমগণ বাংলাদেশের উপকূলে নৌকা ভেড়ানোর অনুমতিও পায়নি। অথচ বাঙালী রাজাকারদের কাছে পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি মুসলিমগণ শত্রু মনে হয়নি। বরং তাদেরকে তারা ভাই হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে ঈমানী দায়িত্ব ভেবেছে।

বিদ্রোহ কোরআনী হুকুমের বিরুদ্ধে

পানাহারে যেমন হারাম-হালালের বিষয় আছে তেমনি হারাম-হালাল আছে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।এব্যাপারে মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাটি হলো,“ঈমানদারগণ যেন ঈমানদারদের ছেড়ে কোন কাফেরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না।” -(সুরা আল ইমরান, আয়াত ২৮)।অর্থাৎ কাফেরদেরকে বন্ধু রুপে গ্রহন করার অর্থ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অধিকাংশ মুসলিম নামধারী হলেও তাদের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার এ নিষেধাজ্ঞাটি আদৌ গুরুত্ব পায়নি। তারা ভারতের অমুসলিম সরকারকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছে। ফলাফল দাঁড়িয়েছে, ভারত সরকারের সাথে শেখ মুজিবের বন্ধুত্বটি স্রেফ বন্ধুত্বের মাঝে সম্পর্ক সীমিত থাকেনি। সে বন্ধুত্ব গড়িয়েছে বাংলাদেশে ইসলামের ব্যাপক ক্ষতি সাধনে। সে বন্ধুত্বের শর্ত পূরণে ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বরের পরপরই শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী চেতনাকে সাম্প্রদায়িক বলে সেটির বিনাশে নেমেছে। রাজনীতি ও প্রশাসনে অবস্থান নিয়েছে ইসলামের প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে। নিষিদ্ধ করেছে সকল ইসলামি রাজনৈতিক দলকে।সংকুচিত করেছে কোরআন শিক্ষা। অথচ ১৯৭০ নির্বাচনে সে বিষয়ে জনগণ থেকে শেখ মুজিব কোন ম্যাণ্ডেটই নেননি।কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ার কারণে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক যে বিলুপ্ত হয়– পবিত্র কোরআনের উপরুক্ত হুশিয়ারিটি শেখ মুজিব ও তার দল এই ভাবেই প্রমাণিত করেছে। ইসলাম থেকে এরূপ দূরে সরার কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারত সরকার এজন্যই এতটা প্রসন্ন।

অন্য যে কোন দেশের ন্যায় পাকিস্তানেও অনেক সমস্যা ছিল।কিন্তু পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যে সমস্যাটি চ্যালেঞ্জ খাড়া করে সেটি অর্থনৈতিক ছিল না, রাজনৈতিকও ছিল না। সেটি ছিল পাকিস্তানকে মেনে নেয়ায় ভারতের অসম্মতি। ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মাঝে স্নায়ু যুদ্ধ কালীন তীব্র প্রতিশোধ পরায়ণতা। ভারতের সে আজন্ম শত্রুতাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছিল। দেশে বিবাদ থাকাটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মুসলিমের জন্য অস্বাভাবিক হলো, সে বিবাদকে বাহানা করে একটি কাফের শক্তিকে নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহ্বান করা বা কাফের দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করা।

রাজাকারের স্বপ্ন ও মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন

সবাই যেমন একই লক্ষ্য নিয়ে বাঁচে না,তেমনি একই রূপ স্বপ্নও দেখে না। মানুষে মানুষে স্বপ্নের জগত জুড়ে তাই বিশাল পার্থক্য। সে বিশাল পার্থক্যটি রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার মাঝেও। রাজাকারের চেতনা-রাজ্যের সবটুকু জুড়ে যে বিরাট স্বপ্ন সেটি বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উত্থানের। স্বপ্নটি ইসলামের পূর্ণ পুণঃপ্রতিষ্ঠার। দেহে প্রাণ থাকা যেমন জীবনের লক্ষণ, তেমনি এমন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচাটি ঈমানের লক্ষণ। আর প্রকৃত ঈমানদারের শুধু এ স্বপ্নটুকুই থাকে না, সে স্বপ্নের বাস্তাবায়নে প্রাণপন প্রচেষ্টাও থাকে। এজন্যই তো ঈমানদার মাত্রই আল্লাহর পথের রাজাকার তথা স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক। এ কাজে তাকে ময়দানে নামতে কেউ বাধ্য করে না,নামে নিজ ঈমানী দায়বদ্ধতায়।আল্লাহর দ্বীনের এমন রাজাকার প্রতিযুগের মোজাহিদগণ। রাজাকার ছিলেন তারাও যারা সাতচল্লিশে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বণিতে কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়েছেন। রাজাকার তাদেরও বলা হতো যারা ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজামের হায়দারাবাদের স্বাধীনতা বাঁচাতে যুদ্ধ লড়েছিল।

একাত্তরের রাজাকারগণই তাই একমাত্র রাজাকার নন। এমন রাজাকার আজও অসংখ্য। এরাই আজ আল্লাহর দ্বীনের বিজয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আজও তারা প্রতিরোধে নামে। এ সত্যটুকু বুঝতে শয়তান ভুল করে না। ভুল করে না শয়তানী শক্তির বাংলাদেশী সেবাদাসেরাও। তাই বাংলাদেশের রাজপথে যখন দাড়িটুপিধারীদের রাজাকার বলে লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। বিস্ময় তখনও জাগে না যখন একাত্তরের পরে জন্ম নেয়া ইসলামী চেতনাধারী যুবককে রাজাকার বলে হত্যা করা হয়। বিস্ময় জাগে না, যখন একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি আশি বছরের এক বৃদ্ধ আলেমকে রাজাকার বলা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। রাজাকারের সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানশূণ্য ও চিন্তাশূণ্য মুসলিমদের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু সে সংশয় শয়তানের নেই। তাই রাজাকার চিনতে সে ভুল করে না। এজন্যই মাদ্রাসা-মসজিদ গুলোকে শয়তানী শক্তির এজেন্টগণ যখন রাজাকার উৎপাদনের কারখানা বলে তখন তারা ভুল বলে না। কারণ এগুলোই তো আল্লাহর ইনস্টিটিউশন।

নবীজী (সাঃ)র হাদীস,“গুনাহ বা ক্ষতিকর কাজ হতে দেখলে ঈমানদারের দায়িত্ব হলো সে কাজ শক্তি বলে রুখা। শক্তি না থাকলে মুখের কথা দিয়ে প্রতিবাদ করা। আর সেটিও না থাকলে মন থেকে সেটিকে ঘৃণা করা। আর এ ঘৃণাটুকুও না থাকলে বুঝতে হবে, তার অন্তরে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই”। একটি মুসলিম দেশকে খন্ডিত করার চেয়ে জঘন্য খারাপ কাজ আর কি হতে পারে? মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজই বা আর কি হতে পারে? দেশের ভূগোলের উপর হামলা রুখতে সাহাবায়ে কেরাম জিহাদ করেছেন, দলে দলে শহীদ হয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অপুরণীয় ক্ষতি করতেই আরব বিশ্বকে খন্ডিত করেছে মুসলিম-দুষমন পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অখন্ড ভূগোলকে ভেঙ্গে তারা বাইশ টুকরায় বিভক্ত করেছে। আরবদের এভাবে দূর্বল ও নির্জীব করার পরই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল।

দেশ খন্ডিত হওয়ায় যে দূর্বলতা বাড়ে সেটি কি মাথাপিছু আয়ু বাড়িয়ে দূর করা যায়? কুয়েত, আবুধাবি, কাতার, সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অধিক। কিন্তু তাতে কি শক্তি বেড়েছে? বেড়েছে কি প্রতিরক্ষার সামর্থ্য। তাই কোন শত্রুপক্ষ যখন কোন দেশবাসীকে দূর্বল করতে চায় তখন তারা সে দেশটির মানচিত্রে হাত দেয়। ভারত সেটি করেছিল পাকিস্তানের বিরদ্ধে। তাই কোন ঈমানদার কি কাফের শক্তির হাতে মুসলিম উম্মাহর দেহ এভাবে টুকরো টুকরো হতে দেখে খুশি হতে পারে? খুশি হলে তার মনে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও যে নাই -তা কি অবিশ্বাস করা যায়? এমন বিধ্বংসী কাজে একমাত্র শয়তান এবং শয়তানের অনুসারীগণই খুশি হতে পারে।

আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মুসলিমের বন্ধু হতে হলে তো তাকে মুসলিম ও ইসলামেরও বন্ধু হতে হয়। মুসলিম দেশের অখন্ডতার হেফাজতে কাফেরদের বিরুদ্ধেও বীরদর্পে রুখে দাঁড়াতে হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর তায়ালার ঘোষণা,“হে ঈমানদারগণ,তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।..” আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার অর্থ শুধু আমিও মুসলমান –এ টুকু বলা নয়। শুধু নামায-রোযা আদায় নয়। আল্লাহপাক তার বান্দাহ থেকে বৃহ্ত্তর কিছু চান। সেটি ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও অখণ্ড মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায় অঙ্গিকার ও কোরবানী। এটিই ছিল রাজাকারের জীবনে মিশন। তাই পাকিস্তান বাঁচাতে তারা ভারত ও ভারতের সেবাদাসদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে।তারা ফেরেশতা ছিল না, কিন্তু একাত্তরে তাদের জীবনের মিশনটি ইসলামি ছিল।এবং এ মিশনটি শ্বাশ্বত। সেটি প্রতি যুগে বিমূর্ত হয় ব্যক্তির রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে। মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা নামে মুসলিম হলেও আল্লাহর ঘোষিত এ মিশনকে তারা নিজেদের জীবনের মিশন রূপে গ্রহন করেনি। বরং ভারতের দেয়া রোডম্যাপকেই তারা নিজেদের রাজনীতির রোডম্যাপে পরিণত করেছে। ফলে মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষার জন্য কিছু করার বদলে তারা সেটিকে ধ্বংস করেছে। এভাবে প্রচন্ড খুশি বাড়িয়েছে কাফেরদের। আর কাফেরদের মুখে হাসি বাড়ালে কি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়া যায়?

বিষয়: বিবিধ

১৩১৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

354654
১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪১
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : চমৎকার। হৃদ্ধয় ছুঁয়ে যায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File