মাওলানা মাওদূদীর চিন্তাধারা : ডঃ ইউসুফ আল কারাদাওয়ী by:সালাম আজাদী
লিখেছেন লিখেছেন আকবার১ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:০৬:২৬ রাত
মাআ আইম্মাতিত তাজদীদ ও রুওয়াহুম’ তথা ‘ইসলামি নবজাগৃতির ইমাম ও তাদের চিন্তাধারার সাথে’ গ্রন্থে আল্লামা ডঃ ইউসুফ কারাদাওয়ী ইসলামি আন্দোলনের কয়েকজন ইমামের চিন্তাধারার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। এই বই থেকে মাওলানা মাওদূদীর প্রসংগ টা আলাদা করে একটা পুস্তিকা ইদানিং বের হয়েছে। এই বই এ মাওলানা মাওদূদীকে তিনি ‘ইমাম’ বলে সম্বোধন করেছেন। আমি এই রচনায় বইটার সার সংক্ষেপ তুলে ধরছিঃ
Maulana Maudoodiমাওলানা মাওদূদীর যুগে ভারতে চিন্তার যে সব দৈন্যতা ছিলো তা হলোঃ
১। গোঁড়া তাক্বলীদঃ এই চিন্তা ছিলো খুব ব্যাপক। মনে করা হতো আগের যুগের ইমামগণ কোন কিছুই আমাদের জন্য ছেড়ে যাননি। এদের মতে ইজতিহাদের সব দরোযা এখন বন্ধ কাজেই একটা মাযহাবের তাক্বলীদ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর কোন মাযহাবের বাইরে যাওয়া মনে হলো খোদ ইসলাম থেকে বের হওয়া।এই চিন্তার ধারক বাহকেরা পুরানো চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এরা পুরাতন ইলমে কালামের প্যাঁচের মধ্যে এমন ভাবেই আবর্তিত হচ্ছিলো যেন অদেখা কিছু শত্রুর সাথে তারা বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমন কি ফিক্বহের যে সব বিষয় আলোচনা এখন শেষ হয়ে গেছে, তা নিয়েও তাদের ব্যস্ত দেখা যায়। আসল ব্যাপার হলো, এদের কাজ ছিলো নতুন কিছু এলেই তার বিরোধিতা করা কিংবা দ্বীনের তাজদীদের কোন কাজ দেখলেই তা অমান্য করা।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাওয়ী এই চিন্তার মর্মমূলে আঘাৎ করে কাঁপিয়ে দেন, এবং ইসলামি চিন্তার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন, তার পরেও ভারতীয় আলিমগনের বড় অংশ সেই প্রাচীনতার যুপকাষ্ঠে তড়পাতে ছিলো।
২। অলিক কল্পনাঃ
ভারতীয় ঊপমহাদেশে এই সময় অলিক কল্পনা বিলাসী বেশ কিছু আলিম উলামাগণের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যারা ইসলামী তাসাউফের অনুসারী ছিলোনা, অথচ নিজদের তাসাউফ পন্থী বলে জাহির করতো। এরা জীবন জগত থেকে ছিলো খুব ই পেছনে। এদের চিন্তার জগতে ছিলো গ্রীকদের যুক্তিবাদিতা ও তাদের দর্শন, তারা মিলিয়ে ফেলতো বেদান্ত মতবাদ, মনু ও যুরাথুষ্ঠীয় দর্শনের সাথে সঠিক ইসলামের ধ্যান ধারণা।
৩। পাশ্চত্যের পদলেহনঃ এখানে অনেক আলিম উলামাদের মাঝে পাশ্চত্যের প্রতি অন্ধ ভালোবাসাও দেখা যায় এই সময়। এরা পাশ্চত্যের উন্নয়ন কে শুধু রোল মডেল মনে করতোনা, এরা পাশ্চত্যের দর্শনকেও মনে করলো ইসলামের অল্টার্নেটিভ।
৪। পরাজিত মানসিকতাঃ কিছু আলিম উলামার উদ্ভব ও এই ভারতে দেখতে পাই যারা মনের দিক দিয়ে ছিলো এপলোজেটিক। তারা ইসলামে কোন জটিল বিষয় দেখলেই সে গুলো অস্বীকার করে ফেলতো বা তার এমন জবাব তৈরি করতে থাকতো যাতে বুঝা যেতো ইসলাম এই বিষয় টা অবতারণা করে ভুল করেছে।
দাস প্রথা, জিহাদ, বহু বিবাহ, বিয়ে তালাক, হিজাব ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মতামত গুলো দেখলেই বুঝা যাবে কত পরাজিত মানসিকতার তারা ছিলো।
৫। হাদীস অস্বীকারঃ এই সময়ে ভারতে হাদীস অস্বীকার করার মত মানুষ ও দেখা গেলো। যারা মনে করতো ইসলাম মানতে এখন কুরআন ই যথেষ্ঠ, হাদীসের প্রয়োজন নেই।
৬। কাদিয়ানিদের উত্থানঃ গোলাম আহমাদ কাদিয়ানির মাধ্যমে ভারতে শুরু হয় আরেক ফিতনাহ, যার মাধ্যমে ইসলামের নবুওয়াত-রিসালাত এর মর্মমূলে আঘাতের ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
মাওলানা মাওদূদীর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার বিকাশঃ
এই মারাত্মক সংকটে ভারতে যে সব আলিম উলামার লেখনী ও বক্তব্য মুসলমানদের মন মগজে সঠিক ইসলামের আক্বীদা বিশ্বাস কে প্রতিস্থাপনের কাজ করেছেন, মাওলানা মাওদূদী তাদের অন্যতম। তার চিন্তা দর্শন কে নিচের কয়েকটা পয়েন্টে আলোচনা করা হলোঃ
১- ইসলাম কে পরিপূর্ন ভাবে মেনে চলাঃ
মাওদূদী যে ইসলামে বিশ্বাস করতেন তা ছিলো ঐ সব মাযহাব পন্থী আলিমগণের চিন্তা ভাবনার বাইরে। ওরা মনে করতো একটা মাযহাবের বাইরে যাওয়া যাবেন, এখন ইজতিহাদের কোন সুযোগ নেই, ওরা মনে করতো আগেকার কয়েকটা ফিকহ বই এর বাইরে যা আলোচনা আসবে তা বাতিল।
মাওলানা মাওদূদীর চিন্তা দর্শন ঐসব আলিমদের ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো যারা কোন মাযহাব মানেনা বটে, কিন্তু কুরআন হাদীসের মূল কথা গুলো আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করে থাকে। মাক্বাসিদে শারিয়ায় তাদের কোন দখল ছিলোনা, ইসলামের মূল স্পিরিট সম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞান ছিলোনা, যারা নতুন জাহেরি মতবাদ নিয়ে দাপটে বেড়াচ্ছে।
তিনি যে ইসলাম বুঝেছিলেন তা, ঐসব তাসাউফপন্থীদের নাগালের বাইরে ছিল, যারা দ্বীন মানার নাম করে এর আক্বীদাহ বিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলেছে, যারা ইবাদাতের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিদ’আতের স্বর্গরাজ্য বানায়ে ফেলেছে, পীর মূরিদির নামে তারা দ্বীন কে গোসলকারীর সামনে মৃতদেহের মত বানিয়ে নিয়েছে।
যারা পাশ্চত্য সভ্যতার ভক্ত হয়ে গেলেন, কিংবা পাশ্চত্য দর্শনের গোলাম হয়ে গেলেন, মক্কা থেকে ঘুরে ইউরোপকে যারা কিবলা বানালেন, তিনি গেলেন তাদের বাইরে।
তিনি যে ইসলামের দিকে মানুষকে ডেকেছেন তা হলো খাঁটি ইসলাম। ইসলামের নামে যে সব মতবাদ গুলিয়ে ফেলা হচ্ছিলো তার বিপরীতে তিনি দাঁড়ালেন, তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, ইসলাম ই ইসলাম। এর সাথে সমাজতন্ত্র, ডেমোক্রেসি কিংবা জাতীয়তাবাদের কোন সম্পর্ক নেই।
তিনি ইসলাম বলতে বুঝিয়েছেন, এটা শুধু আক্বীদাহ বিশ্বাসের কিছু বিষয় নয়, বরং এটা ব্যাপক। আক্বীদাহ বিশ্বাস এর মূল প্রতিপাদ্য, কিন্তু তার প্রতিফলন আসতে হবে রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এখানে শুধু কতিপয় ইবাদাত মেনে চলার জন্য ইসলাম আসেনি, দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ই হচ্ছে ইবাদাহ। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার চিন্তাকেই বিকশিত করেছেন।
তিনি যে ইসলাম বুঝেছেন তা কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। এখানে চারিত্রিক সৌন্দর্য কে যেমন উপজীব্য করা হয়েছে, তেমনি এটাতে একাধারে রয়েছে ইবাদাতী যিন্দেগী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট, সামাজিক বিধি-বিধান, অর্থনৈতিক নীতিমালা এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচি। কোন একটা ও বাদ দেয়ার সুযোগ এখানে নেই।
২। আধুনিকতা ও যুগোপযোগিতাঃ
মাওদূদীর চিন্তাধারার আরেক বৈশিষ্ট হলো তিনি এক চোখে যেমন ইসলাম কে দেখেছেন, অন্য চোখে তেমন বর্তমান যুগকেও রেখেছেন। তিনি বর্তমানকে ছেড়ে অতীত নিয়ে থেকেন নি, বরং আধুনিক মনষ্কের সাথে কথা বলেন তাদের ই ভাষায়, আধুনিক দর্শনের ভাষায় তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এই কাজ করতে চেয়ে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাকে চষে বেড়াতে যেমন হয়ে, আধুনিক বিভিন্ন চিন্তা দর্শনের সাথে তাকে পরিচিত হতে হয়েছে। আর এটাই হলো একজন সফল দায়ী ইলাল্লাহ এর গুণ। আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ আমি প্রতিটি নবী কে তার নিজ জাতির ভাষা দিয়ে পাঠিয়েছি, যাতে করে অহীর কথা গুলো জাতির কাছে পরিস্কার করে দিতে পারেন। (ইব্রাহীমঃ ৪)
এক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলা তাকে ‘নীতিমালা’ ও ‘দর্শন’ প্রনয়নের মত প্রতিভা দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ছড়ানো মুক্তো মাণিক গুলো এক সুতোয় গেঁথে ছোট ছোট বিষয় গুলো কে বৃহত্তর নীতিমালায় একত্রিত করেছেন। নানা প্রশাখা গুলোকে মূলধারায় নিয়ে এসেছেন। এ থেকেই তৈরি হতে পেরেছে ইসলামি দর্শনের। চিন্তা ও জ্ঞানের জগতে এ ধরণের প্রতিভা খুব ই বিরল। তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রতিভার অধিকারি।
মাওদূদির লেখা বই গুলো পড়লে যে বিষয় টা সহজে চোখে ধরে তাহলোঃ তিনি আসলে তার যুগেই বাস করেছেন; এই যুগের সমস্যাগুলো তিনি পরিস্কার ভাবে বুঝতে পেরেছেন; তার সমাজে যে সব স্রোতধারা চলেছে তার সম্পর্কে যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা তার ছিলো। যে সব প্রভাবশালী নতুন দর্শন ও সভ্যতা আধুনিক বিশ্ব কে নাড়িয়ে দিয়েছে, কিংবা জ্ঞান বিজ্ঞানের যে সব অবদান আজ বর্তমান জেনারেশানকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তা গভীর ভাবে অধ্যায়ন করেছেন। তিনি এই সব চাকচিক্যময় সভ্যতার অন্ধকার অলি গলি সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখতেন। ফলে তিনি তার দূর্বলতা গুলো আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি বর্তমান সভ্যতার মূল উৎস গুলো গভীর ভাবে গবেষণা করে দেখেছেন। যে সব দার্শনিক ভিত্তিমূলে বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়েছে তা ছিলো তার নখ-দর্পনে। তিনি এর বৈশিষ্ট গুলো জানতেন, এর রোগ গুলো ও তার ব্যাপ্তি বুঝতেন; ফলে এর বহিরাবরণ দেখে তিনি প্রতারিত হননি, রূপ দেখে ভড়কে জাননি, বাইরের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে ভেতরের অন্ধকার সম্পর্কে চোখ বন্ধ রাখেননি।
৩। চ্যালেঞ্জ গ্রহন করাঃ
ইসলামের যে সব স্কলার ইসলামের উপর আরোপিত প্রশ্নের সামনে কিছুটা ‘অনুনয়ের’ সুর তোলেন, কিংবা পাশ্চত্য সভ্যতার ধ্বজাধারী লিবারেল ও সমাজতান্ত্রিক দের অপ্রতিরোধ্য অপপ্রচারে কাতর হয়ে “ইসলামে কিছু দূর্বলতা আছে” ভেবে যারা আত্মরক্ষা মূলক অবস্থান নিয়ে ‘আইনজীবি’র ভূমিকা পালন করেন, মাওদূদি সে পথে চলেন নি। সত্যিই, মাওদূদি কখনো পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে কিংবা তাদের দর্শনের মুকাবিলায়, অথবা ঐ সব বাতিলের সয়লাবে নিযে আত্মরক্ষা মূলক পদক্ষেপ নেন নি, আইন জীবির ভূমিকা গ্রহন করেন নি। বরং তিনি ছিলেন ওদের চ্যালেঞ্জ গ্রহনকারী, এবং ছুড়েও দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ। তিনি পাশ্চত্য সভ্যতার ঐ সব বড় বড় মূর্তি সমূহের সামনে অন্যদের মত হাঁটু গেড়ে বসে যান নি। এই সভ্যতার সামনে অন্যদের মত মাথা নত করে সেজদায় লুটেন নি।
বরং তিনি ইসলাম পন্থী হওয়ায় গর্ব বোধ করেছেন, ইসলামের সার্বজনীন মেসেজের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাথতেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের বুঝার দূর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে চলার জন্য যা দিয়েছেন তার ধারে কাছেও কোন মনুষ্য রচিত জীবন বিধান যেতে পারেনা। “সৃষ্টি যিনি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনিই সর্বোজ্ঞ এবং পারদর্শি… (আলমুলকঃ ১৪)
তিনি পাশ্চত্য সভ্যতার সমস্যা ও দূর্বলতা সম্পর্কে ব্যাপক জানতেন। জানতেন ইসলামের সাথে কোথায় কোথায় তা সাংঘর্ষিক। এজন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে পাশ্চত্য সভ্যতার মর্মমূলে আঘাত হানা, সম্ভব হয়েছে এর দোষ ও ত্রুটি গুলো অত্যন্ত সাবলিল ও সমালোচনার ভাষায় তুলে ধরা। এজন্য যারা এই কাজে ব্রতী ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে বেশী শক্তিশালী। এতে পাশ্চত্য সভ্যতার বিপরীতে ইসলামের প্রতি আস্থা বৃদ্ধিতে দারুন সহায়ক হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি আসলেই পথিকৃত হয়ে রইবেন।
তিনি ‘পর্দা ও ইসলাম’ বই লিখে পাশ্চত্যের সামাজিক জীবনধারার কঠোর সমালোচনা করেন, এবং তার বিপরীতে পবিত্রতা আর্জন ও নারী এবং পরিবার সম্পর্কে ইসলামি দর্শনের ব্যাখ্যা করেন। এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন ইসলাম এক্ষেত্রে পাশ্চত্যের জীবন দর্শনের চেয়ে কত ব্যাপক ও গভীরতর হতে পারে।
তিনি ‘সুদ’ বই টি লিখে পাশ্চত্য সভ্যতার অর্থনৈতিক দর্শনের অসারতা প্রমান করেছেন। তিনি এই সভ্যতার মূল দর্শন পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থার দূর্বলতা তুলে ধরে সুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (স) যুদ্ধ ঘোষণার কারণ গুলো ব্যখ্যা করেছেন।
তিনি ‘ইসলামিক ব্যাঙ্কিং’ উপর বই লিখে এক দিকে পাশ্চত্য অর্থনৈতিক দর্শনের সমালোচনা করেছেন এবং ইসলামি ব্যাঙ্কিং এর নীতিমালা ব্যাখ্যা করেছেন। যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আজকের ইসলামি ব্যাংকের সফল প্রতিষ্ঠান।
এখানে চ্যালেঞ্জ ও চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মাওদূদীর কিছু ত্রুটি হয়ত হয়ে গেছে। পাশ্চত্য সভ্যতার বিপরীতে ইসলামি আইডেন্টেটি রক্ষায়, ইসলামি সভ্যতার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এবং ইসলামি দৃষ্টিকোনের ব্যাখ্যায় তিনি কিছুটা কঠোরতা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি অন্যদের মত কোন দূর্বলতা বা কম্প্রোমাইজের আশ্রয় নেয়া ভালো মনে করেন নি।
আমরা দেখতে পেয়েছি ইসলামে পর্দার ব্যাখ্যা করতে যেয়ে তিনি নিকাব (মুখ ঢাকা) অজিব মনে করেছেন, এমন কি চাচা ও মামার সামনেও মুখ ঢাকা ফরজ মনে করেছেন।
ইসলামি অর্থনীতির আলোচনা করতে যেয়ে অন্যান্য স্কলার যেমন ডঃ মুস্তাফা সিবাঈ তার ‘ইসলামের সমাজতন্ত্র’ বই এ ও মুহাম্মাদ গাযযালি তার ‘ইসলাম ও সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি’ বই এ ইসলামের সামাজিক সুবিচার সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ উদারতা দেখিয়েছেন। কিন্তু মাউদূদি এখানে খুব কট্টর।
রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করতে যেয়ে মাউদূদি ডেমোক্রেসি কে অগ্রহনযোগ্য মনে করেছেন। এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারন তিনি এর মূল দর্শনের দিকে তাকিয়েছেন বেশি। এবং ভেবেছেন এটা আল্লাহর আইনের শাসনের বিপরীতে মানুষের শাসন। তিনি অন্য কোন দৃষ্টিকোণে এটার বিচার বিশ্লেষণ করেন নি। সরকার প্রধান নির্বাচন, নীতি নির্ধারক নির্বাচন ও তাদের ইম্পীচমেন্ট বা বহিস্কার সংক্রান্ত নীতিমালা ইত্যাদিতে গণতন্ত্র থেকে নেয়ার মত অনেক কিছু আছে। গণতন্ত্র আসলে একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের ক্ষমতায়ন। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো ক্ষমতা জনতার হাতে থাকবে, সরকারের হাতে নয়। আর মুসলিম বিশ্বে গনতন্ত্র ইসলামি শারীয়াহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এই দৃষ্টিকোণে তিনি গনতন্ত্রকে দেখেন নি বলে মনে হয়েছে।
৪। একজন সংস্কারক হিসেবে মাউদূদিঃ
প্রতিটি স্কলার যে একজন সংস্কারক হবেন তা নয়। অনেক স্কলার কে দেখা যায় তারা চিন্তা, দর্শন ও গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, সমাজ ও সংস্কার নিয়ে ভাবেন না। সংস্কারের জন্য কাজ করেন তারা সমাজের সমস্যা ও তার উৎস নিয়ে গুরুত্ব দেন, যাতে রোগ নির্ণয় সহজ হয় ঔষধ দেয়াও যায় দ্রুত। মাউদূদি ছিলেন উম্মাতের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। তিনি উম্মাহর মূল সমস্যা গুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। সেটা ছিলো তার ভাষায় জাহিলিয়্যাত। তিনি এই রোগ টাকে মানব জাতির ইতিহাসের সব চেয়ে প্রাচীনতম রোগ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন জাহিলিয়্যাতের মূলোৎপাটন ই ছিলো নবী রাসূল (আ) গণকে পাঠানোর একমাত্র কারণ ছিলো। তিনি এই জাহিলিয়্যাত কে কয়েকভাগে বিভক্ত করেছেন, খাঁটি জাহেলিয়্যাত, শির্ক ও অলিক কল্পনার মিশ্রিত জাহিলিয়্যাত কিংবা বৈরাগ্যবাদি জাহিলিয়্যাত। তিনি মনে করেন এ জাহিলিয়্যাত সমূহের সাথেই যুগে যুগে নবী রাসূলেরা (আ) লড়াই করেছেন। তিনি এটাও মনে করেন একজন পূর্ণ মুজাদ্দিদের কাজ হলো এই জাহিলিয়্যাতের ধ্বজাধারিদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে আনা।
তিনি মনে করেন জাহিলিয়্যাতের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অনেকেই মনে করেন ইসলামের আগের যুগ কে জাহিলিয়্যাতের যুগ বলে। এটা ঠিক নয়। বরং জাহিলিয়্যাত হলো চিন্তা দর্শন, অনুভুতি ও কিছু ক্ষেত্র। যেখানেই তা পাওয়া যাবে জাহিলিয়্যাত হিসাবে তাকে চিহ্নিত করা হবে। এই জাহিলিয়্যাতের চিহ্ন হলো আল্লাহর হেদায়েতের বাইরে চলা, এবং আল্লাহর হুকুম ও শাসন পদ্ধতির বাইরে যাওয়া।
তিনি এই জাহিলিয়্যাতের মুলোৎপাটন করতে যেয়ে পরিপূর্ণ ভাবে আন্দোলনের গুরুত্বারোপ করেছেন, এক্ষেত্রে কোন সন্ধি করা যাবেনা বলে পথ দেখিয়েছেন। আর সেই আন্দোলনের পথ হবে ‘ইসলামি বিপ্লবের পথ’।
মাআ আইম্মাতিত তাজদীদ ও রুওয়াহুম’ তথা ‘ইসলামি নবজাগৃতির ইমাম ও তাদের চিন্তাধারার সাথে’ গ্রন্থে আল্লামা ডঃ ইউসুফ কারাদাওয়ী ইসলামি আন্দোলনের কয়েকজন ইমামের চিন্তাধারার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। এই বই থেকে মাওলানা মাওদূদীর প্রসংগ টা আলাদা করে একটা পুস্তিকা ইদানিং বের হয়েছে। এই বই এ মাওলানা মাওদূদীকে তিনি ‘ইমাম’ বলে সম্বোধন করেছেন। আমি এই রচনায় বইটার সার সংক্ষেপ তুলে ধরছিঃ
Maulana Maudoodiমাওলানা মাওদূদীর যুগে ভারতে চিন্তার যে সব দৈন্যতা ছিলো তা হলোঃ
১। গোঁড়া তাক্বলীদঃ এই চিন্তা ছিলো খুব ব্যাপক। মনে করা হতো আগের যুগের ইমামগণ কোন কিছুই আমাদের জন্য ছেড়ে যাননি। এদের মতে ইজতিহাদের সব দরোযা এখন বন্ধ কাজেই একটা মাযহাবের তাক্বলীদ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর কোন মাযহাবের বাইরে যাওয়া মনে হলো খোদ ইসলাম থেকে বের হওয়া।এই চিন্তার ধারক বাহকেরা পুরানো চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এরা পুরাতন ইলমে কালামের প্যাঁচের মধ্যে এমন ভাবেই আবর্তিত হচ্ছিলো যেন অদেখা কিছু শত্রুর সাথে তারা বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমন কি ফিক্বহের যে সব বিষয় আলোচনা এখন শেষ হয়ে গেছে, তা নিয়েও তাদের ব্যস্ত দেখা যায়। আসল ব্যাপার হলো, এদের কাজ ছিলো নতুন কিছু এলেই তার বিরোধিতা করা কিংবা দ্বীনের তাজদীদের কোন কাজ দেখলেই তা অমান্য করা।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাওয়ী এই চিন্তার মর্মমূলে আঘাৎ করে কাঁপিয়ে দেন, এবং ইসলামি চিন্তার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন, তার পরেও ভারতীয় আলিমগনের বড় অংশ সেই প্রাচীনতার যুপকাষ্ঠে তড়পাতে ছিলো।
২। অলিক কল্পনাঃ
ভারতীয় ঊপমহাদেশে এই সময় অলিক কল্পনা বিলাসী বেশ কিছু আলিম উলামাগণের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যারা ইসলামী তাসাউফের অনুসারী ছিলোনা, অথচ নিজদের তাসাউফ পন্থী বলে জাহির করতো। এরা জীবন জগত থেকে ছিলো খুব ই পেছনে। এদের চিন্তার জগতে ছিলো গ্রীকদের যুক্তিবাদিতা ও তাদের দর্শন, তারা মিলিয়ে ফেলতো বেদান্ত মতবাদ, মনু ও যুরাথুষ্ঠীয় দর্শনের সাথে সঠিক ইসলামের ধ্যান ধারণা।
৩। পাশ্চত্যের পদলেহনঃ এখানে অনেক আলিম উলামাদের মাঝে পাশ্চত্যের প্রতি অন্ধ ভালোবাসাও দেখা যায় এই সময়। এরা পাশ্চত্যের উন্নয়ন কে শুধু রোল মডেল মনে করতোনা, এরা পাশ্চত্যের দর্শনকেও মনে করলো ইসলামের অল্টার্নেটিভ।
৪। পরাজিত মানসিকতাঃ কিছু আলিম উলামার উদ্ভব ও এই ভারতে দেখতে পাই যারা মনের দিক দিয়ে ছিলো এপলোজেটিক। তারা ইসলামে কোন জটিল বিষয় দেখলেই সে গুলো অস্বীকার করে ফেলতো বা তার এমন জবাব তৈরি করতে থাকতো যাতে বুঝা যেতো ইসলাম এই বিষয় টা অবতারণা করে ভুল করেছে।
দাস প্রথা, জিহাদ, বহু বিবাহ, বিয়ে তালাক, হিজাব ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মতামত গুলো দেখলেই বুঝা যাবে কত পরাজিত মানসিকতার তারা ছিলো।
৫। হাদীস অস্বীকারঃ এই সময়ে ভারতে হাদীস অস্বীকার করার মত মানুষ ও দেখা গেলো। যারা মনে করতো ইসলাম মানতে এখন কুরআন ই যথেষ্ঠ, হাদীসের প্রয়োজন নেই।
৬। কাদিয়ানিদের উত্থানঃ গোলাম আহমাদ কাদিয়ানির মাধ্যমে ভারতে শুরু হয় আরেক ফিতনাহ, যার মাধ্যমে ইসলামের নবুওয়াত-রিসালাত এর মর্মমূলে আঘাতের ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
মাওলানা মাওদূদীর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার বিকাশঃ
এই মারাত্মক সংকটে ভারতে যে সব আলিম উলামার লেখনী ও বক্তব্য মুসলমানদের মন মগজে সঠিক ইসলামের আক্বীদা বিশ্বাস কে প্রতিস্থাপনের কাজ করেছেন, মাওলানা মাওদূদী তাদের অন্যতম। তার চিন্তা দর্শন কে নিচের কয়েকটা পয়েন্টে আলোচনা করা হলোঃ
১- ইসলাম কে পরিপূর্ন ভাবে মেনে চলাঃ
মাওদূদী যে ইসলামে বিশ্বাস করতেন তা ছিলো ঐ সব মাযহাব পন্থী আলিমগণের চিন্তা ভাবনার বাইরে। ওরা মনে করতো একটা মাযহাবের বাইরে যাওয়া যাবেন, এখন ইজতিহাদের কোন সুযোগ নেই, ওরা মনে করতো আগেকার কয়েকটা ফিকহ বই এর বাইরে যা আলোচনা আসবে তা বাতিল।
মাওলানা মাওদূদীর চিন্তা দর্শন ঐসব আলিমদের ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলো যারা কোন মাযহাব মানেনা বটে, কিন্তু কুরআন হাদীসের মূল কথা গুলো আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করে থাকে। মাক্বাসিদে শারিয়ায় তাদের কোন দখল ছিলোনা, ইসলামের মূল স্পিরিট সম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞান ছিলোনা, যারা নতুন জাহেরি মতবাদ নিয়ে দাপটে বেড়াচ্ছে।
তিনি যে ইসলাম বুঝেছিলেন তা, ঐসব তাসাউফপন্থীদের নাগালের বাইরে ছিল, যারা দ্বীন মানার নাম করে এর আক্বীদাহ বিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলেছে, যারা ইবাদাতের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিদ’আতের স্বর্গরাজ্য বানায়ে ফেলেছে, পীর মূরিদির নামে তারা দ্বীন কে গোসলকারীর সামনে মৃতদেহের মত বানিয়ে নিয়েছে।
যারা পাশ্চত্য সভ্যতার ভক্ত হয়ে গেলেন, কিংবা পাশ্চত্য দর্শনের গোলাম হয়ে গেলেন, মক্কা থেকে ঘুরে ইউরোপকে যারা কিবলা বানালেন, তিনি গেলেন তাদের বাইরে।
তিনি যে ইসলামের দিকে মানুষকে ডেকেছেন তা হলো খাঁটি ইসলাম। ইসলামের নামে যে সব মতবাদ গুলিয়ে ফেলা হচ্ছিলো তার বিপরীতে তিনি দাঁড়ালেন, তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, ইসলাম ই ইসলাম। এর সাথে সমাজতন্ত্র, ডেমোক্রেসি কিংবা জাতীয়তাবাদের কোন সম্পর্ক নেই।
তিনি ইসলাম বলতে বুঝিয়েছেন, এটা শুধু আক্বীদাহ বিশ্বাসের কিছু বিষয় নয়, বরং এটা ব্যাপক। আক্বীদাহ বিশ্বাস এর মূল প্রতিপাদ্য, কিন্তু তার প্রতিফলন আসতে হবে রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এখানে শুধু কতিপয় ইবাদাত মেনে চলার জন্য ইসলাম আসেনি, দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ই হচ্ছে ইবাদাহ। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার চিন্তাকেই বিকশিত করেছেন।
তিনি যে ইসলাম বুঝেছেন তা কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। এখানে চারিত্রিক সৌন্দর্য কে যেমন উপজীব্য করা হয়েছে, তেমনি এটাতে একাধারে রয়েছে ইবাদাতী যিন্দেগী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট, সামাজিক বিধি-বিধান, অর্থনৈতিক নীতিমালা এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচি। কোন একটা ও বাদ দেয়ার সুযোগ এখানে নেই।
২। আধুনিকতা ও যুগোপযোগিতাঃ
মাওদূদীর চিন্তাধারার আরেক বৈশিষ্ট হলো তিনি এক চোখে যেমন ইসলাম কে দেখেছেন, অন্য চোখে তেমন বর্তমান যুগকেও রেখেছেন। তিনি বর্তমানকে ছেড়ে অতীত নিয়ে থেকেন নি, বরং আধুনিক মনষ্কের সাথে কথা বলেন তাদের ই ভাষায়, আধুনিক দর্শনের ভাষায় তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এই কাজ করতে চেয়ে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাকে চষে বেড়াতে যেমন হয়ে, আধুনিক বিভিন্ন চিন্তা দর্শনের সাথে তাকে পরিচিত হতে হয়েছে। আর এটাই হলো একজন সফল দায়ী ইলাল্লাহ এর গুণ। আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ আমি প্রতিটি নবী কে তার নিজ জাতির ভাষা দিয়ে পাঠিয়েছি, যাতে করে অহীর কথা গুলো জাতির কাছে পরিস্কার করে দিতে পারেন। (ইব্রাহীমঃ ৪)
এক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলা তাকে ‘নীতিমালা’ ও ‘দর্শন’ প্রনয়নের মত প্রতিভা দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ছড়ানো মুক্তো মাণিক গুলো এক সুতোয় গেঁথে ছোট ছোট বিষয় গুলো কে বৃহত্তর নীতিমালায় একত্রিত করেছেন। নানা প্রশাখা গুলোকে মূলধারায় নিয়ে এসেছেন। এ থেকেই তৈরি হতে পেরেছে ইসলামি দর্শনের। চিন্তা ও জ্ঞানের জগতে এ ধরণের প্রতিভা খুব ই বিরল। তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রতিভার অধিকারি।
মাওদূদির লেখা বই গুলো পড়লে যে বিষয় টা সহজে চোখে ধরে তাহলোঃ তিনি আসলে তার যুগেই বাস করেছেন; এই যুগের সমস্যাগুলো তিনি পরিস্কার ভাবে বুঝতে পেরেছেন; তার সমাজে যে সব স্রোতধারা চলেছে তার সম্পর্কে যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা তার ছিলো। যে সব প্রভাবশালী নতুন দর্শন ও সভ্যতা আধুনিক বিশ্ব কে নাড়িয়ে দিয়েছে, কিংবা জ্ঞান বিজ্ঞানের যে সব অবদান আজ বর্তমান জেনারেশানকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তা গভীর ভাবে অধ্যায়ন করেছেন। তিনি এই সব চাকচিক্যময় সভ্যতার অন্ধকার অলি গলি সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখতেন। ফলে তিনি তার দূর্বলতা গুলো আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি বর্তমান সভ্যতার মূল উৎস গুলো গভীর ভাবে গবেষণা করে দেখেছেন। যে সব দার্শনিক ভিত্তিমূলে বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়েছে তা ছিলো তার নখ-দর্পনে। তিনি এর বৈশিষ্ট গুলো জানতেন, এর রোগ গুলো ও তার ব্যাপ্তি বুঝতেন; ফলে এর বহিরাবরণ দেখে তিনি প্রতারিত হননি, রূপ দেখে ভড়কে জাননি, বাইরের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে ভেতরের অন্ধকার সম্পর্কে চোখ বন্ধ রাখেননি।
৩। চ্যালেঞ্জ গ্রহন করাঃ
ইসলামের যে সব স্কলার ইসলামের উপর আরোপিত প্রশ্নের সামনে কিছুটা ‘অনুনয়ের’ সুর তোলেন, কিংবা পাশ্চত্য সভ্যতার ধ্বজাধারী লিবারেল ও সমাজতান্ত্রিক দের অপ্রতিরোধ্য অপপ্রচারে কাতর হয়ে “ইসলামে কিছু দূর্বলতা আছে” ভেবে যারা আত্মরক্ষা মূলক অবস্থান নিয়ে ‘আইনজীবি’র ভূমিকা পালন করেন, মাওদূদি সে পথে চলেন নি। সত্যিই, মাওদূদি কখনো পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে কিংবা তাদের দর্শনের মুকাবিলায়, অথবা ঐ সব বাতিলের সয়লাবে নিযে আত্মরক্ষা মূলক পদক্ষেপ নেন নি, আইন জীবির ভূমিকা গ্রহন করেন নি। বরং তিনি ছিলেন ওদের চ্যালেঞ্জ গ্রহনকারী, এবং ছুড়েও দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ। তিনি পাশ্চত্য সভ্যতার ঐ সব বড় বড় মূর্তি সমূহের সামনে অন্যদের মত হাঁটু গেড়ে বসে যান নি। এই সভ্যতার সামনে অন্যদের মত মাথা নত করে সেজদায় লুটেন নি।
বরং তিনি ইসলাম পন্থী হওয়ায় গর্ব বোধ করেছেন, ইসলামের সার্বজনীন মেসেজের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাথতেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের বুঝার দূর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে চলার জন্য যা দিয়েছেন তার ধারে কাছেও কোন মনুষ্য রচিত জীবন বিধান যেতে পারেনা। “সৃষ্টি যিনি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনিই সর্বোজ্ঞ এবং পারদর্শি… (আলমুলকঃ ১৪)
তিনি পাশ্চত্য সভ্যতার সমস্যা ও দূর্বলতা সম্পর্কে ব্যাপক জানতেন। জানতেন ইসলামের সাথে কোথায় কোথায় তা সাংঘর্ষিক। এজন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে পাশ্চত্য সভ্যতার মর্মমূলে আঘাত হানা, সম্ভব হয়েছে এর দোষ ও ত্রুটি গুলো অত্যন্ত সাবলিল ও সমালোচনার ভাষায় তুলে ধরা। এজন্য যারা এই কাজে ব্রতী ছিলেন তিনি তাদের মধ্যে বেশী শক্তিশালী। এতে পাশ্চত্য সভ্যতার বিপরীতে ইসলামের প্রতি আস্থা বৃদ্ধিতে দারুন সহায়ক হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি আসলেই পথিকৃত হয়ে রইবেন।
তিনি ‘পর্দা ও ইসলাম’ বই লিখে পাশ্চত্যের সামাজিক জীবনধারার কঠোর সমালোচনা করেন, এবং তার বিপরীতে পবিত্রতা আর্জন ও নারী এবং পরিবার সম্পর্কে ইসলামি দর্শনের ব্যাখ্যা করেন। এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন ইসলাম এক্ষেত্রে পাশ্চত্যের জীবন দর্শনের চেয়ে কত ব্যাপক ও গভীরতর হতে পারে।
তিনি ‘সুদ’ বই টি লিখে পাশ্চত্য সভ্যতার অর্থনৈতিক দর্শনের অসারতা প্রমান করেছেন। তিনি এই সভ্যতার মূল দর্শন পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থার দূর্বলতা তুলে ধরে সুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (স) যুদ্ধ ঘোষণার কারণ গুলো ব্যখ্যা করেছেন।
তিনি ‘ইসলামিক ব্যাঙ্কিং’ উপর বই লিখে এক দিকে পাশ্চত্য অর্থনৈতিক দর্শনের সমালোচনা করেছেন এবং ইসলামি ব্যাঙ্কিং এর নীতিমালা ব্যাখ্যা করেছেন। যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আজকের ইসলামি ব্যাংকের সফল প্রতিষ্ঠান।
এখানে চ্যালেঞ্জ ও চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মাওদূদীর কিছু ত্রুটি হয়ত হয়ে গেছে। পাশ্চত্য সভ্যতার বিপরীতে ইসলামি আইডেন্টেটি রক্ষায়, ইসলামি সভ্যতার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এবং ইসলামি দৃষ্টিকোনের ব্যাখ্যায় তিনি কিছুটা কঠোরতা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি অন্যদের মত কোন দূর্বলতা বা কম্প্রোমাইজের আশ্রয় নেয়া ভালো মনে করেন নি।
আমরা দেখতে পেয়েছি ইসলামে পর্দার ব্যাখ্যা করতে যেয়ে তিনি নিকাব (মুখ ঢাকা) অজিব মনে করেছেন, এমন কি চাচা ও মামার সামনেও মুখ ঢাকা ফরজ মনে করেছেন।
ইসলামি অর্থনীতির আলোচনা করতে যেয়ে অন্যান্য স্কলার যেমন ডঃ মুস্তাফা সিবাঈ তার ‘ইসলামের সমাজতন্ত্র’ বই এ ও মুহাম্মাদ গাযযালি তার ‘ইসলাম ও সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি’ বই এ ইসলামের সামাজিক সুবিচার সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ উদারতা দেখিয়েছেন। কিন্তু মাউদূদি এখানে খুব কট্টর।
রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করতে যেয়ে মাউদূদি ডেমোক্রেসি কে অগ্রহনযোগ্য মনে করেছেন। এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারন তিনি এর মূল দর্শনের দিকে তাকিয়েছেন বেশি। এবং ভেবেছেন এটা আল্লাহর আইনের শাসনের বিপরীতে মানুষের শাসন। তিনি অন্য কোন দৃষ্টিকোণে এটার বিচার বিশ্লেষণ করেন নি। সরকার প্রধান নির্বাচন, নীতি নির্ধারক নির্বাচন ও তাদের ইম্পীচমেন্ট বা বহিস্কার সংক্রান্ত নীতিমালা ইত্যাদিতে গণতন্ত্র থেকে নেয়ার মত অনেক কিছু আছে। গণতন্ত্র আসলে একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের ক্ষমতায়ন। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো ক্ষমতা জনতার হাতে থাকবে, সরকারের হাতে নয়। আর মুসলিম বিশ্বে গনতন্ত্র ইসলামি শারীয়াহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এই দৃষ্টিকোণে তিনি গনতন্ত্রকে দেখেন নি বলে মনে হয়েছে।
৪। একজন সংস্কারক হিসেবে মাউদূদিঃ
প্রতিটি স্কলার যে একজন সংস্কারক হবেন তা নয়। অনেক স্কলার কে দেখা যায় তারা চিন্তা, দর্শন ও গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, সমাজ ও সংস্কার নিয়ে ভাবেন না। সংস্কারের জন্য কাজ করেন তারা সমাজের সমস্যা ও তার উৎস নিয়ে গুরুত্ব দেন, যাতে রোগ নির্ণয় সহজ হয় ঔষধ দেয়াও যায় দ্রুত। মাউদূদি ছিলেন উম্মাতের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। তিনি উম্মাহর মূল সমস্যা গুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। সেটা ছিলো তার ভাষায় জাহিলিয়্যাত। তিনি এই রোগ টাকে মানব জাতির ইতিহাসের সব চেয়ে প্রাচীনতম রোগ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন জাহিলিয়্যাতের মূলোৎপাটন ই ছিলো নবী রাসূল (আ) গণকে পাঠানোর একমাত্র কারণ ছিলো। তিনি এই জাহিলিয়্যাত কে কয়েকভাগে বিভক্ত করেছেন, খাঁটি জাহেলিয়্যাত, শির্ক ও অলিক কল্পনার মিশ্রিত জাহিলিয়্যাত কিংবা বৈরাগ্যবাদি জাহিলিয়্যাত। তিনি মনে করেন এ জাহিলিয়্যাত সমূহের সাথেই যুগে যুগে নবী রাসূলেরা (আ) লড়াই করেছেন। তিনি এটাও মনে করেন একজন পূর্ণ মুজাদ্দিদের কাজ হলো এই জাহিলিয়্যাতের ধ্বজাধারিদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে আনা।
তিনি মনে করেন জাহিলিয়্যাতের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অনেকেই মনে করেন ইসলামের আগের যুগ কে জাহিলিয়্যাতের যুগ বলে। এটা ঠিক নয়। বরং জাহিলিয়্যাত হলো চিন্তা দর্শন, অনুভুতি ও কিছু ক্ষেত্র। যেখানেই তা পাওয়া যাবে জাহিলিয়্যাত হিসাবে তাকে চিহ্নিত করা হবে। এই জাহিলিয়্যাতের চিহ্ন হলো আল্লাহর হেদায়েতের বাইরে চলা, এবং আল্লাহর হুকুম ও শাসন পদ্ধতির বাইরে যাওয়া।
তিনি এই জাহিলিয়্যাতের মুলোৎপাটন করতে যেয়ে পরিপূর্ণ ভাবে আন্দোলনের গুরুত্বারোপ করেছেন, এক্ষেত্রে কোন সন্ধি করা যাবেনা বলে পথ দেখিয়েছেন। আর সেই আন্দোলনের পথ হবে ‘ইসলামি বিপ্লবের পথ
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৬ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল।
শেয়ারিং এর জন্য ধন্যবাদ।
আল্লাহ নবী রসুলের সিলসিলা বন্ধ করেছেন কিন্তু সমাজ সংষ্কারকের পথ বন্ধ করেননি৷ তাঁার প্রয়োজন মত আসতেই থাকবেন৷ মওলানা মোওদুদী তাঁদেরই একজন৷ ধন্যবাদ আলোচনার জন্য৷
মন্তব্য করতে লগইন করুন