জীবনের লুপ

লিখেছেন লিখেছেন ট্রাস্টেড থিফ ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৪:০৪:৫০ রাত



সাদিক সাহেব স্ত্রী এবং মেয়েকে তাড়া দিতে লাগলেন কই তোমাদের হোল? পৌছুতে দেরি হয়ে যাবে যে। মেয়ে সুমাইয়াকে একটু বেশিই আদর করেন। মা সুমু একটু দ্রুত করতে হবে যে। ছেলে সাহিল কে বললেন এই রফিককে বল গাড়ী বের করতে । সাদিক সাহেব এক জন অবসর প্রাপ্ত সচিব। ব্যস্ততা কাটিয়ে বহু দিন পর ছুটি কাটিয়ে আবার শহরে ফিরছেন। ঢাকার অভিজাত এলাকায় থাকেন। মেয়ে সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স করছে আর ছেলেটি এ লেবেল দিবে। আর গৃহকর্তী মিসেস সাদিকই মূলত গৃহ কর্তা। একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন পুরো পরিবার। ৯০র দশকের পাজারো কিছুটা ধীরে ধীরে গ্রামের আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে চলছে। আর কিছুটা পথ পেরুলেই হাইওয়ে। হাইওয়েতে ওঠেই গাড়ী যেন তার যৌবন পিরে পেল। গাড়ী তীর বেগে ছুটে চলেছে সামনের দিকে । হাঠাত বিকট শব্দ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল। সবাই উদ্ধ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে বেরিয়ে এলো। ড্রাইবার ইঙ্গিন চেক করতে লাগলো। পিন পতন নীরবতা। সাদিক সাহেবের আর তর সইচেনা। হাঁক দিলেন কিরে কিছু বুঝলি। দেখতেছি স্যার। স্যার মনে হয় ইঞ্জিনের পিস্টন কাজ করতেছেন গ্যারেজে নিতে হইবো। কি কস এই আসে পাসে গ্যারেজ পাবি কই। স্যার এই খান থকে ১৫/২০ মাইল দুরে একটা বাজার আছে ওইখানে গ্যারেজ আছে। আমি ওইখানে নিয়া যামু। আপনারা বাসে কইরা চইলে যান আমি গাড়ি নিয়া আইতাছি। এইখানে গাড়ি পাবো কোথায়? একটু সামনে হাইটা গেলেই কয়েকটা দোকান দেখতে পাইবেন। ওইখানে কিছু বাস দাঁড়ায়। সাদিকে সাহেব উপায়ন্তর নে পেয়ে স্ত্রী কন্যা পুত্র নিয়ে বাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

সাদিক সাহেব এবং তার পরিবার হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা হয়রান হয়ে গেছেন। বাস স্টপে এসেই কিছুটা ঝিরিয়ে নিলেন। একটা ফার্স্ট ক্লাস কোচের কাউন্টারে গেলেন। না আগামী তিনদিনের আগে কোন সিট খালি নেই। আরেকটাতেও গেলেন একই অবস্থা। মনে মনে রফিকের উপর রাগ ঝাড়ছেন "হারামজাদা তোরে এত টাকা বেতন দেই আর তুই গাড়িটা ভালো করে চেক করে রাখতে পারিস না। এদিকে মেয়েটার দিকে মানুষ যে হারে নন স্টপ তাকিয়ে আছে তাতে তার রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটাকে এতোকরে বলি পর্দা কর। অজুহাত দেখায় গাড়ীতে কে দেখবে আমাকে। সাদিক সাহেব খুব বিনয়ের সাথে একটা কাউন্টারে গিয়ে বললেন দেখুন আমার পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি প্লিজ আমার জন্য চারটা টিকেটে ব্যবস্থা করে দিন। স্যার আমরা অসলেই আপনার জন্য কিছু করতে পারছিনা কারণ কার টিকেট ক্যান্সেল করে আপনাকে দিব। তবে আপনি লোকাল এক্সপ্রেসে ট্রাই করুন। কিছুটা আস্তে চলে তবে ঈদের সময় তো যাত্রী বোঝাই হয়ে গেলে আর কোথাও থমবেনা। সাদিক সাহেব অগত্যা তাই করলেন। কিন্তু সেখানেও কামড়া কামড়ি। যাই হোক অনেক অনুনয় বিনয় করে উঠে পড়লেন। তার সামনে একটা সিট পড়েছে আর বাকি সিট গুলো অনেক পিছনের দিকে কিন্তু সামনেই যেহেতু দুটি সিটি খালি আছে এখন তাই তিনি মেয়ে এবং স্ত্রীকে সেখানে বসিয়ে দিলেন। ছেলে আর বাবা বসলেন পেছনের দিকে।

জায়েদ হন্তদন্ত হয়ে বাসে উঠল ঠিক অল্পের জন্য বাসটা মিস করছিল। সিট খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলো তার সিটে একজন তরুণী বসে আছেন। সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তরুণীর চোখে চোখ পড়লো আবার নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। তরুণীর মা জিগ্যেস করলো

- কিছু বলবে।

-জি মানে ওই সিট টা আমার।

-দেখছনা দু জন মানুষ বসে আছি ।

-জি আমি বসবো কোথায়।

-তুমি অন্য কোথাও বস।

-কোথাও কোন সিট খালি নেই। -

-তাহলে বোনাটে বস।

-দেখুন আমি গত কাল অনেক দুর থেকে এসে টিকেট কেটেছিলাম যাতে বোনাটে বসতে না হ.........। হঠাত গাড়ি কষে ব্রেক। আর একদম সামনের দিকের সিটের সামনে কোন কিছু না থাকায় জায়েদ অনেকটাই তাদের দিকে ঝুঁকে গেলেন। সাদিক সাহেবের আর সহ্য হলোনা।

-এই ছেলে তোমার সমস্যা টা কোথায়। তোমার যদি কোন সমস্যা হয় কন্ট্রাক্টারকে বল। ওদের কে ডিস্টার্ব করছ কেন।

-দেখন আমিতো...।

বেয়াদব ছেলে...।

আবারো কষে ব্রেক। এবার সাদিক সাহেব যায়েদের উপরে উপর হয়ে পড়লো। জায়েদ কিছুটা সরে এসে কন্ডাক্টর কে বলল

- এই আমি বসবো কোথায়? কন্ডাক্টর কিছুটা নরম গলায় ভাই উনাদের গাড়ী নষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবার নিয়ে বিপদে পড়েছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনাকে একটা মোড়ার ব্যবস্থা করে দেই আপনি মোড়ার উপরে বসেন। জায়েদ মনে মনে হাসল অতিরিক্ত ইনকামের সুযোগ হলে তোমাদের গলার স্বরও নরম হয়ে যায়।

সাদিক সাহেব যেহেতু টিকেট করে উঠেন নাই তাই কন্ডাক্টর কিছু পথ যেতেই ভাড়া চাইলেন। ২৫০ টাকা করে চার জনের ১০০০ টাকা। সাদিক সাহেব পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন একি মানি ব্যাগ গেল কোথায়। ভিড়ের মধ্যে যখন তিনি অস্থির হয়ে টিকেট সন্ধান করছিলেন চোর মহাশয় সেই মহেন্দ্রক্ষনের সঠিক সদ্ব্যবহার করলেন। এখন কি উপায়। সামনের পিছনের বুক পকেট সব খুঁজলেন। স্ত্রীকে জিগ্যেস করলেন তোমার সাইড ব্যাগে কত আছে। তিনি ভ্রু কুচকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। সাদিক সাহেব বললেন

-আমার মানি ব্যাগ খোয়া গেছে।

-আমার কাছে তো নেই যা ছিল সব চাচির ঔষধ খরচের জন্য দিয়ে এসেছি।

-মা সুমু তোমার কি অবস্থা।

-বাবা আমার কাছে তো দেড় দুশোর বেশী হবেনা।

-সাহিল তোমার কাছে কত আছে? বাবা তুমি আমাকে স্কুলেই কখন ৫০ টাকার বেশী দাওনা আর এখন তো আছি হলিডেতে।

সব মিলিয়ে সাদিক সাহেব ২৫০ টাকা যোগাড় করতে পারলেন। বাকি টাকার কি হবে। কন্ডাক্টারকে বললেন যে গিয়ে দিয়ে দিবেন। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চাইলোনা। বরং তার নরম স্বরের রুক্ষতা প্রকাশ পেল। এই মাঝ পথে দাড়িয়ে কিবা করবেন। ঈদের পরে যে হারে মানুষ স্রোতের মত আসছে তাতে কিছু খালি পাবারও সম্ভাবনা নেই। পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখছেন একটা মাইক্রো ক্যাব দাড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে রিকুয়েস্ট করে গাড়ি থামালেন কিন্তু তারা পূর্ণ ভারা না দিলে যেতে দিবেনা। একটু পর তাও ফিকে হয়ে গেল কারণ সেই ক্যাবটি কোন অপেক্ষমাণ বরযাত্রীর জন্য সাজতে শুরু করছে । কনডাক্টর সিদ্ধান্ত দিয়ে দিল কিছু দূর সামনে আরেকটি বাজার আছে সেখানে ২৫০ নিয়ে তাদেরকে নামিয়ে দিবেন এবং তারা সেখান থকে নতুন যাত্রী নিবেন।

বাজার আসা মাত্রই সাদিক সাহেব দেখলেন এখানেও-তো অনেক যাত্রী বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। আরো কমপক্ষে ২৫০ মাইল গেলে ঢাকা পাওয়া যাবে। অনিশ্চিত এই পথে নেমে পড়া খুবেই ঝুকিপুর্ন তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নামবেন না। কিন্তু কন্ডাক্টর তাকে নেমেই ছাড়বেন। ড্রাইবারতো বাস বন্ধ করে বসে আছে তাদের নামার অপেক্ষায়। অনেক যাত্রীও অনুরোধ করলো ঢাকায় গিয়ে ওনারা টাকা দিয়ে দিবেন। কিন্তু তারা বিশ্বাস করছেনা। জায়েদ এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল। কন্ডাক্টর কে ইশারায় ডাকলেন। সে এসেই বলল

-ভাই এদেরকে নামাই দিয়াই আপনারে সিট দিমু।

- থেঙ্কু। কিন্তু এদের সমস্যা কি।

- দেখেন ভাই ভদ্র লোক মানুষ কিন্তু কি ভাঁওতাবাজি করছে। বাসে উইঠা বলে ভাড়া নাকি দিতে পারবোনা মানি ব্যাগ নাকি হারায়া গেছে।

- তো হারায়া যাইতে পারেনা। ভাই বুহুত দেখছি। এগুলা সব না দেওনের চক্কর।

- তো কি করতে চাও।

- আবার কি নামায়া দিমু।

-নামায়া দিলে উনারা যাবেন কেমনে।

-উনাদের রাখলে ভাড়া আপনে দিবেন?

-কত পাও উনাদের থেকে।

- ১০০০ টাকা মোট ভাড়া ২৫০ দিছে আরো ৭৫০ পাই।

-ঠিক আছে আমি দিব তবে এটা ওনাদেরকে বলা যাবে না ওকে। শুধু যাওয়ার আগে ওই ভদ্রলোকে বলবি বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। ওকে? ওকে ভাই।

কন্ডাক্টর ড্রাইভারের কানে কানে কি যেন বলল আর হঠাৎ করে গাড়ী চলতে আরম্ভ করল। সাদিক সাহেব কিছুটা ভীত হলেন এই ভেবে যে হঠাত কিছু না বলে গাড়ি চলতে শুরু করলো কেন! আবার ভাবল আল্লাহ ভরসা এত লোকের মাঝ খানে কোন ক্ষতি হবে না ইনশাহ আল্লাহ।

গাড়ি ঢাকায় ঢুকার কিছু দূর আগেই জায়েদ গাড়ি থেকে নেমে গেল আর সাদিক সাহেব তার শ্যালক কে বলল গাবতলিতে অপেক্ষা করার জন্য টাকা নিয়ে। গাবতলি বাসস্টেন্ডে নেমে সাদিক সাহেব কনডাক্টরকে ডেকে ভাড়া সাধলেন। কিন্তু একি সে বলল দেওয়া লাগবেনা। সাদিক সাহেব তো চোখ কপালে তুলে পেল্লেন একি বলে ছোকরা। -আপনার টাকাতো ওই ভাই দিয়া দিছে যার সাথে আপনি জগড়া করছিলেন। আর বলেছেন আপনাকে বলতে বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য। সাদিক সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।

তুই টাকা নিলি ক্যান?

টাকা না নিলে আপনাদেরকে তো ওখানেই নামায়া দিতাম।

তার পর জিগ্যেস করলেন সে কই। সে তো আগেই নাইমা গেছে।

ব্যাপারটা বাসায় আলোচনা হচ্ছে আসলে ছেলেটার সাথে তোমার অমন রুঢ় আচরণ ঠিক হয়নি, বলছিলেন মিসেস সাদিক। দেখ এত ঝামেলার পর ওই রকম কিছু হলে কি মাথা ঠিক থাকে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সবাই ব্যাপারটা ভুলে গেলেও সুমাইয়া ব্যাপারটা ভুলতে পারছে না। তাদের চোখাচখি হয়েছিল মাত্র এক বার সেখানে ভাষা বুঝার ব্যাপার ছিল না। কিন্তু যেখানে এক জন মানুষ ক্ষোভ থাকার কথা সেখানে সে নিজেকে আড়াল করে অন্যের উপকার করার ব্যাপারখানা অতটা সহজ নয়। কিন্তু কেন? সে ভাবছে তার এই উত্তরটা জানা দরকার।

to be continued....

বিষয়: বিবিধ

২৪৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File