পুকুর ঘাঁটে চাঁদের আলো।
লিখেছেন লিখেছেন ট্রাস্টেড থিফ ২৭ জুলাই, ২০১৩, ০২:৩২:৪০ রাত
বাড়ীর মাঝখানটা ঠিক যেখানে পকুরটাও ঠিক সেখানে। পুকুরের সামনের দিকটায় পাঁচ পরিবারের বাস। ডান পাশে এবং পিছন দিকটায় বিশাল বড় বাগান। বাম পাশে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী খাল। খালটা পার হলেই বিস্তীর্ণ ধানের খেত। খালের উপরে বাতাসের তোড়ে অস্থির ভাবে দুলছে কল্মি লতা আর হেলেন্সা। একটি ডিঙি নৌকা প্রান পনে চেষ্ট করছে বন্ধন ছিড়ে ছুটে যেতে দুরের মোহনায়। খালের স্বচ্চ পানিতে ছুটে চলছে পুটি মাছের ঝাঁক। একটি সাদা বক দূরে দাড়য়ে শিকারের অপেক্ষায়। শুভ আর রাজু দু ভাই আপন মনে হেলেন্সা তুলছে।
শুভ বলল
- ভাই ওই দেখ একটা বক।
- হুশ
-তুই ওরে তাড়াই দিলে ক্যান।
- তো কি হইছে
- অয় তোর কি ক্ষতি করছে।
শুরু হয়ে গেল দু ভাইয়ের জগড়া। তার পর এক জনের গায়ে আরেক জনের কাদা ছূড়া ছুড়ি। শুভ রাজুকে ধাক্কা দিয়ে কাদা মাটিতে ফেল দিল। রাজুও কম যায় না। শোয়া থকেই শুভকে ল্যাং দিয়ে ফেল দিল। দুজনেই গড়া গড়ি খাচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তার মা আসলেই দুজন দু দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। এরা দু ভাই প্রচন্ড রকম দুষ্ট। তাদের মা মাসুদা বেগম তাদের যন্তনায় এক প্রকার অস্থির। জগতের এমন কোন দুষ্টামি নেই যে তারা করে না।
তাদের মা দুজনকেই শাসিয়ে -
আজ দুজনের খাবার বন্ধ। আসবিনা ঘরে আজ দেখাবো মজা ?
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে মাসুদা বেগম চলে গেল। কাদা মাখা গায়ে রাজু খালের কিনারে বসে বসে ঢিল ছুড়ছে। শুভ পিছন থেকে ডাক দিল। ভাই! রাজু গোমড়া মুখ করে বসে আছে। শুভ আবার ডাক দিল
-ভাই আমার সাথে কথা কইবি না?
- কি বল।
-দেখ ভাই আকাশে রক্ত।
রাজু কিছুই বলছে না। শুভ আবারো বলল
- আচ্ছা ভাই। আকাশে রক্ত কেন।
-ওগুলা হাসন হোসেনের রক্ত।
- ভাই হাসান হোসেন কে?
- জানিনা। মনি কইছিলো অগুলা হাসান হোসেনের রক্ত।
- ভাই বাড়ীতে যাইবিনা। ঠান্ডা লাগতেছে আমার।
রাজুর মনে ছোট ভাইয়ের জন্য স্নেহের পরশ ভুলিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নিজের কাদা মাখা জামা খুলে ছোট ভাইয়ের গায়ে জড়িয়ে দেয়।
- চল বাড়ী যাই।
- মা যদি মারে।
-তোর কারনেই তো এমন হল।
- সব দোষ আমার?
- আচ্ছা ঠিক আছে বাদ দে।
ঘরের সামনে এসে দু ভাই ঠাণ্ডায় কাঁপছে। ভিতরে ঢুকার সাহস পাচ্ছে না। চুপি চুপি কথা বলছে দুজনে। শুভ বলল তুই আগে যা। রাজু বলল না তুই আগে যা। তাদের কথাগুলো বেড়ার ফাঁক গলে মাসুদা বেগমের কানে পোঁছাল। মাসুদা বেগম দরজা খুল্লেই দুজনে দু দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর আবার দুজনে সেই কাঁদা মাখা শরীরে দরজার সামনে দাড়াল। বাহির থেকে মা মা করে ডাকছে। ছোট দু ভাইকে এই ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বড় বোন রুপার আর সহ্য হল না। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
-ভেজা শরীরে ওদেরকে আর কতক্ষন দাঁড় করাইয়া রাখবা মা।
নিজ হাতে দু ভাইকে পুকর ঘাটে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে আনল রুপা। গৃহকর্তা জামাল হোসেন ঘরে আসা মাত্রই ছেলেদের নিয়ে মাসুদা বেগমের অভিযোগের ফিরিস্থি বর্ননা দিতে শুরু করল। জামাল হোসেন কিছুক্ষণ ছেলেদের বকাবকি করলেন। এবার রাত্রির খাবার আয়োজন-
ঘরের পাশে চোট্র রসুই ঘর। এখানেই পাটি বিছিয়ে দুই ছেলে, বাবা আর মেয়ে খেতে বসেছে। মাসুদা বেগম একটি পিঁড়িতে বসে সবাইকে পরিবেশন করছে। আজকে তাদের খাবারের জন্য যা আছে- হেলেন্সা আর ডাল -ভাত। শুভ বলল
- মা প্রতিদিন হেলেন্সা দিয়ে ভাত খতে ভালো লাগে না। আজকে তো কই মাছ রান্না করেছো। মাছ দাও।
- মাছ দেওয়া যাবে না।
রাজু ছোট ভাইকে সমর্থন করে বলল
-কেন মা?
তোর বুবুকে দেখতে কাল মেহমান আসবে। এগুলো তাদের জন্য।
- একটুখানি দাওনা মা? একটু খানি দিলে কি হয়?
- না আজ না। পরে।
শুভ এক গুয়ে। মাছ ছাড়া সে ভাত খাবেই না। জামাল হোসেন চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষন। ধমক দিয়ে বললেন
-যা দিয়েছে তা দিয়েই খেয়ে উঠ।
বাবার এক ধমক খেয়েই মুখটা চুপসে গেল দু ছেলের। বিনা বাক্যেই খেয়ে উঠল দুজনে। মায়ের মনে যে একটুও খারাপ লাগেনি তা নয়। অবুঝ দুটি বাচ্চার এই টুকু আবদার পুরন করার ক্ষমতাও যে তার নেই। ওই দিকে মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে বিয়ে না দিতে পারলে পরে আর রক্ষা নেই। অথচ তাদের পরিবারের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। কয়েক বছর আগেও জামাল হোসেন যখন একটি চিনির কলের তৃটীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসাবে কাজ করতো তাদের শংসারে ছিলোনা খুব বেশি আভাব। চাহিদাও ছিল না খুব বেশি। অলাভজনক প্রতিষ্টানে পরিনত হওয়ায় কয়েক বছর আগে বন্ধ গেছে এই মিলটি। তার পর থেকে টুক টাক এখানে সেখানে কাজ করছে।
শুয়ে শুয়ে গল্প করছে দুইভাই-
আচ্ছা ভাই বুবুর বিয়েতে আমরা কি নুতুন জামা পরব?
- হাঁ নতুন জামা পরবো। অনেক মজার মজার খাবারও খাবো।
-সত্যি বলছো ভাই।
- তুই দেখস নাই রবিনের বোনের বিয়েতে সে কত সুন্দর সুন্দর জামা পরেছে।
-হুম। কিন্তু তাদের তো অনেক টাকা।
রাজুর কাছে এর উত্তর অজানা। তবুও তার দু চোখ জুড়ে শুধুই স্বপ্ন। যাদুর কাঠি নিয়ে যাবে তাদের পরীর দেশে। দু ভাই মিলে রঙ বেরঙের জামা পরে গুরে বেড়াবে । মেঘের ভাঁজে ভাঁজে উড়ে বেড়াবে আর তৃপ্তি ভরে খাবে পিন্নি পায়েস আরো কতো কি।
মেহমানরা রুপাকে পচন্দ করেছে কিন্তু বাদ সাদল যৌতুকের বিশ হাজার টাকা। জামাল হোসেনের ঘর ভিটেটাইতো বাকি। নিজেই চলতে পারছেনা এত টাকা জোগার হবে কোত্থেকে। টাকাটা বিয়ের আগেই দিতে হবে। জামাল হোসেন চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়। প্রয়োজনে ধার দেনা করে হলেও সম্বন্ধটা করতে চাচ্ছেন তিনি। সারাদিন দু ভাইয়ের দোড়দুড়ি আর ছুটাছুটি পর
-মা খিদা লাগছে খাইতে দাও।
-মেহমানরা এখন যায় নাই। ততক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে আয়।
মনের আনন্দে দু ভাই পুকর ঘাটে গেল। পুকুরে বরষার অথৈ জলে পানি থৈ থৈ করছে। ঘাটের পাশে কছু পাতা গুলো পানির নিছে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হিজল গাছের নুয়ে যাওয়া ডাল গুলো কে পানি ছুয়ে দিচ্ছে বার বার। শুভ বলল
-ভাই জানিস আজকে অনেক মজার মজার খবার খাবো আমরা।
- ওরা তো সব খেয়ে ফেলেছে।
- মা আমাদের জন্য মাছ ভাজা রেখে দিয়েছে।
-তাই?
-ভাই এই দেখ একটাকার একটা সিকি।
- কোথায় পেয়েছিস
- ওইখানে
আমাকে দে বলে রাজু থাবা দিতে গেল সিকিটা পানিতে পড়ে যায়। শুভ কান্না শুরু করলে আচ্ছা আমি তোকে এক্ষনি তুলে দিচ্ছি কান্না থামা। রাজু হাটু পরিমান পানিতে কাঠের গুড়িতে নেমে সিকি খুজতেছে। হটাৎ করে কাঠের গুড়ি থেকে তার পা পিছলে যায়। রাজু পানিতে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। তার হাত দুটি পানির উপর উঠছে আবার ডুবে যাচ্ছে। শুভ তার হাত দুটি ধরার প্রান পনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুভ এখন গাছের সে গুড়ীতে নেমে গেছে। আর একটু। এইত ধরে পেলেছি। না আরেকটু। হাঁ ধরতে পেরেছি। কিন্তু না ততক্ষনে তার পাটাও যে কাঠের গুড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।
মাসুদা বেগম মেহমানদের বিদায় দিতে দিতে সন্ধ্যা পার করে দিলেন। ছেলে গুলা এখন ঘরে আসলোনা কেন! কোথায় গিয়ে দুষ্টামি- বন্দ্রামি করতেছে কে জানে। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজেও কোথাও পাওয়া গেলনা তাদের। তাদের সব সমবয়সীদের জিগ্যেস করল জামাল হোসেন। না কোথাও নেই। হঠাৎ মনে হল মাসুদা বেগমের তাদেরকে সে পুকুর ঘাঁটে পাঠিয়েছিল হাত মুখ ধোয়ার জন্য। সারা পুকুর জুড়ে জ্যোৎস্নার আলো। সারা পুকুরের আশে পাশে দেখলো। একি ওটা কি দেখা যায় হিজল পাতার সাথে। মাসুদা বগমের বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। ভালো করে খয়াল করলেন মনে হল কেউ তার কলিজা এক টানে ছিড়ে ফেলেছে। পাগলের মত জাপিয়ে পড়লেন পুকুরে। এযে আমার শুভ। শুভ তখনো ভাইয়ের হাত ধরে আছে। এ যেন যনম যনমের অকৃতিম বন্ধন।
মাসুদা বেগম আজ বড় একা। মেয়ে পরের বাড়ীতে। স্বামীও অতীত হয়ে গেছে। শুধু সেই পুকর ঘাট টা আছে। মাসুদা বেগম পকুরের ঘাটে বসে আছেন । চাঁদের আলো জ্বলমল করছে। একটি হিজল পাতা পানির উপর নিশব্দ্বে পড়ল। আর হারিয়ে গেলে সবার অজান্তে।
বিষয়: বিবিধ
২৪৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন