সহজ সরল ভালোবাসা ...
লিখেছেন লিখেছেন অন্য আমি .। ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩৩:১৯ দুপুর
হযরত খাদিজা (রা.)-এর ওফাতের পর সাওদাকে বিয়ে করে ঘরে আনেন রাসূল (সা.)। তার পরও এক নিদারুণ শূন্যতা রাসূলের হৃদয় বিষাদমলিন করে তুলছিল। মরুর স্তব্ধ আকাশ অশ্রুর শিশির হয়ে তার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিচ্ছিল। দৃশ্যমান উদাসীনতা নিয়ে দুপুরের অগ্নিঝরা নিস্তব্ধতায় তিনি তাকাতেন জ্বলন্ত প্রকৃতির দিকে। নির্বাক পাহাড় এবং মরুদ্যানের প্রগাঢ় নীলিম ছায়া কোনখানেই তিনি একগুচ্ছ সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রতিপ্রাণা খাদিজা তার বুকে যে বিরহের সুর জাগিয়ে গেছে মরুর দুরন্ত ঝড় হয়ে তা হৃদয়কে দুমড়ে মুছড়ে তছনছ করে দিচ্ছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর এমন অবস্থা দেখে একদিন তার খালা খাওলা (রা.) বললেন, ‘আবুল কাশেম! আপনি আবার বিয়ে করুন।’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘বিয়ে তো করেছি, আবার তা নিয়ে কথা বলছেন কেন?’ খাওলা বললেন, ‘আমার মন বলছে এ বিয়েতে আপনার অন্তরে পূর্ণ আনন্দ আসেনি। আমার সন্ধানে কুমারী মেয়ে আছে। আপনি তার মধ্যে হৃদয়ের প্রশান্তি খুঁজে পাবেন। রাসূল (সা.) জানতে চাইলেন, ‘কে সেই রূপবতী কুমারী?’ খাওলা বললেন, ‘আপনার একান্ত সহচর হযরত আবু বকরের কন্যা। তন্বী গুণবতী আয়েশা। আপনি সম্মতি দান করুন, বাকিটা আমি দেখব।’
প্রিয়সঙ্গী আবু বকরের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন নবী (সা.)। আয়েশাকে তিনি জানতেন। তার আগমন টের পেলে খেলার সাথীদের নিয়ে পালিয়ে যেতেন আয়েশা। একদিন আয়েশা পুতুল খেলায় মগ্ন ছিলেন। খুব সাবধানে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন রাসূল (সা.)। আয়েশাকে চমকে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার হাতে ওটা কি?’ আয়েশা জবাব দিলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন এটা একটা ঘোড়া। তবু প্রশ্ন করছেন কেন হে আল্লাহ্র নবী?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘এ জন্য প্রশ্ন করছি যে এটা আবার কেমন ঘোড়া। ঘোড়ার আবার পাখির মত পাখা থাকে নাকি?’ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে জবাব দিলেন আয়েশা। ‘অবশ্যই, ঘোড়ারও পাখা থাকে। আপনি কি জানেন না সোলায়মান নবীর ঘোড়ার কথা। ওনার ঘোড়ার তো উড়বার পাখা ছিল। আমার ঘোড়ারও তেমন পাখা আছে। জানেন হযরত, আমার ঘোড়াও মাঝে মাঝে আকাশে উড়ে বেড়ায়।’ আয়েশার কথায় বড়ই পুলকিত হলেন রাসূল (সা.)। এক চঞ্চলা কিশোরীর প্রতিভার প্রোজ্জ্বল দ্যুতি তাঁর বিশাল হৃদয়ে ঢেউ তুলল।
একদিন সুযোগ মত আবু বকরের কাছে কন্যার বিবাহ প্রসঙ্গে আলাপ তুললেন হযরত খাওলা। প্রস্তাব শুনে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠল আবু বকরের মুখমন্ডল। কিন্তু একটু ভেবে তিনি ব্যথিত মনে বললেন, ‘বুদ্ধিমতি খাওলা , ভালোই প্রস্তাব এনেছেন আমার কন্যার জন্য। কিন্তু একটা কথা কি ভেবে দেখেছেন? ধর্মীয় ভাই হয়ে তিনি কি করে আমার আয়েশাকে বিবাহ করবেন। বিষয়টি আমার নিকট বেশ ঝামেলার মনে হচ্ছে। আর একবার না হয় নবীজীর সাথে কথা বলুন। নবী তো কোন প্রকার অসামাজিক কাজ করতে পারেন না। সম্পর্কে তিনি হচ্ছেন আয়েশার চাচা।’
খাওলার কাছে হযরত আবু বকরের প্রতিক্রিয়া জানতে পেরে চেহারায় অপরিচিত গাম্ভীর্য প্রকাশ করে রাসূল (সা.) বললেন, ‘এটা হল অন্ধকার যুগের লালিত কুসংস্কার। ধর্মীয় ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করা শরিয়তে নিষেধ নেই। আবু বকর আমার রক্ত সম্পর্কের ভাই নয়। সে আমার ঈমানের পথে জাগ্রত সহযোদ্ধা।’
রাসূলের মতামত জানতে পেরে তার কাছে কন্যাকে অর্পণ করার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে উঠল আবু বকরের হৃদয়। রাসূলের মুখে মিরাজের অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনে যিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নিয়েছিলেন, তিনি সহজেই উপলব্ধি করতে পারলেন জাহেলী জামানার অন্ধকারকে দূরীভুত করার এটাই উপযুক্ত সুযোগ। এ সুবর্ণ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা চলেনা। কতই না খোশনসীব তার! হাবিবে দোজাহান, সাদেক-মাসদুক, সারওয়ারে কাওনাইন তার আদরের বেটিকে মিসবাহুল মুকাররিবিন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়ে গৃহে এসে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিভৃতে ডেকে মনের কথা জানালেন আবু বকর (রা.)। হৃদয়ের উচ্ছ্বাস সংবরণ করে তিনি তাকে বললেন, ‘আজ একটা দারুণ খুশীর বার্তা বয়ে এনেছি আমার উম্মে রাওমান। তুমি কি শুনতে চাওনা সে বিষয়টি কি?’ ‘রাসূলের কাছে শোনা প্রতিটি খবরই তো খুশীর। জান্নাতের সীমাহীন নাজ নিয়ামাতের বর্ণনা প্রতিদিন তিনিই তো শুনিয়ে থাকেন। সারাটা দিন অধীর আগ্রহে সেই অনাগত জিন্দেগীর শুভ সংবাদের প্রতীক্ষায় তো বসে থাকি’-অত্যন্ত শান্তচিত্তে উচ্চারণ করলেন উম্মে রাওমান। হযরত আবু বকর (রা.) স্ত্রীকে হৃদয়ের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘হে আমার জীবন সাথী, তুমি শুনে অত্যন্ত খুশী হবে, খোদার হাবীব আমাদের আয়েশাকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এর চেয়ে খুশীর সংবাদ আর কি থাকতে পারে!’ তার কণ্ঠ হতে তরঙ্গের চপল শব্দের মত কথাগুলো গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তমা স্ত্রীর কানে। তিনি স্বামীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ধৈর্য্য ধারণ করুন আমার কোমল-হৃদয় স্বামী। নবীজীর সাথে আয়েশার বিয়ে তো পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আমি চিন্তা করছি এ ঘটনার পেছনে আল্লাহ্র মহান কোন উদ্দেশ্য নিহিত আছে।’
স্ত্রীর সাথে মত বিনিময় করে শ্রদ্ধাভাজন পিতা আবু কোহাফার শয্যার পাশে গিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়ালেন নবী সহচর সদালাপী আবু বকর (রা.)। অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আববাজান, আয়েশাকে শাদীর জন্য খাওলাকে দিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন রাসূল (সা.)। এতে উম্মে রাওমানের অসম্মতি নেই। এখন আপনার অভিপ্রায় বলুন।’ পুত্রের কথা শুনে আবু কোহাফা বড়ই পুলকিত হলেন। তাঁর শ্মশ্রূমন্ডিত অবয়বে একগুচ্ছ স্বপ্নীল মেঘ ভেসে উঠল। তিনি বললেন, ‘আরে এত বড় সরফরাজির কথা। আমার আয়েশা মাহবুবে মাশরিকাইনের হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী হবে এতে ভাবার কি আছে। কিন্তু যুবাইর ইবনে মাতয়াকে যে আমি কথা দিয়েছি। তোমাকে এতদিন তা বলিনি। তার পুত্রের সাথে আয়েশার বিয়ের বিষয়ে প্রতিজ্ঞায় জড়িয়ে আছি। আমি যুবাইরকে আগে জিজ্ঞাসা করে নেই। তারপর তোমাকে জানাব আমার বিনয়ী পুত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ একটা উপায় করে দেবেন।’
মরুসূর্যের প্রদীপ্ত আলো মুহাম্মদের (সা.) সাথে অবিশ্বাসী যুবাইর তনয়ের তো কোন তুলনা হয়না। তবু ওয়াদা রক্ষার জন্য তিনি যুবাইরকে ডেকে পাঠালেন। সে এলে তিনি তাকে বললেন, ‘দেখ যুবাইর, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। তবু বলছি, পুত্রের বিবাহ নিয়ে কি ভাবছ? ওয়াদার কথা কি মনে আছে তোমার? আয়েশাকে পেতে হলে তোমার পুত্রকে তার দ্বীন গ্রহণ করতে হবে। ভেবেচিন্তে যা বলার এখনই বলে যাও।’
বৃদ্ধের কথায় অপ্রস্ত্তত হল যুবাইর। যে ইসলামের গতি রোধ করার জন্য তার সকল শক্তি নিয়োজিত তা বরণ করবে তার প্রাণাধিক পুত্র! কখনই তা হতে পারেনা। কী এমন সুন্দরী আবু বকরের মেয়ে ক্ষীণকায়া আয়েশা! কত রূপবতী রমণী তার পুত্রের গলায় মালা পরাবে। মাথা তুলে কণ্ঠে কাঠিন্য এনে জবাব দিল যুবাইর, ‘শুনুন মতিভ্রম বৃদ্ধ আবু কোহাফা, ধর্মত্যাগীর সাথে আমার কোন ওয়াদাই পালনযোগ্য নয়। আমি চাইনা বিবাহের সূত্র ধরে আমার পুত্র বিধর্মী হয়ে যাক। যারা বাপদাদার ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’
রাতে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখলেন রাসূল (সা.)। রেশমী রুমালে মোড়ানো একটি মনোরম বস্ত্ত তাকে এনাম দিচ্ছে একজন ফিরিশতা। চিত্তাকর্ষক সে রুমাল হাতে নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কি আছে এর ভেতর ?’ ফিরিশতা তা খুলে দেখার জন্য অনুরোধ করল। রুমালের ভাঁজ খুলে অবাক হলেন রাসূল (সা.)। তার মসৃণ পেলবতায় আয়েশার অনবদ্য প্রতিরূপ শোভা পাচ্ছে। এই রহস্যময় স্বপ্নের দ্বারা রাসূল(সা.) আল্লাহ্র নিগুঢ় নির্দেশনা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন। এ ঘটনার ফলশ্রুতিতে তার অন্তরের গভীরে লাবণ্যময়ী সে বালিকার পুষ্পিত মুখচ্ছবি মুদ্রিত হয়ে গেল।
কয়েকদিন পর নিমন্ত্রিত হয়ে খাওলা গেলেন আবু বকর (রা.)-এর বাড়িতে। তাকে দেখে আবু কোহাফা উল্লাসিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘কী সৌভাগ্য আমার! আনন্দের সওগাত নিয়ে বনের বিহঙ্গ খাওলা এসেছে। তোমরা কে কোথায় আছ, আরে দেখনা কে এসেছে! ও যে আলোর প্রদীপ জ্বেলে আমার আঙিনা উজ্জ্বল করেছে। কার বিয়ের পয়গাম নিয়ে ও এসেছে তোমরা কি তা জান? সে যে মরুর রাজা জান্নাতের নন্দিত মেহমান। কোথায় বসতে দেবে এ সম্মানিতা ফুফু খাওলাকে। আমার ভাঙ্গাঘরে তাকে বসাবার মত উপযুক্ত স্থান তো নেই।’
বিবাহের নির্ধারিত দিনে রাসূল (সা.) কে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন আবু বকর। তিনি যাওয়া মাত্র সকলেই মারহাবান ইয়া রাসূলুল্লাহ, আহলান সাহলান বলে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বাহিরে সাথীদের নিয়ে খেলায় ব্যস্ত ছিলেন আয়েশা। তাকে ডেকে নিয়ে ধাত্রী হাতমুখ ধোয়ালেন। তারপর পরিপাটি করে সাজিয়ে বিবাহ মজলিসে বসিয়ে দিলেন। আয়েশা গিয়ে বসল দাদু আবু কোহাফার কোলে। উপস্থিত লোকদের সামনে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে হৃদয়ের অভিব্যক্তি তুলে ধরলেন আবু বকর (রা.)। তিনি বললেন, ‘আপনারা জানেন মুহাম্মদ (সা.) আমাদের পথপ্রদর্শক। তিনি অন্ধকার থেকে আমাদের আলোর ভুবনে নিয়ে এসেছেন। অনেকদিন থেকে আমি তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলার বাসনা হৃদয়ে পোষণ করছি। তারই ফলস্বরূপ আমার কন্যাকে তার সাদীতে পেশ করছি। এই নিষ্পাপ শিশুদের নিয়ে কত যে কুনীতি আমরা প্রবর্তন করেছি। ওদেরকে মাটিতে পুঁতে ফেলি, দেব-দেবীর সামনে নির্দয়ভাবে হত্যা করি। বন্ধুর মেয়েকে এ সমাজে তো কেউ বিয়ে করতে পারেনা। আরব সমাজ থেকে সমস্ত কুপ্রথা মুছে ফেলার জন্য আয়েশাকে রাসূল (সা.) এর বরকতময় হাতে তুলে দিলাম। তার সান্নিধ্যে থেকে জগতের বুকে ইসলামের সুমহান আদর্শ সে ছড়িয়ে দিতে পারবে।’ তখন সবাই খোদার দরবারে প্রার্থনা করলেন আয়েশার বিয়েকে উপলক্ষ করে জগতের বুকে সেই মহাকল্যাণ নেমে আসুক।
বিবাহের পর আয়েশা তিনবছর পাঁচ মাস পিতৃগৃহে অবস্থান করেন। এ সময় মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র চল্লিশ জন। এদের উপর মক্কার কাফিররা নির্মম অত্যাচার চালাতে লাগল। রাসূল (সা.) কে কন্যা দেওয়ার কারণে আবু বকরের সামাজিক মর্যাদাকে উপেক্ষা করে তার উপরও তারা নির্যাতন করা শুরু করল। রাসূল (সা.) মুসলমানদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। আবু বকর (রা.) হিজরত করার মনস্থ করলেও রাসূলের সম্মতি না থাকায় মক্কায় রয়ে গেলেন। এক রাতে আল্লাহ্র নির্দেশে তাকে নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন রাসূল (সা.)। মদীনায় এসে সুন্নাহ নামক এক পল্লীতে ঘর তৈরি করলেন আবু বকর (রা.)। মসজিদে নববীতে রাসূল (সা.) এর জন্য হুজরা নির্মিত হলে তাদের পরিবারকে মক্কা থেকে মদীনায় নিয়ে আসা হল। মদীনার নতুন পরিবেশে পরিবারের অন্যান্যদের মত অসুস্থ হয়ে পড়লেন আয়েশা। তিনি এতটা রুগ্ন হলেন যে বাঁচার সম্ভাবনাই থাকল না। মরুর তীব্র জ্বরে তার মাথার চুল ঝরে গেল। পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে আয়েশার সাত মাস লেগে গেল। আয়েশা সুস্থ হয়ে উঠলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তার রুছুমাত সম্পন্ন হল। বিবাহের প্রায় চার বছর পরে রাসুলগৃহে পা রাখলেন বিবি আয়েশা (রা.)।
বিদ্ব্যান পিতার তত্ত্বাবধানে আয়েশার জ্ঞানচর্চার যাত্রা শুরু হয়েছিল। শাফা বিনতে আবদুল্লাহ আদকিয়া নামক এক বিদূষী মহিলাকে তার শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ করেছিলেন আবু বকর (রা.)। রাসূলের সান্নিধ্যে এসে আয়েশার জ্ঞানতৃষ্ণা বিপুলভাবে বেড়ে গেল। মুখে মুখে কোরআন শিখে তিনি তৃপ্ত হতে পারলেন না। বিশিষ্ট হস্তলিপিকার জোকওয়ান এর কাছে আক্ষরিক জ্ঞান অর্জন করে রহস্যবারিধির তরঙ্গহিলোলে তিনি সাঁতার কাটতে লাগলেন।
বিয়ের পর প্রায়শই আয়েশাকে সাথে নিয়ে খাবার খেতেন রাসূল (সা.) একই থালায়। আয়েশা যে হাড় ফেলে দিতেন রাসূল তা কুড়ে নিয়ে পরম আনন্দে চুষে খেতেন। শিশুর মত প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিতে একই গেলাসে তারা পানি পান করতেন। যখন ঘরে তেল থাকত না তখন দুটি প্রসন্ন হৃদয় অাঁধারের পর্দা ঠেলে আলো হয়ে জ্বলে উঠত। অনুসন্ধানী চোখে অাঁচ করতেন আয়েশা (রা.), রাসূলের লাবণ্যের সাথে পূর্ণিমার শশী কখনই তুলনীয় হতে পারেনা। আয়েশার কামরা ছিল মসজিদে নববী সংলগ্ন। সেখান থেকে কান লাগিয়ে রাসূলের প্রতিটি নছিহত তিনি মন লাগিয়ে শুনতেন। ইসলামী সমাজ বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে উদ্ভূত সমস্যা, নবুওতের ধারাবাহিকতায় কোরআন নাযিলের সামঞ্জস্য এবং ইসলামী জীবনাচার সম্পর্কে রাসূলের অভিমত তিনি হৃদয়পটে চিত্রিত করে রাখতেন। রাতের শেষ প্রহরে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন রাসূল (সা.)। এ সময় তিনি কোমল কণ্ঠে ডেকে আয়েশাকেও জাগাতেন। ছোবহে সাদেক হলে ফজরের সুন্নত পড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতেন রাসূল (সা.)। এ সময় তিনি ডান কাতে শয়ন করে আয়শাকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মর্মার্থ, ইসলামের গভীরতর উপলব্ধি এবং এলমে মারিফাতের ভেদতত্ত্ব তিনি খুটে খুটে আলোচনা করতেন।
রাসূল (সা.) যেমন আয়েশাকে নানারকম রহস্যপূর্ণ কথা বলে জ্ঞান তথা আনন্দ দান করতেন তেমনি আয়েশাও সরস এবং চটুল গল্প বলে রাসূল (সা.)কে প্রসন্ন রাখত। একদিন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ্র নবী, আজ আপনাকে একটি মজার কিস্সা বলব। যা আপনি কখনো শোনেননি। একদিন এগার সখী নির্জন জায়গায় বসে নানারকম গল্প করছিল। তখন এক সখী বলল, ‘চল আজ আমরা স্বামীদের সম্পর্কে কথা বলি। শুনিনা কার স্বামী কেমন। কোন দুলাভাই কোন মেজাজের জানলে একটু ভাল হয়না?’
তখন প্রথম সখী বলল, ‘আমার স্বামী যেন উটের মাংস। আর সে এতটা ভারী মেজাজের যে মনে হয় সারাদিন পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকে। সে হাতের নাগালে বিচরণ করেনা যে কেউ তার কাছে যাবে, আর সে তেমন রুচিকর নয় যে কেউ তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে।’ দ্বিতীয় সখী বলল, ‘ভাই, আমার স্বামীর কথা বলতে গেলে তিনদিন তিনরাত লেগে যাবে। তাতে তোমাদের ধৈর্য থাকবে না আর ভেতরের অনেক তিক্ত কথা প্রকাশ হয়ে যাবে। তার চেয়ে তোমাদের গল্প বলে যাও।’ তৃতীয় সখী মলিন বদনে বলল, ‘তার কথা কী বলব ভাই। ওর মেজাজ খুব খারাপ। তার বিষয়ে কিছু বলেছি জানতে পারলে আমাকে হয়ত তালাক দিয়ে দেবে। স্বামী থাকার পরও তোমরা আমাকে বিধবা বলতে পার।’ চতুর্থ সখী পা নাচিয়ে খুশীতে আত্মভোলা হয়ে বলতে লাগল, ‘আমার স্বামী হিজাজের রাতের মত; না গরম না ঠান্ডা। না নির্জনতার নির্ঘুম কষ্ট, না ভীতিকর রাতের ক্লান্তিময় অবসাদ।’ পঞ্চম সখী বিষণ্ণ কন্ঠে বলল, ‘কী বলব আমি! আমার স্বামী ঘরের ভেতর বনের চিতা। আর বাইরে সে যেন রক্তলোলুপ হিংস্র হায়েনা। সে যা করতে চাবে কোন না কোন ভাবে করেই ছাড়বে।’ ষষ্ঠ সখী দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমার স্বামী বড় পেটুক। যা সামনে থাকে সবই খেয়ে ফেলে।’ সপ্তম সখী বলল, ‘আমার স্বামীর কথা কী বলব! আমাকে মেরে জখম করা আর থালাবাসন ভেঙ্গে চুরমার করা ছাড়া তার কোন কাজ নেই।’ চোখে স্বপ্নের রঙধনু এঁকে অষ্টম সখী বলল, ‘ওর কথা কী বলব! ওত আমার মনের ভেতর মেঘের নরম পালক। জ্যোস্না রাতে বনের প্রান্তে ফুলের মাতাল সুগন্ধ।’ নবম সখী গর্ব করে দেমাগ দেখিয়ে বলল, ‘আমার স্বামী একজন ধনশালী ব্যক্তি। শুধু কী তাই! সে অকৃত্রিম দাতা এবং অকুতোভয় বীরও বটে।’ দশম সখী বলল, ‘আমার স্বামীর ধনের কথা কী বলব। কোনকিছুরই অভাব নেই তার।’ সব সখীদের কথা বলা শেষ হলে একাদশ সখী বলতে লাগল, ‘আমার স্বামীর নাম আবুজর। সে সর্বদা দামী অলংকারে আমাকে সাজিয়ে রাখে। গভীর মমতা আর অনাবিল প্রেমে আমার মনের ভুবন সে রাঙিয়ে তোলে। সারাদিন কত দাস-দাসী নিয়োজিত থাকে আমার সেবা করার জন্য। তার হৃদয়বান পিতামাতা মধুর কথা বলে আমাকে মুগ্ধ করে । তার বিনয়ী সুশ্রী সন্তানেরা কখনও আমার অবাধ্য হয়না। এমন সুন্দর স্বামী পেয়ে খুব গৌরব বোধ করি আমি।’
অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে এ গল্প শুনে বড় খুশী হন রাসূল (সা.)। তিনি আয়েশাকে চোখের সামনে বসিয়ে বলেন, ‘শোন আমার মধুকণ্ঠী প্রিয়তমা আয়েশা! আমিও তোমার সাথে তেমন আচরণ করছি যেমন আবুজর করে থাকে তার সুন্দরী স্ত্রীর সাথে। এ বিষয়ে তোমার মনে কি কোন সন্দেহ আছে?’ লজ্জায় লাল হয়ে আয়েশা রক্তিম জবার মত রাসূলের চরণে নুয়ে পড়ে। মানবতার দিশারী, মরু-সম্রাট রাসূলের সাথে কারো ভালবাসার তুলনা হতে পারে।
একদিন বিকেলের আলোর ঝিলিক ঠোঁটে মেখে আয়েশা রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন। হযরত! মনে করুন দু’টি সবুজ প্রান্তর। তার একটিতে সারাদিন পশুরা চরে বেড়ায়। যার জন্য তার ঘাস অবিন্যস্ত এবং বিবর্ণ। আর অপর প্রান্তরটি অক্ষত এবং ঘাসের কোমল মখমলে ঢাকা। হে আল্লাহ্র হাবীব! কোন মাঠে উট চরাতে আপনি বেশী পছন্দ করবেন?’ রাসূল (সা.) আয়েশার কথার অন্তর্নিহিত আবেদন বুঝতে পারলেন। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘চির সবুজ সুশীলা আয়েশা আমার! মনে হয় আমি দ্বিতীয় প্রান্তরটিতে উট চরাতে বেশী পছন্দ করব।’
লেখক : ডা. এসএসিএমও, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমপ্লেক্স, ফুলবাড়ী, কুড়িগ্রাম।
বিষয়: বিবিধ
২০৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন