কুরআন এবং আপনি পর্ব -৪
লিখেছেন লিখেছেন অন্য আমি .। ২৬ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:৫৯:১৬ সকাল
সূরা বাকারা আয়াত ৭৯ এ আল্লাহ বলেন,
“অতএব তাদের জন্য আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ – যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্য।”
পৃথিবীর অনেক ধর্মের ঐশী বাণীই মানুষ কাঁটাছেড়া করে বিকৃত করেছে, এটি একটি চিরাচরিত ঘটনা যা ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। আর এর ফলে ধর্মের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে, রটেছে দুর্নাম। পশ্চিমে ধর্মীয় চিন্তাধারা আর বিজ্ঞানের মাঝে যে প্রকট দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রকৃতিপূজারি রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টধর্মের প্রবেশ ঘটে চতুর্থ শতাব্দীতে। খ্রৃষ্টধর্মের প্রকৃত একত্ববাদের শিক্ষা দ্বারা পৌত্তলিক রোমানদের প্রভাবিত করার পরিবর্তে খৃষ্টধর্ম নিজেই পৌত্তলিকদের রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন রোমান সম্রাট হিসেবে কন্সটানটাইন, খৃষ্ট আর রোমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস কে মিশ্রিত করে এক সংকর ভাবধারার প্রচলন করে। ফলাফল, আজকের বিকৃত খৃষ্টধর্ম, যা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার পুরো ইউরোপ জুড়ে। পুরো মধ্যযুগব্যাপী “খৃষ্টধর্মের” এই রূপের আড়ালে ক্যাথোলিক চার্চ ইউরোপে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা একাধারে নিয়ন্ত্রণ করতো। এর ফলে বাইবেলের ব্যাখ্যায় পোপের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয় এবং সে হিসেবে পোপ হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। খৃষ্টধর্মের কিতাবের বাণী নয় – বরং পোপের ব্যাখ্যাই ছিল সমস্ত ধর্মীয়, বৈষয়িক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উৎস।
যাহোক ১৫’শ শতকের দিকে, ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে। এই “প্রোটেস্ট” বা প্রতিবাদের মূল আপত্তি ছিল ত্রিতত্ত্ববাদ(trinity), স্বীকারোক্তি(confession)১ ইত্যাদি ধারণা – যা প্রকৃত খৃষ্টধর্মের অংশ নয়। মার্টিন লুথার, কেলভিন প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ যে সংস্কার নীতিমালা প্রস্তাব করেন তাতে তৎকালীন প্রচলিত খৃষ্টধর্মের অনেক রীতিনীতির বিরোধিতা করা হয়। ঐশ্বরিক বাণীর ব্যাখ্যায় পোপের একচেটিয়া আধিপত্যের উপর অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়। আরও কিছু বিষয় যেমন ত্রিতত্ত্ববাদ বা ট্রিনিটি(trinity) কেও বাতিল ঘোষণা করা হয় – যা রাসূল ঈসা(আঃ) এর আনীত শিক্ষার পরিপন্থী। এই পর্যায়েই রোমান ক্যাথোলিক চার্চ থেকে ভিন্ন মতাদর্শী নতুন আরেক ভাবধারার খৃষ্টান চার্চের আবির্ভাব হয়। যার নাম “প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ” (ইংরেজি ‘protest’ শব্দ থেকে উদ্ভূত)। এটি ছিল যীশুর ( ঈসা(আঃ) ) প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করার প্রাথমিক পরিণাম।
এ ঘটনার দু’শ বছর পর আমরা দেখতে পাই যে, চার্চের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া, বানোয়াট, ভ্রান্ত আর ভ্রমাত্মক বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দানা বেঁধেছে। ক্যাথলিক চার্চ তার শিক্ষার সাথে বিরোধপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে সহিংসভাবে দমন করতে চেষ্টা করে। এইসব কিছুই করা হতো ধর্মের দোহাই দিয়ে। বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন বিষয়াদিতে চার্চের সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন তোলায় সত্যিকারের অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের চার্চের তোপের মুখে পড়তে হয়, বাড়তে থাকে চার্চ এবং বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক সংঘাত। এই নভেম্বরে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ৩৫০ বছর পূর্ণ হল। প্রায় বারোজনের মত বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীরা এক হয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলো। তাদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা বের করা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা আর পরিকল্পিত বিশ্লেষন করা। আজ পশ্চিমা বিশ্ব এটিকে আধুনিক বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে কৃতিত্ব দিয়ে থাকে। খেয়াল করার ব্যাপার হল, এটি ছিল প্রচলিত চার্চের শিক্ষার বিরুদ্ধাচরণ – এটা ছিল “ধর্মের” বিরুদ্ধে একটা চ্যালেঞ্জ।
সপ্তদশ শতাব্দী প্রত্যক্ষ করল চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হতে চলেছে। এর মূল কারন ছিল, বস্তুজগৎ সম্পর্কে ভিত্তিহীন বিচার বিশ্লেষণ এবং সে বিচার-বিশ্লেষণ চাপিয়ে দিতে অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ। ঈসা(আঃ) আনীত বিশুদ্ধ তাওহীদবাদী শিক্ষাকে নষ্ট করে ফেলার কারণেই ঘটনা এতদূর গড়াল। এতে করে ইউরোপের দার্শনিক সমাজে ধর্ম একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মানুষ ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা আরম্ভ করলো। অথচ পূর্বে যুক্তি ছিল ধর্মের অধীন আর চার্চের কর্তৃত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। এ অবস্থায় জ্ঞানের উৎস আর পথনির্দেশিকা হিসেবে যুক্তি আর বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে। রাষ্ট্রনীতি, আইন, শিষ্টাচার এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের উৎস হিসেবেও মানুষ ধর্মের বদলে যুক্তিকে বেছে নেয়। এইসব “জ্ঞান” মূলত ছিল দার্শনিকদের চিন্তাধারার প্রতিফলন। এই যুগ ইতিহাসে আলোকপ্রাপ্তির যুগ, মানবতার যুগ, দেবত্বের যুগ নামে পরিচিত। হ্যাঁ – দেবত্বের যুগ এইজন্য যে দার্শনিকরা “বুদ্ধি” আর “যুক্তি” কে ঈশ্বরের সমকক্ষ বা তার চেয়েও বড় মনে করত। আর তাদের কাছে ঈশ্বর ছিলেন এমন এক সত্ত্বা, এই দুনিয়ার ক্রিয়াকলাপের ব্যপারে যার কোন অধিকার বা যোগসূত্রও নেই। তারা মানুষকে শিক্ষা দিতো যে সকল আধিপত্য “মেধা” র এবং একমাত্র মেধাশক্তির। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মকে কর্তৃত্বের আসন থেকে হটানো। চার্চের দূষিতশিক্ষার ফলে ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় জীবনের যে বেহাল দশা হয়েছিলো, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই তারা এ লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন ভাবধারার আবির্ভাব ঘটে। তারা মনে করলো যে ধর্মকে জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করার চেষ্টায় “আলোকের যুগ” যতটুকু অগ্রসর হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। খেয়াল করুন, এপর্যন্ত দার্শনিকেরা ধর্মকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা ধর্মকে যুক্তিদিয়ে বিচার করে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছিলো, তারা চেয়েছিল যুক্তি এবং বাস্তবসম্মত জ্ঞানের আলোকে ধর্ম সহ অন্য সকল জ্ঞান বিচার করা হবে। কিন্তু নব উদ্ভাবিত চিন্তাধারা এমন সকল কিছুকে অস্বীকার করলো যা অনুভব করা যায় না। যা দেখা যায় না, তার অস্তিত্ব মেনে নিতে তারা রাজী নয়। অবস্থা এমন দাড়ালো যে ধর্মকে কেবল নির্বাসিত ই করা হল না বরং একে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা শুরু হল। মানুষের স্বভাবগত বুদ্ধিবৃত্তি আর সহজাত যুক্তি, মূল্যবোধ লোপ পেতে থাকলো, সেখানে জায়গা করে নিলো প্রকৃতিগত আর জৈবিক প্রবৃত্তি। নব উদ্ভাবিত দর্শন অনুযায়ী, যা বাহ্যত দেখা যায় না তার সবই ধোঁকা। সংক্ষেপে, এটি সেই সময় যখন বিজ্ঞানকে, ধর্মের (ক্যাথোলিক চার্চ)বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আবরো মনে করিয়ে দেই, চার্চ কর্তৃক ধর্মের বিকৃতি সাধন, নতুন বিশ্বাস সংযোজন এবং এগুলোকে ইউরোপের মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ফলেই, এমনটি হয়েছিলো। ব্যাপার এমন নয় যে, ডারউইন আল্লাহকে মানুষ সৃষ্টির কৃতিত্ব এজন্য দেয়নি কারণ তার নিকট বৈজ্ঞানিক প্রমান ছিল। আমার মনে পড়ে, যখন কলেজে ছিলাম আমি “সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব” বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা করেছি। আর আমি জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম যে, বানর থেকে মানুষে রূপান্তর কখন কীভাবে হয়েছিলো সে ব্যাপারে ডারউইন কোনরকম তত্ত্ব দাঁড়া করায় নি। বরং তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চার্চের বিরোধিতা করা।
১৬৩৬ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে, খ্রিষ্টান মিশনারিদেরকে প্রশিক্ষন প্রদানের জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি স্থাপন করা হয়েছিলো। আজকে যদি কেউ গুরুত্বসহকারে ধর্ম শিক্ষার ক্লাস করতে চায় তবে তাকে অনেক দূর হেটে নির্জন আর আলাদা একটা ধর্মীয় স্কুলে যেতে হবে, অথচ দু’শ বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত এর মূলমন্ত্র ছিল ‘Christ et Ecclesiae’ (যীশু এবং গীর্জার উদ্দেশ্যে)। ১৮৪৩ সালে এই মূলমন্ত্র পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘Veritas’ (সত্য)। । ।
এভাবেই ধর্মের (বিশেষভাবে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণায়) সাথে বিজ্ঞানের ব্যবধান আর সংঘাত বাড়তেই থাকে। এসবই ছিল চার্চ কর্তৃক কয়েক শতাব্দীব্যাপী ধর্ম বিকৃতির প্রত্যক্ষ ফল। অতএব, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্র জন্য যিনি শেষ অবতীর্ণ আসমানী বানী অপরিবর্তনীয় রেখেছেন এবং বৈজ্ঞানিক অনুমোদন আর এঁর মধ্যে কোন অসঙ্গতি নেই।
তারিক মেহান্না,
প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮।
তারিখঃ সোমবার, ২০শে রবিউস-সানি ১৪৩১ হিজরি/৫ই এপ্রিল, ২০১০।
১ চার্চে গিয়ে যাজক বা পাদ্রীর(Father) কাছে নিজের পাপ বর্ণনা করে ক্ষমা চাওয়ার প্রথা ।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন