সম্ভাবনার বাংলাদেশঃ সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনা (২)

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার মাহাথির ১২ আগস্ট, ২০১৩, ০৬:৪৮:৩৩ সন্ধ্যা

দ্বিতীয় সমস্যা- দারিদ্র্য ,

দারিদ্র্য আমাদের দেশের একটা মহা সমস্যা। আগে জানা যাক দারিদ্র্য কি?

 দারিদ্রের সার্বজনীন কোন সংজ্ঞা নেই। তাই কে দরিদ্র আর কে দরিদ্র নয় সে ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে যার কোন সম্পদ নাই, উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নাই সে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে ও সর্বসম্মতিক্রমে দরিদ্র।

বিশ্বখ্যাত অনলাইন বিশ্বকোষ wikipedia- এ বলা হয়েছে, `Poverty is the shortage of common things such as food, clothing, shelter and safe drinking water, all of which detemine the quality of life.' (সূত্র: http://en.wikipedia.org/wiki/Poverty)।

 বাংলা পিডিয়ার মতে, `দারিদ্র্য এমন অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একজন মানুষ জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের কারণে জীবনধারণের অপরিহার্য দ্রব্যাদি ক্রয় করতে অক্ষম হয়। দারিদ্র্যের দৃশ্যমান প্রতীক হচ্ছে অপুষ্টি, ভগ্নস্বাস্থ্য, জীর্ণশীর্ণ বাসস্থান, নিরক্ষরতা এবং বেকারত্ব অথবা আধা বেকারত্বে নিপতিত রুগ্ন-দুর্বল মানুষ।' (সূত্র: দারিদ্র্য বিষয়ক অধ্যায়, বাংলা পিডিয়া, সিডি সংস্করণ, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ) ।

 ইসলামী পরিভাষায় দারিদ্র্যের স্তর দুইটি। যথা: ফকির (সেই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি, যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারো নিকটই কিছু প্রার্থনা করে না) ও মিসকিন (লাঞ্ছনাগ্রস্ত অভাবী ব্যক্তি, যে চেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়)।

 বাংলাদেশ সরকারের আই-পিআরএসপি (Interim Poverty Reduction Strategy Paper) অনুযায়ী দারিদ্র্য দুই রকম। যথা: আয় দারিদ্র্য এবং মানব দারিদ্র্য (আই-পিআরএসপি, সার সংক্ষেপ, জানুয়ারি ২০০৪, পৃ-৫)

 বিশ্ব ব্যাংক দারিদ্র্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের দু`টি সীমারেখা টেনেছে। উচ্চতর দারিদ্র্যসীমা নির্ধারিত হয়েছে যেখানে জনপ্রতি বার্ষিক জিডিপি ৩৭০ মার্কিন ডলার এবং নিম্নতর দারিদ্র্যের সীমা হচ্ছে ২৭৫ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতিদিন জীবন ধারনের জন্য ২১২২ ক্যালরি খাদ্য ও ৫৮ গ্রাম প্রোটিন ক্রয়ে অক্ষম জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর ১৮০৫ ক্যালরি খাদ্যও কোনভাবে জুটাতে পারে না যে জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থান চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে।

জানা হল দারিদ্র্য কি। এবার ঘুরে আসা যাক কিছু তথ্য-উপাত্তের জগত থেকে।

 বাংলাদেশে বর্তমান দারিদ্রের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ । সংখ্যার হিসেবে এটা হচ্ছে ৫ কোটি ৬০ লাখ। এরমধ্যে ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ হতদরিদ্র এবং ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র। শতকরা হিসেবে হতদরিদ্রের হার ২০ শতাংশ এবং চরম দারিদ্রের হার ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় ২০০৫ এর জরিপে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আর কোন জরিপ হয়নি। তবে জাতীসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর ২০০৮ সালের এক জরিপে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৫৬ লাখ। তাদের মতে গত তিন বছরে বাংলাদেশের দারিদ্রের হার কমেছে আরো ২ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্যের কারনে বাংলাদেশের ৭৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে।

 দেশের ৬টি বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগে দারিদ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিভাগভিত্তিক দারিদ্র্যের হার- ১.বরিশাল ৩৯.৪ ভাগ,

২.চট্টগ্রাম ২৬.২,

৩. ঢাকা ৩০.৫,

৪. খুলনা ৩২.১,

৫. রাজশাহী ৩৫.৭,

৬. রংপুর ৩২.৩ এবং

৭. সিলেটে ২৮.১ ভাগ জনগোষ্ঠী দরিদ্র।

 বাংলাদেশের দারিদ্র মানুষের সংখ্যার মধ্যে দেখা যায় ৪৬.৩ মানুষ ভূমিহীন, ৫৬.৪ শতাংশ মানুষের জমির পরিমান .০৫ একরের নীচে।

 দেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় ৯২৩ ডলার বা ৭৪ হাজার ৩৮০ টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন দাতা দেশ/সংস্থার সঙ্গে প্রায় ৩৫ লাখ ৩১৯ হাজার ৮৩ মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি বিদ্যমান আছেদেশের একজন নাগরিকের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৪৮ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার ১৩৬ টাকা।।

 বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন করতে হলে এর কারণগুলো চি‎হ্নিত করা জরুরি। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের দারিদ্যের কারণসমূহ প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত:

 ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত

 সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত

 প্রাকৃতিক ও অন্যান্য কারণ

 ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত কারণসমূহ

১. অলসতা/কর্মবিমুখতা

বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র কেন-এই প্রশ্নের জবাবে জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন, `এদেশের মানুষ দরিদ্র থাকতে চায় তাই তারা দরিদ্র্'। এদেশে জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ জীবিকার্জনের জন্য পরিশ্রম না করে কর্মবিমুখ, অলস সময় কাটায়। পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত জায়গা-জমি অনাবাদী রেখে গ্রাম্য চা স্টলে বসে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা অনেক লোক তাদের দিন পাড় করে দেয়। জমি (যা অনায়াসে লাভ করেছে) বন্ধক রেখে খরচ নির্বাহ করে তারপর তা বিক্রি করে এক সময় নিঃস্বের খাতায় নাম লেখায় এমন উদাহরণ আমাদের আশেপাশে বিরল নয়।

২. পুঁজির অভাব

অনেকের সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে নিজেদের দারিদ্র ঘুচানোর জন্য কোন উদ্যোগ নিতে পারে না।

৩. অশিক্ষা, অদক্ষতা

শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব বাংলাদেশের শ্রমশক্তির এক অন্যতম সমস্যা। যথাযথ শিক্ষা ও দক্ষতা না থাকায় তারা দেশে এবং বিদেশে উচ্চ মজুরি থেকে বঞ্চিত হয় এবং দারিদ্র্যের শিকার হয়।

৪. অনর্থক ভোগ-বিলাস, অপচয়

সম্পদের অপব্যবহার, অনর্থক ভোগ-বিলাস, প্রেম-পরকীয়া, যাত্রা, সিনেমা ইত্যাদি নিষিদ্ধ কাজে অর্থের অপচয় করে এদেশের বহুলোক দারিদ্র্যে নিপতিত হয়।

৫. জুয়া

জুয়া বাংলাদেশের সর্বত্র এক মারাত্নক ব্যাধিরূপে ছড়িয়ে পড়েছে। উচ্চবিত্তের প্রাসাদ থেকে ফুটপাতের গৃহহীন পর্যন্ত এ ব্যধিতে আক্রান্ত। সম্প্রতি দৈনিক জাতীয় দৈনিকের সংবাদ শিরোণাম ছিল `নিঃস্ব হয়ে ভোরে বাসায় ফিরে অন্তত: ১০ হাজার মানুষ'। জুয়ার আসরে বসে নিজের ব্যবহার্য জিনিস, ঘরের আসবাব-পত্র এমনকি ঘরের চালের টিন পর্যন্ত পানির দামে বিক্রি করে দেয়ার মত ঘটনাও ঘটে থাকে।

৬. বহুবিবাহের প্রবণতা

সমাজে কিছু লোক রয়েছে যারা কারণে-অকারণে স্ত্রী তালাক দেয়, আবার বিয়ে করে, তারপর তুচ্ছ কারণে আবার তালাক, আবার বিবাহ করে এই বহুবিবাহ প্রবণতা অনেকের জন্য দারিদ্র্য ডেকে আনে।

৭. বিবাহ বিচ্ছেদ

তালাকপ্রাপ্তা হয়ে অনেক মহিলা অসহায়ত্ব এবং দারিদ্র্যের শিকার হয় আবার অনেকে তাদের পিতা/ভাই বা অভিভাবকের সংসারে দারিদ্র্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

৮. পেশা পরিবর্তন/ভুল পেশা গ্রহণ

পেশা নির্বাচনে ভুল বা পেশা পরিবর্তনের কারণেও অনেকে দারিদ্র্যের শিকার হয়। টিভিতে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানে জনৈক বেকার লোকের মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে মৎস্য চাষ শুরু করে অল্পসময়ে কয়েক লক্ষ টাকার মালিক বনে যাওয়ার বিস্ময়কর কাহিনী শুনে শর্টকাট পথে বড়লোক হওয়ার চিন্তায় কেউ কেউ নিজের দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে দিয়ে ঋণ করে বা জায়গা-জমি বন্ধক রেখে পুঁজি সংগ্রহ করে নতুন পেশা বা ব্যবসায় নেমে পড়ে । একসময় দেখা যায় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব।

৯. দুর্ঘটনা/দুরারোগ্য ব্যাধি

পরিবারের কোন সদস্য হঠাৎ দুর্ঘটনা বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণ করলে বা অন্য কোন কারণে কর্মে অম হওয়ার কারণে দারিদ্র্য বাড়তে পারে।

সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত

১. দুর্নীতি

আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা। এইটা নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। এটা আলাদা সমস্যা হিসেবে সামনে আসবে।

২. অব্যবস্থাপনা-

আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা অর্থের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। যে সরকারি বরাদ্দ জনগনের হাতে যখন পৌছার কথা এই হাত সেই হাত ঘুরতে ঘুরতে সেই অর্থ জনগনের হাতে পৌছে অনেক পরে। দেখা যায় ততদিনে হয়ত ঐ ব্যক্তির ঐ অর্থ কাজে লাগানোর সুযোগ শেষ হয়ে গেছে।

৩. রাজনৈতিক অস্থিরতা-

অতি পরিচিত সমস্যা। সবাই এর জন্য দায়ী। সহনশিলতা নামক জিনিষটা আমাদের কাছ থেকে এক্কেবারে চলে গেছে বললেই চলে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা। সবাই মনে করে কেবলমাত্র আমিই ঠিক।

৪. দলীয়করণ-

পত্রিকার খুব কমন একটা খবর “এই বয়স এ ভাতা না পাইলে কাখন পামু”। বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। বিভিন্ন প্রকার ভাতা বণ্টনের ক্ষেত্রে চরম দলীয়করণ দেখা যায়। অনেক বয়স্ককে পাওয়া যায় যাদের বয়স আশির বেশি। অথচ পার্টির লোক না হওয়ায় তাদের ভাতা দেওয়া হয় না।

(চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১৩৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File