হিন্দির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত দেশজ সংস্কৃতি
লিখেছেন লিখেছেন পূস্পিতা ২৫ জুলাই, ২০১৩, ০১:৪৩:৩০ রাত
হিন্দির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত দেশজ সংস্কৃতি। ভারতীয় সংস্কৃতির চলমান আগ্রাসন নতুন প্রজন্মকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে পাঁচ হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর প্রোফাইল দেখে জানা গেছে, যে দেশটি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য রক্ত দিয়েছে, সে দেশের নতুন প্রজন্মের প্রিয় সিনেমার তালিকায় হিন্দির আধিপত্য। বাংলা সিনেমার নাম নেই বললেই চলে। একই সাথে প্রিয় টিভি শোয়ের জায়গায় হাতেগোনা দু-চারজন বাদে সবারই প্রিয় ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল ও রিয়ালিটি শো। আর এর সুবাদে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাণিজ্য। তাদের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বাংলাদেশের মানুষের বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলছেন, ভাষার প্রতি এ রকম উন্নাসিকতা এবং নিজের সংস্কৃতির প্রতি অমনোযোগ আমাদের পীড়া দেয়। নতুন প্রজন্মকে তার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত করতে হবে।
দেশের খ্যাতিমান শিল্পী আবদুল জব্বার বলেন, ভালো কিছু গ্রহণ করতে আপত্তি নেই। কিন' ঢালাওভাবে সব উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষেও আমি নই। আমাদের সংস্কৃতিকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই।
ভাষাসৈনিক মতিন বলেন, বিশ্বায়নের একটা প্রভাব থাকতেই পারে। তাই বলে আমরা নিজেদের ভুলে যাবো, তা হতে পারে না। এটা মেনে নেয়া যায় না।
ভারতীয় শিল্পীদের আধিপত্য
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, কেবল ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে আড়াই শতাধিক ভারতীয় শিল্পী এসেছিলেন। সে জন্য তাদের পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। এসব টাকার জোগান হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর ও দর্শকদের কাছে বিক্রি করা টিকিট থেকে। সাধারণ দর্শকের জন্য এসব আয়োজনের বাইরে নিটওয়্যার প্রস'ত ও রফতানিকারকদের সমিতি বিকেএমইএ, তৈরী পোশাক প্রস'ত ও রফতানিকারক সমিতি বিজিএমইএ, টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলোয় ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে আসেন। এসব অনুষ্ঠানের উপস'াপক পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছেন। ভারতীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস'তকারক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোম্যাক্সের উদ্বোধন করতেও ঢাকায় এসেছিলেন একজন বলিউড অভিনেত্রী।
রাজধানীতে ফ্যাশন শো, শপিংমলের উদ্বোধন করতেও আনা হচ্ছে ভারতীয় অভিনেত্রী, মডেল ও র্যাম্প মডেলদের।
ভারতীয় রাজনীতিক ও কলাম লেখক শশী থারু তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বলিউড হলো-সফট পাওয়ার। এ পাওয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কামানের গোলাবর্ষণ করে না ঠিকই কিন' বাংলাদেশের মানুষের রুমে যে বাক্সটি রয়েছে তার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির গুলিবর্ষণ করে। আর সে গুলি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তছনছ করে দেয়। এ জন্য অভিভাবকেরা আজকাল শিশু-কিশোরদের হিন্দি কথামালায় উদ্বিগ্ন হন না।
সংস্কৃতির আগ্রাসনের রূপ তুলে ধরে মারাঠি রাজনীতিক শঙ্কর রাও দেও ভারতের লোকসভায় বলেছিলেন, নেহরু শুধু সংস্কৃতির কথা বলেন, কিন' ব্যাখ্যা দেন না। সংস্কৃতি বলতে তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন। আজ বুঝলাম সংস্কৃতি মানে হলো বহুর ওপর স্বল্পের আধিপত্য। ভারতের হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর তিনি এ বক্তব্য রেখেছিলেন।
অনুষ্ঠানের সাথে মাগনা বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে দেখানো হয় না। অথচ তাদের প্রায় সব টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টাকা দিয়ে দেখে। একই সাথে সে দেশের পণ্যের বিজ্ঞাপনও। এর মধ্য দিয়ে একটি বড় বাজার তৈরি হচ্ছে।
গুলশান এলাকায় ক্যাবল টিভির ব্যবসায় পরিচালনা করেন আবু তাহের মন্টু। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা আমাদের চ্যানেল দেখায় না। এর জন্য তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সেখানে বাংলাদেশ তাদের সব চ্যানেল দেখায়। সে সাথে বিজ্ঞাপনও। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছে না।
একটি জরিপ, অনেক উদ্বেগ
ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে টেলিভিশনের দর্শক ৯ কোটি ১২ লাখের মতো। এসব দর্শকের বয়স ১৫ বছরের বেশি। শিশুদের যাদের বয়স ১৪ এর নিচে তাদের গোনা হয়নি। সে হিসাব নিলে দর্শকসংখ্যা ১১ কোটির মতো হতে পারে। এ দর্শকেরা তাদের প্রতি শত মিনিটের মাত্র ৩০ মিনিট বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখেন। এটি তারা দেখেন মূলত বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হিন্দি চ্যানেলগুলোর দর্শক বেশি থাকে। বাকিটা তারা ব্যয় করেন হিন্দি চ্যানেলের পেছনে।
পে করতে হয় হাজার কোটি টাকা
দেশে ২৭২টির মতো চ্যানেল দেখা যায় বলে ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ৪০টির মতো চ্যানেল বাংলাদেশ কিনে দেখায়। এসব চ্যানেলের প্রায় সবই ভারতীয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চ্যানেল এইচবিও এখন ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে এর জন্য পেমেন্টটাও সেখানে করতে হয়।
বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল আমদানি করে থাকে দুটো প্রধান প্রতিষ্ঠান। এর একটি মোহাম্মদী গ্রুপ। এর মালিক এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সবিনয় জানতে চাই-এর উপস'াপক আনিসুল হক। অন্য পরিবেশক আবুল খায়ের লিটুর বেঙ্গল গ্রুপ। বেঙ্গল গ্রুপ দেশজ সংস্কৃতিচর্চার জন্য ধানমন্ডিতে গড়ে তুলেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এ দুটো প্রতিষ্ঠান থেকেই মূলত ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা পে চ্যানেলগুলো কিনে গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করে থাকেন।
এ জন্য পরিবেশকদের গ্রাহকপ্রতি চ্যানেলের জন্য আলাদা পেমেন্ট করতে হয়। ইউনাইটেড ক্যাবল সার্ভিসের টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা স্টার গ্রুপের চ্যানেলপ্রতি ৫১ টাকা ও সনি গ্রুপের চ্যানেলপ্রতি ৬০ টাকা করে দিই পরিবেশকদের প্রতি মাসে । এর সাথে তাদের আবার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সে হিসেবে স্টার গ্রুপের একটি চ্যানেলের জন্য গ্রাহকপ্রতি দিতে হয় ৭৩ টাকা ৩১ পয়সা। সনির জন্য দিতে হয় ৮৬ টাকা ২৫ পয়সা।
বাংলাদেশে সে হিসেবে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে ভারত চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
বিষয়: বিবিধ
১৫০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন