সিয়াম পালনের বিধি বিধান

লিখেছেন লিখেছেন কোহিনূর ইসলাম সুমি ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৩:৫০:২২ দুপুর



সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য এবং আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সHappy এবং তার বংশধর ও সকল সাহাবীদের প্রতি দরুদ ও সালাম।

১. ‘সিয়াম’ বা রোজা : ফজরের শুরু হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা ভঙ্গের কারণ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত পালন করা।

২. রমযানের সিয়াম : রমযানের সিয়াম ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম একটি রুকন।

যেমন নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিতঃ (১) সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল (২) রীতি মত নামায আদায় করা (৩) যাকাত দেয়া (৪) রমযানের রোজা পালন করা (৫) বায়তুল্লাহ্রয় হজ্জ করা। (বুখারী ও মুসলিম)

সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের শ্রেণিভেদ

সিয়াম প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স, বিবেক সম্পন্ন, সামর্থ্যবান ও নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী মুসলিম ব্যক্তির ওপর ফরয। যেসব লোকের প্রতি সিয়াম ফরয নয়:

১. কাফের : ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কাফেরের ওপর সিয়াম ফরয নয় এবং তার জন্য ইসলাম গ্রহণের পর কাযা করাও জরুরি নয়।

২. অপ্রাপ্ত বয়স : অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের ওপর সিয়াম ফরজ নয়। কিন্তু অভ্যাস গড়ার জন্য রোজা পালনের আদেশ করা যাবে।

৩. পাগল : প্রাপ্ত বয়স্ক পাগলের ওপর সিয়াম ফরয নয় এবং তার জন্য রোজা করিয়ে নেওয়ারও প্রয়োজন নেই, অনুরূপ বিধান যার জ্ঞান লোপ পেয়েছে এবং যার অতি মাত্রায় মতিভ্রম হওয়ার কারণে ভাল-মন্দ তারতম্য করতে পারে না।

৪. অপারগ : স্থায়ী সামর্থ্যহীন যেমন অতিশয় বৃদ্ধ বা এমন রোগে আক্রান্ত যার আরোগ্য লাভের আর আশা নেই, এরূপ ব্যক্তির প্রতি সিয়াম ফরয নয়। তবে রমযানের প্রত্যেক দিনের জন্য একজন মিসকিনকে খাবার দিতে হবে।

৫. অসুস্থ : অস্থায়ীভাবে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে রোজা রাখা কঠিন হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখবে না, কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর কাযা করবে।

৬. গর্ভবতী বা দুধ পান করায় এমন মহিলা : গর্ভ-ধারণ বা দুধপান করানোর কারণে যদি তাদের প্রতি রোজা রাখা কঠিন হয় বা স্বীয় সন্তানের অনিষ্টের আশঙ্কা করে তবে রোজা না রেখে যখন আশঙ্কামুক্ত হবে তখন সুবিধা মতো সময়ে কাযা করে নিবে।

৭. মাসিক ঋতু স্রাব অথবা সন্তান প্রসবজনিত স্রাব হলে উক্ত অবস্থায় রোজা না রেখে, তা দূর হলে পরে কাযা করে নিবে।

৮. নিরুপায় : এমন ব্যক্তি যে রোজা ছেড়ে দিতে বাধ্য, যেমন কোনো ছোট বাচ্চা পানিতে ডুবে গেছে অথবা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তাকে মুক্ত করার জন্য রোজা ছেড়ে দিতে হলে দিবে কিন্তু পরবর্তীতে কাযা করে নিবে।

৯. মুসাফির : মুসাফিরের জন্য সফরে রোজা রাখা, না রাখার স্বাধীনতা রয়েছে। তবে যদি না রাখে পরে কাযা করে নেবে। উল্লেখ্য, মুসাফির ইচ্ছা করলে যতদিন সফরে থাকবে, (সে সফর স্বল্পস্থায়ী হোক বা স্থায়ী) ততদিন রোজা ছাড়তে পারবে।

রোজা ভঙ্গের কারণ

রোজাদার যদি ভুলক্রমে বা না জেনে বা বাধ্য হয়ে কিছু খেয়ে ফেলে, তবে রোজা নষ্ট হবে না, আল্লাহ বলেন:

“হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা ভুল করে অথবা অজ্ঞাতসারে দোষে লিপ্ত হই তবে আমাদেরকে পাকড়াও কর না।” (সূরা আল-বাকারা : ২৮৬)

আল্লাহ তাআলা বলেন, “তবে তার জন্য মহা শাস্তি নয় যাকে কুফরী করতে বাধ্য করা হয়েছে কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল।” [সূরা আন – নাহাল : ১০]

আল্লাহ তাআলা বলেন, “যা তোমরা অজ্ঞাতসারে ভুল করেছ তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই, কিন্তু তা তোমাদের সংকল্প থাকলে অপরাধ হবে।” [সূরা আল-আহ্যাব : ৫]

* অতএব, রোজাদার যদি ভুলবশত, পানাহার করে তবে সেকারণে তার রোজা নষ্ট হবে না।

* আর কেউ যদি সূর্য ডুবে গেছে অথবা ফজর এখনও হয়নি এরূপ মনে করে পানাহার করে তবে তার অজ্ঞতার কারণে রোজা নষ্ট হবে না।

* যদি কুলি করা অবস্থায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলায় পানি চলে যায় তবে রোজা নষ্ট হবে না।

* স্বপ্নদোষ হলেও এতে তার কোনো ইচ্ছা না থাকায় রোজা ভঙ্গ হবে না।

রোযা ভঙ্গের কারণ ৮টি

স্ত্রী সহবাস : রোজাদার যদি রমযানের দিনে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয় তবে সে রোযা কাযা আদায়সহ জটিল কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। আর তা হলো : একটি গোলাম আজাদ করা, যদি সামর্থ্য না থাকে তবে ধারাবাহিক দুই মাস (মাঝে বিরতি ছাড়া) রোজা রাখতে হবে আর যদি তার সামর্থ্য না থাকে তবে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে।

বীর্যপাত : জাগ্রতাবস্থায় হস্ত মৈথুন, স্ত্রীর সাথে মেলা মেশা করা, চুমো দেওয়া, স্পর্শ করা অথবা অন্য কোনো কারণে বীর্যপাত হলে রোজা বিনষ্ট হয়ে যাবে।

পানাহার : উপকারী বা ক্ষতিকারক (যেমন ধূমপান) কোনো কিছু পানাহারে রোজা ভেঙে যায়।

ইনজেকশনযোগে খাদ্যের সম্পূরক খাদ্য জাতীয় কোনো কিছু প্রয়োগ করলে। কিন্তু তা যদি খাদ্যের সম্পূরক না হয় তবে শরীরের যেখানেই প্রয়োগ করা হোক যদিও তার স্বাদ গলায় অনুভূত হয় রোজা নষ্ট হবে না।

ইনজেকশন যোগে রক্ত প্রয়োগ : যেমন রোজাদারের যদি রক্তশূন্যতা দেখা দেয়, আর তাকে যদি ইনজেকশন প্রয়োগে রক্ত প্রবেশ করানো হয় তবে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে।

মাসিক ঋতু স্রাব ও সন্তান প্রসবজনিত স্রাব।

শিংগা বা এ জাতীয় কিছু লাগিয়ে রক্ত বের করা, তবে যদি রক্ত স্বাভাবিকভাবে যেমন নাক থেকে রক্তক্ষরণ বা দাঁত উঠানোর ফলে বা এ ধরনের অন্য কারণে বের হয় তবে রোজা নষ্ট হবে না।

৮ – বমি করলে : ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা নষ্ট হবে, কিন্তু অনিচ্ছায় বমি করলে রোজা নষ্ট হবে না।

রোজার কতিপয় প্রয়োজনীয় মাসয়ালা

১. অপবিত্র অবস্থায় রোজার নিয়ত করা জায়েয, তবে ফজর হলে গোসল করবেন।

২. কোনো মহিলা যদি রমযানে ফজরের পূর্বে মাসিক ঋতু-স্রাব বা সন্তান প্রসবজনিত স্রাব হতে পবিত্র হয় তবে সে ফজরের পূর্বে গোসল না করলেও তার প্রতি রোজা রাখা ফরয। তারপর ফজরে গোসল করে নিবে।

৩. রোজা অবস্থায় দাঁত উঠানো, জখমে ঔষধ লাগানো চোখে বা কানে ঔষধের ফোটা নিক্ষেপ জায়েয, যদিও চোখে বা কানে ফোঁটা প্রয়োগের ফলে গলায় ঔষধের স্বাদ অনুভূত হয়।

৪. রোজা অবস্থায় দিনের প্রথমভাগে ও শেষ ভাগে মিসওয়াক করা জায়েয বরং অন্যের মত তার জন্যেও এ অবস্থায় সুন্নাত।

৫. রোজাদার গরম ও পিপাসার তীব্রতা কমানোর জন্য পানি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা অন্যকিছুর মাধ্যমে ঠান্ডা গ্রহণ করা বৈধ।

৬. প্রেশার বা অন্য কোনো কারণে শ্বাস কষ্ট হলে রোজা অবস্থায় মুখে স্প্রে করা জায়েয।

৭. রোজাদারের ঠোঁট শুকিয়ে গেলে পানি দ্বারা ভিজান এবং মুখ শুকিয়ে গেলে গড় গড়া করা ছাড়া কুলি করা বৈধ।

৮. ফজরের সামান্য পূর্বে অর্থাৎ দেরি করে সেহরী খাওয়া এবং সূর্যাস্তের পর তাড়াতাড়ি ইফ্তার করা সুন্নাত।

রোজাদার ইফ্তারের জন্য খেজুর, শুকনা খেজুর, পানি, যেকোনো হালাল খাবার যথাক্রমে প্রথম থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করবে। আর যদি ইফ্তারের জন্য কিছুই না পাওয়া যায়, তবে কোনো খাবার পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মনে মনে ইফ্তারের নিয়ত করে নিবে।

৯. রোজাদারের উচিত সৎকর্ম বেশি করা এবং সকল নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা।

১০. রোজাদারের ফরয কাজসমূহ নিয়মিত আঞ্জাম দেওয়া এবং সকল হারাম থেকে দূরে থাকা একান্ত কর্তব্য। অতএব, পাঁচ ওয়াক্ত নামায সময় মতো এবং যদি সে জামায়াতে নামায আদায়ের ওযরবিহীন লোক হয় তবে জামায়াতের সাথে আদায় করবে এবং মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, ধোঁকাবাজি, সুদী লেন-দেন করা ও সকল হারাম কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে।

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, অনুরূপ আচরণ ও জাহেলিয়াত বর্জন না করে, তবে তার পানাহার বর্জনের আল্লাহ্ কোনোই প্রয়োজন নেই।” (বুখারী)

সকল প্রশংসা জগৎ সমুহের প্রতিপালক আল্লাহ্ জন্য এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার বংশধর ও তাঁর সকল সাহাবীর প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। আমীন!

বিষয়: বিবিধ

২০৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File