পেপার থেকে---- গণতন্ত্রের শ্মশানযাত্রায় ভারতীয় পৌরহিত্যের নেপথ্যে

লিখেছেন লিখেছেন সুজা মানুস ২৭ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:১১:০৮ রাত

বাংলাদেশের বর্তমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত এক ঢিলে কম করে হলেও হাফ ডজন পাখি শিকার করে নেয়ার চমত্কার নৈপুণ্য দেখাল যেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ভারত গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখেই দিল না শুধু, বরং পথভ্রষ্ট করেও ছাড়ল। গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃৃদ্ধ ভারতের এহেন স্ববিরোধী অবস্থান কেন তা এখন খতিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করছে গণতান্ত্রিক বিশ্বও। জনগণের বিরুদ্ধে একটি দল বা ব্যক্তির প্রতি এভাবে ঝুঁকে পড়ায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের বিরক্তি, আস্থাহীনতাও সন্দেহ-সংশয় বৃদ্ধিরই কারণ হবে এটা জেনেবুঝেও ভারত তেমনি একটা পথে কেন হাঁটছে এই জিজ্ঞাসা আজ অনেকের। ভারতের কংগ্রেস সরকার কি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, যে কোনো উপায় শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখা না গেলে অর্জিত অসম সুবিধাগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে, ফাঁস হয়ে যাবে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিগুলো? অথচ এর আগে ২৫ বছর মেয়াদি ইন্দ্রিরা-মুজিব অসম চুক্তি মুজিব পরবর্তী সরকারগুলোও পালন করেছে অক্ষরে অক্ষরে, বরং পালন করেনি ভারত এটাই বাস্তবতা। চুক্তিমত ৩ বিঘা করিডোর ভারত আজও দেয়নি এবং দেবে না যে তাও পরিষ্কার। চুক্তির প্রতি বৃৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে দক্ষিণ তালপট্টি ইন্দ্রিরা গান্ধী জীবিত থাকার কালেই তারা দখল করে নিল কোনো প্রকার আলোচনা বা সীমানা নির্ধারণ ছাড়াই। সমতার নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো দেখার সুযোগ ভারতীয়দের নেই বলে বাংলাদেশে তাদের চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়নি একদিনের জন্যও। তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে এহেন অসম এবং গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী অবস্থান গ্রহণের কারণ কী হতে পারে আলোচ্য নিবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেদিকে আলোকপাতের প্রয়াশ পাচ্ছি।

১. আমাদের এই বন্ধু দেশটির কাছে বাংলাদেশে শক্ত মেরুদণ্ড বিশিষ্ট কোনো সরকার নয় বরং নতজানু আজ্ঞাবহ একটা সরকারই পছন্দ। ভারতকে বৈধ-অবৈধ সুবিধা দেবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের স্বার্থ ও দৃষ্টিকোণ চোখ বুজে সমর্থন করবে এমন সরকারই চায় তারা বাংলাদেশে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের নীতি সাধারণত মুসলিম স্বার্থ পরিপন্থীই হয়ে থাকে। সুতরাং মুসলিম দলন ও দমনে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ও সমর্থন অব্যর্থ অস্ত্রের মতোই কাজ দেয় চমত্কার।

২. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থ সাধারণভাবে পরিপূরক নয় বরং বিপরীতমুখী। যেমন—মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি ও ফলমূল রফতানিতে বাংলাদেশ কোনো কারণে পিছিয়ে পড়লে সেই শূন্যতা সেরে দেয় ভারত। মালয়েশিয়ার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ যেমনি মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভূ-খণ্ড তেমনিভাবে কৃষ্টি-কালচার, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকেও বিচ্ছিন্ন এবং ভারতনির্ভর হয়ে থাকুক বাংলাদেশ, এটাই ভারতের প্রত্যাশা ও পলিসি। সংবিধান থেকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের ঘোষণাটি প্রত্যাহারের পেছনে বাংলাদেশী জনগণের সেন্টিমেন্ট নয় বরং ভারতের অভিপ্রায়ই যে কাজ করেছে তেমনটি মনে না করার কারণ নেই। তাই মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় তারা যতটা যত্নবান বাংলাদেশকে বিতর্কিত ও সন্দেহ ভাজন রূপে উপস্থাপনপূর্বক দূরে সরিয়ে রাখতে তারা ততধিক সক্রিয়।

৩. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান খাত এখন গার্মেন্ট শিল্প। প্রায় কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রফতানিমুখি গার্মেন্ট শিল্প। সঙ্গত কারণেই ক্রেতারা তখন পণ্য ক্রয়ে অন্য কোনো দেশ খোঁজে আর এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দের দেশটাই হয় ভারত। বাস্তবতা এই যে, আমরা এ পর্যন্ত যে সকল গ্রাহক হারিয়েছি তাদের প্রায় সকলই লুফে নিয়েছে ভারত।

৪. অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শিল্প ও কৃষি খাতে উত্পাদন কমে যাবে, আর ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে প্রথমত ভারতের দ্বারস্থই হতে হবে। এতে করে একদিকে ভারতের দাদাগিরির সুযোগটা বাড়বে অন্যদিকে তাদের পণ্যের জন্য উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টি হবে, আর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাগুলো জমা হয়ে যাবে ভারতের কোষাগারে।

৫. স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় আগ্রাসন বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দেখা গেছে জামায়াতকে। বেরুবাড়ী, তিনবিঘা করিডোর, দক্ষিণ তালপট্টি, লেলিয়ে দেয়া ‘শান্তির বাহিনী’, ফারাক্কা-তিস্তা, সীমান্তে হত্যা, ইয়াবা-ফেনসিডিল পাচারসহ সকল জুলুম ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই সংগঠনটিকে সদা সোচ্চার দেখা গেছে। টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে তারাই প্রথম জনসভা থেকে প্রতিবাদ জানায় ও জনগণকে সচেতন করে তোলে এমন এক সময় যখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ‘টিপাইমুখ বাঁধ কার্যকর হলে উপকৃত হবে বাংলাদেশ’। ’৭১ এ পরাজিত শক্তির’ এই বাড়াবাড়ি ভারত আদৌ ভালো চোখে তো দেখেনি বরং তার কায়েমী স্বার্থের প্রতি এক বড় রকম হুমকি রূপেই দেখেছে। সুতরাং ‘জামায়াত নির্মূল’ ভারতের ১নং টার্গেটে ওঠে আসে এবং সেই লক্ষ্যে তারা অনেকটা সফলও বলা চলে। সমগ্র বিশ্ব যুদ্ধাপরাধ বিচারের অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাতদুষ্টতার বিষয়ে আপত্তি জানালেও ভারত এই বিচার কার্যক্রমের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাই জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর ও জামায়াত নির্মূলে আওয়ামী লীগকে যেভাবেই হোক ক্ষমতার রাখা ভারতের স্বার্থেই তারা জরুরি মনে করছে।

৬. আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ভারতের অবস্থান প্রকৃত অর্থে মানবিক ও নৈতিক তাগিদজনিত যে নয় বরং কৌশলগত সেটি তাদের কথায় ও আচরণে অনেক আগেই তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ’৭১ ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেক শ’ ৭১ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারকে ইন্দ্রিরা গান্ধীর মহা ভুল হিসেবে মন্তব্য করার কারণ এখানেই। তাদের দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদগণ এখানে এসে বার বার ’৪৭-এর সীমানা মুছে দেয়ার আবদার জানাচ্ছেন প্রকাশ্যে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের সামনেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধনের ঘটনাও ঘটে কলকাতাতে। এসব আলামত থেকে এই সত্যই বোধ করি বেরিয়ে আসে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পাকিস্তান মেনে নিলেও আসলে মেনে নেয়নি ভারত। আর তাই এক সুদূরপ্রসারী নীল নকশার আওতায় ধীরে-সুস্থে এগুচ্ছে তারা। এলক্ষ্যে এখানে ভারতের জন্য চাই লেন্দুপ দর্জি বা শেখ আব্দুল্যার মতো কেউ। এ লক্ষ্যে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ ভারতের প্রথম পছন্দ। তাই তাদেরকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের এই অনৈতিক ও গণবিরোধী আচরণ।

নব্য স্বাধীন যে কোনো দেশের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে স্বাধীনতা উত্তর সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা বিনির্মাণে আত্মনিয়োগের প্রচেষ্টাই লক্ষণীয় হয়ে ধরা দেয়। আর এতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায় বিজয়ী পক্ষকেই। কিন্তু বাংলাদেশের এক নির্মম দুর্ভাগ্য! এখানে ’৭১ সালের প্রসঙ্গ টেনে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তি রূপে বিভাজন করা হচ্ছে ২য় এবং ৩য় প্রজন্মকেও। এই নতুন সমীকরণে যারা ভারতের অন্যায়, জুলুম-অত্যাচারকে নীরবে হজম করতে সক্ষম তারা হচ্ছে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি, হোক না সে দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মানিলন্ডারার, শেয়ার বাজার বা ব্যাংক লুটেরা। আর বিভক্ত জাতিসত্তা ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল বলে এ কাজে ভারত একমাত্র আওয়ামী লীগকেই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে করে।

নিয়তির এই কঠিন বাস্তবতার অক্টোপাসের আমাদের জাতীয় জীবন বন্দি হয়ে পড়েছে যার থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় যেন জানা নেই কারও। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও এর ফলাফল এই সত্যই যেন প্রকাশ করে দিল যে, ভারত যা চায় তাই বাংলাদেশের নিয়তি, জনগণের ইচ্ছা এখানে কিছুই নয়। কারণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহায়তা মানবিক নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। সুতরাং বিনিয়োগের বেনিফিট তাকে নিতেই হবে, ‘শক্তি থাকে ঠেকাও দেখি’ এই হলো তার শেষ কথা।

আমাদের জন্য দুঃখ ও কষ্টের বিষয় হলো ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে গণতান্ত্রিক চেতনা ও গণঅভিপ্রায়ের পক্ষে আমাদের সহযোগী ও বন্ধু হিসেবে যে ভারতকে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পাশে দেখতে পেয়েছিল, আজ ২০১৪ সালে সেই ভারতকেই তারা গণতন্ত্রের শ্মশানযাত্রায় পৌরহিত্য করতে দেখল! গণতান্ত্রিক চেতনা ও ঐতিহ্যের বিপক্ষে ভারতের এই অবন্ধুসুলভ অবস্থান আবারও প্রমাণ করল ভারতের ইচ্ছা ও প্রত্যাশার মোকাবিলায় আমাদের জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার বাঞ্ছিত প্রত্যাশাটিও এখন অদূরদর্শী চিন্তা ও মোহভঙ্গের নামান্তরই যেন। এহেন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অর্থ-তাত্পর্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে, যেমনটি আর একবার অনুভূত হয়েছিল ১৯৭১-এ ।

বিষয়: বিবিধ

১০৬৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

168354
২৭ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৪:৩৩
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : চমৎকার ।
168371
২৭ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৫:১০
তহুরা লিখেছেন :
168457
২৭ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৩৯
প্রিন্সিপাল লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File