ইমার্জেন্সির দিন-রাত্রিঃ ১

লিখেছেন লিখেছেন আবু উসাইদ ০৪ আগস্ট, ২০১৩, ১১:০৬:৩৬ রাত

বাচ্চাটার বয়স দুই বছর। জরুরী বিভাগের টেবিলে শুয়ে চিৎকার করছিলো ব্যথায়। খেলার সময় চোখে ঢিল মেরেছে আরেকটি বাচ্চা। ভয়ংকরভাবে ফুলে গেছে চোখ। ভেতর থেকে চুঁইয়ে রক্ত মিশ্রিত অশ্রু ঝরছে চোখ থেকে। সাথে যে মহিলাটি এসেছে সে বাচ্চাটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছে, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে ঝরছে পানি। একজন পুরুষও ধরে রেখেছে বাচ্চাকে, বিধ্বস্ত চেহারা।

অনেক সময় দেখা যায় চোখের ইনজুরিতে চোখের পাতা বা আইলিড নিজে বড় হয়ে ফুলে যায় কিন্তু চোখের প্রধান অংশগুলো রক্ষা পায় ক্ষতির হাত থেকে। খুব আশা করছিলাম যেন অবোধ শিশুটিরও যেন তাই হয়। তবে তা হলো না। চোখের ভেতর কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে গেছে। সাথে বেরিয়ে পড়েছে চোখের কিছু ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। আইবলের ভেতরে রক্ত জমছে। রক্ত ঢেকে দিয়েছে চোখের দৃষ্টি। খুব খারাপ ধরণের ইনজুরি। এই চোখে স্বভাবিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা খুব ভাগ্যের ব্যাপার। শিশুটির দিকে তাকিয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হলো। মহিলাকে বললাম,

-আপনি ওর মা?

- না স্যার, আমার দেবরের ছেলে।

-ওর মা কোথায়?

- বাইরে বইসা আছে।

- বাবা কি করে?

- স্যার, বাবা মারা গেছে দুই মাস আগে। খুব কষ্ট কইরা চলতেছে ওর মা।

- পুরুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

- আপনি কি হন?

- চাচা হই স্যার।

জরুরীভাবে ভর্তি হয়ে অপারেশন করাতে হবে কিন্তু তারপরও দৃষ্টি পুরো স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ-এভাবেই রোগের ভয়াবহতা বুঝিয়ে বললাম। চাচা-চাচির চোখে পানি ঝরলো আবার।

সরকারি হাসপাতাল। বিছানা ও খাবার থেকে নিয়ে প্রায় সব ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া যাবে, সার্জারিরও কোন চার্জ লাগবে না। এর পরও আনুষাঙ্গিক কিছু ব্যয় আছে এই বাচ্চাটির জন্য, দরিদ্র পরিবারটির জন্য এইই হয়তো অনেক। ভর্তি দেয়ার সময় চাচাটি বলল, “স্যার খরচপাতি যাই হোক যেভাবে ভালো হয় করেন”।

ভর্তির জন্য বিস্তর কাগজপত্র লিখতে হয়। তাদেরকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে সব কিছু লিখে যখন বাইরে বের হয়েছি তখন দেখলাম ছেঁড়া একটি ব্যাগে ঠাসা করে আনা হয়েছে জিনিসপত্র। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়-চোপড়, বালিশ-কাঁথা। এর মাঝখানে শিশুটিকে কোলে নিয়ে মেঝেতে বসে ওর মা মুখে মুখ গুঁজিয়ে কাঁদছে। মাকে পেয়ে শিশুর অসুস্থ্য চোখের কান্না বন্ধ হয়েছে বটে কিন্তু বন্ধ হয়নি মায়ের সুস্থ্য চোখের অশ্রুধারা।

সরে এলাম দ্রুত। মনটা ভিজে উঠলো। আজ এই রাতে কত লক্ষ কোটি চোখ দেখছে পৃথিবীর মায়াবী রূপ। এটা যে আল্লাহর কত বড় অনুগ্রহ তা শুধু সেই বুঝছে, যে চেষ্টা করেও আজ দেখতে পাচ্ছে না।

বিষয়: বিবিধ

১২৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File