'বারাকাহ' - যা'কে গোটা মুসলিম উম্মাহ চিনতেই পারলো না!

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ_রুসাফি ১৬ এপ্রিল, ২০১৫, ০৫:৫৫:০৯ বিকাল

বারাকাহ্ কে? বারাকাহ্ একটি হাবশী বালিকা। বয়স পনের ষোল বছর। মুহাম্মাদের পিতা আব্দুল্লাহ্ তাকে মক্কার ক্রীতদাস-দাসীর বাজার থেকে ক্রয় করে। মুহাম্মাদের মা আমিনা বিন্তে ওয়াহহাবকে বিয়ে করার পূর্বে আব্দুল্লাহ্ তাকে ক্রয় করে।

আব্দুল্লাহ্ ও আমিনার বিয়ের পর তাদের দেখা-শোনার সকল দায়িত্ব বর্তায় বারাকাহর উপর।

বারাকাহ্ বলেন: আমিনা ও আব্দুল্লাহর বিয়ের দু’সপ্তাহ পর আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল মুত্তালিব আমাদের বাড়ী এসে বললো, “আব্দুল্লাহ্ তৈরী হও। তোমাকে সিরিয়াগামী সওদাগরী কাফেলায় ব্যবসার জন্য যেতে হবে।”

এ কথা শোনামাত্র আমিনা আর্তনাদ করে বলে, “আশ্চর্য! আশ্চর্য!! কিভাবে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে এতো দূর দেশ সিরিয়া যাবে? এখনো যে আমি নববধূ! এখনো তো আমার হাতের মেহ্দীর রং যায় নি!”

আব্দুল্লাহর মনের অবস্থাও তাই। কিন্ত সে রাশভারী শ্রদ্ধেয় পিতার নির্দেশের বিরোধিতা করতে পারে কি?

অনিচ্ছা সত্বেও তাকে দীর্ঘ পথের যাত্রায় পা বাড়াতে হলো। আব্দুল্লাহ্ রওয়ানা হয়ে বাড়ীর সীমানা পার হওয়ার পরই আমিনা বেহুশ হয়ে পড়ে যায় দোর গোড়ায়।

বারাকাহ্ বলেন ঃ আমি যখন আমিনাকে পড়ে যেতে দেখলাম, দুঃখে আর্তনাদ করে বললাম, “কি হয়েছে তোমার! তুমি যে পড়ে গেলে?” আমিনা চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো। তার গাল বেয়ে অশ্রুর বন্যা। জবাবে ক্ষীণ কন্ঠে আমিনা আমাকে বললো, “আমাকে বিছানায় নিয়ে চলো”।

এরপর আমিনা বিছানায় পড়লো। সে কারো সাথে কথা বলেনা। এমন কি যারা সাক্ষাৎ করতে আসে, তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। একমাত্র শ্বশুর আব্দুল মুত্তালিব আসলে তার সাথে আদব রক্ষার্থে শুধু কুশল বিনিময় করে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বারাকাহ্ তার জীবনের ইতিহাস বর্ণনা করেন। অশ্রুতে তার চোখ টলমল করে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পুনঃ বলেন ঃ

আব্দুল্লাহর চলে যাওয়ার প্রায় দু’মাস পর একদিন ফজরের পর আমাকে কাছে ডেকে আমিনা বলে, “আমি এক আজব স্বপ্ন দেখেছি আজ রাতে। দেখছি যে আমার জঠর থেকে একটি আলো বিচ্ছুরিত হয়ে সারা মক্কাহ উপত্যকাকে আলোকিত করে ফেলেছে।”

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি গর্ভ অনুভব করছো?” উত্তরে আমিনা বললো, “কি-জানি, মনে তো তাই হয়। কিন্তু গর্ভধারণ করলে মেয়েদের যে উপসর্গ দেখা দেয়, আমি যে তা অনুভব করছি না?”

জবাবে আমি বললাম, “মনে হয় তোমার এমন একটি সন্তান হবে, যার দ্বারা মানব জাতির কল্যাণ হবে।”

এরপর আরো কিছুদিন কেটে যায়। আব্দুল্লাহর কোনো খবর নেই। তার ফলে আমার ও আমিনার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। আমিনার অবস্থা এতোই করুণ যে তার শরীর সাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। আমি তাকে সর্বক্ষণ বিভিন্ন গল্প কাহিনী ও দুশ্চিন্তা বিদূরণের কথা-বার্তা বলে সান্তনা দিতে সচেষ্ট ছিলাম। আমি সর্বক্ষণ পাশে না থাকলে কি হতো বলা যায় না।

এভাবে দিন কাটছে আমাদের দু’জনের। একদিন সকালে আব্দুল মুত্তালিব উৎকন্ঠার সাথে আমাদের ঘরে প্রবেশ করে এবং কোনো ভূমিকা না করেই বলল, “আমিনা তৈরী হও। আমাদের মক্কাহ নগরী ছেড়ে বাইরে যেতে হবে।” আমিনা আশ্চর্য হয়ে বললো, “কি হয়েছে বাবা, আমরা কেনো নগরী ত্যাগ করে বাইরে যাবো?”

উত্তরে আব্দুল মুত্তালিব বললো যে, বাদশাহ্ আবরাহা মক্কাহ আক্রমণ করতে আসছে। সে মক্কাহ্ দখল করে কা’বা ধ্বংস করবে, কোরেশদের উৎখাত করবে এবং ছেলে মেয়েদের দাস-দাসীরূপে ধরে নিয়ে যাবে।

তদুত্তরে আমিনা বললো, “বাবা, আপনি দেখছেন আমি অসুস্থ ও শোকাহত, আমি এতো দুর্বল যে হেটে আমি পাহাড়ে চড়তে পারবো না।”

আব্দুল মুত্তালিব বলল, “কিন্তু আমার যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে তোমার এবং তোমার পেটের সন্তানের জন্য!”

আমিনা বললো, “বাবা, আবরাহা মক্কাহ্ প্রবেশ করতেও সক্ষম হবে না, কা’বাও ভাঙ্গতে পারবে না। কারণ, কা’বার মালিক আছেন, তিনি তা রক্ষা করবেন।”

আব্দুল মুত্তালিব বললো, “কিন্তুুু আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাহ থেকে মাত্র দু’মাইল দুরে, আক্রমণের শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে! আমরাও অন্যান্যদের মতো মক্কাহ ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেই- সেটাই উত্তম।”

কিন্তু আমিনা এ ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ শুনে মোটেও বিচলিত হলো না। যেনো সংবাদটি কোনো চিন্তারই বিষয় নয়। তা দেখে আব্দুল মুত্তালিব রেগে যায় এবং বলে, “কোনো কথার প্রয়োজন নেই। আমিনা কাপড় চোপড় ও জিনিস পত্র গুছিয়ে তৈরী হও। বারাকাহ্, তুমিও সব গুছিয়ে তৈরী হও। তৈরী হয়ে তোমরা দু’জন আসো। আমি তৈরী হয়ে তোমাদের অপেক্ষায় থাকবো।”

এর মধ্যেই অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেলো। আক্রমণকারী আব্রাহার প্রকান্ড হাতি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। আর উঠেনা, একপাও অগ্রসর হচ্ছে না।

হাতিকে তোলার জন্য সৈন্যরা তাকে লৌহদন্ড দিয়ে আঘাত করলো, হাতি দাঁড়ালো বটে কিন্তু একপাও আর সামনে আগাচ্ছে না। তখনই ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখী বিষাক্ত পাথর কুচি নিক্ষেপ করে আবরাহা ও তার সেনা বাহিনীকে নির্মূল করে দিলো। কা’বা রক্ষা পেলো এবং মক্কাহর মাহাত্ম আরো বাড়লো।

তারপর বারাকাহ্ তার কাহিনী বর্ণনা করছেন ঃ

আমি সর্বক্ষণ আমিনাকে চোখে চোখে রাখি। দিবানিশি তার চোখ ও চেহারার দিকে তাকাই। আমিনা যেনো তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো আব্দুল্লাহর বিরহে ও দুশ্চিন্তায়। আমি রাতেও তার পাশে শুতাম। আমি শুনতে পেতাম যে আমিনা ঘুমের মাঝেও যেনো আব্দুল্লাহর সাথে স্বপ্নে কথা বলছে। কখনো আমি তার আর্তনাদে জেগে যেতাম এবং তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রবোধ দিয়ে, সান্তনা দিয়ে উৎসাহিত করতাম। এভাবেই আমাদের দিন কাটছিলো।

তার দু’মাস পর সওদাগরী ক্বাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরৎ আসা আরম্ভ হলো। এক এক ক্বাফেলা পৌঁছুলেই তাদের আত্মীয় স্বজনেরা তাদের আগ বেড়ে গিয়ে স্বাগত জানিয়ে নগরীতে নিয়ে আসতো।

কোনো কাফেলা এলেই আমি চুপি চুপি গিয়ে আব্দুল মুত্তালিবের নিকট থেকে আব্দুল্লাহর সংবাদ নিতে যেতাম। কোনো সংবাদ না পেয়ে আমি পুনঃ চুপি চুপি বাড়ী চলে আসতাম। আমিনাকে কিছুই জানতে দিতাম না। পাছে কোনো সংবাদ নেই শুনতে পেয়ে আমিনা আরো ভেঙ্গে পড়ে!

এভাবে একে একে সকল কাফেলা ফেরত আসে। কিন্তু আব্দুল্লাহ্ ফিরেনি। ব্যাপারটি আমাকেও বিচলিত করে তুললো। তাই একদিন সকালে খুব উদ্বেগ নিয়ে আব্দুল মুত্তালিবের নিকট গেলাম।

গিয়েই দুঃসংবাদ পেলাম। মাদীনাহ থেকে আব্দুল্লাহর মৃত্যুর সংবাদ এসেছে। সংবাদ শুনে বজ্রাহতের মতো হতভম্ভ হয়ে যাই।

দুঃসংবাদের আকস্মিকতা এমনই ছিলো যে আমার মনে পড়ে যে, সংবাদ শুনে আমি চিৎকার করে বসে পড়ি। তারপর প্রায় জ্ঞান হারা হয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী পৌঁছে প্রিয়কে চিরতরে হারানোর শোকে বিলাপ করতে থাকি। আমার অবস্থা দেখেই আমিনা সব বুঝে যায়। আমিনা কোনো প্রকার ছুটে গিয়ে বিছানায় পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

এরপর আর আমিনা শয্যা ছেড়ে উঠতে পারেনি। আমি ছাড়া বাড়ীতে আমিনার পাশে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী ছিলো না। আমার শোকের বোঝা নিয়ে আমি সর্বদা আমিনাকে ঘিরে থাকি। তার সেবা যত্ন, তাকে প্রবোধ দেয়া ও মনোবল দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা আমার একমাত্র জীবনের ব্রত হয়ে যায়। কারণ, আমিনার পেটে যে আমার প্রিয়ের চিহ্ন পূর্ণতা লাভ করছে! তার যত্ন চাই।

এভাবে দিনরাত প্রহর গোনার পর আমিনা মুহাম্মাদকে প্রসব করে। প্রসবের পর সর্ব প্রথম আমি মুহাম্মাদকে দু’হাতে তুলে আমিনার পাশে দেই। মুহাম্মাদ শেষ রাতে জন্মায়। ভোর হওয়ার পর খবর পাঠালে আব্দুল মুত্তালিব আসে ও অন্যান্যরাও আসে।

মুহাম্মাদকে পেয়ে আমরা আব্দুল্লাহ্কে ফিরে পাই। জমাট আঁধার শেষে যেনো বেঁচে থাকার আশার আলো জ্বলে ওঠে।

মুহাম্মাদের জন্মে আব্দুল মুত্তালিবসহ পরিবারের সবাই আনন্দিত হয় এবং মহা সমারোহে জন্মোৎসব করে। আব্দুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মাদকে কোলে করে কা’বায় গিয়ে তাওয়াফ করে ঘোষণা দেয়, “এ হলো মুহাম্মাদ, আমার ছেলে, এ হলো আব্দুল্লাহর বরকতময় স্মৃতি।”

আরবরা, বিশেষ করে মক্কাহবাসী, শিশুদের দুধ পান ও মরুভূমির স্বাস্থ্যকর মুক্ত বায়ুতে লালনের জন্য পয়সার বিনিময়ে ধাত্রীদের কাছে দত্তক দিতো।

বারাকাহ্ বলেন ঃ

মক্কা উপত্যকার বাইরে মরুবাসী ধাত্রীরা পালনের জন্য শিশুদের নিতে আসতো। মুহাম্মাদ দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান বিধায় দুগ্ধদাত্রীরা কেউ তাকে নিলো না। যারা প্রচুর টাকা দিতে সক্ষম, তাদের সন্তানদেরই তারা আগ্রহ ভরে নিলো। হালিমা সাদীয়া নাম্নী এক দুগ্ধদাত্রী সবার শেষে আসলো। কারণ, তার বাহন গাধীটি এতোই রোগা ও দুর্বল ছিলো যে তার মক্কাহ পৌঁছুতে বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো।

অন্য কোনো শিশু না পেয়ে হালিমা মুহাম্মাদকে নিতে বাধ্য হলো। কিন্তু আল্লাহ্ পাকের কুদরত! ফেরার পথে হালিমার রোগা গাধীটি তেজী আরবী ঘোড়ার গতিতে বাড়ী ফিরলো মুহাম্মাদকে নিয়ে। তারপর এতীম শিশু মুহাম্মাদের ভাগ্যে হালিমার দৈন্যদশা দূর হয়ে গেলো। তার ভেড়া বকরির পাল মোটাসোটা হতে আরম্ভ করলো। প্রচুর দুধ দিতে লাগলো এবং দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে হালিমার ঘর ভরে দিলো। চারি দিক থেকে হালিমার সংসারে বরকত উপ্চে আসতে লাগলো।

হালিমার সঙ্গী যে সমস্ত ধাত্রীরা দারিদ্রের জন্য তাকে অবজ্ঞা করেছিলো, হালিমার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখতে পেয়ে তার প্রতি ঈর্ষা পরায়না হয়ে উঠলো। তারা কি জানতো যে এ সমস্ত আমার মুহাম্মাদের বরকতে হয়েছিলো!

এভাবে মুহাম্মাদ ছ’বছর বয়সে পৌঁছালো। আমিনা সিদ্ধান্ত নিলো যে, সে তার স্বামী আব্দুল্লাহর কবর যিয়ারতের জন্য মাদীনাহ্ যাবে। এ সফর বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। শিশু মুহাম্মাদ ও শোকাহত আমিনাকে নিয়ে এ সফরে যাত্রা আমাকে চিন্তিত করলো। আমি এ ব্যাপারে আব্দুল মুত্তালিবকে আমার আশঙ্কা সম্পর্কে জানালাম।

এক সকালে আব্দুল মুত্তালিব এলো। সে আমিনাকে এ কষ্টকর সফর থেকে বিরত রাখতে চাইলো। কিন্তু আমিনা তার অটল সংকল্পের কথা জানালে আব্দুল মুত্তালিব অগত্যা রাজী হয়।

একদিন আমি, আমিনা ও মুহাম্মাদ উটের পিঠে এক পাল্কীতে চড়ে সিরিয়াগামী এক বিরাট কাফেলার সঙ্গী হয়ে মাদীনার পথে যাত্রা করলাম। কাফেলা যখন মক্কাহ থেকে রওয়ানা হয়ে দু‘মাইল দূরে পৌঁছলো, মরু কাফেলার গায়করা তাদের গান ধরলো। এ গান শুনলে উটেরা তাদের গতি বৃদ্ধি করে তালে তালে গন্তব্যের দিকে ছুটে। ওদের যেনো নেশায় ধরে।

আমরা চলছি এ দীর্ঘ যাত্রায়, ধূধূ মরুভূমির বুক চিরে। আমি চেয়ে দেখি আমিনার দু’চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা বেয়ে চলছে। আমি তাকে বললাম, “তুমি সাহসী হও, ধৈর্য্য ধারণ করো তোমার শিশু ছেলের সামনে। তা’না হলে সেও যে ভেঙে পড়বে!”

আমরা যে মুহাম্মাদের বাবার কবর যেয়ারতে যাচ্ছি, একথা শিশু মুহাম্মাদকে জানতে দেইনি। কচি শিশু না আবার শোকাহত হয়!

এভাবে আমরা দিনের পর দিন চলছি মরুভূমি দিয়ে। দীর্ঘ পথ। পুরোটা পথই আমিনা তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর স্মৃতিতে বিভোর হয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে দিয়ে কাটালো। আমি তাকে বিভিন্নভাবে মরুভূমির কিসসা- কাহিনী বলে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করি।

অন্য দিকে মুহাম্মাদের দিকে আমিনার খেয়ালই নেই। সে তো আমার গলা ধরে, কোলে ঘুমাচ্ছে। যখনই উঁচু-নিচু পথে চলাকালে উটের ঝাঁকুনীতে মুহাম্মাদ জেগে উঠতো, তারপর পুনঃ শক্ত করে আমার কন্ঠ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। এভাবে দশ দিন পর আমরা মাদীনাহ্ পৌঁছে মুহাম্মাদের মাতৃকুল বনুন্ নাজ্জারদের আতিথেয়তায় উঠি। মাদীনাহ্ পৌঁছে এক দিনও বিশ্রাম না নিয়ে আমিনা ও আমি চল্লিশ দিন প্রত্যহ আব্দুল্লাহর কবরস্থলে যাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা এভাবে কেঁদে কেঁদে আমিনা আরো দুর্বল হয়ে যায়। আমরা মুহাম্মাদকে সঙ্গে নেইনি। তার বয়স মাত্র ছ’বছর। এ বয়সে তাকে পিতৃশোকে ফেলতে চাইনি। তাই তাকে মাদীনায় তার সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলতে দিয়ে আমরা দু’জন আব্দুল্লাহর কবরে চলে যেতাম। শোকে আমিনা ভীষণ দুর্বল হয়ে গেলো। তারপর পুনঃ আমরা রওয়ানা হলাম মক্কার পথে। পথে আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়লো। তার জ্বর হলো। জ্বর দিন দিন বেড়ে এমন হলো যে, একদিন আমিনা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। আমরা তখন মক্কাহ্ ও মাদীনার মাঝ পথে। “আব্ওয়া” নামক এক গাঁয়ের কাছে। আমাদের জন্য কাফেলা একদিন দেরী করলো। কিন্তু আমিনার সুস্থ হয়ে উঠার কোনো লক্ষণ না দেখে কাফেলা আমাদের রেখে চলে আসলো। দিন রাত আমি একা আমিনার সেবা করছি। আমার জানা মতে যতো চিকিৎসা ছিলো, তা’আমি মরুভূমির লতা গুল্ম দিয়ে করলাম। এক কাল রাত্রিতে যেনো আমার মাথায় বাজ পড়লো। আমিনার জ্বর এমন বাড়লো যে আমি হাত দিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি তাৎক্ষণিক আশঙ্কা ও পরবর্তী পরিস্থিতির কথা ভেবে কাঠ হয়ে গেলাম। আমিনার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। এক পর্যায়ে আমিনা ডুবে যাচ্ছে বলে মনে হলো। প্রতি মুহুর্তে যেনো বিদায়ের দিকে এগুচ্ছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে আমিনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার সেবা করতে লাগলাম, আর আগত বিপদের শঙ্কায় বিমূঢ় হতে থাকলাম। এর মধ্যে মুহুর্তের জন্য আমিনা চোখ খুললো। আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আরো কাছে ডাকলো। আমি তার মুখের দিকে ঝুঁকে তার কথা শুনতে চাইলাম। আড়ষ্ট কন্ঠে আমিনা আমাকে বললো ঃ “বারাকাহ্, আমার বিদায়। মুহাম্মাদের ব্যাপারে তোমাকে বলে যাচ্ছি, মুহাম্মাদ তার বাবাকে হারিয়েছে যখন ও আমার পেটে। এখন আমি তোমার চোখের সামনে তাকে একা রেখে বিদায় নিচ্ছি। ওর তো পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কেউ রইলো না। তুমি আমাকেও পেলেছো। আমার পর তুমিই মুহাম্মাদের মা, মুহাম্মাদের সব। মুহাম্মাদকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তাকে তুমি কখনো তোমার থেকে পৃথক করো না।” আমি আমিনার অন্তিম কথাগুলো শুনছিলাম আর চোখের পানি দিয়ে অন্ধকার রাতে মরুভুমির বালুকে সিক্ত করছিলাম। তার কথা শুনে আমি আর আমাকে স্থির রাখতে পারলাম না। আব্দুল্লাহর ঘরে আমি আমিনার পূর্বে এসেছি। আব্দুল্লাহর দেখা-শোনা করেছি। বিয়ের পর আব্দুল্লাহ্ ও আমিনা উভয়ের সেবা যত্ন করেছি। আব্দুল্লাহ্ যেনো না বলেই হারিয়ে গিয়েছিলো। তারপর আমিনাকে নিয়ে আমার জীবন ছিলো। তারপর আব্দুল্লাহর চিহ্ন স্বরূপ আসলো মুহাম্মাদ। এখন আমিনাও চলে যাচ্ছে আমাকে একা মরুভুমিতে রেখে। আমি মুহাম্মাদকে নিয়ে কিভাবে ভবিষ্যতে আমিনা ও আব্দুল্লাহর আমানত রক্ষা করবো, এ সমস্ত কথা একত্রে জড়ো হয়ে মরুভূমির ভয়ঙ্কর একাকীত্ব আমাকে আড়ষ্ট করে ফেলেছিলো। আমার বুক ফেটে কান্না আসলো। নিজেকে আমি আর সামলাতে পারলাম না। অপ্রতিরোধ্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি। আমার কাঁন্না দেখে মুহাম্মাদ তার মায়ের বুক জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। মুহাম্মাদ তার মায়ের কণ্ঠ দু’হাতে জড়িয়ে কাঁদছে। আমি অন্তিম পথের যাত্রী আমিনার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। এমন সময় আমিনা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

*** *** ***

এতো দিনের পুরাতন স্মৃতি বারাকাহ্ বলেছেন, তার লালন পালন ও যত্নে মুহাম্মাদ বড় হয়ে “খাতামুন্ নাবিয়্যীন” “রাহমাতুল্লিল আলামীন” হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার পর। তখন মুহাম্মাদ বিশ্বের বিস্ময়, আর বারাকাহ্ তাঁর আজীবন পালক মাতা। বিশ্বের মানুষের জন্য আল্লাহর পাঠানো রহমতকে লালন পালনের জন্য আল্লাহর পাঠানো “বরকত” বারাকাহর স্মৃতিচারণ। দ্বিতীয় খলীফাহ্ ওমর বিন্ খাত্তাবের খেলাফতের আমলে বারাকাহ্ ইন্তেকাল করেন। প্রায় ষাট বছর পূর্বের ঘটনা বলতে গিয়ে বারাকাহ্ কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েন ও বলেন ঃ আমার দু’হাত দিয়ে মৃত মায়ের কণ্ঠ থেকে মুহাম্মাদকে পৃথক করে মুহাম্মাদের সে কচি হাত দু’খানা আমার গলায় জড়িয়ে আমি তাকে আমার বুকে নিলাম। মুহাম্মাদ ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে সজোরে কাঁদছিলো। কোনো অবস্থাতেই সে আমার কণ্ঠ ছাড়ছিলোনা। সে অবস্থায়ই আমি আমার এ দু’হাত দিয়ে মরুভূমির বালি সরিয়ে কবর খুদে তাতে আমিনাকে শুইয়ে দিয়ে বালু দিয়ে ঢেকে আমার অবশিষ্ট চোখের পানি দিয়ে ভিজিয়ে ছিলাম। রাতের বেলা। অন্ধকার মরুভূমি। হু হু করে মরুর বাতাস বালু উড়িয়ে যেনো আমার কান্না।

বিষয়: বিবিধ

১৮০৬ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

315320
১৬ এপ্রিল ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৫৭
শেখের পোলা লিখেছেন : অজানা বিষয়টি জানানোর জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ৷
২৫ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২২
263531
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : এ হ'লো ইসলাম
315324
১৬ এপ্রিল ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১২
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ
315338
১৬ এপ্রিল ২০১৫ রাত ০৮:১২
নয়ন খান লিখেছেন : দারুন পোস্ট। বইয়ের সূত্র উল্লেখ করুন প্লিজ।
২৫ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২১
263527
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : এ হ'লো ইসলাম
315351
১৬ এপ্রিল ২০১৫ রাত ০৯:৫২
আবু জান্নাত লিখেছেন : সূত্র উল্লেখ করুন প্লিজ। জাযাকাল্লাহ খাইর
২৫ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২১
263528
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : এ হ'লো ইসলাম

ডাউনলোড করে নিন
315389
১৭ এপ্রিল ২০১৫ রাত ০২:২৪
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম । বারাকাহ - উনার অন্য নাম উম্মু আয়মান । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন!

জাযাকাল্লাহু খাইর! Good Luck
২৫ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২২
263530
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : এ হ'লো ইসলাম
315415
১৭ এপ্রিল ২০১৫ সকাল ০৬:১০
লাইট হাউজ লিখেছেন : ঝাকে ঝাকে বলার পরে 'আবাবিল'বলার দরকার নাই। কারন আবাবিল অর্থই ঝাকে ঝাকে।
আমরা অনেকেই ভুল করে পাখিগুলির নাম আবাবিল বলে থাকি। আসলে তা নয়।

এই গল্পটি পরেছিলাম সেই কত আগে (সীরাতে খাতামুন্নাবিয়্যিন থেকে) আবার এক ঝলকে ই পড়ে ফেল্লাম। খুব ভাল লাগল।
২৫ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২২
263529
মারুফ_রুসাফি লিখেছেন : এ হ'লো ইসলাম

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File