বোরকাঃ বন্দীত্বের প্রতীক???
লিখেছেন লিখেছেন মারুফ_রুসাফি ০১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:৪২:৩০ সকাল
“আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে, আমাদের ‘জঘন্য অবরোধ প্রথা’ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে ‘বোরকা’ ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয়, তবে কি বুঝিব যে, জেলেনী, চামারনী, ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে? আমাদের ত বিশ্বাস যে, অবরোধের সহিত উন্নতির বেশি বিরোধ নাই।
যেসব তথাকথিত আধুনিক ধারার বোনেরা বেগম রোকেয়াকে তাদের পূর্বসূরি মনে করেন তাদের জ্ঞাতার্থে বেগম রোকেয়ার মতিচুর ১ম খণ্ডের “বোরকা” নামক প্রবন্ধের ভূমিকা অংশ থেকে কিছু উল্লেখ করলাম ।
এদেশের কিছু প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষের এলার্জি আছে। এই এলার্জির জন্ম মূলত বিদেশে । নিজেদের এই এলার্জি তারা হয়তো এদেশের মুসলিম সমাজের তরুণদের মধ্যে সংক্রমিত করতে চান। আর এই এলার্জি মূলত ইসলামের বিরুদ্ধেই প্রকট আকার ধারণ করে । পশ্চিমা উদার আদর্শের সাথে যখনই ইসলামের কোন বিষয়ের পার্থক্য ঘটে, এই এলার্জির উপসর্গ চুলকানি তখন প্রবলভাবে ধরা দেয় আমাদের সমাজে। নারী ইস্যুতে এই চুলকানি আরও প্রবল।
জ্ঞান অর্জনে বিমুখ নারীজাতিকে সহজেই উসকে দেয়া যায় ইসলামের বিরুদ্ধে । বিকিনি পরা সেমিন্যাংটা মেয়ে দেখে অভ্যস্ত যারা, বোরকা পরা মেয়ে দেখলে চুলকানিতে তাদের রক্তশূণ্য হবার যোগাড় !
বোরকা নিয়ে তাদের চুলকানির কারণ হল, এই বোরকা নাকি বন্দীত্বের প্রতীক। মুক্তির প্রতীক কি? মুক্তির প্রতীক হল, জিন্স-ফতুয়া এইসব। এই কথা তারা সরাসরি না বললেও বুঝা যায়। শরীর ঢেকে রাখা মানেই বন্দী করা। তাইতো গুণী একজন লেখক বলেছেন, “যাহাই সুন্দর তাহাই প্রদর্শনের বিষয়”। যেহেতু নারীদেহ সুন্দর, এই সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হই কি করে ?
তাই, “খোল কাপড় খোল !” বন্দীত্বের দোহাই দিয়ে যারা মেয়েদেরকে আসলে কাপড় খোলাতে চান, তারা জানেন না যে প্রকৃতপক্ষে মেয়েদেরকে আরও বেশি বন্দী করেন ফেলেন তারা। এইদেশে ছেলে মেয়ে উভয়ের কাপড় চোপড়ে যে ব্যাপক বিবর্তন হয়েছে তা কারও অজানা নয়। এই দেশে ১৯৯৯ সালে কোন মেয়ের মাজাক্কালি পরার শখ হয় নাই, হয়েছে হিন্দী সিনেমা দেখার পর। এই দেশে ১৯৫২ সালে লেগিংস পরে কোন মেয়ে মাঠে নেমেছে দেখা যায় না, এটা দেখা যায় ২০১১ সালে। চিপা জিন্স দূরে থাক, আজ থেকে ১০ বছর আগে জিন্স পরতেও কোন মেয়েকে দেখা যায় নাই, আজকে অলিতে গলিতে অহরহ দেখা যায় এমন মেয়ে।এমন কি কাজের মেয়েও মুনিবের কাছে জিন্সের দাবী তোলে। আপনি কি কখনও চিন্তা করেছেন কারা ঠিক করে মেয়েরা কি পরবে ? কাদের হাতের ডিজাইনের জামা ফলো করছি আমরা ?
একটা মেয়ে কি কাপড় পরে সেটা ঠিক করে তার কালচার, ফ্যাশন হাউজ আর কিছু মডেল; অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা সেই মেয়ে নিজে কখনই ঠিক করে না। বরং সে মার্কেটে যায়, সিনেমা দেখে, ম্যাগাজিন ঘাটে, সেখানে যেসব ড্রেসের বিজ্ঞাপন করা হয় সেগুলোই তারা পরে থাকে ।
বেগম রোকেয়া তার সমসাময়িক সময়ের তথাকথিত আধুনিক নারীদের অবস্থা দেখে বেশ আক্ষেপ করে তার “বোরকা” প্রবন্ধে বলেছেন-
“বর্তমান যুগে ইউরোপীয় ভগ্নীগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন; তাহাদের পর্দা নাই কে বলে? তাহাদের শয়নকক্ষে, এমনকি বসিবার ঘরেও কেহ বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেন না। এ প্রথা কী দোষণীয়? অবশ্য নহে। কিন্তু এদেশের যে ভগ্নীরা বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহাদের না আছে ইউরোপীয়দের মত শয়নকক্ষের স্বাতন্ত্র্য না আছে আমাদের মত বোরকা !
কেহ বলিয়াছেন যে, “সুন্দর দেহকে বোরকা জাতীয় এক কদর্য্য ঘোমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কিম্ভুতকিমাকার জীব সাজা যে কী হাস্যকর ব্যাপার যাহারা দেখিয়াছেন, তাহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন”- ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে রেলওয়ে প্লাটফরমে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমন্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।
ইংরেজি আদব কায়দা আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, ভদ্রমহিলাগণ আড়ম্বররহিত পোশাক ব্যবহার করিবেন-বিশেষত পদব্রজে ভ্রমণকালে চাকচিক্যময় বা জাঁকজমক বিশিষ্ট কিছু ব্যবহার করা তাহাদের উচিত নহে।”
আমাদের সমাজে পোশাকের বিবর্তন এতো দ্রুত হচ্ছে যে কাপড় তৈরি করার পর এক বছর না যেতেই সেটা পরার আর উপযোগী থাকছে না । আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে কেউ যদি ধৈর্য্য ধরে সমসাময়িক সময়ে অচল কোন একটা ড্রেস আলমারিতে রেখে দেয় তাহলে ৩-৪ বছর পর আবার সেই ড্রেস ফ্যাশনাবল ড্রেস হিসাবে চালানো যাবে ।
আজকে যেটাতে স্মার্ট লাগছে, কালকে সেটা ক্ষ্যাত, কে বলেছে ? দুজন জনপ্রিয় মডেল বলেছে। কাদেরকে দিয়ে ঠিক করানো হয় কোনটা পরতে হবে আর কোনটা খুলে ফেলতে হবে? বছর খানেক আগে এক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই দেশের মেয়েদেরকে শেখানো হল পার্টিতে গেলে হাটুর উপর কাপড় তুলতে হয়। একটা ফ্যাশন হাউজ মেয়েদের শেখায় দিল ওড়নার জায়গা বুকে নয়, হাতে । আর তা না পরলেও চলবে। হিন্দী সিরিয়াল আর সিনেমাগুলো শেখায় শাড়ির ফাঁকে নাভি না দেখিয়ে চাম্মাক চালো হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমার প্রশ্ন তথাকথিত
“স্মার্ট” “উচ্ছল” এবং “মুক্ত” মেয়েরা যখন এইসব কাপড় পরে তখন কি তারা সেগুলো নিজে থেকে পরে; নাকি তাদেরকে এইসব ড্রেস পরানোর মাধ্যমে সেগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ঘোষণা করে সাইকোলজিক্যালি তাদেরকে প্রেসার দেয়া হয় ? এটা হল এক ধরণের দখলদারিত্ব; তবে সেই দখলদারিত্ব কোন বৈদেশিক দখলদারিত্ব নয়,সাইকোলজিক্যাল দখলদারিত্ব। মেয়েদেরকে বুঝানো হয় তুমি এটা পরলে স্মার্ট, আর ঐটা পরলে ক্ষ্যাত। শরীর দেখালে আধুনিকা, ঢেকে রাখলে ব্যাকডেটেড।কে চায় ক্ষ্যাত হতে? তাদের মাথায় এই ফ্যাশন হাউজগুলো যা ঢুকাচ্ছে তাই তারা নিচ্ছে, ব্রেইনওয়াশ করছে, এখানে মুক্তির আছেটা কি ? আধুনিকতার দোহায় দিয়ে তাদেরকে সেন্টিমেন্টালি পরাধীন করে দেয়া হচ্ছে ।
এটা কি চয়েস নাকি কমপালশন ??? এটা অবশ্যই কমপালশন । ছেলে হোক, মেয়ে হোক,আমাদের পোষাকের চয়েসটা সম্ভাব্য কি হবে সেটা আমাদের সমাজ থেকে ঠিক করে দেয়া হয়, মোর স্পেসিফিক্যালি বললে মূলত ফ্যাশন হাউজগুলো। আমরা যা কিছু চয়েস করি না কেন তা আসে আমাদের প্রবৃত্তির থেকে, কালচার থেকে, মিডিয়া থেকে, রোল মডেলদের কাছ থেকে। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে পারি – পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা আসলে দাস, এদের কাছেই বন্দী।
আর ইসলামও তো একধরনের কালচার, জীবন ব্যবস্থা । সেটা থেকে কিছু আসলে তাতে আপত্তি কেন? কোথায় ঘা লাগে সবার আমি সেটাই বুঝে পাই না !
এই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলো যে চয়েস নামক ব্যাপারটা ধর্ষণ করে তা নয়, সাথে আছে তার ছোট ভাই কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রি আর পার্লারগুলো। সুন্দরী বলতেই আমাদের চোখে ভেসে আসে লম্বা, ছিপছিপে, উজ্জ্বল রঙের তরূণী, যে ইমেজটা করে দিয়েছে পার্লারগুলো! বিউটিশিয়ানদের হাতে স্বামীর রোজগারের অর্ধেক টাকা ব্যয় হয় নিজের ফ্যাসিয়াল, চুলের রি বনডিং, প্রোটিন ট্রিটমেন্ট করতে এবং বিউটি এক্সপার্টদের নির্ধারিত জিরো ফিগার অর্জন করতে তাই দিনরাত পরিশ্রম, ডায়েটিং আর ব্যায়াম ! ৩৬-২৪-৩৬ হতে না পারলে ইজ্জত নষ্ট! আমি জানতে চাই, এই জিরো ফিগার;এই ৩৬-২৪-৩৬ কে সেট করে দিয়েছে ? তাদের হাতে কেন বন্দী হয়ে আছে আমার বোনেরা ?
একজন সত্যিকারের মুসলিমাহ, তিনি অবশ্যই পর্দা করবেন । সেটা বোরকা বা অন্য কোন পোশাকের মাধ্যমে হোক; এজন্য তিনি বন্দী নন। বরং তিনিই সত্যিকার অর্থে স্বাধীন । কারণ তিনি সেই কাপড়টা পরেন না যেটা তাকে ডিজাইনার পরতে বলে, তিনি সেই কাপড়টাও খোলেন না যেটা তাকে কোন ফ্যাশন হাউজ খুলতে বলে। তিনি নিজের প্রবৃত্তির পূজারী নন, তিনি এমনও নন যিনি কালচার নামক অ্যাবস্ট্রাক এবং রিলেটিভ কিছু সেট অফ কনসেপ্টকে বিনা বাক্য ব্যায়ে গ্রহণ করেন। একজন মুসলিমাহ হচ্ছেন চিন্তাশীল নারী, যিনি জানেন তিনি কোথা থেকে এসেছেন এবং কার কাছে ফিরে যাবেন। তিনি সচেতন কারণ তিনি জানেন দাসত্ব করতে হয় এক সৃষ্টিকর্তার তথা আল্লাহর, ফ্যাশন হাউজের কিংবা যুবকের ক্ষুধার্ত চোখের নয়। তিনিই মুক্ত কারণ তার লাইফের রোল মডেল শরীরসর্বস্ব কোন মডেল বা সিনেমার নায়িকা নয় যে অর্থের বিনিময়ে তার ধোকাঁবাজিময় বিজ্ঞাপন করে সৌন্দর্য নিয়ে ব্যবসা করে।
একজন মুসলিমাহ তার পোশাকটা কেমন হওয়া উচিত সেটা জেনে নেন সর্বজ্ঞানী থেকে , কোন স্বার্থপর মুনাফাভোগীর কাছ থেকে নয়। তার মূল্য তার তাকওয়ায়, সমাজের তথাকথিত স্মার্টনেসের ডেফিনিশনে নয়। বন্দী হল তারা যারা স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে ভেসে চলে, বন্দী হল তারা ; যারা ফ্রিডম এর মিথ্যা ধারণায় ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে আছে। বন্দী এই মানুষগুলোকে মুক্ত করবার দায়িত্ব কিন্তু আমার, আপনার, সবার ।
Written by: Abdullah Al Maruf
Modified by: Sharmin Aktar
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৬ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিও একটা বিষয় ভেবে আজ ক্লান্ত- হাটু আর নাভি দেখিয়ে যারা রাস্তায় বা কোন অনুষ্ঠানে যায়, এসবের মানে আসলে কি? এসব মেয়েরা আসলে কি বুঝাতে চায়।
আপনার চিন্তা অনেক গভীরে চলে গেছে>>>
আসলে এই গুলো হচ্ছঃ
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ [٤٣:٣٦]
যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। (সুরা যুখ্রুফঃ ৩৬)
সুস্মিতাদের মতো হতে পারবেন না, আপনাকে হয়তো সেই কথিত সুন্দর ও লাগবে না। কারন, আপনার দেহ বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি করে নেন নি!
এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় ক্যাটালগ আপনি ই! কারন আল্লাহ আপনাকে ৭০০ কোটি মানুষের
মধ্যে আপনি হিসেবেই অনন্য করে সৃষ্টি করেছেন। একটু কথিত সুন্দর লাগার জন্য তাহলে মিছে কেন মরিয়া হয়ে ঘোরা!
মন্তব্য করতে লগইন করুন