ধনী আমেরিকানদের গরিবি জীবন
লিখেছেন লিখেছেন মারুফ_রুসাফি ০৯ মার্চ, ২০১৪, ০৭:৫৪:৩৫ সন্ধ্যা
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ আমেরিকা। ৫০টি রাজ্য নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রে অনেক জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ বসবাস করে। আগুনের জৌলুস বা ছটা দেখে কীটপতঙ্গ যেভাবে ছুটে যায় আগুন পানে, একইভাবে আমেরিকার সম্পদ, চাকচিক্য, সুপার পাওয়ারের আকর্ষণে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে মানুষ ছুটে যেতে চায় সেখানে। আইনি, বেআইনি, লটারিসহ কত পথই খোলা আছে। যে যেভাবে পারে, সেভাবেই আমেরিকা যেতে চায় এবং যায়।
সবাই জানে দেশটির জাঁকজমক, ঠাট-বাট, অতুল ঐশ্বর্যের কথা, আমেরিকানদের বিলাসী জীবনযাপনের গল্প, মেম সাহেবদের গল্প, স্বপ্নময় হলিউডের গল্প, যুদ্ধনীতির কথা, আগ্রাসী ভূমিকার কথা। আমেরিকায় সাদা মানুষের পাশাপাশি কালো মানুষ, এশিয়ান, ককেশিয়ান, মেঙ্কিানরাও সমান অধিকার নিয়েই বসবাস করে। আমেরিকা মানেই ফ্রিডম, আমেরিকা মানেই গণতন্ত্র! এখানে আইনের শাসন আছে, আইন প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান। আমেরিকায় বসবাসরত প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে মূল্যবান। এমনই তত্ত্বকথা সবার বিশ্বাসের গভীরে লুকানো থাকে।
যান্ত্রিকতার বাইরে
তবে এখানেই আমেরিকার গল্প শেষ নয়। অত্যাধুনিক আমেরিকার বুকে এখনো কতিপয় শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে, যারা আমেরিকার সব আধুনিকতা, যান্ত্রিক সভ্যতাকে অস্বীকার করে নিজেদের মতো করে জীবনযাপন করে চলেছে কয়েকশ' বছর ধরে। তারা সবাই তাদের প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে নিজেদের জন্য আলাদা ভুবন সৃষ্টি করে নিয়েছে। তাদের ভুবনে আধুনিক আমেরিকার স্থান নেই। এই শ্রেণী বা গোষ্ঠীর মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ আছে। একেক গোষ্ঠীর একেক নাম। যেমন অ্যামিশ সম্প্রদায়, মেনোনাইট সম্প্রদায়, মর্মেন সম্প্রদায় এবং এমনই আরও কিছু কিছু ভিন্ন ভিন্ন নামের সম্প্রদায় বাস করে আমেরিকাতে। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে সবাই খ্রিস্টান, তবে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। আধুনিকতাকে ওরা নিজেদের বিশ্বাসের পরিপন্থী মনে করে। মেনোনাইট সম্প্রদায় গোঁড়া হলেও অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতাকে কিছুটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু অ্যামিশরা এর উল্টো। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে এদের কোনো আপস নেই। কয়েক শতক আগেই আদি মেনোনাইট গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে অ্যামিশরা নিজেদের গোষ্ঠী বলয় তৈরি করেছে।
মেনোনাইটের ইতিহাস
অ্যামিশ অথবা মেনোনাইটস সম্প্রদায়ের মানুষগুলো আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা আদি আমেরিকান নয়, সবাই ইমিগ্র্যান্ট। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ড, জার্মানিতে 'মেনোনাইট' নামের বেশ বড় গোষ্ঠীর সম্প্রদায় ছিল, যারা চার্চের কঠিন নিয়মে পরিশীলিত, সুশৃঙ্খল, কঠোর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। ১৬৯৩ সালে, সুইজারল্যান্ডে জ্যাকব আম্মান নামের এক খ্রিস্ট ধর্মগুরু, মূল মেনোনাইট থেকে আলাদা হয়ে আরও বেশি কঠোর নিয়মের ভেতর থেকে সাধারণ জীবনযাপনের পক্ষে মত প্রচার শুরু করেছিলেন। কিছুটা উদারপন্থি মেনোনাইট থেকে আলাদা হয়ে অনেকেই গুরু আম্মানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু আম্মানের মতানুসারীরাই পরবর্তীতে অ্যামিশ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন কারণে নিজ দেশে টিকতে না পেরে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিপুলসংখ্যক অ্যামিশ আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ায় অভিবাসী হয়ে আসে। ধীরে ধীরে এরা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক লাখ ৬৫ হাজারেরও বেশি অ্যামিশ বাস করে আমেরিকাতে এবং ১৫০০ অ্যামিশের বসবাস আছে কানাডাতে। সর্বশেষ ২০১০ সালের পরিসংখ্যানে তা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজারে।
অতি সাধারণ জীবন
অ্যামিশরা খুবই কট্টরপন্থি, গোঁড়া। ওদের জীবন-যাপন খুবই সাধারণ মানের। বাইরের সমাজ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতেই ওরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুধু নিজ গোষ্ঠীর মানুষ নিয়েই ওদের সমাজ, যাদের সবাই আধুনিকতাকে ঘৃণা করে। যান্ত্রিক সভ্যতা, মানুষের নতুন নতুন আবিষ্কারকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ মনে করে। সে জন্যই অ্যামিশ জনগণ স্বাভাবিক লোকালয় থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখে। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একেবারে নিভৃত পল্লীতে ওদের নিজস্ব গ্রাম তৈরি করে ওরা বাস করে। সেখানে অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই।
ওরা আধুনিক জগতের কোনো সংবাদ রাখে না। ঝলমলে আমেরিকায় বাস করে ওরা ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করে না, টিভি দেখে না, রেডিও শোনে না, টেলিফোনও ব্যবহার করে না। মুভি দেখার প্রশ্নই আসে না। কারণ, ওদের বিশ্বাস, টিভি দেখলে বা রেডিও শুনলে শিশুরা শুধু নোংরামি শিখবে। কারও বাড়িতেই বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে না, ফ্যান, এসি, ফ্রিজ কিছুই চলে না। ওদের বিশ্বাস ইলেকট্রিসিটির ব্যবহার প্রকৃতির আলো-বাতাসে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িতে ওয়াটার সাপ্লাইয়ের পানির বদলে ওরা ডিপ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করে। অ্যামিশরা মোটরগাড়ি, ট্রেন বা প্লেন, কোনোটিতেই চড়ে না। ওরা চড়ে নিজেদের তৈরি ঘোড়ায় টানা 'বাগি'তে। অ্যামিশ মহিলারা খুবই পর্দানশিন, বাড়ির ভেতরেই এদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকে। হাটবাজার করতে হলে ঘরের পুরুষরাই কাছাকাছি ওদের নিজস্ব হাট থেকে বাজার-সদাই করে আনে। মেয়েরা অন্দরের যাবতীয় কাজ করে থাকে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর পরিষ্কার করা, ছেলেমেয়েদের পরিচর্যা, পুরুষদের যত্ন-আত্তিসহ যাবতীয় ঘরোয়া কাজ মেয়েরাই করে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার জামা-কাপড়, বিছানা-বালিশ নিজেরাই সেলাই করে। ওদের পোশাকের ডিজাইনও একেবারেই আলাদা। আমেরিকান ললনারা যেখানে যার যার ইচ্ছেমতো ডিজাইনের পোশাক পরিধান করে, তা হতে পারে সংক্ষিপ্ত অথবা লম্বা ঝুলওয়ালা, কিন্তু অ্যামিশ মেয়েদের পোশাক হয় পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা। মেয়েদের মাথা ঢাকা থাকে কানঢাকা টুপিতে, যেন ওদের মাথার চুল কেউ না দেখতে পায়। ছেলেরা অবশ্যই লম্বা দাড়ি রাখে, মাথায় হ্যাট পরে, খুব সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরে। সাধারণ আমেরিকানদের মতো ওরা মদ্যপান করে না, ধূমপানও করে না, নেশা ভাঙের প্রশ্নই আসে না। স্টুডিওতে গিয়ে ছবিও তোলে না, ক্যামেরাও ব্যবহার করে না। এক প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দুই তিন পুরুষ আগের প্রজন্মের গল্প শোনায়। কে কেমন দেখতে ছিল, তার একটি কাল্পনিক বর্ণনা দেওয়া হয়। যেহেতু তাদের জীবনযাপনে কোনো বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব নেই, তাই পূর্ব প্রজন্মকে চোখে না দেখেও পরবর্তী প্রজন্ম ধারণা করে নিতে পারে, কেমন ছিল তাদের পূর্বপুরুষরা দেখতে। মেয়েরা ঘরে থাকলেও কখনো যদি আত্দীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যেতে হয়, তাহলে তারা ঘোড়ায় টানা 'বাগি'তে চড়ে যায়। ('বাগি' হচ্ছে বাংলায় 'টাঙ্গা')। বাগির ভেতর মহিলারা থাকে পর্দায় ঢাকা, পুরুষরা বাগি চালায়। এমনই পর্দানসীন ওরা, ছেলেমেয়েদের পাবলিক স্কুলে পাঠায় না, ওদের নিজস্ব স্কুল আছে যেখানে শুধুই ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। অ্যামিশদের নিজস্ব চার্চ আছে। চার্চেও শ্রেণীভেদ আছে। এলাকাভিত্তিক চার্চে শুধু ওই এলাকার অ্যামিশ জনগণই যেতে পারে। ওদের মধ্যেও উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ আছে।
কৃষি ও পশুপালনে জীবন পার..
ওদের আয়ের উৎস হলো কৃষি ও পশুপালন। কৃষি থেকে উৎপাদিত পণ্যেই ওদের সাদামাঠা সংসার জীবন চলে যায়। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে ওরা ভীষণ রক্ষণশীল। পাত্র বা পাত্রী খ্রিস্টান হলেই হবে না, অ্যামিশ হতেই হবে। নিজ গোত্রের বাইরে ওরা ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেয় না। উপযুক্ত পাত্র না পেলে প্রয়োজনে মেয়েরা বা ছেলেরা সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যায়। যুবক-যুবতীদের মধ্যে কেউ যদি অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে পছন্দ করেও ফেলে, প্রথমে তাকে পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হয়, এরপর চার্চ থেকে নিষেধ করা হয়, অবাধ্য হলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়, প্রয়োজনে তাকে পরিবার থেকে ত্যাজ্য করা হয়, এমনকি সমাজচ্যুত করা হয়। অ্যামিশ এলাকার ভেতরে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। কেউ নিষেধ অমান্য করলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়, প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হতে পারে।
অ্যামিশ জনগণ জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে না, গর্ভধারণ করলে শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতেই হবে। সুতরাং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণে ভ্রূণ অবস্থায় হত্যার কোনো সুযোগ নেই। গর্ভধারিণীর জীবন সংশয়ের প্রশ্নেও গর্ভপাত নিষিদ্ধ। তাদের বিশ্বাস ঈশ্বর মুখ দেন, আহারও তিনিই দেবেন। ঈশ্বর যখন যাকে যেভাবে পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন, তাকে সেভাবেই থাকতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। এই সম্প্রদায়ে শিশু মৃত্যুর হারও বেশি, প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হারও বেশি। অ্যামিশ ছেলেমেয়েদের মাঝে 'বামন'-এর হারও বেশি। কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়ে থাকে, বহির্জগৎ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখে বলেই এ সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃবিবাহ হয়, খুব ঘনিষ্ঠ আত্দীয় সম্পর্কিত পাত্রপাত্রীর মধ্যে বিয়ে হয় বলেই ওদের বাচ্চাদের মধ্যে জেনেটিক সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। এবং একই কারণে শিশুমৃত্যুর হারও অনেক বেশি। তবে বিজ্ঞানের এই যুক্তি তারা মানে না, তাদের বিশ্বাস, জগতের সব কিছু ঈশ্বরের ইশারায় চলে। জন্ম-মৃত্যু সবই ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে মানুষের অবদানও যে ঈশ্বর প্রদত্ত বুদ্ধিবলেই হচ্ছে, এ ব্যাপারে তারা নীরব। ওদের সমাজে পুনর্বিবাহ বা বিবাহ বিচ্ছেদ, কোনোটাই নেই। বিবাহিত দম্পতির মধ্যে কেউ যদি অপরজনের সঙ্গে প্রতারণা করে, তাহলে সমাজে তার বিচার হয়, বিচারেই শাস্তির বিধান দেওয়া হয়। যেহেতু পুনর্বিবাহ নেই, তাই বিধবা হলে বা কুমারী থেকে গেলে বাকি জীবন মেয়েদের ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়। ছেলেদের জন্যও একই নিয়ম। এভাবেই চলেছে যুগের পর যুগ। মুভি 'উইটনেস' অথবা 'দ্য অ্যামিশ'-এ খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে ওদের জীবন। তবে, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোয়ারের উল্টো স্রোতে চলা অ্যামিশদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে। অ্যামিশদের মধ্যেও মতবিরোধ আছে এবং তা বেড়ে চলেছে। যারা খুবই কট্টরপন্থি, তারা নিজেদের কিছুটা উদারপন্থিদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। উদারপন্থি অ্যামিশরা প্রতিনিয়তই দেখছে, উদারপন্থি মেনোনাইটরা নিজেদের অবস্থানে ঠিক থেকেই আমেরিকার আধুনিকতাকেও গ্রহণ করেছে। মেনোনাইটরা আচারে-আচরণে ধার্মিক হয়েও বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে অস্বীকার করছে না, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সুফল তারাও ভোগ করছে। ফলে মেনোনাইটদের জীবন অ্যামিশদের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। জীবনের কঠিন হিসাব-নিকাশের কাছে অনেক অ্যামিশই নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর বাকিরা অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে।
বিষয়: বিবিধ
২৮৪৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন