আর নয় ‘রিয়া’

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ_রুসাফি ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:১১:০৪ সকাল



আজ রাজার বাড়িতে দাওয়াত। এলাকার এক লোক তার ছেলেকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। যথারীতি পৌঁছালেন রাজপ্রাসাদে।

নামাজের সময় হলে রাজার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি নামাজ পড়লেন। তারপর ভোজসভা। রাজার পাশে বসে খেলেন। এবার ঘরে ফেরার পালা।

ঘরে ফিরেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন তিনি, কই গো! খাবার আনো, পেটের ক্ষুধা মেটেনি। সাথে থাকা ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, ‘আব্বা! আপনি না রাজপ্রাসাদ থেকে এই মাত্র খেয়ে এলেন। আবার খাবেন?’ মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘বাবা, রাজার পাশে বসেছিলাম তো, তাই বেশি করে খাইনি, পাছে রাজা আবার পেটুক বলেন! সামান্য কয়েক লোকমা খেয়েছি, তাই আবার খাচ্ছি।’

ছেলেটি এবার মুখ খুলে বলে দিল, ‘তাহলে আব্বা, নামাজও আবার পড়ে নিন। রাজার পাশে নামাজও হয়তো আজ আপনি তাকে দেখানোর জন্য সুন্দর করে পড়েছেন, আল্লাহর জন্য নয়।’ এ কথায় চুপসে গেলেন তিনি।

শুধু তিনি না, দিনে রাতে আমরাও অহরহ মানুষকে দেখানোর জন্য কতো আমল করি! আমাদের সমাজে চারিদিকে আজ ‘সৌজন্যে’র ছড়াছড়ি। মসজিদ কিংবা মাদ্রাসার দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির গায়েও অঙ্কিত থাকে, ‘এ ঘড়িটি দান করেছেন অমুক আলহাজ!’

নিজেদের দান দক্ষিণা প্রচার করে দানবীর সাজার এ লড়াইয়ে সমাজপতিদের আগ্রহের কোনো কমতি নেই।

রাসুল (সা.) এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম একদিন বসে আলোচনা করছিলেন। রাসুল (সা.) এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে তোমরা কথা বলছিলে, তারা জানালেন, আমরা দাজ্জালের প্রকাশ ও বিপদ নিয়ে কথা বলছিলাম। রাসুল (সা.) বললেন, আমি তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও কোন বিষয়টি নিয়ে বেশি আশঙ্কা করি জানো? তা হচ্ছে, পরোক্ষ শিরক। অর্থাৎ মানুষ তখন দু’রাকাত নামাজ এমন সুন্দরভাবে আদায় করবে যেন অন্যরা তাকে দেখে। (আহমদ, ইবনে মাজাহ)

লোক দেখানোর জন্য কোনো আমল করার নাম রিয়া। হাদীসের ভাষায় এ বিষয়টিকে ‘শিরকে খফী’ অর্থাৎ অপ্রকাশ্য শিরক বলা হয়েছে।

মুসলমানের সব আমল তো একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত হবে, এর নাম ইখলাস। ইখলাস ও রিয়ার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত দুই মেরুতে।

কিয়ামতের মাঠে যে সাত ধরনের লোক আল্লাহ পাকের আরশতলে ছায়া পাবে, তাদের এক প্রকার এমন ব্যক্তি হবেন যে তারা এত গোপনে ডান হাতে দান করতেন যা তাদের বাম হাতও জানতো না।

প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও নবীর বংশধর যাইনুল আবিদীন বিন আলীকে মৃত্যুর পর যখন গোসল দেওয়া হচ্ছিল, তখন তাঁর পিঠে ও কাঁধে রশির দাগ দেখে সবাই অবাক হলেন। তাঁর স্ত্রীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন, রাতের অন্ধকারে তিনি নিজের পিঠে খেজুর, কিসমিস, আটা, ময়দা বহন করে একাকী বের হতেন আর বিভিন্ন ঘরের সামনে গিয়ে সেগুলো রেখে আসতেন।

তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পরিবারগুলোর কেউ জানতে পারেনি, কে প্রতি রাতে তাদের জন্য এসব খাবার রেখে যায়।

যেদিন তাঁর ইন্তেকালের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেল, সেদিন সবাই জানলেন, কে ছিল রাতের আগন্তুক।

পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা ও সূরা মাঊনে দুই জায়গায় আল্লাহ ওই সব লোককে মন্দ বলেছেন, যারা লোক দেখানোর জন্য নামায আদায় করে।

তাদের মুনাফিকও বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, মানুষের মালের লোভ ও সম্মানের আশা তার দ্বীন ও আমলে এর চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করে। (তিরমিযী)

যারা এখানে সেখানে ওয়াজ করেন, বক্তব্য রাখেন- তাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের সামনে কোনো বয়ান করে বা বক্তব্য রাখে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, এ বয়ানের পেছনে তার কী উদ্দেশ্য ছিল? (বায়হাকী)

তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে কেউ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশে ইলম শিখে (আলেম মাওলানা হয়) সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বুঝে নেয়।

আরও ভয়ংকর বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জুব্বুল হাযান’ নামে জাহান্নামের একটি উপত্যকা রয়েছে, স্বয়ং জাহান্নাম তার কাছ থেকে প্রতিদিন ১শ’ বার রক্ষা চায়। এ ভয়ঙ্কর উপত্যকাটি ওইসব কুরআন পাঠকদের জন্য, যারা লোক দেখানোর জন্য আমল করে। (তিরমিযী)

সুতরাং সাধারণ মুসলমান কিংবা আলেম ওলামায়ে কেরাম, সবার জন্য এক চরম সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে এমন অসংখ্য হাদীসে।

সামান্য কোনো কাজও যদি মানুষের কাছে নিজের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ানোর জন্য করা হয়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন সবার সামনে ঘোষণা করে তা প্রকাশ করে দেবেন। আর বলে দেবেন, যার জন্য আমল করেছিলে, তার কাছ থেকে এর প্রতিদান নিয়ে নাও।

তাফসিরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ রয়েছে, কেউ মানুষকে দেখানোর জন্য যতক্ষণ কোনো আমলে ব্যস্ত থাকলো, ততক্ষণ সে আল্লাহ পাকের অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকলো।

ইবনে মাজাহ শরীফের এক হাদীসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, দুনিয়াতে যারা সুনাম সুখ্যাতির পোশাক গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন।

আমাদের মানসিক গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এ কয়েকটি হাদীস যথেষ্ট।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা শীতার্তদের পাশে কম্বল বিতরণের জন্য ক্যামেরাম্যান সাথে নিয়ে যাওয়া, সামান্য ত্রাণ বিতরণের জন্য সারা এলাকায় দাতার নাম প্রচার করা, কথায় কথায় নিজের আমলের কথা অন্যকে শোনানো, আলহাজ্ব হওয়ার জন্য হজ্বে যাওয়া- আমাদের সামাজে এমন লোকের অভাব নেই।

তবুও সবার আগে নিজেকে সংশোধিত হতে হবে। আর কারো জন্য নয়, একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য নিবেদিত হতে হবে এক টাকা দান করা থেকে শুরু করে নিজের সব আমল ও ইবাদত।

আবার এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে, কোনো আমল মানুষকে জানানোর কোনো ইচ্ছাই হয়তো ছিলনা, তবুও যদি মানুষ জেনে যায়, তবে আশঙ্কার কিছু নেই। এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

৯৩৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

184391
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:২৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ সুন্দর পোষ্টটির জন্য।
আমাদের রিয়া তো এখন এমন পর্যায়ে দুপুরে মসজিদে অন্যদের ধাক্কাদিয়ে সরিয়ে প্রথম সারিতে নামাজ পড়ি আর বিকালে পাঠ্য বই থেকে ইসলামি শিক্ষা তুলে দেওয়ার দাবি করি।
184408
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০১:১৭
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ০ লিখেছেন : ধন্যবাদ, অনেক সুন্দর লিখা উপহার দেয়ার জন্য । চালিয়ে যান..
184424
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ দুপুর ০২:০৫
ভিশু লিখেছেন : বড় সুন্দর, মূল্যবান, জরুরী এবং উপকারী একটি পোস্ট!
জাযাকাল্লাহ খাইরান ভাইয়া!
Praying Praying Praying
Rose Rose Rose
184502
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৮
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : সকল আমল ধ্বংশ করে দেয় এই রিয়া
184638
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:৫২
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, জাজাকাল্লাহুল খাইরান, শিক্ষনীয় পোস্ট
184640
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:৫৪
মাটিরলাঠি লিখেছেন : যাযাকাল্লাহু খাইরান।

অতীব জরুরী, প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও সুন্দর লেখা।

184670
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১০:১২
সজল আহমেদ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File