তুমিই জয়ী হবে—মাইকেল জ্যাকসন
লিখেছেন লিখেছেন বিল্লাহ মাসুম ২০ আগস্ট, ২০১৩, ১২:৩৫:০০ দুপুর
আট বছর বয়স থেকেই মঞ্চ মাতানো শুরু। জ্যাকসন ফাইভ ব্যান্ডদলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যটি এ সময় পরিচিতি পান নিজের নামেই। শুধু গান নয়, নাচ, ফ্যাশন—সবকিছুতেই মাইকেল জ্যাকসন (১৯৫৮—২০০৯) ছিলেন অনবদ্য। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাঁকে দিয়েছে সর্বকালের সেরা এন্টারটেইনারের খেতাব। পেয়েছেন কিং অব পপ উপাধিও। পাশাপাশি কাজ করে গেছেন সারা বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’ ফাউন্ডেশন গড়েছেন এ কাজের জন্য। ২০০১ সালের ৬ মার্চ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ‘হিল দ্য কিডস’ উদ্যোগটি পরিচিত করার জন্য এ বক্তব্য দেন তিনি।
"এখানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমার কী কী যোগ্যতা আছে—সে কথা বলেই বোধহয় শুরু করা উচিত। বন্ধুরা, আমার আগে এখানে যাঁরা বলে গেছেন, তাঁদের মতো পড়াশোনা আমার নেই। ঠিক তেমনই আমার মতো ‘মুনওয়াক’ করার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। তবে একটা দাবি আমি করতেই পারি, বেশির ভাগ মানুষের তুলনায় দুনিয়াটা আমার অনেক বেশি দেখা হয়েছে। শুধু কাগজ আর কালিতে তো ধরা যায় না মানুষের জ্ঞান। হূদয়ে যে কথা লেখা হয়ে থাকে, আত্মায় যা গেঁথে যায়, শরীরে যা খোদাই হয়ে যায়, সেসব মিলিয়েই তৈরি হয় মানুষের জ্ঞান। আর এই জীবনে আমি যত কিছুর মুখোমুখি হয়েছি, তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমার বয়স মাত্র ৪২! অনেক সময় আমার মনে হয় বয়স বোধ হয় ৮০ ছাড়িয়ে গেছে।
আমার অর্জনগুলো দিয়ে কিন্তু আমার ভেতরের মানুষটাকে চেনা যাবে না। ভক্তদের সামনে রকিন, রবিন বা বেন গাইতে থাকা পাঁচ বছরের শিশুটি আর তার হাসির আড়ালে থাকা শিশুটি এক নয়। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই গান গাইছি, নাচছি। কাজটা আমার জন্য খুব আনন্দেরও। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম গাছ-বাড়ি বানিয়ে, লুকোচুরি খেলে আমার শৈশবটা কাটাতে। আমার আশপাশের শিশুদের এমন জীবন দেখে হিংসা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার। আমার কোনো শৈশব নেই— এই বোধটাই আমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।
আমি এসব তোমাদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বলছি না। আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বোঝানোর জন্যই বলছি। আজ শুধু হলিউডের শিশুরাই নয়, সারা বিশ্বেই শিশুরা ভুগছে এই বেদনায়, শৈশব না থাকার কষ্টে। এখন শিশুদের ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠার জন্য। যেন শৈশব খুব কষ্টের সময়। এটাকে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে হবে। আর এর ফলে শিশুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মা-বাবা ও পরিবারের কাছ থেকে।
এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই যেন জন্ম নিয়েছে এক নতুন প্রজন্মের। আমি সেই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি। আমাদের বাইরেটা ঝাঁ চকচকে—টাকা-পয়সা, দামি কাপড়চোপড়, বিলাসবহুল গাড়ি। কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা। এটা শুধু আমাদেরই যন্ত্রণা নয়, আমাদের মা-বাবারও।
আজ আমি শিশুদের অধিকারের কথা বলতে চাই। প্রতিটি বাড়িতে প্রতিটি শিশুর এই অধিকার থাকবে:
১. ভালোবাসা পাওয়া। ২. সুরক্ষা পাওয়া। ৩. মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হওয়া। হয়তো সে কিছুই করতে পারেনি, তবুও সে মূল্যবান। ৪. শিশুর সব কথা মন দিয়ে শোনা—তা খুব উপভোগ্য না হলেও। ৫. ঘুমোতে যাওয়ার আগে অন্তত একটা গল্প শুনতে পাওয়া—সন্ধ্যার খবর বা টিভি সিরিয়ালের সময়টা যাতে এ জন্য বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। ৫. স্নেহ পাওয়া—হয়তো মা ছাড়া আর কারও কাছেই শিশুটি সুন্দর নয়, তবুও।
বন্ধুরা, আমাদের সব জ্ঞানের, বোধের শুরুটা হোক এভাবে—আমরা জানি আমাদের কেউ না কেউ ভালোবাসে।
প্রায় ১২ বছর আগের কথা। আমার ব্যাড ট্যুরের আগে ছোট্ট একটি ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে আমাকে, আমার গান কত ভালোবাসে, সেসব বলল। ছেলেটি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল। তার মা-বাবার কাছ থেকে জানলাম, যেকোনো দিন সে মারা যেতে পারে। আমি ছেলেটিকে বললাম, ‘তিন মাসের মধ্যে আমি তোমার শহরে গান গাইতে আসব। তোমাকে আমার এই জ্যাকেটটা দিলাম। এটা পরেই কিন্তু তুমি আমার গান শুনতে আসবে।’ তাকে আমার পাথর বসানো দস্তানাও দিয়েছিলাম। সাধারণত আমি কাউকে দস্তানা দিই না। পরে শিশুটির শহরে গিয়ে শুনি সে মারা গেছে। তার সমাধিতে দেওয়া হয়েছে আমার সেই জ্যাকেট আর দস্তানা। তার বয়স ছিল মাত্র ১০। কিন্তু একটাই সান্ত্বনা, সে জেনে গিয়েছিল তাকে কেউ ভালোবাসে। তার মা-বাবা শুধু নন, আমার মতো একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষও তাকে ভালোবাসে। সে জেনে গিয়েছিল, এই পৃথিবী থেকে সে একা বিদায় নিচ্ছে না।
পৃথিবীতে আসার আগে আর পৃথিবী ছাড়ার সময় তুমি যদি জানতে পার, কেউ তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিই খুব সহজ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষকেরা তোমাকে তিরস্কার করতে পারেন, তোমার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা চাপ দিতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমিই জয়ী হবে। কীভাবে কেউ তোমাকে আটকাবে! তোমার তো ভালোবাসার শক্তি আছে।
কিন্তু যদি এই শক্তিটা তোমার না থাকে, গোটা জীবন চলে যাবে তার খোঁজে। যত বিখ্যাতই হও, যত ধনীই হও, ভেতরটা তোমার ফাঁকাই রয়ে যাবে।
কোথা থেকে আমাদের মধ্যে এত ক্রোধ, বেদনা আর সহিংসতা আসে! উত্তরটা আর খুঁজে বেড়াতে হবে না।
কাজ শেষে মা-বাবারা বাড়িতে ফেরেন। কিন্তু অনেকেই মাথাটা রেখে আসেন অফিসে। আর তাঁদের শিশুরা পায় মা-বাবার ছিটেফোঁটা মনোযোগ। তাদের মধ্যে ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছাটাই মরে যায়। নিজের মতো করে বেড়ে ওঠে তারা। পেছনে ফেলে যায় মা-বাবাকে।
আমি তোমাদের অনুরোধ করব, এমন ভুল তোমরা কেউ কোরো না। যদি ভাবো, মা-বাবা তোমাদের অবহেলা করেছেন, তাঁদের ক্ষমা করে দাও। তাঁদের শেখাও, কীভাবে ভালোবাসতে হয়।
আমার বাবা ছিলেন বেশ দক্ষ একজন ব্যবস্থাপক। আমি ও আমার ভাইয়েরা সাফল্যের জন্য তাঁর কাছে ঋণী। তিনি কোনোদিন আমার সঙ্গে খেলেননি। আমার চোখে চোখ রেখে বলেননি আমাকে তিনি কত ভালোবাসেন। আমি মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতাম। কিছুদিন পরপরই সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম রান্নাঘরে আমার জন্য এক ব্যাগ ডোনাট রাখা আছে। আমার বাবা কোনোদিন আমাকে সেটা বলেননি। কত দিন ভেবেছি, রাতে জেগে থাকব আর তাঁকে ডোনাট রাখার সময় ধরে ফেলব। কিন্তু আমি এই মজার খেলাটা নষ্ট করতে পারিনি এই ভয়ে, তিনি হয়তো আর কোনোদিন আমার জন্য ডোনাট আনবেন না।
তিনি আমার জন্য কী করেননি, সেসব নিয়ে আমি আর ভাবি না। তিনি কতটা করেছেন, সেটাই ভাবি।
বাবা খুব দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন। আমাদের বড় পরিবার চালাতে হতো তাঁকে। ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন তিনি। এমন কাজ, যা আস্তে আস্তে অনুভূতিগুলো ভোঁতা করে দেয়। তিনি যে আমাদের সফল হওয়ার জন্য এত চাপ দিতেন, এটা কি খুব আশ্চর্যের? তাঁর শাসনটাকে আমি আজ ভালোবাসা হিসেবেই দেখি। সেই ভালোবাসা নিখুঁত নয়, কিন্তু ভালোবাসা তো! তিনি চাইতেন কেউ যেন তাঁর সন্তানদের ছোট করতে না পারে। আজ আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আমার শুরুর দিকের রাগের অনুভূতিটা এখন ক্ষমায় পরিণত হয়েছে।
এক দশক আগে গড়ে তুলেছিলাম দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিল দ্য ওয়ার্ল্ড। আমি এর সাফল্যে বিশ্বাস করি? আমি কি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীটার ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারব? নিশ্চয়ই করি। না করলে আজ আমি এখানে আসতাম না। কিন্তু এর শুরুটা হতে হবে ক্ষমা দিয়ে। কারণ পৃথিবীর ক্ষত সারিয়ে তোলার আগে নিজের ক্ষত শুকাতে হবে। আজ আমি বুঝি, আমি কখনোই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারব না, যদি না আমার শৈশবের ক্ষতগুলোর কথা ভুলে যাই। তাই তোমাদের বলছি, মা-বাবাকে সম্মান করো। তাঁদের কাজের বিচার করতে যেয়ো না। তাঁদের সুযোগ দাও।
ক্রোধ, হতাশা আর অবিশ্বস্ত এই পৃথিবীতেই আমাদের বাঁচতে হবে। বাঁচতে হবে ভালোবাসা, স্বপ্ন আর বিশ্বাস নিয়ে। যারা মনে করো তোমাদের মা-বাবা তোমাদের যথেষ্ট ভালোবাসেন না, তোমরা তাঁদের দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দাও। শর্তহীন ভালোবাসা দাও তাঁদের, যাতে তাঁরা নিজের সন্তানের কাছ থেকেই শিখতে পারেন কীভাবে ভালোবাসতে হয়।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, দুর্বল কখনো ক্ষমা করতে পারে না। আজ তাই তোমরা শক্ত হও। শৈশবের ক্ষতের যা প্রভাব আজকের জীবনে পড়ছে, তা কাটিয়ে ওঠো।
আজ থেকে শোনা যাক এক নতুন সংগীত। সে সংগীত শিশুদের হাসির। চলো সবাই মিলে সারিয়ে তুলি এই পৃথিবীর যত ক্ষত, বেদনা। সবাই সুখী হও।"
বিষয়: বিবিধ
১৪১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন