বাংলা সন, নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা
লিখেছেন লিখেছেন মোয়াজ্জেম হুসাইন সায়েম ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১০:১৭:২৯ রাত
গত বছরও ১লা বৈশাখে একই লিখা লিখবো বলে তাক করেছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে উঠেনি। আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশে পালিত হওয়ার আসা একটি উৎসবের নাম সন। প্রত্যেক বাংলা বছরের ১ম দিনে ব্যবসায়ী বা মহাজনেরা তাদের কারবারের বার্ষিক দেনা-পাওনা ও হিসেব নিকেশ সম্পন্ন করেন। পাওনা টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে দেনাদারদের দাওয়াত করে নিমন্ত্রনপত্র পাঠান। নিমন্ত্রন দেয়া হয় নিয়মিত খদ্দেরদেরও। দেনাদারেরাও সামর্থ অনুযায়ী অর্থ নিয়ে দাওয়াতে হাজির হন। দেনা অর্থ দিতে না পারলেও হাজির হন সময় চেয়ে নিতে। ছোটবড় সকল অতিথিকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। কিন্তু বিগত দুই যুগ বা তার চেয়েও বেশী সময় ধরে এই দিনে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক অনুষ্ঠান। বলা হচ্ছে এগুলো নাকি আমাদের সংস্কৃতি! আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। হুট করেই যে কেউ যে কোন কিছুকে ‘ঐতিহ্য’ বললেই আমরা সেটাকে গ্রহন করি সানন্দে, অথচে ইতিহাস বলে অন্য কিছু!
পাকিস্তানে জন্ম নেয়া মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ইরানী জোতির্বিজ্ঞানী আমীর ফতুল্লা শিরাজীর মাধ্যমে বাংলা সনের প্রবর্তন করে। সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্য ছিলো কি? প্রচলিত চন্দ্র মাসের সাথে এ অঞ্চলের চাষাবাদের সময়ের অনেকটাই অমিল থাকায় ও চাষাবাদ মূলত ঋতুনির্ভর থাকায় চাষীদের সুবিধার্থেই চন্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রুপ দেয়া হয়েছিল। এর পেছনে আর কোন উদ্দেশ্য ছিলনা। যদি পালনের মতো কিছু থাকে তবে সেটা করবেন কৃষকেরা বা চাষীরা। অন্যরা নয়। আর যদি কোনো অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেটিও হওয়া উচিৎ কৃষি নির্ভর বা কৃষকদের নিয়ে। সর্বোচ্চ ব্যবসায়ীদের নিয়া যারা কৃষিনির্ভর পণ্য বেচাকেনা করেন। কিন্তু এ কি অবস্থা চলছে আমাদের সমাজে? রঙ মাখামাখী, উন্মুক্ত কনসার্টের নামে অবৈধ মেলামেশা আমাদের সমাজে ১লা বৈশাখের প্রকৃত রূপকে বিকৃত করে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এ দিনটি হয়ে গেছে আমোদ-ফূর্তি আর বেহায়াপনার দিন হিসেবেই পরিচিত হচ্ছে। কতোজন তরুণ-তরূণী জানে বাংলা সনের গোড়ার কথা? সারা বছর পশ্চিমা পোশাকে আবৃত থাকা প্রজন্ম একদিনের জন্য কৃষকের পোষাক পরে কৃষকদের যেন তাচ্ছিল্য করে। টুকরি, কুলা, কাচি নিয়ে শরের সড়কগুলিতে বিচরণ করে তারা যেন গ্রামীণ মানুষগুলিকে নিয়ে ঠাট্টা করে।
আরেক অনুষ্ঠানের নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। বলা হয়ে থাকে এটি নাকি বাঙ্গালী জাতির ঐতিহ্য! অথচ এই অনুষ্ঠানের মূলে গেলে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালে সৈরাচার হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সেবারের ১লা বৈশাখে বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা। আর এ থেকেই জাতির মঙ্গল কামনায় প্রতিবছর ১লা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে একটি শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই অনুষ্ঠান কিভাবে বাঙ্গালীদের ঐতিহ্য হয় বা এই অনুষ্ঠানের সাথে বাংলা নববর্ষের কি যোগসূত্র আছে আমি খুঁজে পাইনা! বাঙ্গালী সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গেও এবারই প্রথম এই অনুষ্ঠান হচ্ছে। গত ৯ ই এপ্রিল ভারতের জি-নিউজ ইন্ডিয়া তাদের বাংলা ভার্সনে একটি নিউজ ছেপেছে এই লিখে যে,
“ওপারের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার এপার বাংলায়। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় ১ লা বৈশাখ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যাদবপুর থেকে ঢাকুরিয়া পর্যন্ত এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ১৯৮৯। একদিকে সেনা শাসন। অন্যদিকে বন্যা। প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদন এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাংলাদেশ। জন অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় একাধিক মানুষের। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। স্থির হয় পয়লা বৈশাখ পথে নামবেন ছাত্রছাত্রীরা। সেটাই শুরু। এরপর থেকে ফি বছর পয়লা বৈশাখ মঙ্গলশোভাযাত্রা হয়ে আসছে ঢাকার রাজপথে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন অসংখ্য মানুষ। মঙ্গল শোভাযাত্রাও হেরিটেজ স্বীকৃতি পায় ইউনেস্কোর।”
এর মাধ্যমেই বুঝা যায় যে, এই অনুষ্ঠানটি ‘সৈরাচারের অপশাসন’ থেকে মুক্তি ও ‘গণতন্ত্রের পূণঃপ্রতিষ্ঠা’র দাবি নিয়ে হয়েছিলো। দিনের পর দিন বিকৃত হয়ে আসছে এই অনুষ্ঠানের ইতিহাস। ঢাবি’র চারুকলার এই অনুষ্ঠান দেশের প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর বাধ্যতামূলক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে! অথচ এর প্রেক্ষাপটের সাথে ১লা বৈশাখের বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কোনো মিলই নেই!
আরেকটি অনর্থক অনুষ্ঠান হচ্ছে পানতা-ইলিশ খাওয়া। এদেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী এমনও অনেক মানুষ আছে যারা পানতা ভাত খেয়ে দিনাতিপাত করে থাকেন। তাদের সাথে কটুক্তি করতেই কি এই আয়োজন? প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্চ ও এপ্রিল মাসে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরাকে সম্পূর্ণ নুষেধ করেছেন সরকার। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও ধরা হচ্ছে ঝাকে ঝাকে ইলিশ মাছ। বিপন্ন হচ্ছে আমাদের জাতীয় মাছ। কিন্তু এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই কারোরই। যদিও ১লা বৈশাখের সাথে ইলিশের কোন সম্পর্কই নেই, তবুও এই দিনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার টন ইলিশ বিক্রি হয় সারাদেশে। চাহিদা বাড়ায় দাম থাকে চড়া। প্রতিযোগিতা করে চড়া দামে ইলিশ কিনে সেটাকে গরীবের খাবার পানতা ভাতের সাথে মিশিয়ে খাওয়া আর যা-ই হোক, অর্থবহ হতে পারেনা! সব মিলিয়ে ১লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ তার প্রকৃত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এর বদলে এই দিনে স্থান করে নিচ্ছে নব্য আবিস্কৃত কিছু অনর্থক অনুষ্ঠান, যা থেকে নতুন প্রজন্মের পাওয়ার মতো বা শেখার মতো কিছুই নেই বরং আছে হারাবার মতো অনেক কিছু।
বিষয়: বিবিধ
৮৯১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন