মানুষের জীবনে কি টাকাই সব?

লিখেছেন লিখেছেন সময়ের সাক্ষী ২৬ জুলাই, ২০১৫, ১১:১৫:২৮ রাত

ছোট বেলায় টাকার মূল্য নামে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। তখন ঠিক কথা গুলো ঠিকমত বুঝিনি। কথাগুলো বুঝলাম যখন নিজের জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

বাবা-মা

আগে জানতাম বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের মূলত: সম্পর্ক রক্তের, টাকা-পয়সা ও অর্থ-বিত্তের নয়। কিন্তু যখন দেখলাম সে সম্পর্কের ভিত্তিও চাওয়া-পাওয়ার মত ঠুনকো ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে তখন এস. এম. জাকির হোসাইন স্যারের কথা মনে পড়ে। উনি উদাহরণ দিতে যেয়ে প্রায়ই বলতেন, দুটো নাউনের (বিশেষ্য) মধ্যে সম্পর্ক ও যোগ করে একটি প্রোনাউন (সর্বনাম)। উনি বলতেন, আমরা সব সময় দুটো সমগোীয় বস্তু ও বিষয়ের মাঝে

সম্পর্ক তৈরী করতে বা জোড়া লাগাতে কোন না কোন কিছু ব্যাবহার করি। যেমন: দুটো কাগজের মাঝে জোড়া লাগাতে আমরা সাধারণত: আঠা বা পিন বা স্টাপলার ব্যাবহার করে থাকি। তেমনি আমাদের সমাজের মাঝে আমরা অনেক সম্পর্ক এমন কিছু বিষয়, বস্তু ও ব্যক্তির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখি। যেমন: অনেক সময় দাম্পত্য সম্পর্ক সন্তানের জন্য

(অনেক ব্যতিক্রম আছে তাদেরকে আমার শ্রদ্ধা ও সালাম), কখনো কখনো পিতা-মাতা উপার্জনকারী সন্তানের সাথে সম্পর্ক টিকে থাকে দেয়ার পরিমাণ ও অবস্থার উপর (অনেক মা-বাবা আছেন যারা সত্যিকার অর্থে এসবের উর্ধে, তাদেরকে আমার সহস্র সালাম)।

স্যারের আরেকটা গল্প ছিল এমন। অজ পাড়া গাঁয়ের একটি ছেলে ঢাকায় এসে চাকরী পেল। বাবা-মায়ের আশা আকাংখার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নিজেকে কল্পনা করত ছেলেটা। কিন্তু কোন এক কুরবানীর ঈদে অফিসের ব্যস্ততার কারণে ছেলেটা বাড়ী যেতে পারেনি। ছেলেটা সরল মনে বাবা-মার সাথে শেয়ার করে যে হয়ত এ ঈদে সে অফিসের বসের সাথে নতুন প্রজেক্টে যেতে হবে।

ছেলেটা লক্ষ্য করে যে এ সংবাদের জন্য তার পরিবার মোটেই প্রস্তুত ছিলনা। কারণ ছেলেটা ঢাকায় আসার পর থেকে বাবা-মায়ের সাথে ছাড়া কখনো কোন ঈদ সে বাড়ীর বাইরে করেনি। তাকে তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ সংবাদ পাবার আগে যে ভাষায় ও ভাবের সাথে ফোন করা হত, সংবাদ শোনার পর তাদের কন্ঠের সেই আবেদন যেন খরা মৌসুমের কোন শুকনো নদীর পানির মত মনে হতে থাকে।

পরিবারের এখন একটিই আশংকা ছেলে বাড়ী না আসলে ঈদের খরচের টাকা আমারা কোথায় পাব? এখন বাবা-মা ছেলের সাথে যে ভাষায় কথা বলে তাতে ছেলের বুঝতে কষ্ট যে এরাই কি তার সেই দীর্ঘদিনের পিরিচিত বাবা-মা যাদের জন্য সে জীবনে একটা ভাল কাপড় কখনো পেরেনি। তাদের একটু খানি সুখের জন্য সে জীবনের বড় একটা সময় পার করেছে। তিনটা বোনকে মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারে খরচাপাতি করে বিয়ে দিয়েছে। নিজে সব ভাই-বোনদের মধ্যে বড় হবার পরও নিজে কখনো নিজের বিয়ের কথা চিন্তা করেননি। সে আজ অনুভব করে যে তার বোনদের বিয়ের আগে মা প্রায়ই ফোন দিয়ে বোনদের বিয়ের বয়স হয়েছে মনে করিয়ে দিত। একে একে তিনটা বোনদের বিয়ের পর মায়ের নতুন প্রজেক্ট হল ছোট দু ভাইকে ব্যাবসা ও পড়ালেখার জন্য শহরে নিয়ে যেয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া। মা প্রায়ই ফোন দিয়ে ছোটভাইদের ভবিষ্যত বিষয়ে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিত। সে হিসেবে তারা গ্রাজুয়েশন শেষ করে একজন ৩ মাস হল ব্যবসা করছে কিন্তু পুজিটা সে ছেলের, অন্যজন একটি প্রতিষ্ঠিত বহুজাতিক কোম্পানীতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পদে সপ্তাহ খানেক হল চাকরী পেয়েছে।

চিন্তার মাঝেই মায়ের ফোন। খোকা তোর বাড়ী আসা খুবই দরকার ছিল কিন্তু তুই যখন বাড়ী আসতে পারবি না বলছিস তখন পথে-ঘাটের এই খারাপ অবস্থার মধ্যে কষ্ঠ করে তোর বাড়ী আসার দরকার নেই। তাছাড়া আজকাল যা সড়ক দূর্ঘটনা বেড়েছে তাতে কখন কি হয়ে যায়।

মা মুখ ফুটেই বলে ফেললেন; "কুরবানীর ও ঈদের খরচের টাকাগুলো তাড়াতাড়ী পাঠিয়ে দিস বাবা। তাছাড়াও হাজার পাচেক টাকা বাড়তি দিস। ঈদের পরের দিন কিছু নামি-দামী মেহমান আসবে তো"

রফিক মাকে সম্মতি সূচক জবাব দিয়ে ইসলামী ব্যাংকের এম ক্যাশের মাধমে বরাবরের মত মাকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সাধারণ রুটিন মত এবার মায়ের টাকা প্রাপ্তির ফিরতি ফোন পায়না। ছেলেটা অবাক হয় কিন্তু মাকে ফোন না দিয়েই বসের সাথে নতুন প্রজেেক্টে চলে যায়। টাকা পাঠানোর বিষয়টা তার মন থেকেই হারিয়ে যায়।

রফিকের এবার প্রথম পরিবারের বাইরে ঈদ হবার কথা তার বস জানত। সেজন্য সে যাতে কোন কষ্ট অনুভব না করে বস তার সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু পরিবারের সাথে নিয়মিত ঈদ করা রফিক ঈদের নামাজের পর এক ধরনের শূণ্যতা অনুভব করে। পরিবারের সদ্স্যদের প্রত্যেকে মনে হতে থাকে। এবারই প্রথম ঈদ তিন ভাই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত বাবা-মায়ের মনকে ভরিয়ে দিবে। রফিক তার জীবন দেয়ে মায়ের স্বপ্নকে সার্থক করতে পেরেছে। এটাই তার গর্ব। কিন্তু গর্বের সে পারিবারিক মিলন মেলায় বাধ সাধে তার বস। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ ও অভিমান গিয়ে পড়ে বসের উপর। কিন্তু বসের উপর তো তার কোনটার বহি:প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ নেই্। সেই কষ্টে মনের ব্যাথাটা আবারো মোচড় দিয়ে ওঠে। যা হোক সারাদেনের ব্যস্ততা ও নতুন প্রজেক্টের কাজে রফিক ও তার বসের পরিবারের খোজ নেবারও ফুরসত হয়ে ওঠে না।

মা সারা দিনের মধ্যে রফিককে একটি বারের জন্য ফোন দেয়নি। ঈদের নামাজের পর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে রফিক। বসের সাথে থাকাতে সারাদিনে আর কথা হয়নি। রাতে মাকে ফোন দিয়ে মাকে সে অনেক ব্যস্ত পায়। পরে ফোন দিবে বলে মা আর ফোন দেয়নি রফিকও ক্লান্ত ছিল বিধায় ঘুমিয়ে পড়ার ফলে আর ফোন দেয়া হয়নি।

ঈদের দিন প্রজেক্টের কাজ কম ছিল। পরের দিন নাস্তা খেয়েই বসের সাথে প্রজেক্টে যাওয়ার ফলে রফিক বাড়ীর কথা প্রায়ই ভুলে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা রফিকের রাগ-ক্ষোভ তার মনের মধ্যে একের পর এক তীব্র ঢেউ তুলে চলেছে যেন যে কোন সময়ই দুকুল প্লাবিত করে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। একপর্যায়ে মানবিক দূর্বলতাগুলো বসের প্রতি ঘৃণায় রূপ নিল।

ঠিক এমন সময় মায়ের ফোন। "বাবা, তুই কাল কি জরুরী একটু বাড়ী আসতে পারিবি? মা জানে যে রফিক ঈদের এক সপ্তাহের আগে ঢাকাই ফিরতে পারবে না। রফিক অবাক হয় মায়ের এ আচরণে। কিন্তু মনের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে "কেন মা?" মা সহজ সরল ভঙ্গিতেই উত্তর দেন কাল শফিক ও তৌফিকের বিয়ে তো? তুই বড় ভাই না আসলে কেমন করে হয়? আর তোকে না বলে আমরা তো এমন শুভ কাজ করতে পারিনা। হাজারো হোক তুইতো আমার বড় সন্তান এবং বংশের বড় সন্তান। আর হ্যাঁ তোকে তো সময়ের অভাবে বলতে পারিনি যে তোর কেনা রাস্তার বাকের ঐ জমিটা ওদের বিয়ের খরচের জন্য বিক্রি করে দিয়েছি। তোর ঘাড়ে আর কত অর্থনৈতিক প্রেসার দেয়া যায় বল? হাজারো হোক বড় ভাইয়ের টাকায় ছোট ভাইদের বিয়ে হচ্ছে এটা জানলে লোকে কি বলবে বল। আর তুই তো সারাজীবন ওদের জন্য আর কম করিসনি। ওদরে সুখের জন্য তো তুই আজ পর্যন্ত বিয়েটা পর্যন্ত করতে পারলি না। তোর জন্য বড় মায়া লাগে। আমাকে কখনো ভুল বুঝিস না।

রফিক শেষের কথাগুলো আর শুনতে পায়না। তার কল্পনার সাজানো গোছানো পৃথিবীটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসে এবং কাল বৈশাখীর দূদান্ত তান্ডবে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকানো কাগজের মত হয়ে যায়। (ক্রমশ)

বিষয়: Contest_priyo

৩৬৯১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

331905
২৭ জুলাই ২০১৫ সকাল ১০:৩৫
হতভাগা লিখেছেন : ০ বিয়ে করতে : টাকা লাগে ।
০ ভরণ পোষন করতে : টাকা লাগে
০ জন্মের সময় : টাকা লাগে ।
০ খাবার কিনতে : টাকা লাগে
০ পোশাক কিনতে : টাকা লাগে
০ বেড়াতে গেলে : টাকা লাগে
০ বাজার করতে : টাকা লাগে
০ চাকরি পেতে : টাকা লাগে
০ ব্যবসা করতে : টাকা লাগে
০ বউয়ের মন পেতে : টাকা লাগে
০ ছেলে মেয়ের পড়াশুনার জন্য : টাকা লাগে
০ বিদেশে যেতে : টাকা লাগে
০ চিকিতসা করাতে : টাকা লাগে
০ এমন কি মারা যাবার পর কবর দিতেও : টাকা লাগে
332389
২৯ জুলাই ২০১৫ সকাল ১০:২৫
সময়ের সাক্ষী লিখেছেন : টাকা অবশ্য জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সাথে জড়িত। কিন্তু হতভাগা ভাই আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম যে, মানুষের জীবনে কী মায়া-মমতা ও ভালবাসা এবং আত্মত্যাগের কোন অধ্যায় থাকবে না?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File