কোরআন সুননায় কী শবেবরাত আছে ?
লিখেছেন লিখেছেন সত্যের ১২ জুন, ২০১৪, ১০:৪২:৩৪ সকাল
সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি পরিপূর্ণ দ্বীন হিসাবে আমাদেরকে ইসলাম দান করেছেন, যে দ্বীনে মানুষের পক্ষ থেকে কোন সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন হয় না ৷ সালাত ও সালাম তাঁরই রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি, যিনি আল্লাহর দ্বীনের রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করেছেন, কোথাও কোন কার্পণ্য করেননি ৷ দ্বীন হিসাবে যা কিছু এসেছে তিনি তা উম্মতের কাছে পৌছে দিয়েছেন ও নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে গেছেন ৷ তার সাহাবায়ে কিরামের প্রতি আল্লাহর রাহমাত বর্ষিত হোক, যারা ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর আদর্শ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ পালনে সকলের চেয়ে অগ্রগামী ৷
প্রতি বছর যখন ১৫ শাবান আসে তখন দেখি আলেম-উলামাগণ, ওয়াজীনে কিরাম, আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ বিভিন্ন মাসজিদে, পত্র-পত্রিকায়, রেডিও টিভিতে শবে বরাত সম্পর্কে লাগামহীন এবং মনগড়া আলোচনা করেন, যা শুনে একজন সাধারণ মানুষ ধারণা করে নেয় যে, শবে বরাত ইসলামের মূল পর্বগুলির একটি ৷ তাই তারা অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তা পালন করেন ৷
যখন ১৫ শাবান সমাগত হয় তখন সাধারণ মানুষ ও অনেক দা‘য়ী ইলাল্লাহ, আলেম-উলামাগণ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন, জানতে চান ৷ তাদের প্রশ্নের ভাষা এ রকমঃ
“অনেকে বলেন শবে বরাত বলতে কিছু নেই, এ সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই ৷ আবার অনেকে বলেন শবে বরাত, উহার ফাযীলাত ও ‘আমল রয়েছে, আছে তার বিশুদ্ধ প্রমাণ ৷ আসলে বিষয়টির ব্যাপারে সঠিক অবস্থান কি হওয়া উচিত ?”
তাদের এ প্রশ্নের পূর্ণ জওয়াব দেয়া যেমন যরুরী তেমনি কঠিন ৷ আর কিছু না বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই ৷ এড়িয়ে গেলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না ৷
বিদ‘আত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা তাঁর উম্মতকে বিদ‘আত সম্পর্কে সতর্ক করতেন ৷ তিনি প্রায় সকল খুতবায় বলতেনঃ
أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة.(رواه مسلم عن جابر بن عبد الله)
অর্থঃ শুনে রেখ ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ, আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয় এবং সকল বিদ‘আতই পথ-ভ্রষ্টতা ৷ (মুসলিম)
বিদায় হজ্জেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ‘আতে লিপ্তদের পরিণাম সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছেন ৷
রাসুল (সাঃ) বলেছেন-যারা আমাদের হুকুম সুমুহের মধ্যে নতুন কোন জিনিস প্রর্বতন করবে, যা আমাদের দ্বারা প্রবর্তিত নয়, তা বাতিল । (বুখারী, মুসলিম, মেশকাত হাঃ ১/১৩৩)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ (যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে নেই, তা তার উপর নিক্ষিপ্ত হবে) । (বুখারী, হাদীস নং ২৬৯৭)।
তিনি আরো বলেছেনঃ (যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করবে যার উপর আমাদের দ্বীনের মধ্যে কোন নির্দেশ নেই তা অগ্রহণযোগ্য) । (মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮) ।
কতিপয় মূলনীতি
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কতিপয় মূলনীতি উল্লেখ করছি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস ৷
(এক) যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে চলে আসে, তাহলে তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করেনা ৷ এটা বলা ঠিক হবে না যে, শত শত বছর ধরে যা পালন করে আসছি তা না জায়েয হয় কিভাবে ? বরং তা শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই শর‘য়ী দলীল থাকতে হবে ৷
(দুই) ইসলামের যাবতীয় বিষয়াবলী দু‘প্রকার (ক) ‘আমল বা কাজঃ- কোন ‘আমল বা কাজ ইসলামের শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস এই চারটির যে কোন একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে ৷
(খ) আকীদাহ বা বিশ্বাসঃ- কিন্তু আকীদাগত কোন বিষয় অবশ্যই কুরআন অথবা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে ৷ ইজমা অথবা কিয়াস দ্বারা আকীদাহর কোন বিষয় প্রমাণ করা যাবে না ৷
(তিন) যে সকল হাদীস কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে উলি্লখিত সবগুলো হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ নয় ৷ হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন কোনটি সহীহ, কোনটি যয়ীফ (দুর্বল সূত্র), কোনটি মওজু (জাল বা বানোয়াট) ৷ তাই সব ধরনের হাদীস মোতাবেক ‘আমল করা ঠিক নয় ৷ হাদীসসমূহ থেকে শুধু সহীহগুলি ‘আমলে নেয়া হবে ৷ যদি সব ধরনের হাদীস ‘আমলে নেয়া হয় তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিষয় গবেষণা ও তা চর্চার সার্থকতা কি ?
(চার) দুর্বল বা জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শরীয়তে কোন আকীদাহ ও ‘আমল চালু করা যায় না ৷ তবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত কোন ‘আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায় ৷
‘শবে বরাত‘ এর অর্থ
‘শব‘ একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত ৷ ‘বারায়াত’কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি ৷ যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত ৷ ইরশাদ হয়েছেঃ
بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ (التوبة: 1)
অর্থঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা ৷ (সূরা তাওবা, ১)
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা ৷ ‘বারায়াত‘ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমনঃ
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ . (سورة القمر :43)
অর্থঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে ? (সূরা কামার, ৩৪)
আর ‘বারায়াত‘ শব্দক যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য ৷ অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী ৷ অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত‘ শব্দটিকে ফারসী শব্দ ধরা হয় ৷
শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত‘৷ এখানে বলে রাখা ভাল যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন ৷
যেমন ‘গোলাম‘ শব্দটি আরবী ও ফারসী উভয় ভাষায় একই রকম লেখা হয় এবং একইভাবে উচ্চারণ করা হয় ৷ কিন্তু আরবীতে এর অর্থ হল কিশোর আর ফারসীতে এর অর্থ হল দাস ৷
সার কথা হল ‘বারায়াত‘ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি ৷ আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য ৷
আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না ৷ সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই ৷ সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই ৷
অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন আয়াতসমূহ হল:
حم ﴿1﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿2﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿3﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿4﴾ (الدخان: 1-4)
অর্থ: হা-মীম ৷ শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের ৷ আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে ৷ আমি তো সতর্ককারী ৷ এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় ৷ (সূরা দুখান, ১-৪)
শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন ৷ যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ ৷ কারণ:
(এক) কুরআন মাজীদের এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয় ৷ সেই সূরায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ ﴿1﴾ وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ ﴿2﴾ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ ﴿3﴾ تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ ﴿4﴾ سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ ﴿5﴾
অর্থ: আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে ৷ আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি ? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ৷ এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (ফেরেশ্তাগণ) ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে ৷ এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে ৷ (সূরা কাদর, ১-৫)
অতএব বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর ৷ লাইলাতুল বারায়াত নয় ৷ সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর ৷ আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা ৷
(দুই) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে ৷ অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে ৷
যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.
অর্থঃ রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন ৷
(তিন) অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে ৷ শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা রহ. এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে ৷
তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত ৷ যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য ৷ এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা ৷
(চার) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুরআন ও হাদীস সম্মত তাফসীর ৷ সকলেই জানেন কুরআন ও হাদীস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই ৷
(পাচ) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে ৷ সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসীর, কুরতুবী প্রমুখ মুফাচ্ছিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা‘র অর্থ শবে বরাত নেয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ (তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ “কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ‘ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত) ৷ কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা
অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ‘ এর অর্থ লাইলাতুল কদর ৷ শাবান মাসের পনের তারিখের রাত নয় ৷
(ছয়) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই ৷ বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী ৷ তিনি যেমন ভুলের উর্ধে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয় ৷
(সাত) শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয় ৷ আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন ৷ তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয় ৷ অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত ৷ তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না ৷
(আট) ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তার আল-জামে লি আহকামিল কুরআন তাফসীর গ্রন্থে লাইলালাতুন মুবারাকা দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেন : লাইলাতুল কদরের চারটি নাম রয়েছে, তা হল : লাইলাতুল কদর, লাইলাতু মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক ৷
(আল জামে লি আহকামিল কুরআন, সূরা আদ-দুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম ৷ শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের নাম নয়
ইমাম শাওকানী (রহ.) তার তাফসীর ফতহুল কাদীরে একই কথাই লিখেছেন ৷
(তাফসীর ফাতহুল কাদীর : ইমাম শাওকানী দ্রষ্টব্য)
এ সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুম মুবারাকা‘র অর্থ করবেন শবে বরাত, তারা সাধারণ মানুষদের গোমরাহ করা এবং আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না ৷
শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি
প্রশ্ন থেকে যায় হাদীসে কি লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত নেই ? সত্যিই হাদীসের কোথাও আপনি শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত নামের কোন রাতের নাম খু্জে পাবেন না ৷ যে সকল হাদীসে এ রাতের কথা বলা হয়েছে তার ভাষা হল ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান‘ অর্থাত্ মধ্য শাবানের রাত্রি ৷ শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত শব্দ আল-কুরআনে নেই, হাদীসে রাসূলেও নেই ৷ এটা মানুষের বানানো একটা শব্দ ৷ ভাবলে অবাক লাগে যে, একটি প্রথা ইসলামের নামে শত শত বছর ধরে পালন করা হচ্ছে অথচ এর আলোচনা আল-কুরআনে নেই ৷ সহীহ হাদীসেও নেই ৷ অথচ আপনি দেখতে পাবেন যে, সামান্য নফল ‘আমলের ব্যাপারেও হাদীসের কিতাবে এক একটি অধ্যায় বা শিরোনাম লেখা হয়েছে ৷
ফিকহের কিতাবে শবে বরাত
শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহীহ হাদীসে নেই, বরং আপনি ফিক্হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়ে দেখুন, কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাবেন না ৷
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীনি মাদ্রাসাগুলিতে ফিক্হের যে সিলেবাস রয়েছে যেমন মালাবুদ্দা মিনহু, নুরুল ইজাহ, কদুরী, কানযুদ্ দাকায়েক, শরহে বিকায়া ও হিদায়াহ খুলে দেখুন না ! কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনা ! অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি ৷ তারা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন ৷ অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও ৷ শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন ৷
অতএব এ রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারায়াত অভিহিত করা মানুষের মনগড়া বানানো একটি বিদ‘আত যা কুরআন বা হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয় ৷
শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত আকীদাহ বিশ্বাস ও ‘আমল
শবে বরাত যারা পালন করেন তারা শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধারণা পোষণ করেন ও উহাকে উপলক্ষ করে যে সকল কাজ করে থাকেন তার কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হল ৷
তারা বিশ্বাস করে যে, শবে বরাতে আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন ৷ এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরী করা হয় ৷ এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয় ৷ এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয় ৷ এ রাতে কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে ৷ এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয় ৷ মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে ৷ এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয় ৷ বাড়ীতে বাড়ীতে মীলাদ পড়া হয় ৷ আতশবাযী করা হয় ৷ সরকারী- বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা হয় ৷ সরকারী ছুটি পালিত হয় ৷ পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করা হয় ৷ কবরস্থানগুলো আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয় ৷ লোকজন দলে দলে কবরস্থানে যায় ৷ মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলি লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায় ৷ যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও জুমু‘আয় মাসজিদে আসেনা তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে ৷ মাসজিদগুলিতে মাইক চালু করে ওয়াজ নাসীহাত করা হয় ৷ শেষ রাতে সমবেত হয়ে দু‘আ-মুনাজাত করা হয় ৷ বহু লোক এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করে থাকে ৷ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একশত রাকাত, হাজার রাকাত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয় ৷
লোকজন ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে ‘হুজুর ! শবে বরাতের সালাতের নিয়ম ও নিয়্যতটা একটু বলে দিন ৷‘ ইমাম সাহেব আরবী ও বাংলায় নিয়্যাত বলে দেন ৷ কিভাবে সালাত আদায় করবে, কোন্ রাকা‘আতে কোন্ সূরা তিলাওয়াত করবে তাও বলে দিতে কৃপণতা করেননা ৷
যদি এ রাতে ইমাম সাহেব বা মুয়াজ্জিন সাহেব মাসজিদে অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তাদের চাকুরী যাওয়ার উপক্রম হয় ৷
শবে বরাতের সম্পর্ক শুধু ‘আমলের সাথে নয়
শবে বরাত সম্পর্কে উপরোলি্লখিত কাজ ও আকীদাpহসমূহ শবে বরাত উদযাপনকারীরা সকলেই করেন তা কিন্তু নয় ৷ কেহ আছেন উলি্লখিত সকল কাজের সাথে একমত পোষণ করেন ৷ আবার কেহ আতশবাযী, আলোক সজ্জা পছন্দ করেন না, কিন্তু কবরস্থানে যাওয়া, হালুয়া-রুটি, ইবাদাত-বন্দেগী করে থাকেন ৷ আবার অনেক আছেন যারা এ রাতে শুধু সালাত আদায় করেন ও পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেন ৷ এ ছাড়া অন্য কোন ‘আমল করেন না ৷ আবার অঞ্চল ভেদে ‘আমলের পার্থক্য দেখা যায় ৷
কিন্তু একটি বিষয় হল, শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধর্ম বিশ্বাস বা আকীদাহ পোষণ করা হয় তা কিন্তু কোন দুর্বল হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় না ৷ যেমন ভাগ্যলিপি ও বাজেট প্রনয়নের বিষয়টি ৷ যারা বলেনঃ ”আমলের ফাযীলাতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করা যায়, অতএব এর উপর ভিত্তি করে শবে বরাতে ‘আমল করা যায়, তাদের কাছে আমার প্রশ্নঃ তাহলে শবে বরাতের আকীদাহ সম্পর্কে কি দুর্বল হাদীসেরও দরকার নেই ?
অথবা এ সকল প্রচলিত আকীদাহর ক্ষেত্রে যদি কোন দুর্বল হাদীস পাওয়াও যায় তাহলে তা দিয়ে কি আকীদাহগত কোন মাসয়ালা প্রমাণ করা যায় ? আপনারা শবে বরাতের ‘আমলের পক্ষ সমর্থন করলেন কিন্তু আকীদাহর ব্যাপারে কি জবাব দিবেন ?
কাজেই শবে বরাত শুধু ‘আমলের বিষয় নয়, আকীদাহরও বিষয়৷ তাই এ ব্যাপারে ইসলামের দা‘য়ীদের সতর্ক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি ৷
শবে বরাত সম্পর্কে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, তিনি এ রাতে মানুষের হায়াত, রিয্ক ও ভাগ্যের ফায়সালা করে থাকেন, এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত হলে আল্লাহ হায়াত ও রিয্ক বাড়িয়ে সৌভাগ্যশালী করেন ইত্যাদি আকীদা কি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মত অন্যায় নয় ?
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ. (الصف : 7)
অর্থ তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে ? (সূরা সাফ, ৭)
শাবানের মধ্যরজনীর ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
হাদীস
1-حدثنا أحمد بن منيع أخبرنا يزيد بن هارون أخبرنا الحجاج بن أرطاة عن يحيى بن أبي كثير عن عروة عن عائشة رضى الله عنها قالت : فقدت رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة فخرجت فإذا هو بالبقيع فقال أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله؟ قلت يا رسول الله ظننت أنك أتيت بعض نسائك.
فقال إن الله تبارك وتعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى سماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب.
قال أبو عيسى: حديث عائشة لا نعرفه إلا من هذا الوجه من حديث الحجاج، وسمعت محمدا يقول يضعف هذا الحديث، وقال: يحيى بن كثير لم يسمع من عروة، قال محمد والحجاج لم يسمع من يحيى بن كثير، انتهى كلامه، فهذا السند منقطع بوجهين.
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী‘ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু‘মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন - আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী‘ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম ৷ তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন ?
আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল ! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন ৷ তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন ৷
ইমাম তিরমিযী বলেনঃ আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না ৷ আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন ৷ তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ ইয়াহ্ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি ৷ এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেনঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি ৷
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাত্ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন ৷
অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত ৷
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ ! যারা শবে বরাতের বেশী বেশী ফাযীলাত বয়ান করতে অভ্যস্ত তারা তিরমিযী বর্ণিত এ হাদীসটি খুব গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন অথচ যারা হাদীসটির অবস্থা সম্পর্কে ভাল জানেন তাদের এ মন্তব্যটুকু গ্রহণ করতে চাননা ৷ এ হাদীসটি ‘আমলের ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযীর এ মন্তব্যটুকু কি যথেষ্ট নয় ?
যদি তর্কের খাতিরে এ হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে কি প্রমাণিত হয় ? আমরা যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপন করি তাদের ‘আমলের সাথে এ হাদীসটির মিল কোথায় ?
বরং এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না ৷ ডাকলেন না অন্য কাউকে ৷ তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না ৷ অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন ৷ বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন ৷ যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না ? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন ৷ এ ব্যাপারে তিনি তো কোন অলসতা বা কৃপণতা করেননি ৷
হাদীস
3-عن علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)
অর্থঃ আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে ৷ কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেনঃ আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব ৷ আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব ৷ আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব ৷ এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে ৷ (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
প্রথমতঃ এ হাদীসটি দুর্বল ৷ কেননা এ হাদীসের সনদে (সূত্রে) ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীস জালকারী হিসাবে পরিচিত ৷ এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল ৷
দ্বিতীয়তঃ অপর একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় ৷ সে সহীহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন ৷ হাদীসটি হলঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ينزل ربنا تبارك وتعالى في كل ليلة إلى سماء الدنيا حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن يستغفرني فأغفرله. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থঃ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব ৷ কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব ৷ কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব ৷ (বুখারী ও মুসলিম)
আর উলি্লখিত হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন ৷ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন ৷ আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে ৷ তাই হাদীসটি প্রসিদ্ধ ৷ অতএব এই মশহুর হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে উপরের হাদীসটি পরিত্যাজ্য হবে ৷
শাবানের মধ্যরজনীর সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনার সারকথা
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো উল্লেখ করা হল ৷ এ সকল হাদীসের দিকে লক্ষ্য করে আমরা কয়েকটি বিষয় স্পষ্টভাবেই বুঝে নিতে পারি ৷
(১) এ সকল হাদীসের কোন একটি দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি যে, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তা‘আলা আগামী এক বছরে যারা ইন্তেকাল করবে, যারা জন্ম গ্রহণ করবে, কে কি খাবে সেই ব্যাপারে ফায়সালা করেন ৷ যদি থাকেও তাহলে তা আল-কুরআনের বক্তব্যের বিরোধী হওয়ায় তা গ্রহণ করা যাবে না ৷ কারণ আল-কুরআনের স্পষ্ট কথা হল এ বিষয়গুলির ফায়সালা হয় লাইলাতুল কদরে ৷
(২) এ সকল হাদীসের কোথাও বলা হয়নি যে, এ রাতে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা তাদের গৃহে আসে ৷ বরং এটি একটি প্রচলিত বানোয়াট কথা ৷ মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন কোন সময় গৃহে ফিরে আসার ধারণাটা হিন্দুদের ধর্ম-বিশ্বাস ৷
(৩) এ সকল হাদীসের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে গোসল করেছেন, মাসজিদে উপস্থিত হয়ে নফল সালাত আদায় করেছেন, যিকর-আযকার করেছেন, কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ নাসীহাত করেছেন কিংবা অন্যদের এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে উৎসাহিত করেছেন অথবা শেষ রাতে জামাতের সাথে দু‘আ-মুনাজাত করেছেন ৷
(৪) এ হাদীসসমূহের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এ রাতের সাহরী খেয়ে পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেছেন ৷
(৫) আলোচিত হাদীসসমূহে কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে হালুয়া-রুটি বা ভাল খানা তৈরী করে বিলিয়েছেন, বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে মীলাদ পড়েছেন ৷(৬) এ সকল হাদীসের কোথাও নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে’ কিরাম (রাঃ) এ রাতে দলে দলে কবরস্থানে গিয়ে কবর যিয়ারত করেছেন কিংবা কবরে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন ৷
এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ বাদ দিলে খুলাফায়ে রাশেদীনের ত্রিশ বছরের ইতিহাসেও কি এর কোন একটা ‘আমল পাওয়া যাবে ?
যদি না যায় তাহলে শবে বরাত সম্পর্কিত এ সকল ‘আমল ও আকীদা কি বিদ‘আত নয় ? এ বিদ‘আত সম্পর্কে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সতর্ক করার দায়িত্ব কারা পালন করবেন ? এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আলেম-উলামাদের, দ্বীন প্রচারক, মাসজিদের ইমাম ও খতীবদের ৷ যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের ইশারা নেই সে সকল ‘আমল থেকে সাধারণ মুসলিম সমাজকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরীদের ৷
ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও উহার পর্যালোচনা
عن عائشة رضي الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: هل تدرين ما هذه الليلة؟ يعني ليلة النصف من شعبان.
قالت ما فيها يا رسول الله ؟ فقال : فيها أن يكتب كل مولود (من) بني آدم في هذه السنة وفيها أن يكتب كل هالك من بني آدم في هذه السنة وفيها ترفع أعمالهم وفيها تنزل أرزاقهم.
من مشكاة المصبايح في باب قيام شهر رمضان، رواه البيهقي في الدعوات الكبير.
অর্থঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তুমি কি জানো এটা (অর্থাত্ মধ্য শাবানের রাত) কোন্ রাত ? তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ ! এ রাতে কি রয়েছে ? তিনি বললেনঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব-সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়, এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়, এ রাতে রিয্ক নাযিল করা হয় ৷
আলোচ্য হাদীসটি আল-মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম‘ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে ৷
তিনি লিখেছেন যে, ইমাম বাইহাকী (রঃ) তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর‘ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ৷ হাদীসটির পর্যালোচনা নিম্নে তুলে ধরলামঃ
(এক) উলি্লখিত হাদীসে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত‘ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা নয় ৷ এ বাক্যটি পরবর্তী কালের বর্ণনাকারীর নিজস্ব বক্তব্য বলে ৷ আর আয়িশা (রাঃ) এমন কোন অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে তাকে তারিখ বলে দিতে হবে ৷
(দুই) এ হাদীসে বর্ণিত ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত‘ কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয় ৷ কারণ তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন‘ বাক্যটির পর ৷ তাহলে এ বক্তব্যটি কার ? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয় ৷
(তিন) এ হাদীসের বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত ৷ কেননা জন্ম, মৃত্যু, ‘আমল পেশ, রিয্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে স্থির করা হয় ৷ এ কথা যেমন কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ৷
(চার) আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন ৷ বুঝা গেল যে, তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত ৷ যদি তিনি বুঝতেন যে, হাদীসটি মধ্য শাবানের তাহলে তিনি তা রামাযান মাসের অধ্যায়ে আলোচনা করবেন কেন ?
(পাঁচ) এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন, তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর‘ কিতাব থেকে নিয়েছেন ৷
ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর‘ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন ৷ তার একটি হল এই হাদীস ৷ তিনি তার ‘শুআ‘বুল ঈমান‘ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসটি উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ
وقد روي في هذا الباب أحاديث مناكير، رواتها قوم مجهولون ، ذكرنا في كتاب الدعوات منها حديثين.
অর্থঃ এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে ৷ যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত ৷ আমি তা থেকে দু‘টি হাদীস ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি ৷
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ ! তাহলে ফলাফল দাড়াল কি ? ইমাম বাইহাকীর এ মন্তব্যে যা প্রমাণিত হলঃ
(১) শবে বরাত সম্পর্কে অনেক মুনকার (অগ্রহণযোগ্য) হাদীস রয়েছে ৷
(২) আদ-দাওআত আল-কাবীর গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস দুটি মুনকার ৷
(৩) তাই আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার ৷
(৪) তিনি ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর‘ গ্রন্থটি আগে সংকলন করেছেন, তারপরে শুআবুল ঈমান সংকলন করেছেন ৷ এ কারণে তিনি পরবর্তী কিতাবে আগের কিতাবের ভুল সম্পর্কে পাঠকদের সতর্ক করেছেন ৷ এটা তার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার একটি বড় প্রমাণ ৷
(৫) মুনকার হাদীস ‘আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না ৷
(৬) যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন তখন আমরা তা সঠিক বলে গ্রহণ করব কেন ?
সৌভাগ্য রজনী ধর্ম বিকৃতির শামিল
ইসলাম ধর্মে সৌভাগ্য রজনী বলতে কিছু নেই ৷ নিজেদের সৌভাগ্য রচনার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদাত-বন্দেগী ইসলামে অনুমোদিত নয় ৷ শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলে বিশ্বাস করা একটি বিদ‘আত তথা ধর্মে বিকৃতি ঘটানোর শামিল ৷ এ ধরনের বিশ্বাস খুব সম্ভব হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে ৷ তারা সৌভাগ্য লাভের জন্য গনেশ পূজা করে থাকে ৷ সৌভাগ্য অর্জন করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে ৷ কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে এবং সারা জীবন সালাত-সিয়াম-যাকাত ত্যাগ করে শুধুমাত্র একটি রাতে মাসজিদে উপস্থিত হয়ে রাত জেগে ভাগ্য বদল করে সৌভাগ্য হাসিল করে নিবেন এমন ধারণা ইসলামে একটি হাস্যকর ব্যাপার ৷
ধর্মে বিকৃতির কৃতিত্বে শিয়া মতাবলম্বীদের জুড়ি নেই ৷ এ শবে বরাত প্রচলনের কৃতিত্বও তাদের ৷ ফারসী ভাষার “শবে বরাত” নামটা থেকে এ বিষয়টা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয় ৷ তারা এ দিনটাকে ইমাম মাহদীর জন্ম দিন হিসাবে পালন করে থাকে ৷ তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে ৷ এ রাতে তারা এক বিশেষ ধরনের সালাত আদায় করে ৷ যার নাম দিয়েছে “সালাতে জাফর” ৷
শবে বরাত সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য
শবে বরাত সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য আলেম শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বায (রহঃ) এর -
حكم الاحتفال بليلة النصف من شعبان، للشيخ عبد العزيز بن عبد الله بن باز رحمه الله.
‘মধ্য শাবানের রাত উদযাপনের বিধান‘ এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরব ৷ তিনি বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا. (المائدة : 3)
অর্থঃ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূণর্াঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেআমাত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম ৷ (সূরা মায়িদা, ৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ
أم لهم شركاء شرعوا لهم من الدين ما لم يأذن به الله. (الشورى : 21
অর্থঃ তাদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে যারা তাদের জন্য ধর্মের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি ? (সূরা শুরা, ২১)
হাদীসে এসেছে
عن عائشة رضى الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (رواه البخاري ومسلم)
অর্থঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে যা দ্বীনের মধ্যে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে ৷ (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসে আরও এসেছেঃ
عن جابر رضي الله عنه أن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقول في خطبة يوم الجمعة: أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة. (رواه مسلم)
অর্থঃ সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর খুতবায় বলতেনঃ আর শুনে রেখ ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশ ৷ আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় ৷
বর্তমানে প্রচলিত বিদআ’ত সমুহের মধ্যে একটি হচ্ছে শবেবরাত পালন করা ও এ দিনে সিয়ামরত (রোযা) থাকা । কিছু সংখ্যক লোক ধর্মের নামে এটা চালু করে দিয়েছে অথচ শরীআ’তে এর সর্মথনে যে সকল যঈফ হাদিস পেশ করা হয়, তার কোনটার উপর নির্ভর করা যায় না । এর অনেকগুলিই বানোয়াট, কপোলকল্পিত জাল হাদিস মাত্র । শবে বরাতকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে যে আক্বীদাগত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে তা আরো মারাত্মক । সামাজিক কারণে শবে বরাতকে একটি উৎসবে পরিণত করে বাড়িতে, মাসজিদে ও ক্ববরস্থানে আলোক সজ্জা, ঘরে ঘরে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা, পটকাসহ বিভিন্ন ধরনের আগুনের খেলায় মেতে উঠা, দল বদ্ধভাবে ক্ববরস্থান যিয়ারত করা, কুরআন শরীফ খতম পড়া, আয়োজন প্রভৃতি সবই অন্ধ অনুকরণ, সীমালঙ্ঘন । ব্যয় বহুল এবং জঘন্য অনাচার । (আত্তাহযীরু মিনাল বিদ’আ-হাফেজ মাওঃ রুহুল আমীন কর্তৃক বাংলা অনুবাদ কৃত বই এর ১৯ ও ২৬ নং পৃষ্টা, সাপ্তাহিক আরাফাত ৩১ বর্ষ ৩০ তম সংখ্যা)
শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেনঃ আর ইমাম আওযায়ী
(রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) যে, এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদত করা ভাল মনে করেছেন, আর যা হাফেয ইবনে রাজাব পছন্দ করেছেন, তাদের এ মত অত্যন্ত আশ্চার্যজনক বরং দুর্বল; কেননা কোন কিছু যতক্ষন পর্যন্ত না শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে জায়েয বলে সাব্যস্ত হবে ততক্ষন পর্যন্ত কোন মুসলিমের পক্ষেই দ্বীনের মধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে বৈধ হবে না । চাই তা ব্যক্তিগতভাবে করুক বা সামষ্টিক- দলবদ্ধভাবে । চাই গোপনে করুক বা প্রকাশ্য । কারণ বিদআতকর্ম অস্বীকার করে এবং তা থেকে সাবধান করে যে সমস্ত প্রমাণাদি এসেছে সেগুলো সাধারণভাবে তার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে । (আত্তাহযীর মিনাল বিদআঃ১৩) ।
যদি শাবানের মধ্যরাত্রিকে উদযাপন করা বা ঘটা করে পালন করা জায়েয হতো তাহলে অবশ্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে আমাদের জানাতেন । বা তিনি নিজেই তা করতেন । আর এমন কিছু তিনি করে থাকতেন তাহলে সাহাবাগণ অবশ্যই তা উম্মাতের কাছে বর্ণনা করতেন । তারা নবীদের পরে জগতের শ্রেষ্টতম মানুষ, সবচেয়ে বেশী নসীহতকারী, কোন কিছুই তারা গোপন করেননি’। (আত্তহযীর মিনাল বিদা১৫,১৬) ।
উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতনামা রিজালশাস্ত্রবিদ শাইখ আবূ মুহাম্মাদ আলীমুদ্দীন নদীয়াভী সাহেব বলেন-১৫ই শ’বানের রাত্রের সলাতকে কোন এক শ্রেণীর মানুষ লাইলাতুল ক্বদর অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে । ইহা হল জাতির দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক । কুরআন ও সহিহ হাদিসে ঐ ক্বদরের রাত্রির ফযিলত অকাট্য দলীলে প্রমাণিত এবং এ সম্পর্কে বছরের নির্দিষ্ট রমাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে সংঘটিত হওয়ার কথা বর্ণিত থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণীর মানুষ ১৫ই শা’বানকে তাক্বদীরের রাত্রি বলে গলদ ধারণায় সারা রাত্রি সলাতে কাটায় যা প্রকাশ্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই নয় । কেননা, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মদীনায় দীর্ঘ দশ বৎসরের মধ্যে কোন এক বছরেও সাহাবাগণ (রাঃ) লাইলাতুল ক্বদরের ন্যায় ১৫ই শা’বানের রাত্রে সলাত আদায় করেননি, অথবা রাসুল (সাঃ) এর মৃত্যুর পর সাহাবাগণ (রাঃ) রমাযান মাসে জামাআ’ত সহকারে যেমন তারাবীহ সলাত আদায় করেছেন, অনুরুপভাবে কোন মাসজিদে, নিজস্ব মহল্লায় অথবা বাসগৃহে জমায়েত হয়ে জামাআ’তসহ কিংবা একাকী ১৫ই শা’বানের রাত্রে বিশেষ কোন সলাত আদায় করেননী । (রাসুল সঃ-এর সলাত এবং আক্বীদাহ ও জরুরী সহিহ মাসআলাহ ২৪৩-২৪৪ পৃষ্টা)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো যে, কুরআন, হাদীস ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের বাণী থেকে আমরা জানতে পারলাম শাবানের মধ্য রাত্রিকে ঘটা করে উদযাপন করা চাই তা নামাযের মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোন ইবাদতের মাধ্যেমে অধিকাংশ আলেমদের মতে জগন্যতম বিদআত । শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই । বরং তা সাহাবাদের যুগের পরে প্রথম শুরু হয়েছিল । যারা সত্যের অনুসরণ করতে চায় তাদের জন্য দ্বীনের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা করতে বলেছেন তাই যথেষ্ট ।
নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের সাথে বিরোধীতা করে তারা লাঞ্ছিত হবে (মুজাদালা-২০);
যারা রাসুলের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরন করে তাদের সতর্ক থাকা উচিত যে, তারা যে কোন বিপদের সম্মুখীন হবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদের কে গ্রাস করবে (নুর-৬৩);
এক্ষনে যে কেহ আল্লাহ ও রাসুলের কথা অমান্য করবে, তার জন্য জাহান্নামের আগুন রয়েছে এবং তারা উহাতে চিরকাল থাকবে (জীন-২৩)
বিষয়: বিবিধ
১৮৩৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত
২৫/৩০ বছর আগে আমাদের এখানে কোন কোন বাড়ীতে সারি সারি করে মোমবাতি বসিয়ে সন্ধ্যার পর জ্বালানোর রেওয়াজ ছিল নিসফু শাবানে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন