অপরাধী কি ক্ষমার যোগ্য ?

লিখেছেন লিখেছেন সত্যের ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:৪৪:২১ সকাল



সকল প্রশংসা এক আল্লাহর যিনি আমাকে লেখার তৌফিক দান করেছেন । অসংখ্য দুরুদ ও সালাম নবী মোহাম্মদ সা: এর উপর ।

আমরা অনেকেই ভুলক্রমে না জানার কারনে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অপরাধ করে ফেলি, (জীবিতাবস্থায় বা মৃত্যাবস্থায়) যা অন্যের কাছে অপরাধ বলে মনে হয় । আবার অনেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অপরাধ করি বা চক্রান্তকরে অন্যকে অপরাধী বলি ।

কারও অপরাধ প্রমানিত হলে বা প্রমানিত না হলে সে কি ক্ষমারযোগ্য ? এ নিয়ে ইসলামের কিছু বিধান জানানোর চেষ্টা করব ।

তাওবা (توبة) আভিধানিক অর্থ পাপ থেকে ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, প্রত্যাগমন করা ইত্যাদি । বিশেষ পদে অর্থ অনুতাপ, অনুশোচনা । অনুশোচনা করার সাথে সাথে সুযোগ পেলেও আর কখনোও না করার দৃঢ় সংকল্প করা ।

মৃত্যুর পূর্বে বিশুদ্ধ তাওবা করতে পারলে রাহমানুর রাহিম পরম ক্ষমাশীল আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’য়ালা প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সকল অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন ।

আল্লাহ বলেন,

“হে ঈমানদারগণ ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর বিশুদ্ধ তাওবা; তাহলে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যারা পাদদেশে নদী প্রবাহিত” [আত্‌-তাহ্‌রীম আয়াত ৮]

‘বল, হে আমার সেসব বান্দা ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন আচরণ করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না । আল্লাহ নিশ্চয়ই সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন । কেননা তিনিই অতিশয় ক্ষমাশীল ও অশেষ দয়াবান’ (যুমার ৫৩)

‘যে গোনাহ করে কিংবা নিজের উপর যুলুম করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়’ [আন্‌-নিসা আয়াত ১১০]

‘হে মুমিনগণ ! তোমরা সকলেই আল্লাহর কাছে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ [আন্‌-নুর আয়াত ৩১]

তিনিই তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন ও পাপ মোচন করেন এবং তোমরা যা কর তিনি তা জানেন” [আশ-শুরা আয়াত ২৫]

‘তিনি স্বীয় বান্দাদের তাওবা কবুল করেন’ [আত্‌-তাওবাহ আয়াত ১০৪]

বিচারকের গুণঃ

মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে ঘোষণা করেছেন-'নির্দিষ্ট কোনো জাতির বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে তাদের প্রতি অবিচার করতে উদ্বুদ্ধ না করে । তোমরা নির্বিশেষে সবার প্রতি সুবিচার করো । কারণ এটাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী । (জেনে রেখো) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজের খবর রাখেন (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত-৮)

যদি তোমরা আসলেই আল্লাহ তায়ালা ও শেষ দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের ব্যাপারে (আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়নের সময়) অপরাধীদ্বয়ের প্রতি দয়ার উদ্রেক না হয় । (সুরা নূরঃ ২)

রাসুল (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে বলেছেন:

যখন তোমার সামনে বাদী বিবাদী আসবে তখন তাদের মাঝে বিচার করবে না যতক্ষণ না প্রথম জনের কাছ থেকে যেমন শুনেছ অপরজনের কাছ থেকেও শুনবে । কেননা, তাতে তোমার কাছে বিচারের ধরণটা স্পষ্ঠ হয়ে যাওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে । (আবু দাউদ: ৩৫৮২)

স্বাক্ষীঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ ! তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্য ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাও । যদিও সাক্ষ্যটি হয় তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা নিজেদের পিতামাতা অথবা নিকটাত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে । যদি তারা (যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া হচ্ছে) ধনী কিংবা গরীব হয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশী বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু । অতএব, তোমরা ন্যায়বিচারের পথে নিজেদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না । যদি তোমরা (সত্য সাক্ষ্য না দিয়ে) সাক্ষ্যকে পরিবর্তন কর কিংবা সত্য সাক্ষ্য না দাও তাহলে, জেনে রেখো !!! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কর্মকান্ড সম্বন্ধে খোজখবর রাখেন !!! (সুরা নিসাঃ ১৩৫)

হত্যার বিধানঃ

হত্যাকারীর পরিচয় না পেলে রাসুল (সাঃ) এর গভীর দুঃখ প্রকাশ যা বর্তমানে আছে বলে মনে হয় না !!

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেল, কিন্তু হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া গেল না । মহানবী (ছাঃ) চরম অসন্তুষ্ট অবস্থায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন; ‘হে লোক সকল ! ব্যাপার কি, আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান থাকতে মানুষ নিহত হচ্ছে এবং তার হত্যকারীর পরিচয় মিলছে না ? একজন মানুষ হত্যা করার জন্য আসমান-যমীনের সমগ্র সৃষ্টিও যদি একত্রে হয়ে যায়, তবুও আল্লাহ এদের সকলকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না’ [তাবারাণী]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করল । আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে রক্ষা করল’ (মায়েদাহ ৩২)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, - ‘আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না’ (বনী ইসরাঈল ৩৩)

তিনি আরো বলেন, ‘আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন’ (নিসা ৯৩)

হত্যা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হুঁশিয়ারী:

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিনা কারণে মানুষ হত্যাকে কবীরা গুনাহ বলেছেন । তিনি মারামারি ও সশস্ত্র ঝগড়া বিবাদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন । কেননা তাতে অকারণ ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানবহত্যা সংঘটিত হয়ে যেতে পারে, যা কোনক্রমেই কাম্য নয় । এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, দুই জন মুসলমান তরবারি (মারণাস্ত্র) সহ পরস্পরের মুখোমুখী হয়ে পড়লে (একজন নিহত হ’লে), হত্যাকারী ও নিহত উভয় ব্যক্তিই জাহান্নামী হবে । নিহত ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়ার কারণ কি ? জিজ্ঞেস করা হ’লে রাসূলে করীম (ছাঃ) বললেন, ‘কেননা সেও তো প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে উদ্যোগী ছিল । অন্য জনের নিহত হওয়া তো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার । তার পরিবর্তে তারই হাতে সেও নিহত হ’তে পারত’ [বুখারী হা/৩১; মুসলিম হা/২৪৪৪।]

আল্লাহ গনহত্যা কারীর তওবা কবুল করে ক্ষমা করেছেন:

হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি নিরানববই জন মানুষকে হত্যা করে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করল । অতঃপর তাকে একজন খৃষ্টান পাদ্রীর কথা বলা হ’লে সে তার নিকট এসে বলল যে, সে নিরানববইজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে । এমতাবস্থায় তার জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কি ? পাদ্রী বলল, নেই । ফলে লোকটি পাদ্রীকেও হত্যা করল । এভাবে তাকে হত্যা করে সে একশত সংখ্যা পূর্ণ করল । অতঃপর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করায় তাকে একজন আলেমের কথা বলা হ’ল । সে তাঁর নিকট গিয়ে বলল যে, সে একশ’ জনকে হত্যা করেছে, এখন তার জন্য তওবার কোন সুযোগ আছে কি ? আলেম বললেন, হ্যাঁ, আছে । তার ও তার তওবার মাঝে কিসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল ? তুমি অমুক জায়গায় চলে যাও । সেখানে কিছু লোক আল্লাহর ইবাদত করছে । তুমিও তাদের সাথে ইবাদত কর । আর তোমার দেশে ফিরে যাবে না । কেননা ওটা খারাপ জায়গা । লোকটি নির্দেশিত জায়গার দিকে চলতে থাকল । অর্ধেক পথ অতিক্রম করলে তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হ’ল । সে তার বক্ষদেশ দ্বারা সে স্থানটির দিকে ঘুরে গেল । মৃত্যুর পর রহমতের ও আযাবের ফেরেশতামন্ডলীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল । রহমতের ফেরেশতা বলল, এ লোকটি নিখাদ তওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে । পক্ষান্তরে আযাবের ফেরেশতা বলল, লোকটিতো কখনও কোন ভাল কাজ করেনি । এমন সময় অন্য এক ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে তাদের নিকট আগমন করলেন । তখন তারা তাকেই এ বিষয়ের শালিস নিযুক্ত করল । তিনি বললেন, ‘তোমরা উভয় দিকের জায়গার দূরত্ব মেপে দেখ । যে দিকটি নিকটবর্তী হবে, সে দিকেরই সে অন্তর্ভুক্ত হবে’।

““আল্লাহ তা‘আলা সামনের ভূমিকে আদেশ করলেন, তুমি মৃত ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে যাও এবং পিছনে ফেলে আসা স্থানকে আদেশ দিলেন, তুমি দূরে সরে যাও”” ।

অতঃপর জায়গা পরিমাপের পর যেদিকের উদ্দেশ্যে সে যাত্রা করেছিল, তারা তাকে সেদিকেরই এক বিঘত পরিমাণ নিকটবর্তী পেল । ফলে তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হ’ল এবং রহমতের ফেরেশতা তার জান কবয করল’ [বুখারী হা/৩৪৭০, মুসলিম হা/২৭৬৬, মিশকাত হা/২৩২৭ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ‘ইস্তিগফার ও তওবা’ অনুচ্ছেদ]

হত্যায় উদ্ধত ব্যক্তিকে নিজ আয়াতে পেয়েও ক্ষমা করা

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) একটি বাবলা গাছের নীচে অবতরণ করলেন এবং তাতে তাঁর তরবারী ঝুলিয়ে রাখলেন । অতঃপর সকলেই ঘুমিয়ে পড়লেন । জেগে উঠে দেখতে পেলেন এক গ্রাম্য আরব ব্যক্তির হাতে তাঁর খোলা তরবারী । সে বলল, আমার থেকে তোমাকে কে রক্ষা করবে, আমি বললাম, আল্লাহ ! আল্লাহ ! আল্লাহ ! তিনবার । তারপরও তিনি কোন প্রতিশোধ নেননি, অথচ সে সেখানে বসে আছে (বিস্তারিত বুখারী তাঃপাঃ ৩য় খন্ড, ৫৬/৮৪ অধ্যায়, হাঃ ২৯১০)

পিতার হত্যাকারীদের ক্ষমা করা

আশেয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, উহুদের দিন ইবলীস লোকদের মাঝে চিৎকার করে বলল, হে আল্লাহর বান্দারা ! পিছনের দলের উপর আক্রমণ কর । ফলে তাদের সম্মুখভাগ পশ্চাতভাগের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । এমন কি তারা ইয়ামানকে হত্যা করে ফেলল । তখন হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, আমার পিতা !! আমার পিতা !! কিন্তু তারা তাকে হত্যা করে ফেলল । তখন হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন (বুখারী ইঃফাঃ খন্ড ১০ রক্তপণ অধ্যায় অনুছেদ ২৮৭৫ হাঃ ৬৪১৭)

রাসুল (সাঃ) এর সাধারণ ক্ষমা:

রাসূল (ছাঃ) বিশ্ব দাবারে মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ।

৬৩০ সালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের সময় কাফির-কুরায়েশদের উপর কোন রূপ প্রতিশোধ নেননি । মক্কাতে এমনকি মদীনায় হিজরতের পরও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর কুরায়েশ ও কাফিররা লোমহর্ষক নির্যাতন-নিপীড়ন, চালিয়েছিল । তারা তাঁকে (ছাঃ) হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, ছাহাবীদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছিল ও কোন কোন ছাহাবীকে হত্যা করেছিল, যা ইতিহাসের পাতায় নির্মমতার নযীর হিসাবে ভাস্বর হয়ে রয়েছে ।

মক্কা বিজয় করলেন রাসূল (ছাঃ) । তিনি তাদের উপর কোনরূপ প্রতিশোধ না নেয়ার অঙ্গীকার করলেন । মক্কা বিজয়ের পরে কা‘বার প্রাঙ্গনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হে কুরায়েশগণ ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’ ? সবাই বলে উঠল, ‘উত্তম আচরণ । আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘শোন ! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন,

‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)

যাও তোমরা সবাই মুক্ত-স্বাধীন’ [ইবনু হিশাম ২/৪১২; আল-বিদায়াহ ৪/৩০১; সীরাতু ইবনে কাছীর ৩/৫৭০; ফিক্বহুস সীরাহ ১/৩৮২] এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার সকল শত্রুকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন ।

ভুক্তভোগী হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিতে পারেঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদাররা ! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে । মুক্ত ব্যক্তি মুক্ত ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় । অতঃপর তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে যদি কাউকে মাফ করে দেয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে । এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ । এরপরও যারা বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব । (সূরা বাকারা: ১৭৮)

আর আমি এতে তাদের উপর অবধারিত করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান ও দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমের বিনিময়ে সমপরিমাণ জখম । অত:পর যে তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা কাফ্‌ফারা হবে । আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই যালিম । (সূরা মায়েদা: আয়াত ৪৫)

কোরআনে পাকের এ আয়াত দ্বয়ের আলোকে ইসলামী আইনজ্ঞদের সিদ্ধান্ত হলো কাজির মাধ্যমে খুনির দন্ডাদেশ হয়ে গেলে তাকে দুনিয়ায় ক্ষমা করার একমাত্র অধিকার থাকবে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিস ও তার অভিভাবকদের (শরিয়াহ নির্ধারিত নিকটাত্মীয়ের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী অভিভাবক সাব্যস্ত হবেন), তারা শর্ত-জরিমানাসহ কিংবা নিঃশর্তেও মাফ করতে পারেন । ভুক্তভোগী যেহেতু তারা, কাজেই ক্ষমা করার অধিকারও তাদের, অন্য কারও নয় । এটাই হলো ইসলামী আইনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন । এভাবেই প্রকৃত মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা হতে পারে ।

যেনার বিধানঃ

যিনা সুস্পষ্ট হারাম এবং শিরক ও হত্যার পর বৃহত্তম অপরাধ ।

আল-কুরআনে আছে: এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না । যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে । কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে । কিন্তু যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পুন্য দ্বারা পরিবর্তত করে এবং দেবেন । আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (ফুরকান, ৬৮-৭০)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না । নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ । (ইসরা, ৩২)

যিনার শাস্তি

আল-কুরআনে আছে: ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর । আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক । মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে । (নূর: ২)

হাদীসে আছে, অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি এক শত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর । আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (সহীহ মুসলিম)

মায়েয ইবনু মালিকের ঘটনাঃ

একবার তিনি ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর স্বয়ং মহানবী (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে পবিত্র করুন’। তিনি বললেন, ‘ধিক তোমাকে ! তুমি চলে যাও । আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তওবা কর’ । বর্ণনাকারী বলেন, তিনি চলে গেলেন এবং সামান্য একটু দূরে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসলেন এবং আবারও বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে পবিত্র করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবারও তাকে পূর্বের ন্যায় বললেন । এভাবে তিনি যখন চতুর্থ বার এসে বললেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি তোমাকে কোন্ জিনিস হ’তে পবিত্র করব’? তিনি বললেন, ‘যেনা হ’তে’। তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীগণকে) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ লোকটি কি পাগল’ ? লোকেরা বলল, ‘না, সে পাগল নয়’। তিনি আবার বললেন, ‘লোকটি কি মদ পান করেছে’ ? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার মুখ শুঁকে তার মুখ হ’তে মদের কোন গন্ধ পেল না ।

অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সত্যিই যেনা করেছ’ ? সে বলল, ‘হ্যাঁ’। এরপর তিনি রজমের নির্দেশ দিলেন, তখন তাকে রজম করা হ’ল । এ ঘটনার দু’তিন দিন পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীগণের নিকট) এসে বললেন, ‘তোমরা মায়েয বিন মালিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর । বর্ণনাকারী বলেন, তখন ছাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ মায়েয বিন মালিককে ক্ষমা করুন । এরপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘সে এমন তওবা করেছে, যদি তা সমস্ত উম্মতের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়, তবে তা সকলের জন্য যথেষ্ট হবে’। মুসলিম হা/১৬৯৫-৯৬, মিশকাত হা/৩৫৬২ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায় ।

আরেকটি হাদীসে বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) এবং জায়েদ বিন খালিদ (রাঃ)কতৃর্ক বর্ণিত (বুখারী হাদীসে ০৮২:৮১৫ নং )

বলা আছে- একদিন আমরা রাসুলের (সাঃ)এর সাথে বসা আছি, হঠাৎ মজলিশের মাঝ থেকে এক লোক দাঁড়িয়ে নবী (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো "আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি আপনি আল্লাহর আইন অনুযায়ী আমাদের বিচার করে দেন"। তখন সেই লোকটির প্রতিপক্ষ যে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী জ্ঞানী ছিল সে দাঁড়িয়ে নবী (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো "আল্লাহর আইন অনুযায়ী আমাদের বিচার করেন এবং দয়া করে আমাকে কিছু বলার অনুমতি দেন"। নবী বললেন, বল ।

তখন সেই ২য় লোকটি বললো "আমার ছেলে শ্রমিক হিসেবে এই লোকটির অধীনে কাজ করতো এবং সে এই ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে যেনা করে । আমার ছেলের অপরাধের ক্ষতিপুরণ স্বরুপ আমি তার মালিক অর্থাৎ এই ব্যক্তিকে কে ১০০ টি ভেড়া এবং ১টি দাস দেই । এবং এবিষয়ে আমি পরবর্তীতে একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে সে আমকে বলে এই অপরাধের দরুন আমার ছেলেকে ১০০টি বেত্রাঘাত করা এবং তাকে এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো উচিত । এবং সেই ব্যক্তির স্ত্রীকে পাথর মেরে হত্যা করা উচিত ।"

নবী (সাঃ) তখন বললেন " যার হাতে আমার প্রান সেই সত্বার কসম খেয়ে বলছি, আমি তোমার বিচার অবশ্যই আল্লাহর আইন অনুযায়ী করবো । তোমার ১০০ টি ভেড়া এবং ১টি দাস যা তুমি তোমার ছেলের অপরাধের ক্ষতিপুরণ স্বরুপ প্রদান করেছিলে তা তোমাকে ফেরত দেয়া হবে এবং তোমার ছেলের এই অপরাধের দরুন তাকে ১০০টি বেত্রাঘাত করা হবে এবং এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হবে । ওহে আনাস, তুমি এই ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট যাও এবং জিজ্ঞেস করো তার অপরাধ সম্পর্কে যদি সে স্বীকার করে তবে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হউক"।

আনাস সেই ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলে সেই ব্যক্তির স্ত্রী তার অপরাধ স্বীকার করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয় ।

ধর্ষণের শাস্তি

ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে যিনা সংঘটিত হয় । আর অন্যপক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত । তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই । কেবল জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে । প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত যিনার শাস্তি পাবে ।

ইফক তথা অপবাদঃ

স্বমী ব্যাতীত অন্য কেউ কোন অবিবাহিতা, বিবাহিতা নারীকে অপবাদ দিলেঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

যাহারা সম্মানীয় স্ত্রীলোককে অভিযুক্ত করে, কিন্তু চারিজন সাক্ষী আনিতে পারে না, তাহাদিগকে আশিটি বেত্রাঘাত করিবে এবং ভবিষ্যতে কখনই তাহাদের শপথ-বাক্য গ্রহণ করিবে না –তাহারা যথাযর্থই দৃষ্কৃতকারী । কিন্তু যাহারা পরে পরিতাপ করে এবং সংশোধনশীল হয়, স্মরণ রাখিও ! (তাহাদের জন্য) আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়াময় (সুরা নুর ৪, ৫)

যারা ইফক তথা অপবাদ আরোপ করেছে তারা তোমাদেরই একটা গ্রুপ; তোমরা এটাকে অকল্যাণ বলে মনে করো না । বরং, এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর । তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্ম পরিমাণে সাজা । আর যে এর নেতৃত্বে আছে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি । যখন তোমরা এটা শুনলে তখন মুসলমান নর-নারীরা কেন তাদের নিজেদের লোকদের সম্বন্ধে সুধারণা করে এ কথা বলল না যে, এটা স্পষ্ট অপবাদ ??? যদি তারা (চারজন) সাক্ষী না নিয়ে আসে তাহলে তারা আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে মিথ্যাবাদী হিসেবে গণ্য হবে । যদি তোমাদের উপর আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত তাহলে তোমাদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে কঠোর শাস্তি নিপতিত হত !! যখন তারা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কিছু কথাবার্তা বলাতে চেয়েছিল এবং তোমরা তা বলেছিলে যে ব্যাপারে তোমাদের কাছে কোন জ্ঞান ছিল না । তোমরা মনে করেছিলে ব্যাপারটা খুবই সাধারণ অথচ, আল্লাহ তায়ালার কাছে এটা অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার । যখন তোমরা এটা শুনেছিলে কেন তোমরা বললেনা যে, আমাদের এসব কথাবার্তা বলা উচিত হবে না; এটা জঘন্য অপবাদ ???? আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, খবরদার !! যদি তোমরা বাস্তবেই মুসলিম হয়ে থাকো তাহলে এমন কাজের যেন পুণরাবৃত্তি না হয় । (সূরা নুরঃ ১১-১৭)

উপরের আয়াতগুলো যা নির্দেশ করেঃ

১। সালিশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপবাদকারীকে কোন রকম দোষারোপ করা যাবে না ।

২। স্বাক্ষী প্রমান না হলে অপবাদকারী সাজা পাবে ।

৩। অভিযুক্ত নারী নির্দোষ হলে অপবাদকারীকে ক্ষমা করে দিতে পারে ।

স্বামী নিজেই স্ত্রীকে অপবাদ দিলেঃ আল্লাহ তায়ালা বলেন:

যাহারা তাহাদের স্ত্রীদিগকে অভিযুক্ত করে, কিন্তু নিজ ব্যতীত অন্য কোন সাক্ষী আনিতে পারে না, সেক্ষেত্রে তাহাদের একজনের শপথ-বাক্য চারিজনের বলিয়া গণ্য হইবে, (তবে) আল্লাহর নামে শপথ করিতে হইবে যে, সে একজন সত্যবাদী । এবং পঞ্চমবার শপথ করিবে আল্লাহর অভিশাপ চাহিয়া, যদি সে মিথ্যা বলে । এবং অভিযুক্ত স্ত্রীলোক শাস্তি হইতে নিষ্কৃতি পাইবে যদি সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখিয়া চারিবার বলে যে ঐ ব্যক্তি যাহা বলিতেছে তাহা বাস্তবিকই মিথ্যা । এবং তাহাকে পঞ্চমবার শপথ করিতে হইবে যে আল্লাহর ক্রোধ তাহার উপর বর্ষিত হইবে যদি তাহার স্বামী সত্য বলিয়া থাকে (সুরা নুর ৬-৯)

স্বামী স্ত্রীকে দেওয়া অপবাদ শপদ করানোর পর প্রমানিত না হলেও তাদের বিবাহ বন্ধন বাতিল হবে (বিস্তারিত দেখুন বুখারী ইঃফাঃ ৯ম খন্ড তালাক অধ্যায় হাঃ ৪৯২৩, ৪৯২৫, ৪৯২৬, ৪৯২৮, ৪৯২৯, ৪৯৩০, ৪৯৩১, ৪৯৫৮, ৪৯৫৯)

চোরের বিধানঃ

যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে, তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসাবে । আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী । আল্লাহ পরাক্রান্ত, জ্ঞানময় (সুরা মায়েদাহ ৩৮)

মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

‘নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী কওমের লোকেরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে যখন কোনো বংশীয় লোক চুরি করত, তারা তাকে ছেড়ে দিতো (শাস্তি প্রদান করত না)। আর তাদের মধ্যে গরীব কেউ যখন চুরি করতো, তার ওপর তারা হদ কায়েম করত । আল্লাহর শপথ, মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করত, তবে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম ।’ [বুখারী: ৩৪৭৫]

বিষয়: বিবিধ

১৯১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File