একজন বাবার গল্প - (দুবাই আরব আমিরাত) থেকে
লিখেছেন লিখেছেন Mujahid Billah ১২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:২০:১৮ রাত
ছেঁড়া লুঙ্গিকে কীভাবে ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে পরতে হয় বাবার কাছ থেকে শিখেছিলাম। অনেক যত্ন করে লুঙ্গি পরতেন বাবা। এক লুঙ্গিতে তিন চার বছর অনায়াসে পার করে দিতেন। ছোটবেলায় বাবার পরনে নতুন লুঙ্গি ঠিক কখন দেখেছি আমার মনে পড়ে না। এমনকি ঈদ, কোরবানিতেও না। ঈদের আগে পুরোনো পাঞ্জাবি আর ঈদের বিশেষ লুঙ্গি খানা বের করে দিতেন মা। ধোপার বাড়ি ঘুরে এসে সেই কাপড়গুলোই ঝকঝকে ঈদের পোশাক হয়ে উঠত।
নিজের জন্য নতুন কাপড়, এটা যেন তিনি ভাবতেই পারতেন না। এটাকে স্রেফ বিলাসিতা আর অনর্থক অর্থ অপচয়ের কাতারেই রাখতেন। আমার বড় বোনরা অনেক করে বলতেন বাবাকে, একটা নতুন জামা নেওয়ার জন্য। বাবা কয়েক বছরের পুরোনো কিন্তু দেখতে নতুনের মতো ঝকঝকে জামাগুলো দেখিয়ে বলতেন, এই দেখ আমার কত জামা।
টানাটানির সংসারে নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনার বিলাসিতা এক দণ্ডও পছন্দ ছিল না বাবার। কিন্তু আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের আপ্যায়ন খরচটা যেন ওনার গায়েও লাগত না। আমাদের শিক্ষকদের তিনি ঠিক ততটুকুই ভালোবাসতেন যতটুকু তিনি আমাদের বাসতেন। এক মাস এই খরচটা বাঁচালে নতুন কাপড় কিনতে কোনো বেগ পেতে হয় না।
একটা ছোট টেবিলের তিনপাশে চেয়ার টেনে আমরা তিন ভাই পড়তাম। মাঝখানে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলত। প্রতিদিন বাবা কেরোসিন কিনতেন অল্প অল্প। দোকানে যাওয়ার আগে বোতলে থাকা তেলগুলো আরেকটি বোতলে জমিয়ে রাখতেন। যদি কোনো দিন তেল কিনতে না পারেন তাহলে জমানো কেরোসিন থেকেই সেই রাতটা পার করিয়ে দিতেন। কেরোসিন সাশ্রয়ের জন্য কুপির যে সুতোটা জ্বলত সেটা টেনে একটু ছোট করে দিতেন মা। যাতে আলোটা ছোট হয়ে দীর্ঘ সময় জ্বলে।
আমাদের টেবিলের হাত পাঁচেক দূরে আরেকটি চেয়ারে বসে থাকতেন বাবা। সেই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি। আমাদের বিছানায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েই তারপর তিনি বিছানা ধরতেন। শুধুই কী বসে থাকা? কিছুক্ষণ পর পর তিনি গল্প বলতেন। জীবনের গল্প। জীবনে হেরে যাওয়ার গল্প। জয়ের গল্প। মানবতার গল্প। মমতার গল্প। মানুষের গল্প। জীবনে টিকে থাকার গল্প। একাগ্রতার গল্প। অধ্যবসায়ের গল্প। এত গল্প!
জীবনের এমন কোনো শাখা নেই যে শাখার গল্পগুলো বাবার মুখে শোনা হয়নি। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম বাবার গল্পগুলো। আর সেই গল্পের একজন হয়ে যেতাম কখনো কখনো। নিজের অজান্তেই সেই গল্পের আল ধরেই চলতাম আমরা। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আবার পড়ালেখায় মন দিতাম।
পূর্ণিমার রাতগুলোতে উঠোনে উঠোনে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর পসরা বসতো। সারা বাড়ি গম গম করত হই হুল্লোড়ে। আমরা থাকতাম পড়ার টেবিলে। বাবা থাকতেন একই জায়গায়। হই চইয়ের মধ্যে আমাদের মনোযোগ ভ্রষ্ট হতে দেখলে বাবা একাগ্রতার গল্প জুড়ে দিয়ে শেষে বলতেন, মনে রেখো, বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে, একা আমি বসে রবো কর্তব্য সাধিতে। তারপর এর ভাবটা সম্প্রসারণ করে বুঝিয়ে দিতেন একাগ্রতার গুরুত্ব। সত্যি সত্যিই এরপর আমরা আর কিছুই শুনতে পেতাম না। ছেলেমেয়ের হই হই কিংবা বিয়ে বাড়ির রই রই কোনো কিছুই এই দুই কানের ত্রিসীমানার হদিসও খুঁজে পেত না।
বাবার অসচ্ছলতা ছিল চাল-ডাল কেনার ক্ষেত্রে। কিন্তু খাতাকলম কেনার সময় কোনো দিন অসচ্ছলতা দেখিনি। এক রিম খাতা। কয়েক ডজন কলম। একবারেই কিনে রাখতেন বাবা। বলে রাখতেন, খাতা-কলম ফুরিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই যেন বলে রাখি। দৃঢ়স্বরে বলতেন, যেভাবেই হোক, উপোস থেকে হলেও তোদের খাতাকলম আমি সংস্থান করে রাখবই।
একদিন পড়ার টেবিলের মাঝখানে থাকা কেরোসিন কুপির অবসান হলো। বাবা হাতে করে নিয়ে এলেন একটি হারিকেন। কেরোসিন কুপির কালো ধোয়ায় আমাদের নাকি ক্ষতি হচ্ছে। সেটা ভেবেই হারিকেন নিয়ে এলেন। তাতে বাবার ঝক্কি ঝামেলাই বেড়ে গেল। হারিকেনে তেল বেশি লাগে আবার এর ফিতাটাও কিনতে হয়। তবুও তিনি হারিকেন জ্বালাবেন। হারিকেনের অনেক সুবিধা আমরা পরখ করতে লাগলাম। চাবি দিয়ে হারিকেনের আলো ছোট বড় করা যায়। চোখে আলো না পড়ার জন্য ছোট ছোট কাগজ চিমনিতে আটকে দিলে, চোখ আরাম পেত। ঝড়-বাদলার দিনে হারিকেন নিয়ে বাইরে উঁকি দেওয়া যায়।
দশ কী বারো বছরের মাথায় আমার বাবা তার বাবাকে হারিয়েছেন। এই ছোট্ট শিশু বালকটিই সংসারের একমাত্র পুরুষ। সংসারের পুরো ঘানিই একাই টেনে নিয়ে যেতে হলো বালকটিকে। চাষের জমি দেখাশোনার পর মা-বোনের জীবিকার রসদ যুগিয়ে, নিজের জীবনের রসদ জোগানোর কোনো ফুরসতই যেন মিলত না তার। তবুও পড়ালেখার প্রতি দুর্নিবার আসক্তি এই অদম্য বালকটিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শত প্রতিকূলতা পেছনে রেখে হাইস্কুলের গণ্ডি মাড়িয়ে কলেজের দোরগোড়ায় পৌঁছে যান এতিম কিশোর। কিন্তু তত দিনে দামামা বেজে ওঠে হানাহানির। ছেলেটিকে একা পেয়ে কিছু লোভী প্রতিবেশী তার জমিজিরাত নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। আর এই বিশৃঙ্খলাই বই-খাতা-কলমের সঙ্গে মিতালি গড়ে তোলা ছেলেটির জীবনে এক ঝোড়ো সন্ধ্যা নেমে আসে।
ছেলেটি একা। এই ঝড়ে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে ছেলেটি। হারতে হারতে জীবনের ঘানি টেনে নিয়ে যায় সামনে। ঝড়ে ঝড়ে রাত আরও গভীর হয়। ঝোড়োময় জীবনের কোনো এক সময়ে তার জীবনে এক এক করে আমরা আসলাম। লেখালেখির উৎসাহ কিংবা গুনা গুনের ছিটেফোঁটা যদি আমার মধ্যে থেকে থাকে তবে সেটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। চাল, ডাল সংস্থানের জন্য সারা দিন খাটাখাটির পরও দেখতাম অবসর সময়টুকুতে তিনি শরৎ সমগ্র, বঙ্কিম সমগ্র কিংবা গল্পগুচ্ছে ডুবে আছেন। শুধু সাহিত্য নয়; আইনের বই, কোরআন তাফসিরসহ যে কোনো ধরনের বই পেলেই ডুবে থাকতেন। আমরা নতুন ক্লাসে উঠলে আমাদের নতুন বইগুলো তিনিই প্রথমে পড়ে নিতেন।
পড়ালেখার প্রতি আমার বাবার এমন আগ্রহ, একাগ্রতা দেখে আমাদেরও বইগুলোর সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল এবং সে জন্যই পড়ালেখা ছেড়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার পথ কখনোই আমাদের জন্য খোলা থাকেনি। প্রবন্ধ লেখন কিংবা রচনা লেখন ছোটবেলায় কখনোই ব্যাকরণ বই থেকে শিখতে হয়নি। আমার বাবা নিজের হাতে নিজের মতো করে লিখে নোট করে রাখতেন।
১৯৯২ সালে আমার বড় ভাই জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেবেন। বাবা বললেন, সমসাময়িক হিসেবে ১৯৯১ সাইক্লোন রচনা আসতে পারে। বাবা হাত পাঁচেক দূরের সেই চেয়ার থেকে বলা শুরু করলেন আমার বড় ভাই লিখতে থাকলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাবার মুখে ঘূর্ণিঝড়ের রাত-দিনের সেই বর্ণনাটি সাহিত্যের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।
আরবি, বাংলা ও ইংরেজি সনের তারিখগুলো কখনোই বাবার ভুল হতো না। যন্ত্রে তার স্মৃতিশক্তি মাপতে পারলে নির্ঘাত অনেক ওপরেই দেখতে পেতাম। প্রতিবেশীর অনেকেই এসে জিজ্ঞেস করামাত্রই তিনি তারিখ বলে দিতেন। আমাদের চৌদ্দগুষ্টির নামও বলে দিতেন ফর ফর করে। বাবার হাতের লেখা ছিল দেখার মতো। সাদা কাগজে সুতো টানা লাইনের মতন সোজা।
একদম ছোটবেলায় বাবা আমাদের এমন কৌশলে বর্ণমালা ও অঙ্ক শেখাতেন যা ভুলে যাওয়াটাই অসম্ভব হয়ে যেত। শেখানোর সময় বিরক্তি কিংবা রাগের মতো বস্তুগুলো কখনোই বাবার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেখিনি। তার দেখানো পথে যখন একটি অঙ্ক ঠিক ঠিক ভাবে করে ফেলতাম, বাবা তখন হাত তালি দিয়ে শাবাশ শাবাশ বলে চিৎকার করে উঠতেন।
আমাদের প্রাইমারি স্কুলের অফিসের একটি ফলকে আমার বাবার নামটি পরপর তিনবার লেখা রয়েছে। বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের নামফলক। ওখানে পর পর আমাদের তিন ভাইয়ের নাম ও পাশেই আমার বাবার নাম। হয়তো এই ফলকটিই আমাদের নিয়ে আমার বাবার স্বপ্নে দৃঢ়তা এনে দিয়েছিল। ছেলেদের পাঠচ্যুত না করানোর জন্য তিনি হয়তো তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন। আর এই কঠিন সিদ্ধান্তটিই তাকে ঠিক কয় বেলা আহারচ্যুত রেখেছিল আমার জানা নাই।
পড়ালেখার মতো এমন দুর্গম, পাথুরে রাস্তাটি তিনি সুকৌশলে আমাদের জন্য মসৃণ করে গড়ে দিয়েছিলেন। খালি পায়ে চলতে গিয়েও কখনো বুঝতে পারিনি কী পরিমাণ ঘামে, চোখের পানিতে রাস্তাটি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল!
২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর বাবা তার ছেলেদেরকে জীবনের গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে নিজেই চিরকালের গন্তব্যের পথ ধরেন।
সুখ কী? আমি জানি বাবা, সুখের সংজ্ঞাটি আপেক্ষিক। তুমি চাইলে আমাদের কাজে ঠেলে দিয়ে যাবতীয় জাগতিক সুখের হিসাবটি কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে পারতে। কিন্তু সুখের আপেক্ষিকবাদ তত্ত্বের যে ধারায় তুমি নিজের শীর্ণ শরীরটাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমাদের জন্য বিরাট মহিরুহের যে শীতল ছায়া রচনা করে গেলে, ঠিক কত প্রজন্ম ধরে তার স্তুতি গেয়ে শেষ হবে তা আমার জানা নাই।
বাবা, যেখানেই থেকো সুখে থেকো।
বিষয়: Contest_priyo
১৪৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন