রমজানের রাত্রি

লিখেছেন লিখেছেন Mujahid Billah ০৭ জুন, ২০১৭, ০৯:০০:৩৮ রাত

সন্ধ্যা রাতে সবাই ব্যস্ত। রাতে মসজিদে তারাবী। ওখানে সুন্দর আমেজ। অনেকটা রাতের বেলা ঈদের মত। গ্রামের সকল মুসল্লি আগেভাগে হাজির। টিউবওয়েলের কল চেপে পানি তোলার কাজ। শফিক ভাই বিগত চার বছর মেট্রিক পরক্ষিা দিচ্ছেন। পাস হচ্ছে না। সেই শফিক ভাই পাসের আশায় সবার আগে মসজিদে আসেন, কাঁচা নিমের ডাল ভেঙ্গে ডলতে থাকে অনেকক্ষণ। চাঁদের আলোতে ছাল ছড়ানো নিমের চিকন ডালটি অনেক সাদা লাগে। অদ্ভুত সুন্দর। মোটাসোটা কোঁকড়া চুলের শফিক ভাইয়ের গায়ের রঙ বেজায় ফর্সা। সুন্দর সাদা সুঁতি পাঞ্জাবীতে রাতে চাঁদের আলোর ফিনিক ফুটে।

হারিকেনের আলো জ্বেলে নানার হাত ধরে মসজিদে গিয়ে দেখি প্রায় জামাতের সময় হয়েছে। অধিকাংশ নতুন মুসল্লি মসজিদের বারান্দায় চাঁদের আলোয় গল্প করছেন। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু নওশাদ মৌলভী।

আদতে উনি মওলানা লাইনে পড়া মৌলভী নন। ইন্টার পাস, গলার স্বরগ্রাম ভালো। বাড়ী সরেরহাট। এখান থেকে মাইল চারেক দূরে। সর্বদা আতরমাখা হাজী রুমাল, টুপি-পাঞ্জাবী পরেন।

উনিই এই মসজিদের ইমাম। তারাবীর নামাজ, ঈদের জামাত তাঁর দায়িত্বে। পদ্মা নদীর চরের মসজিদে চাকরি, বেতন নেই। ধানের সময় ধান, গমের সময় গম দিয়ে তার খোরাকী। তারাবীর নামাজ পড়াতে নওশাদ ভাইয়ের বেশি সময় লাগে না। সূরাহ্্ তারাবীর ব্যবস্থা। গ্রামের লোকজন সংক্ষেপ নামাজ পড়ে চলে যান। সারাদিন কাজকর্ম করে দীর্ঘ নামাজ কঠিন। কৃষকদের ভয়ে শফিক ভাই আর আমার ঘুম আরো বেশি। ঘুমকাতুরে শফিক ভাই বিশ রাকাত নামাজ পড়তে গিয়ে দুর্বার ঘুমের ঝুলে দু’তিনবার পড়ে যান। মাঝখানে একবার সিজদার মধ্যে শফিক ভাই প্রকৃত নিদ্রামগ্ন। দ্বিতীয় সিজদা থেকে মাথা তোলে সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছে, শফিক ভাইয়ের মাথা তোলার নাম গন্ধ নেই। নিয়মিত মুসল্লি ফরিদ মামা চা-স্টলে তিনচারজন লোকের সামনে গত রাতে ধুমের মধ্যে মাথা না তোলার কথা গল্প করছেন। ভারি লজ্জার কথা। ঘুম তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। বিশ রাকাত তারাবীর কথা মনে হলেই চোখে রাজ্যের ঘুম।

বিকাল বেলা সমবয়েসী আব্বাস, রাজ্জাকের সাথে ওদের বৈঠকখানায়। আমরা তিনজন কিশোর। আমি গতবার ত্রিশ রোজা রেখেছি, আব্বাস সতেরটা আর রাজ্জাক সাতটা। এবার ওরা আমার মত সবগুলো রাখবে। ওদের উঠানে বিশ্রী অবস্থা। চারদিকে কেবল থুথু ছিটানো। [রোজা রেখেছে তাই মুখের থুথু না গিলে এদিক ওদিক মুখস্থ ছুড়ে ফেলছে।] রাজ্জাকের মা-বাবাও মুখের থুথু গিলে না। তাতে রোজার দোষ লাগে। রোজা দুর্বল হয়। ভারী বিপদ। ওদের চারিদিকে থুথুর বিছন বোনা। [রোজাকে শক্তিশালী, বলশালী করার জন্য এ ব্যবস্থা] রোজা শক্তিশালী করার এ পদ্ধতি দেখে চলে এলাম আমাদের বৈঠকখানায়। সুর করে নওশাদ মৌলভী ওখানেই কুরআন তেলাওয়াত করছেন। খতম দিতে তাই তাড়া। থুথুর বিষয়ে তারও একই মত। তাঁর পাশে চৌকির উপর জনাচারেক রাখাল কৃষাণ।ওদের সবার মুখেই দাঁতন। রমজান মাসের শেষ বিকেলে দাঁতন করার হিড়িক। পুরুষ মহিলা বলে কথা নেই। আকাশের তারা দেখে ভোর রাতে জাগ্রত হয়। আবার নানি উঠেন আরও আগে। পনের বিশ জনের পরিবারে গভীর রাতে ভাত তরকারি রান্না। রাখাল কৃষাণের মধ্যে এবার রোজা রাখার প্রতিযোগিতা। জোয়ান মর্দা জমশেদ গাড়োয়ান ছাড়া বাকী সবাই রোজাদার। ছাগল-ভেড়ার রাখাল মানিক আর গরুর রাখাল ফৈজুও নিয়মিত রোজা রাখে।

আমি ঘরের বারান্দায় নানার সাথে ঘুমিয়ে রান্নাঘরের পাটকাঠি পোড়ানোর শব্দ শুনছি। কাজের মেয়ে ময়না আর রাসনা বুবু জোরে কথা বলছেন। মধ্যরাতে পাটা নোড়ার শব্দও। ঘুম চোখে কানের কাছে ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে রাতের বেলা। এমন আয়োজন আসলেই সুন্দর। ভাবছি তারাবির নামাজে আমি ঘুমে মরি। ওরা রাত জেগে আবার বিশ রাকাত নামাজে জেগে থাকে কি করে? নানির সাথে উঠানে দাঁড়িয়ে গাঁয়ের মহিলারা নামাজ পড়েন। রাসনা বুবু ও ময়নাকে দেখি তাদের সাথে। তখন ওদের ঘোমটা দেয়া দৃশ্যটা আড়চোখে দেখতে বউদের মত। আসলেই ভালো লাগে। আমরা নামাজ শেষ করে এসে দেখি মহিলাদের নামাজ তখনও চলছে।

সেহেরী খাবার সময় ছোট বোন নিলু জাগল। ও কোনদিন জাগে না। আজ দিব্যি সজাগ। ড্যাবড্যাব চোখে তাকাচ্ছে। মামাত ভাই রিপনটাও জেগেছে। রান্নাঘরে চুলার পাশে চুপচাপ বসে আছে। দু’জনেরই বয়েস পাঁচ ছয়ের মধ্যে। মাদুর বিছানো। গোল হয়ে খেতে বসেছি। হারিকেনের হালকা আলোতে স্বর্গীয় খানা। আমাদের বাড়িতে পুরা রমজান মাস নওশাদ মৌলভী থাকেন। উনি টুপি পরে খানা খান, নানার পাশে বসে। আমি, রিপন ও নিলু একসাথে বসেছি। ওরা দু’জন খাচ্ছে না। রিপন আর নিলুর হাতে একটা করে পাকা কলা। একবাটি দুধ সামনে। সুন্দরী লাল মামানী সবার পাতে খানা দিচ্ছেন। মাহে রমজানের এই স্মৃতিময় রাত্রিটা ছবির মত মনে হয়। তখন কত যে ভালো লাগে। সে কথা কাকে বলব?

বিষয়: বিবিধ

৮৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File