পুনশ্চ
লিখেছেন লিখেছেন Mujahid Billah ২১ মে, ২০১৭, ০৬:০৭:০৯ সন্ধ্যা
দরজা খুলে অনেকটা ভুত দেখার মত চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিল মায়া। কতো বছর পরে দেখা হল অরিত্র’র সাথে। এখনও আগের মতই আছে। চমকে দেবার অভ্যাসটা পাল্টাতে পারেনি মনে হয়। নিজের মলিন বেশভূষার কারণে নিজেকে দীনহীন মনে করেনি কিন্তু এতদিন পরে দেখা হবে অরিত্র’র সাথে সেই মনোভাব লুকানোর কোন ব্যর্থ চেষ্টা মায়া করেনি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধাতস্থ হয়ে দরজা ছেড়ে দিয়ে বলল, আসুন। বাস এতটুকুই সম্ভাসন।
হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অরিত্র বললো, কেমন আছো?
ভাল। এবারো সেই অতি সংক্ষিপ্ত জবাব।
তোমার ছেলে কোথায়? সরাসরি মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো অরিত্র।
আমার ছেলে! বলেই কেমন যেন দীর্ঘশ্বাস ফেললো মায়া। এই এসে পড়বে এখুনি। স্কুলে গেছে।
কি নাম ওর?
প্রত্যয়।
বাহ! বেশ নাম তো। কে রেখেছে এই নাম? তাপস?
জ্বী। চোখ নামিয়ে মায়া বলে ওঠে, কিছু খাবেন? ঘরে আমাদের তো তেমন কিছু খাবারের ব্যবস্থা নেই। সামান্য কিছু আছে। আপনি খেতে পারবেন তো?
আমি এবেলায় কিছু খাবো না। তুমি চিন্তা করো না মায়া। প্রত্যয় এলে কি খাবে?
ঘরে যা আছে ও খেয়ে নেবে।
ঘরের দরজায় উদয় হল দশ বছর বয়সী এক কিশোরের। পরনে ময়লা একটা শার্ট, হাফ প্যান্ট আর পিঠে পুরনো একটা স্কুল ব্যাগ। অবাক হয়ে দেখতে লাগলো অতিথিকে। মায়া কাধ থেকে ব্যাগ নিতে নিতে বললো, প্রণাম কর। ইনি তোর পিসতুতো দাদা হন।
প্রত্যয় সেই ঝুকে অরিত্র’র পা স্পর্শ করতে যাবে অমনি ওর হাত ধরে বললো, কর কি কর কি! এসো তো বসো আমার পাশে। টেনে নিজের পাশে বসালো। অরিত্র আর প্রত্যয় দু’জন দু’জনকে জরিপ করতে লাগলো।
আপনি আমার কোন পিসির ছেলে হন? সরল মনে প্রশ্ন করলো প্রত্যয়।
তোমার বড় পিসি।
ও! যেই পিসি আমেরিকা থাকে?
হুম।
আপনিও কি আমেরিকা থাকেন? আমেরিকা কেমন দেখতে দাদা?
এটা কেমন কথা প্রত্যয়? তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে মায়া। যাও হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। আসতে না আসতেই দাদাকে বিরক্ত করা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গেল প্রত্যয়। এই দাদার কথা, পিসির কথা মায়ের কাছে অনেক শুনেছে কিন্তু কখনও দেখা হয় নি এদের সাথে। কত কথা যে জিজ্ঞেস করার ছিল। মা টা যে কি না! কোন কথাই বলতে দিল না।
খামাখা ওকে ধমক দিলে মায়া। ও আমাকে কোনদিন দেখেনি। কত রকম কথা ওর মনে। অরিত্র নিজেই উঠে গেল ঘর ছেড়ে।
প্রত্যয় প্রত্যয়? জোরে জোরে ডাক দিল অরিত্র।
ঘাড়ে গামছা নিয়ে চলে এল। দাদা ডেকেছেন?
হুম। চল এখুনি আমার সাথে বের হবি।
কোথায়? কিশোরটির চোখ বিস্ফোরিত। মা বকবে যে?
তোর মা কিছুই বলবে না। তুই চল আমার সাথে। শার্ট গেঞ্জি কিছু পরে নে। আমি রেডিই আছি। তুই রেডি হ।
এখুনি আসছি দাদা। বলেই দৌড় দিল বারান্দার শেষ দিকের ঘরটায়। অরিত্র দাঁড়িয়ে রইলো ও না আসা পর্যন্ত।
মায়া আমরা বের হচ্ছি। প্রত্যয়কে বাইরে খাইয়ে দেব চিন্তা করো না। বলেই ছেলেটার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো অরিত্র, মায়ার কোন অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। ওদের গমন পথের দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মায়া নিজের ঘরে চলে গেল।
রিক্সায় বসে প্রশ্ন করলো, দাদা আমরা কই যাচ্ছি?
তা তো জানি না রে।
সে কি? কই যাচ্ছি জান না?
না। অরিত্র মুচকি হাসতে থাকে প্রত্যয়ের অবাক হওয়া চেহারা দেখে। ছোটবেলায় অরিত্রও ঠিক এমনটাই ছিল দেখতে। মায়ের আলমারিতে পড়ে থাকা অ্যালবাম ঘাটলে একখনও ছোটবেলার অনেক ছবিই পাওয়া যাবে।
তোর কি খিদে লেগেছে রে?
না দাদা। আসার আগে জল খেয়ে নিয়েছি।
জল খেলে কি পেট ভরে রে বোকা ছেলে?
দুই গ্লাস জল খেয়েছি। ওতেই পেট ভরে গেছে দাদা।
বেশ নামকরা এক হোটেলের সামনে রিক্সা রাখতে বললো অরিত্র। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে প্রত্যয় কে নিয়ে ঢুকলো। নিজে মাছ দিয়ে সাদা ভাত খেল আর প্রত্যয়ের জন্য নিল খাসির বিরিয়ানি, কোক, ফালুদা, পুডিং। খুব আগ্রহ নিয়ে প্রত্যয়ের খাওয়া দেখতে লাগলো অরিত্র। ছেলেটা এমন খাবার কতদিন খায় নি কে জানে। মনে মনে কতো কিছু ভাবতে লাগলো অরিত্র।
দাদা আর পারবো না। এত খাওয়া যায় নাকি?
সে কি রে? খাওয়া তো সবে শুরু। বল আর কি কি খাবি?
না না দাদা আর না। সত্যি বলছি আর কিচ্ছুটি খেতে পারবো না।
আচ্ছা যা। আর খেতে হবে না। যা হাত ধুয়ে যায়। আরো কাজ আছে।
প্রত্যয় বুঝে গেছে তার এই দাদা কিছুটা পাগলা কিছিমের মানুষ। যা বলে তাই করে ছাড়ে। বড়খুড়ো যেখানে মায়ের সাথে কথা বলতে ভয় পায় সেখানে এই দাদা মাকে কেমন করে ধমকে দিল!
এরপর অরিত্র গেল শহরের নতুন শপিং মলটায়। এরপর একের পর এক জিনিস কিনতে লাগলো প্রত্যয়ের জন্য। তিনটা শার্ট, দুটা গেঞ্জি, বাটা’র স্যান্ডেল, কালো জুতা, সাদা কেডস, মোজা, স্কুলের ব্য্যাগ, পানিত বোতল, টিফিন বক্স, রিমোট কন্ট্রোল করা খেলনা গাড়ি, চকলেট আরো কতো কি! প্রত্যয়ের চোখ কপালে উঠে গেল এত কিছু দেখে। কাল যখন সুমিত আর রাজু দেখবে ওর নতুন সব জিনিস তখন কেমন মজা হবে? ওরা নিশ্চই হিংসে করবে। প্রত্যয় ঠিক করল রাজুকে ও কিছুতেই গাড়ি দিয়ে খেলতে দেবে না। রাজুর বাবা রাজুর জন্মদিনে একটা রেলগাড়ি কিনে দিয়েছিল। রাজু প্রত্যয়কে ধরতেও দেয় নি। এখন কেমন মজা হবে না?
দাদা আপনি আমার জন্য এত কিছু কিনলেন? ওরা বাড়ি ফিরছিল ভাড়া করা ট্যাক্সিতে চড়ে।
কিনলাম।
কতো টাকা লেগেছে এসব কিনতে?
তা দিয়ে তুই কি করবি রে? বলে হেসে প্রত্যয়ের মাথার চুল এলোমেলো করে দিল অরিত্র।
কিন্তু আপনাকে তো টাকা দিতে দেখলাম না।
বলিস কিরে? টাকা দেই নি? মিথ্যে অবাক হবার ভান করে অরিত্র।
হা দেন নি তো। প্রত্যয় অরিত্রর দিকে তাকায়। টাকা ছাড়া মানুষ এত কিছু কিভাবে কেনে এটা এখনও কিশোরটির কাছে পরিস্কার না।
অরিত্র ক্রেডিট কার্ড বের করে দেখালো। দেখ, এই কার্ড টাই আমার টাকা। আমি এটা দিয়ে দাম দিয়েছি।
বিস্ময়ের সীমা নেই প্রত্যয়ের। এর মধ্যে টাকা আছে? বলেই উলটে পালটে দেখতে লাগলো। কার্ড রহস্যের জট না খুলতেই হঠাৎ অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে বসলো, দাদা আপনি আর আমি দেখতে একি রকম কিছুটা তাই না?
অরিত্র অন্যমনষ্ক ছিল। প্রশ্ন শুনে মনে হল ওকে কেউ জোরে ধাক্কা দিয়েছে।
কি বললি?
আপনি আর আমি কি দেখতে এক রকম?
কে বললো তোকে? অরিত্র পালটা প্রশ্ন করে।
কেউ বলেনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তাই।
হতেই তো পারে। আমি তোর পিসতুতো ভাই না? অনেকটা যেন নিজেকেই প্রবোধ দেয়ার সুরে বলে অরিত্র।
প্রসঙ্গ পালটে বলে, তুই বিদেশ যাবি?
যাব। কিন্তু মা যে একা থাকবে।
কেন মা কে রেখে একা যেতে পারবি না?
দু পাশে মাথে নেড়ে না বোঝায় প্রত্যয়।
তুই না বড় হয়েছিস। এখনও তোর মা লাগবে?
মা কে ছাড়া তো কখনও একা থাকিনি দাদা।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। বিদেশ গেলে মা কে বাক্সের মধ্যে ভরে নিয়ে যাস।
এই কথা শুনে প্রত্যয় খিলখিল করে হেসে ওঠে। রাস্তায় কাবাবের দোকান থেকে অরিত্র বেশী করে কাবাব পরাটা কিনে নেয়। মায়া যদি কিছু খায়!
রাতে অরিত্র কিছুই খেল না। মায়ার সাথে তেমন কোন কথাও হল না। শুধু একবার ওকে বলল, এসবের কোন দরকার ছিল না। শুধু শুধু ওর অভ্যাস খারাপ করে দিয়ে গেলেন। পরে ওকে আমি এসব কোত্থেকে দেব? মায়ার কথায় কোন তিরস্কার ছিল না। তবুও অরিত্র’র ভেতরটা কেমন যেন দুমড়ে গেল মায়ার কথার সামনে। কিছুই বলতে পারলো না উত্তরে। সারারাত ছটফট করে কাটালো অরিত্র। ঘুমাতে পারলো না। লাইট জ্বেলে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলো-
মায়া,
তোমাকে লেখার কোন অধিকার আমার নেই জেনেও লিখছি। প্লিজ না পড়ে অবহেলা করে ছিঁড়ে ফেলে দিও না। তোমাদের সংসারের অবস্থা আমার জানা ছিল না যদিও জানা উচিত ছিল। আমি সব কিছুতেই অযোগ্য ছিলাম এখনও আছি। তাপস আমার আপন মামা হলেও আমরা ছিলাম একদম বন্ধুর মত। তাপস আমার চাইতে মাত্র দুই বছরের বড় ছিল। দাদু যখন তখন তাপসের সাথে তোমার বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেললো, তখনও আমি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলাম। আমার বাবাকে তুমি চিনতে। কোনভাবেই তখন আমাকে বিয়ে দেবার জন্য রাজী ছিলেন না। আমার ভালবাসার কথা বলতেও পারলাম না। তাপসের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে শুনে আমার মাথা ঠিক ছিল না। সেদিন দুপুরে তোমাদের বাসায় গিয়ে …… ও কথা মনে করে নিজের পাপের বোঝার ভাগীদার তোমাকে করতে চাই না। শুধু বলি যদি পারো আমার অক্ষমতা এবং অবহেলা ক্ষমা করে দিও যদিও আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
এই চিঠির সাথে প্রত্যয়ের জন্য একটা চেক লিখে দিয়ে গেলাম। তোমাকে কোন উপহার দেবার মত সাহস আমার আজও হয় নি মায়া। ছেলেটা যা খেতেঁ চায় কিনে দিও। যা চায় দিও। ওর জন্য আমি আবার চেক পাঠাবো। প্লিজ, তোমার ছেলের মাথার দিব্যি দিয়ে বলছি, চেকটা নষ্ট করো না মায়া। আমার প্রায়শ্চিত্ত এতে হবে না জানি, তবুও।
তোমাদের না জানিয়ে চোরের মতই বিদায় নিচ্ছি। আসলে তোমাদের সামনে আমার বলার আর কিছুই নেই যে। প্রত্যয় একটু বড় হোক। ওকে আমি আমেরিকায় নিয়ে যাব যদি তুমি অনুমতি দাও। ছেলে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না।
ইতি,
অরিত্র
পুনশ্চঃ ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল ও আর আমি দেখতে কেন একরকম। আমি এর কোন উত্তর দিতে পারিনি। তুমিও দিও না।
বিষয়: বিবিধ
৯০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন