সাগর-রুনির মেঘ : এক শেষ না হওয়া গল্প
লিখেছেন লিখেছেন Mujahid Billah ১১ মে, ২০১৭, ১২:১৯:৫৬ রাত
আজ আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাবো। এ এক হতভাগা রাজপুত্রের গল্প। রাজা আর রানী আদর করে যার নাম রেখেছিলো ‘মেঘ’। হয়তো ভেবেছিলো তপ্ত রোদে সে মাথার ওপর ছায়া হয়ে শীতল পরশ দেবে, ক্লান্তির অমানিশায় ছুঁয়ে যাবে পেঁজা তুলোর মত কিংবা বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দিয়ে যাবে সব বেদনা। কারণ মেঘ ছিলো তাদের ভালোবাসার ফসল, অনেক যত্নে গড়া রত্ন। আজ আমি সেই মেঘের গল্প শোনাবো তোমাদের। মেঘের গল্প, ছবির ভাষায় মেঘের কাব্য।
মেঘের জন্ম হলো আজ থেকে বছর দশএক আগে।
রূপকথার এক রাজ্যে। রাজা আর রানী তো ভীষণ খুশি। মেঘের জন্মে তাদের পরিবারে যেন আনন্দের বান ডাকলো। মেঘ জন্ম নিলো, আদরে আদরে বড় হয়ে উঠতে লাগলো রাজা-রানীর ভালোবাসার সমুদ্রে।
ছোট্ট মেঘ ভেবেছিলো সে আকাশ ছোঁবে, মেঘের জন্মই তো তার জন্য। তাই সে মাঝে মাঝেই রাজার কাঁধে চড়তো। কাঁধে চড়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতো।
মেঘের দুরন্তপনায় সমস্ত রাজ্য সারাদিন আনন্দের হুল্লোড়ে মেতে থাকতো। রাজা-রানী প্রতিদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে যোগ দিতো সেই আনন্দে।
তাই বলে কিন্তু মেঘ মোটেও বাজে সময় নষ্ট করতো না। রাজা যখন ঘরের বাইরে যেত তখনই সে এক ছুটে চলে যেত রাজার পড়ার ঘরে। কী জানি সে কী ভাবতো! হয়তো ভাবতো বড় হলে এই সব বই তার হবে। এক ঘর ভর্তি বইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে স্বপ্ন দেখতো তার বাবার মত বড় হবার, মায়ের মত বড় হবার।
তারপর যদি বা কখনো টের পেত যে তার বাবা ফিরে এসেছে কাজ শেষে, অমনি ছুট ছুট বাবার কোলে, শুরু হয়ে যেত রাজার সাথে তার যত আহ্লাদপনা।
মাঝে মাঝে বায়না ধরতো মেঘ ঘুরতে যাবে, সোমেশ্বরীর তীরে। রাজা কখনো নিষেধ করতো না। সময় পেলেই রাজপুত্রকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতো নদীর তীর থেকে।
আর কখনো যদিবা রাজা সময় না পেতো, ছোট্ট রাজপুত্র মেঘ ছুটে যেত রানীর কাছে। মায়ের আদরে আদরে সিক্ত হয়ে তখন তার কতইনা দুষ্টুমি!
সারা প্রাসাদ জুড়ে চলতো মেঘের ছুটোছুটি আর হুটোপুটি। ঘরময় দৌড়ে বেড়ানো, এমনকি পায়রাদের সাথে ছুটে ছুটে পাল্লা দেয়া কিছুতেই তার কোন কমতি ছিলো না।
সাথে ছিলো আরও একটা শখ। ছবি তুলতে সে খুব ভালোবাসতো। ছোট ছোট হাতের ছোট্ট মুঠোর ভিতর ক্যামেরাটা ধরে সে বাবা-মায়ের ছবি তুলতো। শুধু যে ছবি তুলতো তা-ই নয়, বাবা আর মাকে তার নির্দেশমত ছবির জন্য ঠিকঠাক দাঁড়াতেও হতো। তার ভয় ছিলো বাবা-মাকে যদি কোনভাবে পঁচা দেখায় ছবিতে! বাবা-মাকে যে সে খুব ভালোবাসে। তাদের ছবি পঁচা হলে মেঘের নিজের কষ্ট হবে না বুঝি?
মাঝে মাঝে ছোট্ট রাজপুত্র রাজার সাথে চোর-পুলিশ খেলতো। রাজা হতো চোর আর রাজপুত্র পুলিশ। তারপর যা হয়। পুলিশ ধরে ফেলে চোরকে আর চোরের তখন সে কী মন খারাপ! মেঘ ছিলো এমনই। সে বাজে লোকদের শাস্তি দিতে চাইতো, রাজা আর রানীকে সে এতোটাই ভালোবাসতো যে কখনো তাদের কেউ কিছু বললে সে তেড়ে আসতো। সে চাইতো তার বাবা-মাকে রক্ষা করতে। কিন্তু শেষ অবধি বাবা-মাকে রক্ষা করতে সে পেরেছিলো কি?
সারাদিন ছুটোছুটি করে, ছবি তুলে আর চোর-পুলিশ খেলে যখন ছোট্ট মেঘ ভীষণ ক্লান্ত, তখন শুরু হতো টেবিলে বসে তার আঁকিবুঁকি খেলা। একবার রাজার জন্মদিনে সে একটি উপহার দিয়েছিলো। সেটি ছিলো নিজের হাতে আঁকা তার বাবার ছবি! ছবি দেখে রাজা তো মহাখুশি। কিন্তু রাজপুত্র যেই দেখলো রানীকে কিছুই দেয়া হয় নি বলে সে মন খারাপ করে বসে আছে, তখন সে তাকে কথা দিলো যে রানীর জন্মদিনেও তাকে অমনি একটি আঁকা ছবি সে উপহার দেবে। কেউ তখনো জানতো না, রানীর সেই জন্মদিন আর কখনো আসবে না!
মেঘের একটা প্রিয় খেলা ছিলো। অনেক অনেক দূরের মাঠে সে প্রায়ই ঘুরতে যেত রাজা-রানীর হাত ধরে। তারপর বাবা-মাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে সে প্রায় দিগন্তের কাছাকাছি চলে যেত। রাজা-রানী যখন চিন্তায় চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠতো ঠিক তখনই এক নিমেষে মেঘ ছুটে চলে আসতো তাদের কাছে। এমনি একদিন সে ছুটতে শুরু করলো সেই দিগন্তের কাছ থেকে। ছুটতেই লাগলো, ছুটতেই লাগলো। কিন্তু সেই মাঠের কোন শেষ সে দেখতে পেলো না। যতই দৌড়ে মেঘ সামনে এগিয়ে যায়, রাজা-রানীর ছবিটা যেন ততই ঝাপসা হয়ে আসে, আরও দূরে মিলিয়ে যায়। ছোট্ট মেঘ তবু দৌড়োতে থাকে, ছুটে যেতে থাকে বাবা-মাকে স্পর্শ করার আশায়।
তারপর রাজা আর রানী একদিন হারিয়ে যায় চিরতরে। রাজ্য পুরো শোকে স্তব্ধ। রাজপুত্র তখনও দৌড়ে চলেছে, তার কাছে সবসময়ের হিরো যে সেই স্পাইডারম্যানকে ডেকে চলেছে যাতে স্পাইডারম্যান এসে তার বাবা-মাকে ফিরিয়ে দেয় তার কাছে। স্পাইডারম্যান আসে নি। রানীর জন্মদিনে মেঘের আর নিজের হাতে আঁকা মায়ের ছবি উপহার দেয়া হয় নি, কখনো হবে না। ছোট্ট মেঘ তবু বুঝতে পারে না। সে এখনও বিশ্বাস করে বসে থাকে তার বাবা-মা একদিন ফিরে আসবে। পুরনো ছবির অ্যালবাম জড়িয়ে সে বাবা-মাকে খুঁজে ফিরে, কবে যে তারা ফিরে আসবে, ছোট্ট মেঘ আবার তাদের একসাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলবে! বাবা-মা ফিরলে সে আবার পুলিশ হবে, যারা যারা তার বাবা-মাকে মেরেছে তাদের খুব করে শাস্তি দেবে, দেবেই দেবে।
গল্পের শেষে মেঘের জন্য আমার মনটা কেঁদে যায়। আমি মনে মনে মেঘকে বলে চলি, ‘মেঘ তুমি ছায়া হও, পেঁজা তুলো হও কিন্তু বৃষ্টির মত নিজেই ঝরে যেও না। কারো উপর অভিমান করে কালো মেঘের মত মুখ ভারি করে থেকো না। তোমার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার কবে হবে, আদৌ হবে কিনা তাও জানি না কিন্তু তবু তুমি ছায়া হও, পেঁজা তুলো হও। একা একা দূরে উড়ে চলে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে যেও না।’
বিষয়: বিবিধ
৮৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন