ক্বওমান তাজহালুন, তরিকায়ে জাহান্নাম এবং আল্লামা ইবলিস ।

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ_২ ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৮:০৫:৫৯ সকাল

‘জাহেল’ এবং এ থেকে জাত শব্দসমূহ পবিত্র কুরআনে এসেছে মোট ২৪ বার। অজ্ঞ, মূর্খ অর্থে ব্যবহৃত শব্দটি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে সবারই প্রায় জানা। আরবী এই শব্দটি হিন্দি-উর্দু বলয়েও ব্যাপক ব্যবহৃত।

কুরআন থেকে জেনে নিতে চেষ্টা করি কতরূপে ‘জাহেল’ শব্দটি এসেছে- জাহিলিন (২.৬৭; ৬.৩৫; ৭.১৯৯; ১১.৪৬; ১২.৩৩; ২৮.৫৫); জাহিল (২.২৭৩); জাহিলিয়্যা (৩.১৫৪; ৫.৫০; ৩৩.৩৩; ৪৮.২৬); জাহালাহ (৪.১৭; ৬.৫৪; ১৬.১১৯; ৪৯.৬); ইয়াজহালুন (৬.১১১); ক্বওমুন/ক্বওমান তাজহালুন (৭.১৩৮; ২৭.৫৫; ১১.২৯; ৪৬.২৩); জাহিলুন/আয়্যুহাল জাহিলুন (১২.৮৯; ২৫.৬৩; ৩৯.৬৪); জাহুলা (৩৩.৭২)।

হযরত ইয়াকুবের (তাঁর প্রতি শান্তি) প্রিয়পুত্র হযরত ইউসুফ (তাঁর প্রতি শান্তি) নিজের ব্যাপারে ‘জাহালাতের’ আশংকা করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। যে সমস্ত নারীরা তাঁর সৌন্দর্যে মু্গ্ধ হয়ে সম্ভ্রান্ত ফেরেশতা (মালাকুন কারীম-১২.৩১) মনে করে নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল তাদের এবং জুলেখার উদ্দেশ্যে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন: “আমার প্রভু! তারা আমাকে যার প্রতি আহ্বান করছে তার চেয়ে কারাগারই আমার কাছে অধিক প্রিয়। আর তুমি যদি আমার থেকে তাদের ছলনা দূরীভূত না কর তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব, ফলে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব (আকুম্ মিনাল জাহিলিন)”।-১২.৩৩

আল্লাহ তা’য়ালা স্বয়ং দুটি জায়গায় কুরআনে হযরত নূহ (তাঁর প্রতি শান্তি) এবং খাতামুন্নাবিয়্যিন হযরত মুহম্মদ (তাঁর প্রতি শান্তি)-এর প্রতি অজ্ঞতা বা নির্বুদ্ধিতার সম্ভাব্যতার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

নিজ সন্তানকে নৌকায় উঠতে বলার পরও যখন সে তা প্রত্যাখ্যান করল, তখন নূহ নবী কাকুতি প্রকাশ করে স্বীয় প্রভুর কাছে বলেছিলেন - হে পরওয়ারদেগার, আমার পুত্র তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত (রব্বি ইন্নাবনি মিনাল আহলি..)। তখন আল্লাহ জবাব দিলেন -''হে নূহ! নিঃসন্দেহে সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিঃসন্দেহে তার কাজকর্ম সৎকর্মের বর্হিভূত, কাজেই আমার কাছে সওয়াল কর না যে-সন্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নেই। আমি অবশ্যই তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি-পাছে তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড় (ইন্নি আইজুকা আন তাকুনা মিনাল জাহিলিন)।’’- ১১.৪৬

আল্লাহর এই একান্ত বাধ্য, অনুগত নবী তাতক্ষণিকভাবেই নিজেকে সংশোধন করে নেনঃ “হে আমার পালনকর্তা আমার যা জানা নেই এমন কোন দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব”।-১১.৪৭

গোত্রবাদী, বর্ণবাদী কুরাইশ কাফেররা দিব্যচোখে আল্লাহর মহান কালাম না দেখে তার শেষ নবীর কাছে ম্যাজিক (প্রচলিত মোজেযা/কুরআনে আয়াহ হিসেবে উল্লিখিত) দেখতে চাইত; তাদের ফরমায়েশের প্রেক্ষিতে রাসূলও চাইতেন যদি কোন উপায়ে তারা ঈমান গ্রহণ করে অথচ তা মহান, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর অভিপ্রেত ছিলনা। তাই এ ব্যাপারে তাঁর শক্ত অবস্হান নবীকে জানিয়ে দেনঃ “আর যদি তাদের ফিরে যাওয়া তোমার কাছে কষ্টকর হয়, তবে যদি সমর্থ হও তো ভূগর্ভে সুড়ঙ্গপথ খোঁজো অথবা আকাশে উঠবার একটি মই, এবং তাদের কাছে নিয়ে এস কোনো নিদর্শন! আর যদি আল্লাহ্ ইচ্ছা করতেন তবে তিনি তাদের সকলকে অবশ্য সৎপথে সমবেত করতেন, কাজেই তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না (ফালা তাকুনান্না মিনাল জাহিলিন)।-৬.৩৫

ক্বওমান তাজহালুন

‘ক্বওমান তাজহালুন’ অর্থাৎ জাহেল বা নির্বোধ সম্প্রদায়-এর কথা হযরত মূসা (তাঁর প্রতি শান্তি), হযরত লূত (তাঁর প্রতি শান্তি), হযরত হুদ (তাঁর প্রতি শান্তি) এবং হযরত নূহ (তাঁর প্রতি শান্তি) তাঁদের দাম্ভিক সম্প্রদায়কে বলেছিলেন যারা আল্লাহর বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল।

জাহেল যেমন আমরা বুঝি, তেমনি আ্ইয়ামে জাহিলিয়্যাও বুঝি। যে সময়ের মানুষগুলোকে জাহিলিয়্যা যুগের বলে আমরা নিন্দা করি তারা কিতাবের জ্ঞানের অধিকারী ছিলনা। কিন্তু স্কন্ধে কিতাব বহন করে কেউ যদি বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাসকে খোলাখুলি বিপণন করে যে, কুরআন সুর করে তিলাওয়াতেই বহুত সওয়াব আর কুরআন বুঝে পড়তে নিবৃত্ত করে এই বলে যে তাতে করে গোমরাহ হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে –তবে তাদেরকে কী বলা যাবে? ‘জামাতে তাবলীগের’ নিবেদিতপ্রাণ অনেক কর্মীর সাথে কথা বলে এই ধারণাই পাওয়া যায়।

যে লোকগুলো জীবনের বহু ‘তিনদিন’ পার করল মসজিদে মসজিদে পিকনিক করে, চিল্লা দিয়ে দেশ-দেশান্তর ঘুরল, জীবনচিল্লার মত চূড়ান্ত কসরত করল, তাদেরই তৌফিক হলনা কুরআনের একটা আয়াতকে তার দাবী অনুযায়ী তিলাওয়াত করার, তার মতলব-মর্ম অনুধাবনের। সেই দায়িত্ব তারা দিয়ে রাখল তাদের কথিত ‘মুরব্বী’দের হাতে। যারা দ্বীনকে একেবারেই খেলো বিষয় এবং সস্তা সমাবেশে রূপান্তরিত করেছে। আর সস্তার বাজারে খদ্দের সমাবেশ সবকালেই বেশি।

‘জামাতে তাবলীগের’ নামে ধর্মের এই যে বাজার কায়েম করা হয়েছে সেখানে কৌশলে সাধারণ মুসলমানদের কুরআন-বিমুখ করে রাখা হয়। জোর করে তারা নির্বোধ থাকতে চায়, এবং সারাজীবন তাদের এই নির্বুদ্ধিতা লালন করে থাকে। মসজিদে বসে কুরআন সরিয়ে গীতা-বাইবেল পাঠ করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, কিন্তু কেউ যদি একইভাবে ‘ফাজায়েলে আমল’ বা তাবলীগি কুতুবখানা প্রকাশিত অন্য কোন কিতাব দলবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে তা সম্পূর্ণ সিদ্ধ। অথচ সবাই মিলে মসজিদে কুরআন পড়া একদম হারাম(?)। মসজিদের ‘ইমাম’ পদবীর যে চাকুরীজীবী তাকেও এই কুরআন-চর্চার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিতে দেখা যাবে। এটাই ‘জামাতে তাবলীগের’ দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের নতিজা। যদি জানতে চাওয়া হয়, এই সুগভীর ষড়যন্ত্রের হোতা কে, চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় -প্রফেসর আল্লামা ইবলিসে আযম এবং তার দোসররা।

মনগড়া, আজগুবী এবং দলিলবিহীন কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে তারা মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্তির জালে আবদ্ধ করছে। “কতদিন সময় লাগানোর পর আপনারা কুরআন-চর্চা শুরু করবেন”- এ জাতীয় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে কোন তাবলিগার থেকেই আমি কোন উত্তর পাইনি। দেশে দেশে ইসলামের নামে নির্বুদ্ধিতার এইযে মহোৎসব, এইসব মহাসম্মেলন অতিসত্বর বন্ধ হোক!

তরিকায়ে জাহান্নাম

“আল্লাহ তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন তিনি তা সজ্ঞানেই করেছেন, সে ব্যাপারে আল্লাহ নিজেও সাক্ষী এবং ফেরেশতাগণও সাক্ষী। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। যারা (সেই নাযিলকৃত বাণী) প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সত্য চাপা দিয়ে রেখেছে, আল্লাহ কখনও তাদের ক্ষমা করবেন না এবং সরল পথ দেখাবেন না -জাহান্নামের পথ ব্যতীত(ইল্লা তরিকায়ে জাহান্নাম)। সেখানে তারা বাস করবে অনন্তকাল। আর এমন করাটা আল্লাহর পক্ষে সহজ”।-৪.১৬৭-১৬৯

মানুষের মত জ্বীন সম্প্রদায়ও বিভিন্ন তরীকায় বিভক্ত (তরায়িকা ক্বিদাদা-৭২.১১); কিন্তু তাদের মধ্যকার যারা জ্ঞানবান তারাও স্বীকার করে এই কুরআনই একমাত্র সঠিক পথের (তরীকিম্ মুস্তাকীম) দিশা দেয়ঃ “তারা বলল, হে আমাদের সম্প্রদায়, আমরা এমন এক কিতাব শুনেছি, যা মূসার পর অবর্তীণ হয়েছে। এ কিতাব পূর্ববর্তী সব কিতাবের প্রত্যায়ন করে, সত্যধর্ম ও সরলপথের দিকে পরিচালিত করে”-৪৬.৩০। ইসলামের আপাত পোশাক পরিয়ে আমরা যত ‘তরিকা’র উদ্ভব ঘটিয়েছি সবইতো তরিকায়ে জাহান্নাম- জাহান্নামে যাওয়ার সহজতম পথ।

দ্বীন অবিভাজ্য। দ্বীনকে খন্ডিত করলে তা আর দ্বীন থাকে না, আল্লাহর কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়না। “তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, অথচ তারা তোমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়, বরং তারা হচ্ছে ফারাককারী সম্প্রদায়-৯.৫৬ (ক্বওমুই ইয়াফরকুন-দ্বীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী)”। খেদ ব্যক্ত হয়েছে: “আর যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা বিভক্ত হয় নি যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছিল।-৯৮.৪

‘ফারাক করা’ আমরা কে না বুঝি? ‘ফারাক’ কুরআনে বহু ব্যবহৃত একটি শব্দই শুধু নয়, অতিগুরুত্বের সাথে দ্বীনকে খন্ডিত না করার জন্য ব্যাবহৃত। সেই গুরুভার বাণীগুলো কি আমরা পড়েছি? কোন তাগিদ কি আমাদের আছে সূরা আল-ইমরান (৩.১০৩), সূরা আনআম (৬.১৫৯), সূরা রূম (৩০.৩২), সূরা শূরা (৪২.১৩), সূরা মূমিনুন (২৩.৫৩)- এর এই আয়াতসমূহে কোন বিষয়ের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে?

‘কতায়া’ (কেটে ফেলা অর্থে) শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন- ফাতাকত্তায়ু আমরহুম যুবুরা, কুল্লু হিযবিম বিমা লাদাইহিম ফারিহুন (কিন্ত তারা নিজেদের মধ্যে তাদের অনুশাসন টুকরো-টুকরো ক’রে কেটে ফেলল। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তষ্ট)।অতপর বলা হয়েছে, ‘আন আক্বিমুদ্দিনা ওয়ালা তাতাফার্রাকু ফিহি’ (দ্বীনে কায়েম থাক, আর তাতে ফারাক করো না)। সেই অখন্ড দ্বীন পালন করতে গিয়ে যদি আল্লাহর দ্বিতীয় কোন বান্দা আশেপাশে না পাওয়া যায়, তবুও দ্বীনের খাতিরে একা হতে হবে। জাহেল বা মূর্খদের মজমায় শামিল হওয়া যাবে না।

যারা দ্বীনে ফারাক সৃষ্টি করে তাদের চরিত্র চিত্রন করা হয়েছে ব্যাপক ভাবেঃ হে মুসলমানগণ, তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিল, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিল।-২.৭৫ (আরও-২.৮৫, ২.৮৭, ২.১০০-১০১, ২.৪৬, ৩.২৩, ৩.৭৮, ৪.৭৭, ৪.১৫০-১৫১, ৫.৭০, ৬.৮১, ৭.৩০, ৯.১০৭, ১৬.৫৪, ২৪.৪৭-৪৮, ২৭.৪৫, ৩০.৩৩, ৩৩.১৩, ৪২.১৪)

ঈমান আনয়নে নবীগণের মধ্যেও ফারাক বা পার্থক্য রচনা থেকে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে (লা নুফার্রিক বাইনা আহাদিম মিনহুম-২.১৩৬, ২.২৮৫, ৩.৮৪)। যারা ফারাক করেনি তাদের প্রশংসা করা হয়েছে: “আর যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর রসূলের উপর এবং তাঁদের কারও প্রতি ঈমান আনতে গিয়ে কাউকে বাদ দেয়নি, শীঘ্রই তাদেরকে প্রাপ্য সওয়াব দান করা হবে। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু”।-৩.১৫২

দ্বীনে ফারাক সৃষ্টিকারী এই ফেরকাবাজ, মুনাফিকদের সহজে চিহ্নিত করার জন্যই যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা সত্য-মিথ্যার ফারাক নির্ণয়কারী ‘ফুরকান’ দান করেছেন। “আর (স্মরণ কর) যখন আমি মূসাকে কিতাব এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী নির্দেশ (ফুরকান) দান করেছি, যাতে তোমরা সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার”-২.৫৩; ২১.৪৮। সর্বশেষ নাযিলকৃত আল-কুরআন হচ্ছে সেই আল্টিমেট ফুরকান (২.১৮৫, ৩.৪, ৮.২৯, ২৫.১)।

ঈমানদারকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, দ্বীনে ফারাক সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করলে তারা তাদেরকে কাফিরে পরিণত করে ফেলবে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবদের কোন ফেরকার কথা মান, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদিগকে কাফেরে পরিণত করে দেবে”।-৩.১০০

দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে নবীকে উদ্দেশ্য করে কঠিনতম সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে: “নিঃসন্দেহে যারা তাদের ধর্মকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দল হয়ে গেছে, তাদের জন্য তোমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিঃসন্দেহে তাদের ব্যাপার আল্লাহ্র কাছে, তিনিই এরপরে তাদের জানাবেন যা তারা করত”-৬.১৫৯। এর বিপরীতে কঠোর নির্দেশ দেয়া হচ্ছে: “আর তোমরা সকলে (জামিয়া’) আল্লাহর রজ্জুকে (কুরআন) সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (ওয়ালা তাফার্রকু)”।-৩.১০৩

একটু বাদেই তাম্বিহ ঘোষিত হয়েছে: আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শন সমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে (ওয়ালা তাকুনু কাল্লাজিনা তাফার্রকু ওয়াখতালাফু মিম বা’দি মাযা আহুমুল বায়্যিনাহ্)-তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর আযাব।-৩.১০৫

সুনির্দিষ্টভাবে আল-কুরআনকে (হাজা) সরল পথ উল্লেখ করে আল্লাহ ঘোষণা করেন: “তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব তোমরা ইহারই অনুসরণ করবে (ফাত্তাবিয়ুহু) এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও।-৬.১৫৩

এক আয়াত পরেই সেই ‘ফাত্তাবিয়ুহু’ যোগে আবারও বলা হয়: এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, এর অনুসরণ কর (ফাত্তাবিয়ুহু) এবং ভয় কর-যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।-৬.১৫৫

আল্লাহর শেষনবীকেও এত্তেবা করার কথা বলা হয়েছে (৭.১৫৮); বহু জায়গায় আতিউল্লা, ওয়া আতিউর্ রাসূলও এসেছে। কুরআন বর্জনকারী ধূর্ত এবং নির্বোধ লোকেরা ঠিক এই জায়গাটিতে রাসূলের নামে চালু হওয়া শতশত মিথ্যা কথাগুলোকে (হাদীস) ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আম-মুসলমানকে বিভ্রান্ত করে।

আল্লাহ পাক নবী এবং মু’মিনদের সান্তনা দান করেনঃ “অথবা তুমি কি মনে কর যে তাদের অধিকাংশই শোনে অথবা বোঝে? তারা তো গরু-ছাগলের মতো (কাল আনআম) ছাড়া আর কিছু নয়, বরং তারা পথ থেকে অধিক পথভ্রষ্ট”।-২৫.৪৪

দ্বীনের দাওয়াহ

আর কে তার চাইতে কথাবার্তায় বেশী ভাল যে আল্লাহ্র প্রতি আহ্বান করে (ওয়ামান আহসানু ক্বওলাম মিম্মান দায়া ইলাল্লহ..) এবং সৎকর্ম করে আর বলে- ''আমি তো নিশ্চয়ই মুসলিমদের মধ্যেকার একজন’’-৪১.৩৩

সেই আহবান কিভাবে করতে হবে তা সূরা নাহলে বলা হয়েছে: “তোমার প্রভুর রাস্তায় আহ্বান করো জ্ঞান ও সুষ্ঠু উপদেশের দ্বারা (উদয়ু ইলা সাবিলি রব্বিকা বিল হিক্বমাতি ওয়াল মাওয়িজাতিল হাসানাহ…), আর তাদের সাথে পর্যালোচনা কর এমনভাবে যা শ্রেষ্ঠ। নিঃসন্দেহ তোমার প্রভু স্বয়ং ভাল জানেন তাকে যে তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে, আর তিনি ভাল জানেন সৎপথাবলন্বীদের।-১৬.১২৫

কুরআনেরই আর এক নাম হিকমাহ (হিকমাতুম বালিগাহ-৫৪.৫); কুরআন ব্যতীত উত্তম ওয়াজ বা মাওয়িজাতিল হাসানাহ আর কী হতে পারে (২.২৩১, ২.২৭৫, ৩.১৩৮, ১০.৫৭, ৫.৪৬)?

ওরা যা বলে আমরা তা ভাল জানি, আর তুমি তাদের উপরে জবরদস্তি করার লোক নও। অতএব তুমি কুরআন দিয়ে স্মরণ করিয়ে চলো তাকে যে আমার প্রতিশ্রুতিকে ভয় করে।-৫০.৪৫

“হে গ্রন্থধারিগণ! কেন তোমরা সত্যকে মিথ্যার পোশাক পরিয়ে দিচ্ছ, আর তোমরা জেনেশুনে সত্যকে লুকোচ্ছ”-৩.৭১। “নিঃসন্দেহ যারা গোপন করে রাখে পরিস্কার প্রমাণাবলী ও পথনির্দেশের যে-সব আমরা অবতারণ করেছিলাম এগুলো জণগণের জন্য ধর্মগন্থে সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করার পরেও, তারাই! যাদের আল্লাহ্ লানৎ দেন, আর তাদের বঞ্চিত করে লানৎকারীরা”।–২.১৫৯

অবশ্যই যারা ধর্মগ্রন্থের মধ্যে থেকে আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা লুকিয়ে রাখে আর এর দ্বারা তুচ্ছ বস্তু কিনে নেয়,- এরাই তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছু গেলে না, আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তাদের সাথে কথাবার্তা বলবেন না, বা তাদের শুদ্ধও করবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে ব্যথাদায়ক শাস্তি। এরাই তারা যারা কিনে নেয় হেদায়তের বিনিময়ে ভ্রান্তপথ ও পরিত্রাণের পরিবর্তে শাস্তি। কাজেই কতো তাদের ধৈর্য আগুনের প্রতি!-২.১৭৪-১৭৫

খাতামুন্নাবিয়্যিনের ওফাতের পর থেকে কুরাইশ রাজতন্ত্রী থেকে শুরু করে এই সেদিন পর্যন্ত সুচতুর, ধুরন্ধর মুনাফিকেরা (লেবাসী মুসলিম) হরেক রকম ব্রান্ডের ইসলাম (কুরাইশী ইসলাম, আল-হামরা ইসলাম, অটোম্যান ইসলাম, মোঘলাই ইসলাম, ইত্যাদি) ভেল্কিবাজী দেখিয়ে আল্লাহর লানতে ধ্বংস হয়েছে– যদিও তার প্রেতাত্মারা এখনও সুযোগ পেলেই ফোঁস ফোঁস করে। সেই কায়েমী গোষ্ঠীর হাত থেকে ‘পোশাকী ইসলাম’ গত পৌনে এক শতাব্দীকাল ধরে নির্বোধদের কবলে এসে পড়েছে।

আফালা ইয়া তাদাব্বারুনাল কুরআন? “কি! তারা কি তবে কুরআন সন্বন্ধে ভাববে না? বস্তুত তা যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে হতো তবে তাতে নিশ্চয়ই তারা পেতো প্রচুর গরমিল”।-৪.৮২

“এরাই তারা যাদের প্রতি আল্লাহ্ ধিক্কার দিয়েছেন, ফলে তিনি তাদের বধির বানিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন। কি! তারা কি তবে কুরআন সন্বন্ধে ভাববে না, না কি হৃদয়ের উপরে সেগুলোর তালা দেয়া রয়েছে? নিঃসন্দেহ যারা তাদের পিঠ ফিরিয়ে ঘুরে যায় তাদের কাছে সৎপথ সুস্পষ্ট হবার পরেও, শয়তান তাদের জন্য হাল্কা করে দিয়েছে এবং তাদের জন্য সুদীর্ঘ করেছে। এইটাই! কেননা আল্লাহ্ যা অবতারণ করেছেন তাতে যারা ঘৃণা করে তাদের কাছে তারা বলে, ''আমরা তোমাদের মেনে চলব কোনো-কোনো ব্যাপারে।’’ আর আল্লাহ্ জানেন তাদের গোপনীয়তা। কিন্ত কেমন হবে যখন ফিরিশ্তারা তাদের মুখে ও তাদের পিঠে আঘাত হানতে হানতে তাদের মৃত্যু ঘটাবে? এইটিই! কেননা আল্লাহ্কে যা অসন্তষ্ট করে তারা তারই অনুসরণ করে আর তাঁর সন্তষ্টিলাভকে তারা অপছন্দ করে, সেজন্য তিনি তাদের ক্রিয়াকলাপ ব্যর্থ করে দেন। অথবা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা কি ভাবে যে আল্লাহ্ কদাপি তাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করবেন না?”-৪৭.২৩-২৯

আল্লামা ইবলিস

মানবজাতির আদি, চীরকালীন ও চূড়ান্ত দুষমন শয়তান সবদিক বিবেচনায়ই মানুষের চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ। আল্লাহর বানী হাতের নাগালে থাকার পরও যে মানুষ সেই কিতাব পড়েনা, কুরআন বুঝে পড়তে অন্যদেরকে নিরুৎসাহিত করে বিভ্রান্ত ও হালাক হয়ে যাবার ভয় দেখিয়ে – নিশ্চয়ই এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে শয়তানকে অনেক কুশলী হতে হয়। জ্ঞানের যে স্তরের জন্য আমরা কাউকে ‘আল্লামা’ তকমায় অবিহিত করে থাকি, শয়তান অবশ্যই তারচে অনেক বেশি জ্ঞান রাখে।

যারা আল্লাহর প্রদত্ত কিতাবের অনুসরণ করেনা সূরা জুমুয়ায় বলা হয়েছেঃ “তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে গাধার মতো (কাল হিমার), যে গ্রন্থরাজির বোঝা বইছে। কত নিকৃষ্ট সে-জাতির দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহ্র নির্দেশাবলী প্রত্যাখ্যান করে। নিকৃষ্ট। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না”।

ডেভিলকে তার প্রাপ্য ‘ডিউ’ দিয়ে দিতে হয়। যে শয়তান তার মেধা-মনন দিয়ে কুরআন-ধারীদেরক গাধা বানিয়ে রেখেছে, সে বর্তমান দুনিয়ার বড় আল্লামা। আমাদের জাহিলিয়াতকে প্রকটিত করে বুঝতে ও বুঝাতে হলেও শয়তানকে তার ক্যাপাসিটি বা যোগ্যতায় আমাদের অনুধাবনে আনতে হবে। ‘আল্লামা’সহ আরও যত বাজারী লকব চালু আছে, তা করা হয়েছে পারস্পরিক হীন স্বার্থ উদ্ধারে, তা স্রেফ মতলবী। আর কাজটি স্বয়ং শয়তান ‘হিযবুশ্ শয়তানদের’ প্ররোচনা দিয়ে করিয়ে নেয়। সময় এসেছে শয়তানের শয়তানীকে তারই কাছে প্রত্যার্পনের। শয়তানকে তার এই প্রাপ্য স্বীকৃতটুকু দিলে আমাদের দায়-দায়িত্বগুলো অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়।

বাড়া ভাতে যেমন ছাই পড়ে, শ্রম যেভাবে পন্ড হয় তেমন আমলও বিনষ্ট হয়। জানবাজ তাবলিগ কর্মীদের মত আমরা যারা বস্তা বস্তা আমলের পিছনে ছুটে চলছি, কুরআনের সেই সুনির্দিষ্ট আয়াতগুলো খুঁজে বের করে বিশ্লেষণ সহকার পড়তে হবে, বুঝতে হবে, অন্য মু’মিন ভাইকে তার দাওয়াত দিতে হবে কী কী কারণে আমল বিফলে যায় – যেভাবে নাকি প্রচন্ড ঝড়ো বায়ু স্তুপীকৃত ধুলিকনাকে মুছে ফেলে। “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা পছন্দ করে না। অতএব, আল্লাহ তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন (ফাআহবাতা আ’মালাহুম)”।-৪৭.৯

“আগে ঈমান, পরে কুরআন”

তাবলীগ জামাতের তালিমগুলোতো ‘স্লো পয়জন’-এর মত এই বিষাক্ত কথাটি সংক্রামিত করে দেয়া হয় যে, ‘আগে ঈমান, পরে কুরআন’। একথা বলে সুকৌশলে কুরআনুল কারীমকে অন্ধ প্রকোষ্ঠে ছুড়ে ফেলা হয়। কুরআনকে সংঘবদ্ধভাবে পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে গত পৌনে এক শতাব্দীর অধিক কাল ধরে। একথার ভিত্তি কী? জবাব: জানিনা, মুরব্বী জানেন। মুরব্বীকে ধরা হয়, এটি কার কথা, ‘কোন এক সাহাবী বলেছেন’, নাম কী তার। ‘এই মূহুর্তে মনে নেই’। দ্বিতীয়তঃ এই যে ‘পরে কুরআন’, সেই পরেটা কবে, কত জনম চিল্লা দেবার পরে। কোন জবাব নেই।

ইতিহাসের পাতা থেকে জনৈক জুনদুব ইবন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী’র এ জাতীয় একটি উদ্ধৃতি পাওয়া যায়- “আমরা ঈমান আনলাম এবং তারপর কুরআন শিখলাম এবং তা আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করল”। এটি আল্লাহর সেই বান্দার ব্যক্তিগত ভাষ্য – তবে তা অসাধারণ, সুন্দর উক্তি। কুরআনে মু’মিন বান্দার যে বৈশিষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে সামঞ্জস্যশীল। “আর যারা জ্ঞানে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত তারা বলে- ''আমরা এতে বিশ্বাস করি, এ-সবই আমাদের প্রভুর কাছ থেকে।’’ আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না”-৩.৭। অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। ৯.১২৪

বলুনঃ তোমরা কোরআনকে মান্য কর অথবা অমান্য কর; যারা এর পূর্ব থেকে এলেম প্রাপ্ত হয়েছে, যখন তাদের কাছে এর তেলাওয়াত করা হয়, তখন তারা নতমস্তকে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং বলেঃ আমাদের পালনকর্তা পবিত্র, মহান। নিঃসন্দেহে আমাদের পালকর্তার ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা ক্রন্দন করতে করতে নতমস্তকে ভুমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি পায়।-১৭.১০৭-১০৯

“আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যেই তার এই সংখ্যা করেছি-যাতে কিতাবীরা দৃঢ়বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীরা ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে এবং যাতে যাদের অন্তরে রোগ আছে, তারা এবং কাফেররা বলে যে, আল্লাহ এর দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছেন”।-৭৪.৩১

অথচ ঈমানের সর্বোত্তম শর্ত আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন এই বলে যে, “যাদের আমরা গ্রন্থ দিয়েছি তারা উহার তিলাওতের ন্যায্যতা মোতাবেক উহা অধ্যয়ন করে (হাক্কা তিলাওয়াহ), তারাই এতে ঈমান এনেছে। আর যারা তা প্রত্যাখ্যান করে তারাই হয় ক্ষতিগ্রস্ত”।-২.১২১

“তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া আল্লাহর গ্রন্থের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছুই নেই। অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।“-২.৭৮-৭৯

আহমদ দীদাত তাঁর গ্রন্থ ‘দি চয়েস’-এ উল্লেখ করেছেন, কীভাবে খ্রীস্টান বিশ্বে প্রতিবছর বাইবেলকে পরিবর্তন, পরিমার্জন সাপেক্ষে লক্ষ লক্ষ কপি নতুন সংস্করণ প্রকাশ ও বিক্রির চক্রান্তের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। একই চক্রান্তে জামাতে তাবলীগ একধাপ এগিয়ে এবং এ পর্যন্ত সার্থক। কুরআনের পরিবর্তন সম্ভব নয়, আল্লাহ তায়ালা নিজে সেই দায়িত্ব নিয়ে (১৫.৯) আমাদেরকে অথর্ব বানিয়ে রেখেছেন। অতএব ভিন্ন পন্থা অবলম্বন। কী সেটা, কুরআনকে প্রতিস্থাপিত কর। কী দিয়ে, এর মত কিছু একটা দিয়ে। লক্ষ লক্ষ মসজিদকে প্রতিবছর তাবলিগী কুতুবখানার লক্ষ লক্ষ ‘কিতাব’ কেনান হয় আর বলা হয়: এতে কুরআনেরই কথা লেখা আছে। ঝকঝকে ‘ফাজায়েলে আমলে’র পাশেই পড়ে থাকে ময়লায় আকীর্ণ কুরআন- অবহেলিত, পরিত্যক্ত। সহজ যুক্তিটা আমাদের মাথায় আসেনা, এতে যদি কুরআনের কথাই লেখা আছে তবে খোদ কুরআনটাকেই কেন আমরা গ্রহণ করছি না?

না, এতে কুরআন নেই, শুধুমাত্র কিছু আয়াতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেই সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে তাকে করা হয়েছে এক শয়তানী কাব্য। আর যখন সত্যের সাথে মিথ্যা মেলান হয় এবং সত্যকে লুকান হয় তখন তা আর সত্য থাকে না তা হয়ে যায় আল্লাহর লা’নতের যোগ্য (২.১৫৯, ৩.৮৭, ৯.৬৮, ১১.১৮)। দাওয়াতে তাবলিগের দোহাই দিয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নামে এমন অনেক কথা, আক্বীদা-বিশ্বাস চালু করা হয়েছে যা তাঁরা বলেন নাই। “আর কে তার চাইতে বেশী জালিম যে আল্লাহ্-সন্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে? নিঃসন্দেহ অন্যায়কারীরা সফলকাম হবে না।”-৬.২১; ৭.৩৭; ১০.১৭

“সুতরাং কে বেশি অন্যায়কারী তার চাইতে যে আল্লাহ্র বিরুদ্ধে মিথ্যা রচনা করে, যেন সে লোককে বিভ্রান্ত করতে পারে জ্ঞানহীনভাবে?”-৬.১৪৪। “অতঃপর সে ব্যক্তির চাইতে অধিক অনাচারী কে যে আল্লাহর আয়াত সমূহকে মিথ্যা বলে এবং গা বাঁচিয়ে চলে।……..-জঘন্য শাস্তি তাদের গা বাঁচানোর কারণে।”-৬.১৫৭

“তার চাইতে অধিক জালেম কে, যাকে তার পালনকর্তার কালাম দ্বারা বোঝানো হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার পূর্ববর্তী কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়? আমি তাদের অন্তরের উপর পর্দা রেখে দিয়েছি, যেন তা না বোঝে এবং তাদের কানে রয়েছে বধিরতার বোঝা। যদি আপনি তাদেরকে সৎপথের প্রতি দাওয়াত দেন, তবে কখনই তারা সৎপথে আসবে না।”-১৮.৫৭

আল্লাহর রাসূলের কথা থেকেও আমরা জানতে পারি যে, তাঁর নামে যে কেউ মিথ্যা কথা চালু করে সে তার বাসস্থান জাহান্নামে করে নিল। লাখো ‘মুসলমান’ তাদের যে সময়-শ্রম-অর্থ প্রতিনিয়ত ব্যয় করছেন তা কুরআনের আলোয় ঝালিয়ে নেয়া জরুরী। কেননা কুরআনের নূর দেওয়া হয়েছে সকল জুলুমাতের (অন্ধকার) কালিমা থেকে আলোর জগতে উত্তরণের জন্য। যদি সেই উত্তরণ না ঘটে, তবে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সেই ব্যক্তি নিজের উপর এবং অন্যের উপর জুলুম করে, সে পরিগনিত হয় জালেমে। জুলমাত এবং জুলম একই রুট থেকে উদ্ভূত।

“এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি তোমার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথরূপে। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর তারা কোন হাদিসে বিশ্বাস স্থাপন করবে। প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর দুর্ভোগ। সে আল্লাহর আয়াতসমূহ শুনে, অতঃপর অহংকারী হয়ে জেদ ধরে, যেন সে আয়াত শুনেনি। অতএব, তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন”।-৪৫.৬-৮

তাবলিগের এই লক্ষজনতা হল সেই ‘বোকার বেহেস্তর’ খদ্দের যারা মনে করে যে তারা কথিত ‘নবী-ওয়ালা’ কাজ করে হেদায়েতের উপর আছে। “যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর জিকর (কুরআন) থেকে অন্ধ সাজে, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। তারাই মানুষকে সৎপথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে”।-৪৩.৩৬-৩৭

এরা হল ধর্মের সেই আচমকাসুন্দরী যাদের লেবাস আর বাহ্য কিছু আমল দেখে সবারই ভ্রম হয় দ্বীনদার, ধার্মিক বলে, অথচ তাদের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা-সৌন্দর্য অনুপস্থিত যেহেতু তারা কুরআন বর্জন করেছে।

মাকরান কুব্বারা

আল্লাহর দ্বীনের এবং দ্বীনদারদের বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে যত ষড়যন্ত্র এযাবতকাল সার্থকভাবে বা্স্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে ‘জামাতে তাবলিগ’ সম্ভবত সবচে’ বড়। দরবারী মৌলভী আর মতলবী মৌলানার দ্বীন কেনাবেচা অনেকের চোখেই ধরা পড়ে, ইসলামের নাম ব্যবহার করে দুনিয়া কামানোর জন্য যারা রাজনীতি করে- তাদের কপটতাও আমাদের অনেকের দৃষ্টি এড়ায় না, আর পীর-মোজাদ্দেদের ভণ্ডামী-শঠতা তো অতি-আলোচিত বিষয়। ‘তাবলিগের’ ভেল্কি সেইভাবে পরিদৃষ্ট হয়না। আপাত নিরীহ এই মানুষগুলোর মসজিদে ঘুরে বেড়ানো অনেকের অপছন্দ হলেও এর বিরুদ্ধে বলার মত কোন শক্ত কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। পাবার কথাও নয়। কেননা সে নিজেও সেই একই দোষে দুষ্ট- তা হচ্ছে কুরআন বিমুখতা। তিনি হয়ত কুরআন পড়েন না, তবে কুরআনকে বুঝে পড়ার বিরোধিতা করার মত ঔদ্ধত্যও দেখান না। অথচ একজন সাধারণ মুসলমান যেই না তাবলিগে যাতায়াত শুরু করে, তারপর থেকেই মুরব্বীর দোহাই দিয়ে কুরআন-চর্চার বিরোধিতা করার মত দুঃসাহস দেখায়- অথচ নিজেকে দ্বীনের দাঈ ভেবে পরিতৃপ্তির পান চিবোয়।

‘গায়েবী মদদ’ আর ‘যবের যাতার’ রসালো গল্প দিয়ে কুরআন-বিমুখ মানুষকেই মোহাবিষ্ট করা যায়, কুরআন পড়নেওয়ালাই কেবল শুভংকরের ফাঁকিটা আঁচ করতে পারে।

তাবলিগের কর্মীরা জনপ্রিয় যুক্তি প্রদর্শন করে থাকে, তাদের কারণে অনেক মানুষ ‘নামাজী’ হচ্ছে। না, বরং তাবলীগের ফাঁদে পড়ে সাধারণ মুসলমানেরা ভেজাল ইসলামের পক্ষাবল্বন করতে গিয়ে অজ্ঞাতসারেই কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে- তারা আল্লাহ এবং রাসূলের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করছে।

নবীর কপট দরদী (আবু জাহল-এর ভালবাসা)

আবু জাহল কে এবং তার নামের হাকীকত কী, সাধারণ মুসলমান মাত্রই তা অবগত। সেই আবু জাহল একদিন স্বীয় ভাতিজা হযরত মুহম্মদকে (তাঁর প্রতি সালাম ও শান্তি) বলল, আমরা অবশ্য তোমাকে অবিশ্বাস করিনা, কিন্তু যেই ধর্ম এবং কিতাব তুমি এনেছ তা আমরা বিশ্বাস করতে পারিনা। ‘নবী-ওয়ালা কাজের’ এই কপট দরদীরা, আল্লাহর যমীনে নবীর আদর্শ কায়েমের রাজনৈতিক কুশীলবেরা, ‘নবীর সুন্নতের’ ফরমাবরদার দাবীদার ভন্ড পীর-মোজাদ্দেদরা আবু জাহলের মতই আল্লাহর কিতাব কুরআনকে বাদ দিয়েই নবীর প্রতি তাদের কথিত বিশ্বাস-ভালবাসার আদিখ্যেতা জাহির করতে চায়। কুরআনের পরতে পরতে কপট, মুনাফিকের চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মু’মিনদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে

আফসোস! আফসোস!! আফসোস!!! (হাসরাহ্)

যাবতীয় বিভ্রান্তির মোকাবেলায় আমাদের আক্বল প্রয়োগের সময় এসেছে। কুরআনে বহু বহুবার আমাদের উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বলে যেঃ আফালা তা’ক্বিলুন-তোমরা কি উপলব্ধি কর না। আক্বল সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে মোট ৪৯টি। আর তারা বলবে-“আমরা যদি শুনতাম অথবা বুদ্ধি (আক্বল) প্রয়োগ করতাম তাহলে আমরা জ্বলন্ত আগুনের বাসিন্দাদের মধ্যে হতাম না।’’-৬৭.১০

যে বিচার-বিবেচনা বোধ আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের দিয়েছেন তা প্রয়োগ না আমরা যে ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হচ্ছি তার জন্য আল্লাহ্ স্বয়ং আমাদের অবস্থার উপর আফসোস করেন। লাও কানু ইয়া’লামুন (হায়, যদি তাদের বিবেকবুদ্ধি থাকত)-২.১০২, ২.১০৩, ১৬.৪১, ২৯.৪১, ২৯.৬৪, ৩৯.২৬, ৬৮.৩৩। হায়! আফসোস বান্দাদের জন্য (ইয়া হাসরতান আলাল ইবাদ)! তাদের কাছে এমন কোনো রসূল আসেন নি যাঁকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করেছে!-৩৬.৩০

যদি যুক্তির খাতিরে ‘তাবলিগের’ দাওয়াতের পদ্ধতিগত বিষয়টিকে ধরেও নেই, সেক্ষেত্রেও তা কুরআন-চর্চার এক অভূতপূর্ব মাধ্যম হতে পারত। প্রতি বছর দেশের একটি সরকার যেমন বাজেট ঘোষণা করে, তেমনিভাবে বিশ্বএজতেমা সারা বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য বাৎসরিক কুরআন-চর্চার সিলবাস ঘোষণা করতে পারত। সকল মুসলমান জানত কোনদিন তার পাঠের তালিকায় কী আছে। কুরআনের একই আয়াত একই সাথে যমিনের এক বিশাল জনগোষ্ঠী যখন অভিনিবেশ সহকারে তিলাওয়াত করত তার সুফল কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হত তা আমরা ভাবতেও পারিনা। ফজর এবং মাগরিবের সালাতের পর যদি যমিনের আনাচে-কানাচে কোন এক সূরার একটি রুকুর আলোচনা হত, তাহলে আল্লাহর কত সহস্র বান্দা কুরআনের আলোয় সিক্ত হয়ে তা অন্যত্র ছড়িয়ে দিতে পারত। বিশ্বের মসজিদে মসজিদে সারা বছরে পঠিত কুরআন-চর্চার সর্বজনিন পর্যালোচনার আসর হতে পারত এই মহাসম্মেলন। অথচ একজন মানুয় চল্লিশ বছর তাবলিগ করার পরও গৎবাঁধা আজগুবী, কুরআনের সত্য বর্জিত কথা ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারে না। তারা যুক্তি-তর্ক করে ‘বিগইরি ইলম, ওয়ালা হুদা’। “আর মানুষদের মধ্যে এমনও আছে যে আল্লাহ্ সন্বন্ধে বিতর্ক করে কোনো জ্ঞান না রেখে আর কোনো পথনির্দেশ ছাড়া আর কোনো দীপ্তিদায়ক গ্রন্থ ব্যতিরেকে”।-২২.৮, ৩১.২০

অতএব শয়তানের তাবেদারী বয়কট করে অনতিবিলম্বে বন্ধ হোক কুরআন-বিরুদ্ধ এই কপট আয়োজন– একে পরিণত করা হোক পাক-কুরআনের নূরে আলোকিত হবার মহান অভিযাত্রায়। নইলে আমাদেরকে তাঁর ‘ক্বওম’ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েও ক্বিয়ামতের সুকঠিন দিনে আমাদের থেকে আল্লাহর শেষনবী (তাঁর প্রতি সালাম ও শান্তি) নির্দায় হবেন এই বলেঃ “হে আমার প্রভু! নিঃসন্দেহে আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যজ্য বলে সাব্যস্ত করেছিল।’’-২৫.৩০

মহিমান্বিত কুরআনের কতিপয় আয়াত উল্লেখ করে আমাদের বদ্ধমূল নির্বুদ্ধিতা, জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা কুপমন্ডুকতাকে তুলে ধরার যে চেষ্টা এখানে করা হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই অকিঞ্চিতকর, আংশিক। একমাত্র বিকল্প, সবাই মিলে সারাজীবনের জন্য কুরআনের আলোর অভিযাত্রায় নিজেকে শামিল করার জন্য নিয়ত করা, উদ্যোগী হওয়া। নইলে আল-কুরআন নিজেও ক্বিয়ামতের দিন এর অবহেলাকারীদের জন্য ‘হাসরাহ’ বা আফসোসের কারণ হয়ে দাড়াবে –“আর নিঃসন্দেহে এটি (কুরআন) প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য বড় অনুতাপের বিষয়।-৬৯.৫০

********************

বিষয়: বিবিধ

১৩২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File