ইউরোপের ললাটে দুঃশ্চিন্তার বলিরেখা, টাকা দিয়ে সুখ কেনা গেল না
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ_২ ০৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৩:১৮:০৯ দুপুর
খবরে প্রকাশ, নরওয়ের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কোষাগারে বর্তমানে জমা আছে ৭৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় হয় প্রায় ৬০০,০০,০০,০০,০০,০০০ (ষাট লক্ষ কোটি টাকা), মাথা পিছু অর্থের পরিমাণ হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৫ হাজার ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ১১ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা করে। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ও সম্পদ থাকায় স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের এ রাষ্ট্র্রের নাগরিকরা বিব্রত বোধ করছেন। দেশটির এত বেশি পরিমাণ অর্থ কিভাবে খরচ করবেন এই নিয়ে দুঃচিন্তায় বিভোর দেশটির প্রশাসন। আরবীয় তেল সমৃদ্ধ দেশগুলির একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষেরও একই অবস্থা। সম্পদ রাখার জায়গা নেই, খরচের উপায় চিন্তা করে গলদঘর্ম হচ্ছেন। পৃথিবীতে প্রতিদিন এ বিলিয়ন মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এ পরিসংখ্যান তাদের কাছে কেবলই কতগুলি নির্বিকার সংখ্যা। আরবরা না হয় তেল সম্পদে তৈলাক্ত, কিন্তু ইউরোপের মানুষ এত ধনী কিভাবে। সে ইতিহাস সকলের জানা। যে বিপুল সম্পদের পাহাড়ে বসে আজ তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে সেই সম্পদ প্রকৃতপক্ষে লুটের সম্পদ। কয়েক শ’ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশসহ প্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার সমৃদ্ধ দেশগুলিকে শোষণ করে ইউরোপিয়রা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এদেশের চাষীদের ধানক্ষেতকে নীলক্ষেতে রূপন্তরিত করে ভারতের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাকে মন্বন্তরের শিকারে পরিণত করে হত্যা করেছে। প্রাচ্যের শিল্প সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেরা এখানকার কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে এ দেশের মানুষের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রী করেছে। এসব ইতিহাস কি মানুষ ভুলে গেছে। সেই ইউরোপীয়রা আজও তাদের সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির (যেমন নরওয়ের টেলিনর) মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে করে যাচ্ছে পদ্ধতিগত ডাকাতি (Systematic Robbery)। এভাবে বিভিন্ন সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথিবীর সম্পদ তাদের কাছে গিয়ে জমা হচ্ছে। আর বঞ্চিত হচ্ছে বাকী পৃথিবী। যেহেতু পৃথিবীর মোট সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণ, তাই এক জায়গায় যখন অধিক সম্পদ স্তুপীকৃত হয়, তখন অন্যত্র টান পড়ে। এই ভাটার টানে পৃথিবীর এক অংশের মানুষ হয়ে যায় তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা।
এ বৈষম্য ইউরোপের মধ্যেও দুঃখজনক রূপ পরিগ্রহ করেছে, যদিও তাদের অবস্থা এশিয়া, আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলির থেকে শতগুণ ভাল। বিপুল অর্থ বৈভব নিয়ে নিশীথ সূর্যের দেশটির অধিবাসী ও সরকার যখন চিন্তায় অস্থির তখন পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত অর্থাৎ এশিয়া বা আফ্রিকার কঙ্কালসার মানুষদের কথা বাদই দিলাম, খোদ ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের অবস্থা লক্ষ্য করুন। অর্থনৈতিক মন্দার শিকার ব্রিটেনে চলছে ব্যয় সংকোচনের প্রতিযোগিতা। সেনা সংখ্যাও কমাতে হয়েছে ব্যয় সংকোচনের স্বার্থে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও হাজার হাজার সরকারী চাকুরীজীবী বেকার হয়ে পড়ছে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলনের দৃশ্যপট এখনও বিশ্ববাসীর স্মৃতিপটে জাগরুক। আরও বহু দেশে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের বহ্নিশিখা- আমরা ৯৯% বঞ্চিত। ইউরোপের আরেক রাষ্ট্র গ্রীসের অবস্থা রীতিমত ভয়াবহ। যেন দেশ বিক্রি করতে যাচ্ছে রাষ্ট্র। ইতিমধ্যে কয়েকটি দ্বীপ আরবদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে অর্থের যোগান দেওয়ার প্রয়োজনে। ফ্রান্স, স্পেন এবং ইতালিতেও চলছে ব্যয় সংকোচন ও কর্মী ছাটাই, বেতন দিতে না পেরে বিদেশী শ্রমিকদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছে মাতৃভূমিতে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে বঞ্চিত জনসংখ্যার মাঝে যখন বিক্ষোভ শুরু হয় তখন মুহূর্তেই সেখানে ৩/৪ লাখ লোক একত্রিত হয়ে যায়। সেই বিক্ষোভ সেই দেশের বড় বড় শহর তো বটেই আশ পাশের দেশগুলিতেও দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভে সরকারপক্ষ একটু বাধা দিলেই শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা, রায়ট। মানুষের মনের ভিতরে যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সঞ্চিত আছে সেটা বিস্ফোরণের আকারে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মাত্র কিছুদিন আগে খোদ লন্ডনে এমন একটি দাঙ্গা অগ্নিকাণ্ডের রূপ নেয়, দোকান পাট, শপিং মল ভাঙচুর লুট পাটের সেই দৃশ্য পৃথিবীবাসী টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আতঙ্কিত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর হস্তে এই গণবিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত করে। কিন্তু কাউকে ভুললে চলবে না যে, গোটা মানবজাতিই এখন অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে। কেবল পেশিশক্তি দিয়ে একে আজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। সমাজের মধ্যে যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এবং জীবনের সর্ব অঙ্গনে যে অবিচার, বৈষম্য ও অন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সিস্টেমের মাধ্যমে, এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ যে কোন সময়ে ফেটে পড়বে। এই অনিবার্য পরিণতি বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানী হতে হয় না। এখন প্রশ্ন হল, এক রাষ্ট্রে দুধের নহর বয়ে যাচ্ছে, অর্থের বন্যায় ভাসছে অর্থ কিভাবে কোনপথে ব্যয় করবে সেই পথ খুঁজে পাচ্ছে না অথচ তারই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো অর্থাভাবে চরম দৈন্য দশায় পড়ে রাষ্ট্রের ভূখণ্ড বিক্রি করছে। কিনে নিচ্ছে আরবীয় আমীর ওমরাহ, তেলব্যবসায়ীরা। কেন এই অবস্থা?
এই অবস্থার প্রকৃত কারণ হচ্ছে, স্রষ্টা পৃথিবী সৃষ্টি করে মানুষ প্রেরণ করেছেন পৃথিবীতে সকলে মিলে শান্তিতে বসবাস করার জন্য অথচ পৃথিবীর মানুষ এই পৃথিবীকে সীমানা দাগ কেটে টুকরো টুকরো করেছে। এর অনিবার্য ফল হয়েছে আজকের নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডের নাগরিকরা যারা সম্পদের, অর্থের আধিক্যে চিন্তিত পক্ষান্তরে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র একই ইউরোপ, একই ধর্মজাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বত্ত্বেও চরম আর্থিক দুর্ভোগে পতিত। নরওয়ের আয়োতন ৩২৪০০০ বর্গ কি.মি. যা বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি, জনসংখ্যা মাত্র ৪৫ লাখের মত, বলা যায় ঢাকা শহরে যে পরিমাণ লোকের বসবাস পুরো নরওয়েতে তার চার ভাগের এক ভাগ লোক বাস করে। কী অন্যায়! যতদিন না মানবসৃষ্ট কৃত্রিম সীমান্তরেখা ভেদ করে মানবজাতি একজাতি না হবে, পৃথিবীর সকল স্থানের সমস্ত সম্পদ সমভাবে বণ্টিত না হবে ততদিন এই অশান্তি দূর হবে না। এই বিশাল পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র জায়গায় মাত্র কয়েক লাখ বিলাসী মানুষকে অর্থের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া আর সমস্ত মানবজাতিকে অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেওয়ার মধ্যে আসমান জমিনের ফারাক। এই দ্বিতীয় অবস্থাটি সম্ভব করতে পারে কেবলমাত্র আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা। অথচ এই মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীটি আল্লাহর দেওয়া সেই জীবনব্যবস্থা ভুলে গিয়ে প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থাগুলি যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মেনে নিয়ে ভারবাহী পশুর মত প্রভুর আরাম আয়েশের যোগান দিয়ে যাচ্ছে, নিজেদের কষ্টার্জিত সম্পদ অঞ্জলিভরে প্রভুদের পায়ে সমর্পণ করছে।
যাহোক, এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ কি ধনী ইউরোপীয়দেরকে সুখ দিতে পারছে? পারছে না। কারণ অর্থ মানুষকে আরাম দিতে পারে, কিন্তু সুখ-শান্তি প্রধানত একটি আত্মিক বিষয়। অর্থের প্রবেশাধিকার সেখানে নেই। তার প্রমাণ, আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে বিশ্বের প্রথম তেরটি দেশের মধ্যে দশটি দেশই ইউরোপের। ১৩তম হচ্ছে নরওয়ে। এই বছর নরওয়েতে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছে পাঁচ হাজার তিনশ’ জন। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসার কারণে পাঁচশ ত্রিশ জন ব্যতিরেকে বাকী সবাইকে সুস্থ করতে সক্ষম হয় নরওয়ের হাসপাতালসমূহ। আত্মহননের অধিকার আদায়ে এসব দেশে আন্দোলন করে মানুষ। গত দশ বছরে প্রায় ৫০হাজার নরওয়েবাসী স্বেচ্ছামৃত্যু বরণের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগেই চিকিৎসা করে তাদেরকে ইহলোকেই বন্দী করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার প্রবণতা সেখানে ৩৫-৪৪ বয়সসীমার মানুষের (World Health Organization )। অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল সময়ে মানুষ জীবনের প্রতি মায়া হারাচ্ছে। সবচেয়ে বড় পরিহাস, এই নরওয়েই কি না মানুষকে শান্তির জন্য নোবেল দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এত অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি পেয়েও জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কেন তাদের?
এর একটাই উত্তর, আসলে এই আত্মাহীন বস্তুবাদী সভ্যতা তাদের জীবনে শান্তি (Peace) দিতে পারছে না। কি করলে শান্তি পাবে খুঁজে না পেয়ে বিকৃতপথে পা বাড়াচ্ছে তাদের যুবসমাজ, তাদের বিকৃত যৌনাচারের বিবরণ দেওয়া আমাদের জন্য অমর্যাদাকর। কিছুদিন আগেই নরওয়ের অ্যান্ডারসন ব্রেইভিক একাই হত্যা করে ৭৭ জন নিরপরাধ নির্দোষ ব্যক্তিকে। সেই খুনী অ্যান্ডারসন ব্রেইভিকরা যাদের আদর্শের অনুসারী অর্থাৎ চরম ডানপন্থী বলে পরিচিত। তার ধর্ম ইসলাম হলে তাদের দলকেও জঙ্গি দল বলা হত। সেই উগ্রবাদী কনজারভেটিভ দলই জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন সরকার গঠন করছে। এতেই বোঝা যায় নরওয়েবাসী কত অসুস্থ, কতটা বিকৃত তাদের রুচি ও জ্ঞানবোধ।
তবু তারা প্রাচ্যের দেশগুলোর সামনে নিজেদের অর্থগরিমা প্রকাশ করে আত্মতুষ্টি পেতে চায় আর প্রাচ্যের দাসমানসিকতার শাসক ও জনতাও তাদের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। কী নির্লজ্জ হীনমন্যতা!
এ ঘটনাই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট যে, মানুষের সৃষ্টি করা বিধান দিয়ে জীবন পরিচালনা করার পরিণতি কত ভয়াবহ। বৈষম্য ছাড়িয়ে গেছে সকল বিশ্বরেকর্ড, মানবতা এখন কেবলই মুখের বুলি।
সংগৃহীত।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন