হাতমাম মাকদিয়্যা-২

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ_২ ২১ জুলাই, ২০১৩, ০৫:০৪:৫১ বিকাল

প্রতিটি সত্ত্বার নিয়ত বসবাস আল্লাহর খড়গের নীচে। নাছিইয়াতুন (নুন, ছোয়াদ, ইয়া, তা) মানে ললাট ও তার সন্নিহিত কেশ। এর বহুবচন নাঅছিয়ুন কেশগুচ্ছ)। সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে মহাপরাক্রান্ত আল্লাহর শাসনের খড়গ যে প্রতিটি ব্যক্তিসত্তার অতি সন্নিকটে তার এক অত্যন্ত শক্তিশালী প্রয়োগ আমরা লক্ষ্য করি সূরা হুদে।

‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত তাদের ভাই ও নবী হযরত হুদ (আHappy তাঁর জাতিকে আল্লাহর শেখানো ভাষায় সতর্ক করছেন এই বলে: ‌ইন্নি তাঅক্কালতু ‘আলাল্লহি রব্বি অরব্বিকুম, মা মিং দাব্বাতিন ইল্লা হুয়া আখিযুম্ বিনাছিয়াতিহা, ইন্না রব্বি ‘আলা ছিরাতিম্ মুছতাক্বীম (১১.৫৬) – “আমি আল্লাহর উপর নিশ্চিত ভরসা করেছি যিনি আমার এবং তোমাদের পরওয়ারদেগার। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নাই যার কপালের ঝুটি (forelock) তাঁর করতলগত নয়। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সরল পথে রয়েছেন। “পুনরায় তাদেরকে সতর্ক করছেন এই বলে: “তথাপি যদি তোমরা মুখ ফেরাও, তবে আমি তোমাদেরকে তা পৌছিয়েছি যা আমার কাছে তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছে; আর আমার প্রতিপালক অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, আর তোমরা তাঁর কিছুই বিগড়াতে পারবে না; নিশ্চয়ই আমার পরওয়ারদেগারই প্রতিটি বস্তুর সংরক্ষণকারী”।

আল্লাহ্‌ তায়ালা স্বয়ং কিয়ামতের দৃশ্যপট বর্ণনা করছেন: ইয়ু’রফুল মুজরিমুনা বিসিমাহুম ফাইয়ু’খযু বিন্নাঅছি অলআক্বদাম। ফাবিআয়্যি আলা ইরব্বিকুমা তুকায্যিবান। হাযিহি জাহান্নামুল্লাতি ইউকায্যিবু বিহাল মুযরিমুন। ইয়াত্বুফুনা বাইনাহা অবাইনা হামীমিন আন (৫৫.৪১-৪৪)। “অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা থেকে; অতঃপর তাদের কপালের চুল (forelocks) ও পা ধরে টেনে নেয়া হবে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? এটাই জাহান্নাম, যাকে অপরাধীরা মিথ্যা বলত। তারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে প্রদক্ষিণ করবে।“

সেই একই ‘নাছিইয়াতুন’ শব্দের চূড়ান্ত ক্রোধযুক্ত ব্যবহার করেন সুরা আলাক্বে: আরাআইতা ইং কায্যাবা অতাঅল্লা। আলাম ইয়া’লাম বিআন্নাল্লহা ইয়ারা। কাল্লা লায়িল্লাম ইয়াংতাহি লানাছফায়াম্ বিন্নাছিইয়াতি। নাছিইয়াতিন কাযিবাতিন খত্বিয়াহ্ (৯৬.১৩-১৭)। অর্থাৎ তুমি কি দেখেছ, যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন? কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই। মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ”। এখানে ‘লানাছফায়ান’ জমা’ মুতাকাল্লেমের ছিগাহ; অর্থ: আমি অবশ্যই টানব বা হেঁচড়াব।

আমরা এই পর্যায়ক্রমিক ব্যাবহারটা বুঝতে চেষ্টা করি। একই ঘটনা আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর নবীর বিবৃতি আকারে আমাদেরকে জানিয়ে হুশিয়ার করছেন। সুরা আর-রাহমানে নিজেই বিবৃতিদাতা অথচ তার প্রকাশ কর্মবাচ্যে। কিন্তু আল্লাহ্‌ তায়ালার ভয়াবহ অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে এই শেষোক্ত উদ্ধৃতিতে। এখানে অপরাধীদের প্রতি তার যারপরনাই আক্রোশ প্রকাশে নিজেকে আর অনোন্মোচিত রাখলেন না, তিনি নিজেকেই এখানে কারক (কর্তৃবাচ্য) হিসেবে ঘোষণা দিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি স্বয়ং চূড়ান্ত আঘাত হেনে সুতীব্র ভর্ত্সনাসূচক তাঁর মন্তব্যও আমাদের জানিয়ে দেন যে, সেই অপরাধীর কেশগুচ্ছ মিথ্যা ও পাপযুক্ত। তিনটি মাত্র শব্দ প্রয়োগে এই যে ক্রোধের সর্বশেষ প্রকাশ: নাছিইয়াতিন কাযিবাতিন খত্বিয়াহ্ – এর তুলনা কোথায়? একটা পুরো জীবন পার করে দেয়া যায় এর উপর ফিকির করে। আহ্! আহ্!! নিতান্ত আফসোস!!! যদি আমাদের বুঝ আসত।

নবী-রাসূলগণ এই রূঢ় সত্যগুলোকে সর্বদা মাথায় রেখে চলতেন আর সেভাবেই নিজ জাতিকে হুশিয়ার করতেন। কদাচিৎ তাঁদের পক্ষ থেকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কোন কথা বা কাজ হয়ে গেলে আল্লাহ্‌ তায়ালা যখন যেমন প্রয়োজন তাঁর প্রিয় নবী-রাসূলগণের উপরও তার শাসনের দণ্ড চালিয়েছেন। এমনকি কিয়ামতের ময়দানেও নবী-রাসূলগণকে যে জেরা (৫.১১৬) করবেন তার দৃষ্টান্ত আমরা কুরআনে পাই। শাসনের এই খড়গ আমাদের মাথার উপরও বিদ্যমান, কিন্তু আমরা তা বিস্মৃত হয়েছি – তাই আমাদের কথা ও কাজ, চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই বেপরোয়া। শয়তান আমাদের উপর তার পূর্ণ রাজত্ব কায়েম রেখে চলেছে।

‘অকাট্য নির্দেশ’, ‘অনিবার্য সিদ্ধান্ত’, ‘অবধারিত ফয়সালা’, ‘অনিবার্য নির্দেশ যাহা সম্পন্ন হবেই’, ‘অমোঘ সিদ্ধান্ত’, ‘অনিবার্য ফয়সালা’ – এভাবেই ‘হাতমাম মাকদিয়্যা’র অর্থ করা হয়েছে বাংলাভাষায়; ইংরেজীতেঃ ‘absolute decree’, ‘decree which must be accomplished/fulfilled’, ‘binding affair’, ‘decreed determined’, ‘inevitable decree’, unavoidable decree’, ‘fixed decree’।

বস্তুত ‘মাকদিয়্যা’ (ইসমে মাফউল বা কর্মকারক) শব্দটি একাই এই ভাব প্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত ছিল, কিন্তু এখানে অতিরিক্ত একটি ইসম ‘হাতমন’ যুক্ত হয়েছে। এর অর্থ চূড়ান্ত, স্থির নিশ্চিত, অনিবার্য। সেজন্যে কেউ কেউ অর্থ করেছেন – ‘স্থিরীকৃত অনিবার্য প্রতিশ্রুতি’। অর্থের ক্ষেত্রে তেমন কোন হেরফের পরিলক্ষিত হয়না। কিন্তু বিষয়ের গাম্ভীর্য বোঝাতে বাড়তি জোর যে দেয়া হয়েছে, তা সুস্পষ্ট। কী সেই অলঙ্ঘনীয় প্রতিপালনীয় ঘটনা? যার সংবাদ আল্লাহ অনেপনেয় কালির আচর দিয়ে তিনি নিজেই আবার আর এক শক্ত বাণীর বাধনে তাকে বেধে রাখলেন।

আল্লাহ তায়ালা সুকঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন: অইম্মিংকুম ইল্লা অরিদুহা কানা য়ালা রব্বিকা হাতমাম মাকদিয়্যা (১৯.৭১) - তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তা অতিক্রম করবে না। এটা তোমার রব্বের অমোঘ ফয়সালা।

‘মাকদিয়্যা’ শব্দটির ক্রিয়ামূল ক্বদাউন (ক্বফ, দোয়াদ, হামযা)। কুরআনে ক্বদাউন থেকে রূপান্তরিত শব্দের সংখ্যা বহু। ‘মাকদিয়্যা’ শব্দটি পবিত্র কুরআনে সূরা মারইয়ামেই আরও একবার এসেছে - অকানা আমরম মাকদিয়্যা (১৯.২১)। আমরা বাংলায় যে কাযি (যিনি রায় বা ফয়সালা দেন) বলি তাও এখান থেকেই উৎসারিত। উল্লেখ্য, ‘হাতমন’ (হা, তা, মিম ) ইসমটি পবিত্র কুরআনে এই একবারই ব্যবহৃত হয়েছে। এর রুট থেকে আর কোন শব্দ পরিলক্ষিত হয়না।

আল্লাহ তায়ালার যে শান ও আজমত এবং সকল সৃষ্টির মাঝে নিজ সন্নিধান হতে অবারিত দানের মাধ্যমে মানুষকে যে গৌরব তিনি দান করেছেন – অন্ততঃ এ দুটি বিষয় যদি বিবেচনায় আনা হয় তাহলেও মহান করুণাময়, মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তায়ালাকে অবাধ্যতার যে পরিণাম তার সর্বজনীন সাক্ষ্য যে অনিবার্য তা যৌক্তিকভাবেই সিদ্ধ। অন্যত্র এর সমর্থনে আরও বলা হয়েছে: ‘এবং জাহান্নাম সকলের সামনে প্রকাশ করা হবে’-৭৯.৩৬। সূরা তাকাছুরে (১০২.৬-৮) বলা হয়েছে, “তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে, অতঃপর তোমরা তা অবশ্যই দেখবে দিব্য প্রত্যয়ে, এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”।

আয়াতের (১৯.৭১) দুটি অংশ, প্রথমত: অইম্মিংকুম ইল্লা অরিদুহা - তোমাদের মধ্যে এমন কেহ নেই যে সেখানে পৌছবে না। এখানে ‘সেখানে’ দিয়ে জাহান্নাম বা তার সংলগ্ন/সন্নিহিত কোন স্থানকে বুঝানো হয়েছে। যখন আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন “তোমাদের মধ্যে এমন কেহ নেই”, তখন সেই ‘তোমাদের’ থেকে কোন নবী-রাসূলগনও বাদ পড়েন না। তো সেই কমন জায়গাটা যা আমরা ‘পুলসিরাত’ নাম দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি সেটা নিশ্চিতভাবেই জান্নাত নয়, তবে জাহান্নামের খুব কাছাকাছি। এমন একটি জায়গা যেখানে তিনি সকলকে নিয়েই ছাড়বেন, যার কোন ব্যত্যয় হতেই পারবে না। আয়াতের মূল বিবৃতি এটিই। বক্তব্য বিষয় হিসেবে তা যথেষ্ট। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নিজের বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠা করতে, আমরা যেন একে হেলাফেলার ভঙ্গিতে না দেখি তার জন্য বাড়তি জোর দিতে যোগ করলেন দ্বিতীয় অংশ: কানা য়ালা রব্বিকা হাতমাম মাকদিয়্যা- আর এ তোমার প্রতিপালকের উপর অনিবার্য সিদ্ধান্ত।

আমরা কি দুচোখ বন্ধ করে সেই অনিবার্য অবস্থানের জায়গাটিতে নিজেদেরকে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হব? আত্ম-বিশ্লেষণে ব্রতী হব আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলকে কতটুকু চিনতে চেষ্টা করেছি কুরআনের মাধ্যমে? পরিমাপ করে দেখতে চেষ্টা করব আমাদের অবস্থা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য পর্যাপ্ত কিনা? নাকি আমাদের কর্মফল নতজানু অবস্থায় ফেলে দেবে স্থায়ী আযাব আর জিল্লতির সংকীর্ণ কোন গহ্বরে (মাকানান দয়্যিকা-২৫.১৩)?

আমাদের কার সাথে কী আচরণ করা হবে, আমরা কেউ বলতে পারি না, আমরা কে জাহান্নামী আর কে জান্নাতি – তা কেই জানিনা। যেটা নিশ্চিতভাবেই জানি, তা হল জাহান্নামের এই পথটি যা মাড়িয়ে আমাকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে এই পৃথিবীর জীবনেই সচেষ্ট হতে হবে। সূরা মারইয়ামে এর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে: “অতঃপর আমি মুত্তাকীদিগকে উদ্ধার করব আর যালিমদিগকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব”।

এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা সাধ্যমত দেখে নিতে পারি। ব্যাকরণগত দিকটিও আমরা যথাসাধ্য আয়ত্ত করব। আগ্রহী পাঠক আয়াতের ছন্দ অলংকার খুঁজে দেখতে পারেন। আমাদেরকে স্থায়ী কল্যাণ আর মহিমা দিতে এবং চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা আর চূড়ান্ত সর্বনাশ থেকে রেহাই দিতে আল্লাহ তাঁর শান অনুযায়ী ভাবপ্রকাশের যে সুনির্দিষ্ট শব্দসমষ্টির আশ্রয় নিয়েছেন – তার সাথে আমাদের মাখামাখি অনেক বেশি জরুরী। তাঁর বাণীকে আমাদের মুখের বাণী করে নেয়া। এর অন্তর্নিহিত যে অফুরান-অপরিসীম শক্তি ও আলো তা কখনই এর অনুবাদ থেকে পাওয়া যাবে না। এই বাণীর ওজন ঠিক তেমনি (৭৩.৫), যেমন তিনি নিজে। আমরা যেন সেই ওজনটি টের পেতে চেষ্টা করি, সেজন্যে হেন পন্থা নাই যা তিনি প্রয়োগ করে এই কুরআনে আমাদেরকে বুঝাতে প্রয়াসী হন নাই। আবার বাস্তবতাও জানিয়ে দিয়ে বলেছেন যে, “তোমরা আল্লাহকে সেভাবে মর্যাদা দাও নাই যেভাবে দেয়া উচিত ছিল”। এটাকে যদি শুধুই মুখস্থ করা বলে মনে করা হয় তবে নেহাতই সংকীর্ণ করা হবে – তারচে’ অনেক বেশি কিছু। কুরআনের বাণীসমূহ নির্বাচন, তার বাক্য বিন্যাস, শব্দচয়ন, অলংকার, প্রকাশভঙ্গীর ঋজুতা যাবতীয় সবকিছু স্বয়ং তাঁরই, এজন্যে তিনি কারো সাথেই কোন পরামর্শ করেননি।

‘হিজরাম মাহজুরা’, আঝমিল উমুর’, দলালিম বায়িদ’, ছামানান কলিলা’, বাগইয়াম বাইনাহুম’, দ্বিনুল ক্বয়্যিমা’, আযালিম মুছাম্মা’, আক্বিবাতুল উমুর’, ক্বওমান গউরকুম/খলক্বিন জাদিদ’, ক্বরদান হাসানান’, ‘ফাতারব্বাছু মুতারব্বাছুন’, অলা মুবাদ্দিলা লিকালিমাতিল্লাহ্’, ‘উম্মাতাও অহিদাহ’– এজাতীয় বহু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ কুরআনে বহুবার বহুভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম ‘হাতমাম মাকদিয়্যা’র জায়গায় এরকম আরও অনেক কিছুই হতে পারত। উদ্দেশ্য এই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ গুলো, বাক্যাংশ, বাক্য নিচয় আমাদের অনেক চেনা আর আপন হয়ে যাক, আমাদের অস্থি-মজ্জা আর মেধা-মননের সাথে একাকার হয়ে যাক। পরম মমতা আর স্নেহে আমরা এগুলোকে বুকে ধারণ ও লালন করি।

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সম্মানিত করলেন, সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিলেন, সকল উত্তম বস্তু আহার করতে দিলেন (১৭.৭০, ১৬.৭২, ৪০.৬৪), এত এত নেয়ামত দিলেন যা গুনে শেষ করার নয় (অইংতাউদ্দু নে’মাতাল্লহি লাতুহ্ ছুহা-১৪.৩৪, ১৬.১৮)। মানব ইতিহাসের চূড়ান্ত লগ্নে পুরো মানবজাতির হেদায়েতের লক্ষ্যে তাঁর সকল নেয়ামত পূর্ণ করে দান করলেন মহা গ্রন্থ আল-কুরআন (২.১৫০, ৫.৩)। কিন্তু এসবই তাঁর অপিরসীম দরদ আর অনুগ্রহ তাঁর সেরা সৃষ্টির প্রতি। এর কিছুই আমরা তাঁর কাছ থেকে যাচ্ঞা করে পাইনি। এগুলোর কোনটিই আমাদের কোন অধিকার ছিল না। কুরআনের ব্যাপারে সেকথা জানিয়েও দিয়েছেন: অলায়িন শিনা লানাযহাবন্নাবিল্লাযি আওহাওনা ইলাইকা ছুম্মা লাতাজিদুলাকা বিহি আলাইনা অক্বীলা; ইল্লা রহমাতাম্মির রব্বিকা ইংফাদলাহু কানা আলাইকা কাবিরা (১৭.৮৬-৮৭)। পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর নবীকে সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, ‘আমি ইচ্ছা করলে তোমার প্রতি যা ওহীর মাধমে পাঠিয়েছি তা অবশ্যই প্রত্যাহার করতে পারতাম, তখন এব্যাপারে তুমি নিজের জন্যে আমার মোকাবিলায় কোন উদ্ধারকারী পেতে না। এ প্রত্যাহার না করা তোমার প্রতিপালকের অশেষ দয়া। নিশ্চয় তোমার প্রতি তাঁর রয়েছে মহা অনুগ্রহ”।

এই চূড়ান্ত হুমকির মোকাবেলায় কৈ আমরা তো এই কুরআনকে বুকে আগলে ধরে রাখলাম না। কুরআন তো একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে পরিত্যক্ত রয়ে রইল (২৫.৩০)। কুরআনের আয়াত নিয়ে জিব্রাইলের আসতে দেরি হলে যে নবীর সুতীব্র দহন-পীড়ন, রক্তক্ষরণ আর অন্তর্জালার শেষ থাকত না, আমরা চূড়ান্ত হতভাগার দল তা একসাথে হাতের নাগালে পেয়েও ন্যুনতম কদর করলাম না (অমা ক্বদারুল্লাহা হাক্কা ক্বদিরিহি-৬.৯১, ২২.৭৪, ৩৯.৬৭)। আমাদেরকে গভীরভাবে ফিকির করতে হবে। ধিক আমাদের অবস্থার উপর, আমরা আমাদের সত্তাকে বিসর্জন দিলাম কিছু ভ্রষ্ট, ধুরন্ধর ও নির্বোধ মানুষের মনগড়া কথাকাহিনীর জালে (২১.৬৭), আমরা আমাদের সকল ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা আর জান-মাল উজাড় করে দিলাম কিছু লেবাসী গোষ্ঠীর হীন স্বার্থের কাছে।

কোথায় আমাদের সেই পেরেশানী? অথচ আমরা সবাই সেই ঝুলন্ত পথের যাত্রী (১৯.৭১) যেখান থেকে নিমিষেই অনন্তকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারে আমাদেরর স্বপ্ন। আমরা হয়ে যেতে পারি স্থায়ী আযাব আর লাঞ্ছনার শিকার। মানুষের হারাম উপার্জন খেয়ে পীর-মোজাদ্দেদ পদবী নিয়ে কেউ গায়ে-গতরে মোটাতাজা হচ্ছি (অইয়া’কুলুনা কামা তা’কুলুল আনআম-৪৭.১২), কেউ ধর্মের নামে মহা ধুমধামের পিকনিক আয়োজন করছি, দরবারে জম্পেশ জলসা চলছে। ইসলাম বাস্তবায়নের নিয়ত পরিবর্তনশীল হরেক রকম প্যাকেজ উপস্থাপন করছি। দ্বীনের দাওয়াত আর দ্বীন কায়েমের কথা বলে আল্লাহর শত্রুদের সাথে দোস্তি করছি, তাগুতের সকল প্রথা-পদ্ধতির সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক বজায় রাখছি। ‘দো রাকাত কি ইমাম সব কিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও তার চাকরিটা রক্ষায় তটস্থ, ব্যস্ত। কবি ইকবাল যখন সুতীব্র আঘাত হানেন, ‘ক্বওম কিয়া চিজ হ্যায়, ক্বওমো কো ইমামত কিয়া হ্যায়, ইস কো কিয়া সমঝায়ে ইয়ে বেচারে দো রাকাত কি ইমাম’ তখন তার মধ্যে যেমন তীক্ষ্ণ শ্লেষ পরিদৃষ্ট হয়, তেমনি তার রূঢ় সত্যটাকেও অস্বীকার করার উপায় থাকে না। ব্যতিক্রম কেউ হয়ত আছেন যারা ‘ইমামতি’র দায়ভার আর ওজনটা টের পেতে চেষ্টা করেন এবং অসহায়ত্ব-অক্ষমতার যন্ত্রনাটা এড়াতে পারেন না।

চল.....

বিষয়: বিবিধ

২২৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File