নিজ চোখে দেখা সেই ভয়াল ৫ মে রাত্রে.... (নিজের বাস্তব কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন স্বাধীন ভাষী ০৬ মে, ২০১৪, ০১:৫০:১২ রাত
আজ সেই ভয়াল রাত্রি, গত বছর যে রাতে আওয়ামী পুলিশের নির্মম গণহত্যার শিকার হয় আলেমসমাজ। ঘুমন্ত ও ইবাদতরত আলেমদের উপর চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। আহত আর নিহতের সাগরে ভেষে যায় মতিঝিলের শাপলা চত্বর।
আমিও সেদিন ছিলাম সেই আহতদের কাতারের একজন। অবশ্য সামান্য আহত হয়েছিলাম।
একটা গুলতি হাতে রাস্তায় আছি। রাস্তায় অবিরত পুলিশের গুলি। কয়েকটি এলাকায় সারাদিন ধরেই পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলছে আমাদের। সন্ধ্যার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আলেম সমাজের অধিকাংশই চলে গেছেন শাপলা চত্বরের সমাবেশে যোগ দিতে। অল্প কিছু জন আছেন এখানে। পুলিশ একটু পর পরই গোলাগুলি করে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কোনঠাসা করে ফেলেছে সবাইকে। সন্ধ্যার পর সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশের নির্বচারে গুলি শুরু হলো। জনগণও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললো। তার পর আমাদের পক্ষে আসলো লম্বা (.............) রোড। দুই পাশে পুলিশ। আমরা বিদ্যুতের থাম ও লোহার দন্ডসমূহে বাড়ীয়ে বাড়ীয়ে আমাদের উপস্থিতি পুলিশকে জানান দিতে লাগলাম। পুলিশ গুলির সাথে ককটেল নিক্ষেপ করছে। আমরা দাঁড়াতে পারলাম না। আশেপাশের ময়লা, আবর্জনা, বাস, কাঠ, লাঠিসোচাতে ধরানো আগুন পুনরায় বৃদ্ধি করে টিয়ারগ্যাস থেকে বাচার উপায় বের করলাম।
পুলিশ কিছুক্ষন পর পর বিভিন্ন গলিতে এসে আমাদের উপর আক্রমন করে আমাদেরকে কোনঠানা করতে ব্যস্ত। রাত ১২ পর্যন্ত এভাবে সংঘর্ষ শেষে আমরাও শাপলা চত্বরের সমাবেশে যোগদান করলাম। ওখানে পৌছে এশার নামাজ আদায় করলাম।
ঘটনার কিছুক্ষণ আগে আমি শাপলা চত্ত্বরের নিকটস্থ সমাবেশের মঞ্চসহ বেশ খানিকটা যায়গায় ঘুরে আমার নির্ধারিত স্থানে ফিরে আসলাম। দেখলাম অনেকে সারাদিন হাটাহাটির পর ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছেন, অনেকে ইবাদত করছেন, জিকির আজকার করছেন, অনেকে নামায আদায় করছেন। অনেকে দলীয় ভাবে বসে পড়ে মঞ্চের বক্তব্য শোনায় মসগুল। লোকে লোকারন্য চরিদিক। মনে হচ্ছে গণজোয়ার আজ ঢাকাকে ভাসিয়ে দিয়েছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু মানুষের সমাগম।
ঘোরাফেরা শেষে ফিরে এলাম আমার নির্ধারিত স্থানে। সেখানে সাংগঠনিক ভাইগণ আছেন। এই রাস্তাটার দায়িত্ব ছিল আমাদের উপর। নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। হায়েনারা যেন এই ঘুমন্ত ও ক্লান্ত আলেমদের উপর কোন রকম পৈশাচিকতা না চালাতে পারে সে জন্য সাধ্যমত চেষ্টা। রাস্তায় ইট ফেলে বেরিকেট, বাস দিয়ে বেরিকেটসহ যেভাবে পারা যায়।
রাত ২টা বেজে ৩০ মিনিট বা তার কিছুক্ষণ পর। হঠায় দূর থেকে গোলাগুলির শব্দ। মিনিট খানিক বা তার কম সময়েই মনে হলো আমাদের এই গলির রাস্তা দিয়ে হায়েনারা আসছে..! আমরা প্রস্তুতী নিলাম যেকোন ভাবে তাদেরকে মোকাবেলা করতে হবে। আমিসহ অনেকে গুলতি হাতে, অনেকে লাঠিসোচা, ইটপাটকেল, বাশ ইত্যাদি আমাদের হাতিয়ার। মনে পড়লো আজ যেন আমরা তিতুমীরের সেই যোদ্ধা। বিশাল সজ্জিত বাহিনীর সামনে সামান্য ও সাধারণ অস্ত্র ও বুকভরা সাহস নিয়ে প্রতিরোধের দিপ্ত শপথে বলিয়ান।
মিনিট পার হতে পারলো না। আমাদের সামনে থেকে নয়, পিছন থেকে... অর্থাৎ মেইন রাস্তা থেকে আমাদের উপর গুলির বৃষ্টি শুরু হলো। আমাদের এই গলিটা যেখানে ছিল সেখানে মেইন রাস্তার উপর বাইরের দিকে প্রায় আধাকিলোমিটার পর্যন্ত লোকজন ঘুমাচ্ছে ও ইবাদত করছে আমি নিজে দেখে এসেছি। বুঝতে পালাম, কি হচ্ছে। মানুষ যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। সাথে সাথে আমার পাশে কয়েক ভাই গুলিতে আহত। আমার গায়ে ছড়ড়া গুলির আঘাতে ফুলে গেছে। সেদিকে সামান্যতম খেয়াল নেই। এর মধ্যে অন্যদিকে প্রতিরোধের চেষ্টা। কিন্তু সেদিক থেকেও গুলি ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। বুঝতে আর বাকী রইলো না যে, হায়েনারা চারিদিক থেকে আমাদের ভাইয়ের উপর হামলা করেছে। কোনদিকে যাওয়ার দিশা নেই। মানুষ বের হওয়ার কোন পথ পাচ্ছে না।
অবশেষে বিজয়নগরের দিকে কালভার্ট রোড থেকে পুলিশ সামনের দিকে এগিয়ে গেলে প্রাণ হাতে করে রাস্তায় বেরিয়ে আসলাম। সামনে যেন হত্যার তান্ডবলীলা চলছে। সে কি ভয়ানক...! আমরা কালভার্ট রোড হয়ে সেগুন বাগীচা হয়ে কাকরাইল অডিট ভবনের সামনে বের হলাম। বের হতে গিয়ে সামনে পুলিশ। পিছাবো সেখানেও পুলিশ। চাইলাম একটা বাড়ীতে আশ্রয় নিব। উঠলাম একটা প্রাচীর উপর বাড়ীটাতে ঢুকবো বলে। দারোয়ান ঢুকতে দিল না।
পুলিশের গাড়ী সাঁ সাঁ করে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়ীর গতি ভিন্নদিকে গেলে দ্রুত বের হলাম। কাকরাইল মোড়ে একটা রিকশা পেলাম। যেতে রাজী হলো না। এদিক ওদিক মানুষ ছোটাছুটি। এখানে আমরা কয়েকজন পৌছিয়েছি। অনেকে অনেকদিকে চলে গেছে। তখনো পুলিশের অবিরত গুলির আওয়াজ। মানুষের আর্তনাতে আকাশও যেন কাঁদতে শুরু করেছে। ভয়ের মধ্যেও সে কথা মনে হতে নিজের কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। নিজে যে সামান্য আহত সেটাও খেয়াল নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা পেলাম। বললাম মামা একটু পৌছে দাও। রিকশা ওয়ালাকে এ গলি ও গলি করে বাসায় পৌছলাম। বাসায় যখন পৌছলাম তখন ভোর ৫.১৫ মি.
পরদিন হত্যাযজ্ঞের সে ভয়াবহ চিত্র দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেন আল্লাহ তায়ালা আমাকেও ঐ শহীদি তালিকার একজন করে নিলেন না......!
ইয়া আল্লাহ...! সকল সকল শহীদভাইদের জান্নাতবাসী করুন....। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৩ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজ খুবই দূঃখ হয় যখন দেখি আকাবেরীনে হাযারাতদের সাম্প্রতিককালের ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্নবোধক কথাবার্তা শুনে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন