॥ আমার প্রিয় আব্বু ॥
লিখেছেন লিখেছেন স্বাধীন ভাষী ০১ মে, ২০১৪, ০৮:৫১:২৮ রাত
পৃথিবীর অন্যতম রাগী ব্যক্তি তালিকার একজন বলে আমার আব্বুকে আমি মনে করি। শক্ত একজন মানুষ।
শুনেছি কোন ব্যক্তি যত রাগী হন তত কোমলও হন। আমার আব্বুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে তার কোমলিয়তা অতুলনীয়।
ছাত্রজীবন থেকে রাগী ব্যক্তিটি মেধার দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালে অর্থাৎ পাকিস্তান আমল থাকা কালীন যশোর এম.এম কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। মোটামুটি জমিদার বংসের ছেলে। দাদা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের মেম্বর। আশেপাশে দু’এক উপজেলার মানুষ এক ডাকে চিনে, নাম ‘গনি মেম্বর’। দাদার ১ম পক্ষের বড় ছেলে মোঃ আব্দুর রহিম আমার আব্বু। এক কথায় পুরা বংশের বড়। এই দিক থেকে বললে রাগ থাকাটা অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১ম পক্ষে আমার আব্বুর আরো ২ টা ভাই ছিল। যার একজন কুকুরের কামড়ে মারা যান এবং অপরজন বিমান উড়ার শব্দে ভয় পেয়ে মারা যান। ঐ পক্ষে আব্বুর একমাত্র বোন অর্থাৎ আমার একটা ফুফু আছে। ফুফুকেও কখনো আব্বুর সম্মুখে রাগের ভয়ে ঠিক মত কথা বলতে দেখি নাই।
রাগের কথা যখন বলছি, তখন একটু বিস্তারিত বলি। আমার জন্মের পর থেকে আমি যতটুকু দেখে আসছি, আমার গ্রামে বা পরিচিত জনদের মধ্যে এমন রাগী মানুষ দ্বিতীয় কাউকে দেখি নাই। আমি ছোট বেলায় কোন বিষয়ে (পড়াশোনার বিষয়ে হোক বা অন্য কোন) টাকা-পয়সা বা যেকোন বিষয়ে কিছু দরকার হলে কখনো আব্বুকে বলবো এই সাহস আমার বা আমার ভাই-বোন কারো ছিল না। যদি কিছু লাগতো তবে আম্মুকে বলতাম। আম্মু আব্বুকে বলে ম্যানেজ করে দিতেন।
গ্রামের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তিত্ব আমার আব্বু। অবশ্য এ শ্রদ্ধা তার রাগের কারণে নয়, তার মেধার কারণে। আমার দাদার ২য় পক্ষ ছিল। অর্থাৎ ২ টা বিবাহ করেছিলেন তিনি। আমার আব্বুর আম্মু অর্থাৎ দাদার ১ম পক্ষকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। অবশ্য আমার দাদাকেও আমি দেখিনি। শুনেছি দাদি অনেক সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি ছিলেন। আর অনেক সম্পদশালীও ছিলেন। অবশ্য আমার দাদা উনার সম্পত্তিতেই জমিদার হতে পেরেছিলেন। দূর্ভাগ্যবসত তাড়াতাড়ি দাদী মারা যান।
সে সময়ে আমার আব্বুদের অনেক জমিজমা ও গরু মহিস ছিল। গ্রামের রাখালেরা পালে পালে গরু চরাতে মাঠে নিয়ে যেত। গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান প্রবাদটিতে যে প্রতিচ্ছবি বোঝানো হয় তার প্রতিটিই বিদ্যমান ছিল তখন আমাদের। এলাকার সমাজকল্যাণমূলক সকল কাজের জমি-জমা দান থেকে শুরু করে মসজিদ, বিদ্যালয়, ঈদগাহ, গোরস্থান ইতাদির সকল জমি এই পরিবারেরই দান।
আমার আব্বু ছাত্রজীবন থেকেই মেধার দিক থেকে একটু আলাদা ধরণের প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। জমি জমা চাষের জন্য লাঙ্গল ব্যবহার আদী কাল থেকে চলে আসছে। কিন্তু এত অধিক জমি চাষে সুবিধার ক্ষেত্রে আমার দাদারা একটা পুরাতন ট্রাক্টর কেনেন। তখন ট্রাক্টরের প্রচলন ছিল একদম চোখে না পড়ার মত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটা মানুষের কাছে আমাবস্যার চাদের মত ছিল। কিন্তু ট্রাক্টরটি পুরাতন হওয়ায় কয়েক দিন পর পরই নষ্ট হতো। শহর থেকে বড় মেকানিক নিয়ে আসা হতো সেটা মেরামত করার জন্য। মেকানিক সামান্য কি একটু আধটু কাজ করে দিয়েই কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে যেত। যেহেতু গ্রামে তখন মেকানিক পাওয়া যেত না সুতরাং এটা নিয়ে কৈফিয়ত নেয়ারও কেউ ছিল না। আমার আব্বু ছোটবেলা থেকে মেকানিকের এই মেরামত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনযোগের সাথে প্রত্যক্ষ করতেন। কয়েক মাস যাওয়ার পর তিনি আর মেকানিক আনতে দিতেন না। পরবর্তীতে নিজেই মেরামত করতেন। মাত্র কয়েকদিনের দেখায় এ কাজ তিনি এমনভাবে আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন যা আজও গ্রামের দক্ষ টেকনিশিয়ান হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে।
আমার আব্বু একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আমার আব্বু একটা গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন। আব্বুর অধীনে ২০০ জন যোদ্ধা ছিলেন। যদিও যুদ্ধের ঘটনা খুব একটা বলতে চান না তার পরও বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের যে সব বাস্তব কাহিনী শুনেছি তাতে অপারেশনের সেই ভয়াবহ মুহূর্তগুলো মনে হলেই গা শিউরে উঠে। আব্বু টেকনিশিয়ানে দক্ষ হওয়ায় যুদ্ধে অনেক ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক বড় ভারী অস্ত্র ছিল মেশিনগান। যেটার ওজনই ছিল ২৮ কেজি ! চাকাযুক্ত এ মেশিনটি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে আব্বুর হস্তগত হয়। হানাদার বাহিনীর এক ক্যাম্প আক্রমনের মাধ্যমে লব্ধ এ মেশিন। আব্বু যুদ্ধের সময় সর্বদা সাথে লুঙ্গির দু’পাশে দুটি গ্রেনেড ও সাথে একটি হালকা অস্ত্র রাখতেন। এমনকি সে সময়ে সাধারণ চলাচলের সময়ও রাখতেন।
আমার আব্বুর পেশায় বর্তমানে তেমন কিছুই করেন না। পরিবার দেখাশুনার পাশাপাশি তার পেশা হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব বলা যায়। যদিও আন্দোলনটা পেশা নয়। কারণ এটাতে কখনো কোন আয় বা অর্থ লাভ আমার আব্বুর দ্বারা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে পেশা বলছি এ জন্যই যে, ইসলামী আন্দোলনে সময় দিতে গিয়ে নিজের পরিবারের সম্পর্কে কর্তব্যও অনেক সময় ভুলে যান তিনি। তবে আমার আব্বুর বিশেষত্ব তিনি অন্যের অধীনে থাকতে পছন্দ করেন না। জীবনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকেছেন। কিন্তু ঐ যে, কোন দিন কারোর অধিনস্ত থাকা পছন্দ না করার দরুন কোনটাই স্থায়ীভাবে করেন নি।
পরবর্তীতে গার্ডিয়ান হিসেবে বিদ্যালয়ের সভাপতিত্বসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত থেকেছেন এবং আছেন। তবে ইসলামী আন্দোলন করা তার ছাত্রজীবনের নেশা বলা যায়। কলেজ জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ডে তার সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও বলিষ্ট ভূমিকা যখন লোকমুখে শুনতে পাই তখন নিজদেরকেও অনুপ্রাণীত করে।
এলাকাবসীর মুখে আব্বুর নামে অনেক গল্পও শুনেছি। সেগুলোর মধ্যে অনেক গল্প আমার কাছে গালগল্প মনে হতো। এরমধ্যে সত্যের পরিমাণ ছিল বেশী। কারণ তার বিরুদ্ধে গালগল্প করতে সচারচর কেউ সাহস করত না। আব্বুর কাছেও সেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারতাম না ভয়ে। যেটুকু শুনেছি বিভিন্ন কাকুর সাথে গল্প করা কালে বা বিশেষ জনের মাধ্যমে আবদার করিয়ে।
এ পর্যন্ত যা বললাম তার শেষ করাটা কঠিন। এগুলো শেষ করতে চাইলে কতক্ষন লাগবে বলা মুসকিল। তবে আমার মনে হয় বোঝাতে পেরেছি তিনি তকটা শক্ত মানুষ।
এবার তার কোমলীয়তা সম্পর্কে কয়েকটা তুচ্ছ ঘটনা তুলে ধরব।
আমার আব্বুকে এলাকার মানুষ খুব ভালোবাসে। শত্রু বলতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছাড়া তেমন কেউ নেই। তাও আবার সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এলাকার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি গ্রামের কোন সমস্যার ফায়সালা, মিমাংসা ইত্যাদিতে তাকে সম্মানের স্থানে সকলেই অধিষ্ঠিত করেছেন। আব্বুর অসুস্থতার খবর ছোটবেলায় সামান্য একটু মাথাব্যাথা ছাড়া ছোখে পড়তো না। তবে একবার তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। সেটা বোধহয় আমার জন্মের পূর্বের কথা। তার মারাত্মক অসুস্থতাতে গ্রামের মানুষের মাঝে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। তবে তার চেয়েও ভয়ানক যেটা ঘটেছিল সেটা আমাকে নিয়ে।
আমার আব্বু ও কাকুদের অনেক পুকুর আছে। তার মধ্যে একবার শ্রমিকগণ পুকুর খনন করছিল। সে সময়টা ছিল শীতকাল। খেজুর গাছে খেজুর পেকে আছে। সকাল ৯টার দিকে আমিসহ আমার পাড়াতো ৪ বন্ধু গেলাম পুকুর পাড়ে। খেজুর গাছ দেখে ইচ্ছা হলো খেজুর খাব। আমি ছোট বেলা থেকেই অনেক নরম সভাবের। বিশেষ করে ছোটবেলায় যে ধরণের ছিলাম তা বললে হয়তো হাসি পাবে। তবে ভীষণ জেদী। বলা যায় অনেকটা আব্বুর ধাচের। যাহোক আমি খুব একটা গাছে উঠতে পারতাম না। আমাদের ৪ জনের মধ্যে ১ জন গাছে উঠেছে খেজুর পাড়তে। ও ছিল একটু বেশী পাজি এবং আমাকে জ্বালাতন করতে খুব পছন্দ করতো। গাছে উঠে ঘোষণা দিল আমি গাছে না উঠলে আমাকে খেজুর খেতে দেয়া হবে না। আমার জেদ চেপে গেলো। পুকুরের অপর পাশে আব্বুর উপস্থিতি। বুঝতে পারছিলাম না কি করব। তার পরও আব্বুর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক কষ্টে খেজুর গাছে উঠলাম। আমি যখন উঠলাম তখন এক খেজুর গাছে একসাথে ৩ জন হয়ে গেছি। একজন নীচে আছে। আমি একটা খেজুরের কান্দি ধরে ঝাকি দিচ্ছি। এমতাবস্থায় ওই বন্ধুটা যে আমাকে গাছে উঠার জন্য উদ্ভুদ্ধ করেছে সে আমার ধরে রাখা ওই কান্দিটা ধরে টান দেয়। সাথে সাথে কান্দি ছিড়ে আমি একদম নীচে !
নীচে ছিল এবরো থেবরো করে রাখা ইটের স্তুপ। উপুর হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম ইটের উপর। দাত ও মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের দু’একজন আমাকে দেখে দ্রুত সেখান থেকে উদ্ধার করে আব্বু যেদিকে আছে তার উল্টা দিকে বসিয়ে রেখেছে। মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। কয়েক মিনিট হয়ে গেলেও আব্বুর কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। কিছুক্ষণ পর কি মনে করে আব্বু আমাকে লক্ষ্য করে এবং জানতে পেরে আমার কাছে দৌঁড়ে ছুটে আসে। আমার অবস্থা দেখেতো আব্বুর তো বেহুঁশ অবস্থা। আব্বুকে এতক্ষণ না জানানোতে শ্রমিকদের উপর আব্বু মারাত্মক ক্ষেপে যায়। সেখান আব্বু আমাকে পাজাকোলা করে নিয়ে আসে বাড়ীতে। আমার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সামনের ২/৩ টা দান উল্টে উপরের দিকে ঢুকে গিয়েছিল। মুখমন্ডল হয়ে গিয়েছিল বিভৎষ। সে অবস্থায় আমাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি কাতরাতে থাকি। আমার মুখ-হাত সম্পূর্ণ অবস হয়ে গেছে। ৭ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়িতে আসি।
বাড়ীতে এসে শুনতে পারি সেই ভয়াবহ কাহিনী। আমাকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে গাড়ী উঠিয়ে দিয়ে আব্বু অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আব্বুর অবস্থা ছিল আমার থেকেও ভয়াবহ। চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমার ভয়াবহ অবস্থা দেখে এমন শক্ত মানুষটি এত পরিমাণে ঘাবড়ে গিয়েছিল যে তাকে বাঁচানো কষ্ট হয়ে পড়ছিল। অবশেষে আমার থেকে চিকিৎসার পরিমাণটা আব্বুকে বেশী দিতে হয়েছিল বলে জানতে পারি। অবশ্য তার পরে আমাকে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
এর পর যখনই মনে হয়, ভাবতে থাকি- পিতা-মাতা সন্তাদেরকে কত ভালোবাসেন ! আমার আব্বুর মত এমন শক্ত মানুষ যেখানে এভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল সেখানে যাদের হার্ড দুর্বল তারা কি করবেন! এর পর অবশ্য আমার আব্বুকে আরো একটা মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে। যার কষ্ট আব্বুকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আমার আব্বু জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করলেও তিনি কোরআন হাদীস ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনে অনেক ওয়াকিভাল। এ দিক থেকেও তার দক্ষতা একজন আলেম বা মুহাদ্দিসের সমতূল্য। তিনি মানুষকে সহজে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য “ফি তারিকী ইসলাম বা ইসলামের জীবন আদর্শ” নামে একটা বই প্রকাশ করেছে। এছাড়া অপ্রকাশিক কয়েকটা বই লেখা রয়েছে উনার। আব্বু বিভিন্ন তাফসীর মাহফীলে আলেমদের কাতারে বসে তাফসীর পেশ করতেন।
একবার এক তাফসীর মাহফীলে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখে গভীর রাতে একা একা বাড়ীতে ফিরছিলেন। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন বিধায় সর্বদা যত রাতই হোক না কেন, একা একাই বাড়ীতে ফিরতেন। ৭০/৮০ দশকে নকশাল বলে এক সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপট ছিলো আমাদের এলাকায়। কিন্তু তারা কখনো আব্বুর সামনে এসে তাদের দাপট দেখানোর সাহস করেনি। বরং রাস্তাঘাটে এমনকি গভীর রাত্রে দেখা হলেও সালাম দিয়ে ভালো মন্দো জিজ্ঞেস করে দোয়া চেয়েছে তারা। হুমকীর পরিবর্তে বলেছে, ভাই কোন সমস্যা হলে বলবেন। কিন্তু এদিন এধরণের কোন বিপদ নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় রাস্তার মধ্যে ছোট্ট ইটের টুকরাতে মটরসাইকেল পিছলে গিয়ে আব্বু পড়ে যান মটরসাইকেল থেকে। দুর্ভাগ্যবসত মটরসাইকেলটিও অবশেষে পড়ে আব্বুর পায়ের উপর। বেকায়দাভাবে পড়ায় এবং মটরসাইকেলটি আব্বুর পায়ের উপর পড়ায় আব্বুর পায়ের দুইটা হাড়ই ভেঙ্গে ৪ খন্ড হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষন আব্বু পড়ে থাকেন রাস্তায়। ফোন করার অবস্থাও ছিল না উনার। স্থানীয়রা আব্বুকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ কয়েকমাস চিকিৎসা শেষে আল্লাহর রহমতে মোটামুটিভাবে সুস্থ হন। বর্তমানে এ অবস্থায়ই দিনানিপাত করছিলেন।
আব্বু আমাদের উপজেলার ইসলামী আন্দোলনের একজন দায়িত্বশীল। বর্তমান সরকারের প্রতিহিংসা পরায়ন রাজনীতির কারণে কয়েকবার ছোটখাটো হয়রাণীর মুখোমুখি হতে হয় আমার আব্বুকে। দীর্ঘদিন বাড়ীতে থাকতে পারেন না। আমরাও বাড়ীতে থাকতে না পারায় মাঠ-ঘাট, চাষ-আবাদ একরকম পরিত্যাক্ত প্রায়। আমার আম্মু, ছোটবোন, ছোটভাই বাড়ীতে সারাক্ষন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় সময় পার করছিলেন। এর মধ্যে আব্বু সময় সুযোগ করে বাড়ীতে মাঝে মাঝে দেখা করে যেতেন। ইতিমধ্যে বিশাল ফোর্সসহ ৪/৫ দফা হামলা চালানো হয়েছে আমার আব্বুকে গ্রেফতার করার জন্য। নির্বাচনের আগের রাতে আব্বুকে না পেয়ে ঘরের দরজা ভেঙ্গে আমার ছোট্ট ভাইটাকে নিয়ে যায় হায়েনারা। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা ছোট ভাইকে টাকা পয়সার মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনা হয়। উপযুক্ত বয়সের হলে হয়তো আমার ছোট্টভাইটাও আমার মায়ের বুকে ফিরে আসতো কিনা সন্দেহাতিত ছিলাম! কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না। এরা শিশুদেরকেও ছাড় দিতে রাজী নয়! এটা কেমন দেশ! আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে এরা কারা, যারা জনগণের নিরাপত্তা দেবার ওয়াদা করে গায়ে জনগণের ট্রাক্সের টাকার পোশাক পড়েছে !
সম্প্রতি আদালত থেকে সকল মামলায় জামিন নিয়ে বাড়ীতে ফিরে আসেন আব্বু। কিন্তু আবারো হয়রাণীর আশঙ্কায় বাড়ীতে থাকতেন না।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, গত ২১ এপ্রিল আমার আব্বু রাত ১ টার পর বাড়ীতে উপস্থিত হন। কিন্তু পিলে চমকে দেয়ার মত রাত ২ টা বেজে ৩০ মিনিট। পুলিশের ৭ টি গাড়ী বাড়ীতে উপস্থিত। বাড়ীর চারিদিকে ঘেরাও করা হয়। আমার আব্বুকে টেনে হেচড়ে বাড়ী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। একজোড়া স্যান্ডেলও পরার সময় দেয়া হয়নি। আমার আম্মুর শত আকুতি মিনতি তাদের কাছে হাওয়ার মত বিলিন হয়ে গেছে!
আব্বুকে নিয়ে চরম শঙ্কায় আছি। আমাদের এলাকায় নির্মমভাবে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে নির্যাতন ও হত্যা করা হচ্ছে ! সকলের কাছে দোয়া চাচ্ছি, আমার আব্বু যেন সুস্থভাবে আবারো আমাদের ফিরে আসেন। আবারো দ্বীনের খেদমত করার সুযোগ পান।
এরকম শত ঘটনা রয়েছে বলতে গেলে দিন পার হয়ে যাবে। সবশেষে আবারো মহান রাব্বুল আলামীর কাছে কামনা-
ইয়া রাব্বুল আলামীন বাংলাদেশকে তুমি জালিমের হাত থেকে রক্ষা করো। এই পবিত্র জমিনে তোমার দ্বীনের আলো জ্বালানোর কাজে যারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তাদেরকে তুমি শহীদ হিসেবে কবুল করে নাও। নির্যাতনের শিকার সকল দ্বীনপ্রেমি মানুষদেরকে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরিয়ে দাও। আমীন।
বিষয়: Contest_father
২১৪০ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধর্য হারাবেন না, আল্লাহ পিয়ারা বান্দার উপর পরিক্ষা একটু বেশীই নেন।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
মন্তব্য করতে লগইন করুন