একটি ভালোবাসা এবং শিক্ষকের নির্লজ্জতা (সত্য ঘটনা)
লিখেছেন লিখেছেন স্বাধীন ভাষী ২১ জুলাই, ২০১৩, ০১:৫৭:১০ দুপুর
--এই রাফি তুমি কি আমাকে চিনো?
ক্যাবলার মত কিছুক্ষন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । আজই প্রথমদিন কলেজে আসলাম আর বলে কি এই মেয়ে !!!
একটু আমতা আমতা করে বললামঃ
--নাতো ! কিভাবে চিনবো ? কিন্তু তুমি আমার নাম জানলা কিভাবে?
--আমি তানিয়া ,আর জানলাম কিভাবে ! তুমিই একমাত্র ছাত্র যে এ প্লাস পেয়ে এই ভাঙ্গাচূড়া প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হয়েছ। এই কারনেই টিচাররা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ !!
--ওহ আচ্ছা
তানিয়ার কথা শুনে একটু হাসি পেল,টেকনিক্যালে পরীক্ষা দিয়ে টিকতে পারিনি ,সেই সময়টাতে অন্য সব কলেজের ভর্তির তারিখ ওভার হয়ে গেছে ,ভর্তির টাকায় কিঞ্চিত ছাড় পাওয়া যাবে এইসব মুখ্য কারনেই বাবা মাকে ছেড়ে এই শহরে এখানে ভর্তি হওয়া ।
মামার বাসায় থেকে লেখাপড়া করতে হবে,সবকিছু মিলিয়ে ঘুরপাক খেতে লাচ্ছিলাম । মামা ছোট বেলা থেকে খুব আদর করতেন,তাছাড়া তানিয়ার মত একটা বন্ধু পেয়ে সহজেই সবকিছু সামলে নিলাম ।
সাহায্যকারী যন্ত্রের মত এই তানিয়া নামের মেয়েটা সবসময়ই আমার পাশে থাকত ।কোথায় কার কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে,কোনটা ভাল কোন মন্দ সবকিছুই ওর সাথে আলোচনা করে করতাম ।ফারুক স্যার আমাদের ইংরজী প্রাইভেট পড়াতেন,তানিয়ার পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারনে ওকে স্যার ফ্রি পড়াতেন,স্যারকে এই কারনে কলেজের সব স্যারের থেকে বেশিভাল লাগত।
শুধুমাত্র বন্ধু থেকে অল্প দিনেই বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম দুজন দুজনার,সম্পর্কটা তুমি থেকে তুইতে রূপান্তরিত হল । বন্ধুমহলে আমাদের একটা নাম ছিল জোড়া ঘুঘু ,নামটার পিছনে রয়েছে অন্য একটা কাহিনী ,সেটা না হয় আমার মাঝেই থাক ।
কলেজ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হল ,এ ব্যাপারে আমরা ফ্রেন্ডরা আগে থেকেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম ।কিন্তু আমি বেলালুম তা ভুলে গেলাম ।
তানিয়া পিছন থেকে এসে বললঃ
--এই রাফি কলেজ পিকনিকে যাবি না ?
--হমম যাব ,তুই গেলে
--আরে ছাগল আমিতো যাবই ,কিন্তু ঐ যে ঐ ব্যাপারটা বলছিলাম না?ঐটা কতদূর কি করলি ?
--কোনটা ? ঠিক করে বল
--আরে ঐযে ঐটা
--কিছুই বুঝলাম না ,ঐ তুই যা এখান থেকে,মেজাজ গরম করিস না
তানিয়া আমার পেটের ভেতর একটা ঘুষি মেরে বললঃ
--এই ব্যাটা মুখ সামলে কথা বল ,আমাদের তুই দিনাজপুর নিয়ে যাবি বলছিলি না ? একটা সুযোগ তো পাওয়া গেলো নাকি বল ?
--ওরে দাড়া এইবার মনে পরছে
--কিরে ঘটনা কি ? বিলাই উপস সরি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র সবকিছু ভুলে যাচ্ছে ,মনটা কাউরে দিয়া দিলি নাকি ?
--একটু মুখ বাকিয়ে বললাম
তুই জানিসনা ! কবে থেকেই তোকে মন দিয়ে বসে আছি
--লাথি দিব শয়তান ,যা প্রিন্সিপালকে রাজি করা
প্রিন্সিপাল স্যারকে অনেক রিকয়েস্ট করে রাজি করিয়ে পিকনিক স্পট ঠিক করলাম দিনাজপুরের রামসাগরে ।
হৈ হুল্লোড় করলাম,অনেক ছবি তুললাম,বিশাল বড় দিঘীর পারে ঘুরে বেড়ালাম,রামসাগর যে একটা সাগর না সেটাও জানলাম । এই বড় দিঘীর পেছনের কাহিনীটা পড়ে একটু আজগুবি লাগল ।দিঘীর ঘাটে ইচ্ছা মত ডুবিয়ে গোসল করলাম,সেখানেও বিপদ ছিল ।আমাদের গোসল করার দৃশ্য কেউএকজন ক্যামেরা বন্ধী করে রেখেছিল ।
পিকনিক শেষ করে ফেরার পথে তানিয়া আমারদিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
--আমারে তো পাত্তাই দিলি না আজকে
--তুইতো রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলি ,অতগুলো মেয়েদের মাঝে তোর সাথে কথা বলতে গেলে সবাই ভাবত কিছু একটা,হাহা হা
--হারামী কিছু একটা কি ?হিমমম,আমি তোরে অভিশাপ দিছি ,ওপর ওয়ালা তোকে শাস্তি দিলে কিছু করার নেই ।
--শকুনের দোয়ায় গরু মরে না
জবাবে খালি একটু মুচকি হাসি দিলো রহস্য মানবীর মত ।
পরদিন কলেজে গিয়ে যা দেখলাম বিভত্ষ্য অবস্থা ,ক্লাসের সারা দেয়ালে আমাদের গোসল করার ছবিগুলো লাগানো ।
নিচে লেখাঃ
Photo Courtsy: Tania Ahmed
মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেল ,ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম ।
একগাল হেসে বললঃ
--সবই ওনার শাস্তি ,আমার কিছু করার নেই
মেজাজটা অতিরিক্ত গরম ছিল ,সামলাতে নাপেরে ঠাস করে এক থাপ্পর লাগিয়ে দিলাম ।তানিয়া কিছু বলল না ,ওর চোখদুটো ছলছল করে উঠল । যথাসম্ভব এক টুকরো মলিন হাসি দিতে চেষ্টা করেছিল,তারপর চলে গেলো ।
কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলাম কলেজের বারান্দায়,নিজেকে খুব ধিক্কার দিচ্ছিলাম ,মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল । আমি যে অন্যায়টা ওর সাথে করেছিলাম তার জবাবে ওর সেই মলিন হাসিটা আমার আমিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ।
সেদিন ওর প্রতি একটা আলাদা টান অনুভবকরি ,বুজতে পারি এই মেয়টা আমার জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ।
ঐদিনই কলেজে শীতকালীন ছুটি দিল,বাসায় এসে বহুবার ফোনে চেষ্টা করেও কোন সারাশব্দ না পেয়ে বেশ হতাশ হলাম ।
এদিকে আমার মামাতো বোনের প্রথম জন্মদিনে ওকে দাওয়াত দিতে হবে ,বাসাও চিনিনা,বন্ধু বান্ধব গুলার কাছ থেকেও কোন খবর নাই ।
কলেজ খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় খুঁজে পেলাম না ,বলতে বলতে ছোট বোন তুর্নার বার্থডে চলে আসল ।
দিনটি শুক্রবার ছিল,আমি ঘর দোর সাজানোতে ব্যস্ত ,তানুর জন্য মনটা কেমন জানি করছে ।
এমন সময় ফারুক স্যার আমাকে ফোন দিয়ে তানিয়ার কথা জানতে চাইলে আমি বললাম,
--জানিনা স্যার
স্যার একটু দুষ্টামি করে বললেনঃ
--কিরে ব্যাটা মন খারাপ হচ্ছে তানিয়ার জন্য ? মন খারাপ করিস না রাফি ।
একটু লজ্জা পেলাম বটে কিন্তু স্যারের কথাটা শুনে ভালই লাগল।
কয়েকদিন পর তানিয়া আমাকে ফোন দিলো,ফোনটা ধরলাম ।
অনেকক্ষন দুজন চুপচাপ,ওপাশ থেকে তানিয়া বললঃ
--রাফি আমাদের কলেজের পাশে যে বড় মাঠ আছে ওখানে আসতে পারবি ?
ওর কন্ঠটা কেমন যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা লাগছিল,মনে হচ্ছিল অনেক কষ্টে আছে তানিয়া । কত কিছু বলব ভেবে রেখেছিলাম,কিন্তু বলতে পারলাম না ,শুধু ঠান্ডা গলায় বললামঃ
--আসতেছি
একবার জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম ,শূন্য মেঘহীন আকাশ ,রোদের আলো অনেকটা ম্লান ,এমন একটা দিনে যদি ওর হাতটা ধরে বলি ভালবাসি !! জানি ও আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না ।
টব থেকে কয়েকটি লাল গোলাপ তুলে নিয়ে কলেজ মাঠের দিকে পা বাড়ালাম ।
পড়ন্ত বিকেল ,মাঠের এক কোনে একটি বটগাছের ছায়াতে বসলাম ।
একটু পরেই দেখলাম তানিয়া ধীর পায়ে হেটে আসছে ।বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করতেশুরু করল ,চিরচেনা বন্ধুটির দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাচ্ছিলাম না ।ওকে আসতে দেখে ফুলগুলো পিছনে লুকিয়ে ফেললাম।
একবার আড়চোখে তাকালাম ওর দিকে,ওর নীল মায়াবী চোখের নিচে কালি পরে গেছে,চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো ,ঠোটের কোনায় একটুখানি রক্তের মত কি যেন !! কেনো জানি ওর প্রতি বরাবরের চেয়ে একটু বেশিমায়া হচ্ছিল ।মেয়েটা আমার সাথে অভিমান করে কি হাল করেছে নিজের !!
উদ্বিগ্ন হয়ে ওকে প্রশ্ন করলামঃ
--কিরে তানু তোর এ অবস্থা কেনো ?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলঃ
--একটা কথা দিবি ?
আমি মাথা নিচু করে বললাম
--হমম দিব,তোকে আমি কিছু কথা বলতে চাই তানু !!
--আগে আমাকে বলতে দে!!
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও বলা শুরু করলঃ
--দিনটা ছিল শুক্রবার ,ফারুক স্যার আমাকে ফোন দিয়ে কলেজে যেতে বলল । উনি বলেছিলেন একটা শীট আনতে যেতে ,স্যার আমার বাবার মত ।পুরো কলেজে আমি আর ফারুক স্যার ছাড়া অন্য কোন প্রানী ছিলনা ।
স্যারকে অনেক অনুরোধ করেছি ,স্যারের পায়ে ধরেছি ,বাবা বলে ডেকেছি তবু ওনার হিংস্রতার হাত থেকে আমি পারিনি নিজের নারীসত্বাকে রক্ষা করতে,পারিনি তোর তানুর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদটুকু টিকিয়ে রাখতে ।
আমি জানি তুই কি বলতে চাস,জানি এ ঘটনা শোনার পরেও তুই আমাকে তোর করে চাইবি। তুই আমাকে ভালবাসিস ,কথা দিয়েছিস কথা রাখবি। কথা দে আমার সামনে কোনদিন ভালবাসার দাবি নিয়ে দাড়াবি না,একজন বন্ধু হয়ে থাকবি আমার পাশে সারা জীবন !!
ওর চোখেমুখে করুন আকুতি,চিবুক বেয়ে টুপ করে কয়েক ফোটা জল আমার হাতের উপর পরল ।
চুপসে গেলাম আমি । গোলাপগুলো শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম , কখন যে হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে খেয়াল করিনি ,চোখে দিয়ে নোনা মতন কিছু একটা পড়ছিল । তানিয়ার দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলাম ,ওকে কিছু বলতে চাই আমি কিন্তু সেই চলার পথের গতি ও কেন মন্থর করে দিল ??তানিয়ার হাতটা ধরে বললামঃ
--তানু ,তুই এত নিষ্ঠুর কেনো ?
ও করুন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললঃ
--কিরে গোলাপ গুলো আমাকে দিবি না ?? বন্ধুকে বুঝি বন্ধু গোলাপ দেয়না ?
ওর হাতে রক্তফোটা গোলাপ গুলো তুলে দিলাম ।
তানিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে হাইমাউ করে কেঁদে উঠল ।
আমার চোখের বৃষ্টিতে ওর চুলগুলো ভিজে যাচ্ছে। সান্তনা দেওয়া নিস্প্রোয়জন ।কারন এখানে সান্তনা শুধুমাত্র গতানুগতিকতা ,বন্ধুত্ত্বের মাঝে গতানুগতিকতার কোন স্থান নেই ।
লেখকের কথাঃ
আমাদের সমাজ সংসার আজ এতটাই নিচে নেমে গেছে । তানিয়ার মত অনেক মেয়েকেই হতে হয় এরকম শারিরীক নির্যাতনের শিকার । ভেঙ্গে যায় অনেক রাফি ,তানিয়ার স্বপ্নের ঘর। রাফি হয়ত তানিয়াকে এখনও চায় ,কিন্তু তানিয়া নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে অনেক দূরে । পৃথিবী থেকে আড়াল করে ফেলেছে নিজেকে ,আর কত মেয়েকে ধর্ষনের কারনে পৃথিবী থেকে আড়াল হয়ে যেতে হবে জানা নেই,জানতে চাই ও না ।শুধু চাই এই অত্যাচার বন্ধ হোক ।
ঘটনার সত্যতাঃ এই ঘটনাটি ২০১০ এর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিকুঞ্জ মডেল কলেজে ঘটেছিল । গোপনীয়তা রক্ষার্থে ছেলেটি এবং মেয়েটির আসল পরিচয় গোপন করা হয়েছে
বিষয়: বিবিধ
২৮৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন