আওয়ামী লীগের সংশোধনের ১১ উপায় ডক্টর তুহিন মালিক
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার খুদে মানুষ ১৯ জুলাই, ২০১৩, ০৭:৫১:২৭ সন্ধ্যা
আওয়ামী লীগের সংশোধনের ১১ উপায়
ডক্টর তুহিন মালিক
প্রচণ্ড গণক্ষোভের স্রোতের মুখে পড়েছে ডুবন্ত নৌকা।আওয়ামী লীগের সংশোধনের ১১ উপায়
একে একে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও চার সিটি নির্বাচনে হেরে এবার গাজীপুরে এসে ডুবু ডুবু মহাজোটের নৌকা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি আর দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ বলে খ্যাত গাজীপুরেও শোচনীয় পরাজয়ে হোয়াইট ওয়াশ হয়ে গেছে মহাজোট সরকার। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও অনেকে এই পরাজয়কে জনগণের ক্ষোভের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। কিন্তু জনগণের ক্ষোভ কী কারণে এত নিষ্ঠুর হলো তা অনুধাবন কি ক্ষমতাসীনরা করতে পারবে? দলের মধ্যে কি তারা এ প্রশ্ন তুলতে পারবে, হাইভোল্টেজ নির্বাচনে হাইব্রিডরা হারল কেন? হেফাজতকে রাজাকার বলে তাদের কাছে আবার ভোট চাইতে হলো কেন? শাহবাগীদের কাছে কেউ ভোট চাইতে গেল না কেন? এরশাদের ঘোষণার পরও জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ১৮ জোটের পক্ষে কাজ করল কেন?
ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে_ একের পর এক নানা কেলেঙ্কারি, দলের নেতা-এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে না নেওয়ার একগুঁয়েমি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একতরফাভাবে বাতিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম অবমাননাকারীদের শাস্তি না দেওয়ার ব্যর্থতা, ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে কোনো আইন না করা, এই দাবি উত্থাপনকারীদের রাজাকার-পাকিস্তানি বলে কটাক্ষ করা, আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, রাতের অন্ধকারে হামলা এবং তাদের রক্তকে রং বলে বিদ্রূপ করা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলা-নির্যাতন, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলার কোনো বিচার না করা, শেয়ারবাজার-হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অহেতুক যুদ্ধ ঘোষণা, ড. ইউনূসকে অসম্মানজনক হয়রানি, রেলের কালো বিড়াল এবং সেই বিড়ালের দুর্নীতি, হত্যা-সন্ত্রাস-গুম-আইনশৃঙ্খলার অবনতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণসহ সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতায় জনমনে সঞ্চারিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে।
তা ছাড়া মন্ত্রীর মুখের কথায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন, ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর খারাপ নজির সরকারকে জনবিরুদ্ধে নিয়ে গেছে। বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় লাথি মেরে ভেঙে নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৫১ হাজারেরও বেশি মামলা করে আট লক্ষাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করাকে জনগণ সরকারের স্বৈরাচারিত্ব হিসেবে দেখেছে। অপরদিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি আর প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, বিশ্বজিতের প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজির গুলিতে নিহত আট বছরের মাদরাসা ছাত্রের হত্যা মানুষকে উত্তেজিত করেছে বহুলাংশে। এ সবকিছুই সাধারণ জনগণ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। সরকারের ব্যর্থতার তালিকা তো আরও অনেক দীর্ঘ। মানুষ জানেও এগুলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বৃহৎ এ দলটি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন আওয়ামী লীগ কি নিজের ভুল স্বীকার করে তা শোধরানোর ব্যবস্থা করবে? আত্দঅহমিকা, দাম্ভিক, বেপরোয়া এই দলটির দ্রুত ফলনশীল হাইব্রিড নেতারা, নৌকার ঘাড়ে চড়ে বসা ধর্মবিদ্বেষী নষ্ট বামরা, আর সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজরা কি বঙ্গবন্ধু কন্যাকে তার রঙিন চশমা খুলে নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে দেখতে দেবেন? তেমনটি হলে এটি শুধু আওয়ামী লীগের একার জন্য নয়, বরং লাখো শহীদের আত্দত্যাগের স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও বিজয় হবে নিশ্চিতভাবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কোনো কিছুই একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায় না কখনো। প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতেও শক্ত হাতে হাল ধরলে তীরে পেঁৗছানো সম্ভব হয়। তবে তার জন্য প্রয়োজন হয় আত্দোপলব্ধি আর ভুলকে শুধরে নিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তোলার অপরিমেয় ইচ্ছাশক্তি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, অতি দাম্ভিক অহমিকায় ভরপুর আওয়ামী লীগ নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করবে কিনা? একটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। নিচের ১১টি সুপারিশ তারা বিবেচনায় আনবে কিনা? নাকি এগুলো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অবজ্ঞা করবে?
১. গ্রামীণ ব্যাংক ১৯ টুকরা না করে ও ৮৪ লাখ নারীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করে বরং সরকার কি গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়াতে পারবে? ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আর হেনস্তা-অসম্মান না করে প্রধানমন্ত্রী তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিনন্দন ও সম্মান জানাতে পারবেন কিনা?
২. শাপলা চত্বরে অভিযানের বিষয়ে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করে দায়ীদের দ্রুত শাস্তি দিতে পারবেন কিনা? আল্লাহ-রাসূলের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর আইন পাস করতে পারবেন কিনা? চিহ্নিত অবমাননাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারবেন কিনা?
৩. শেয়ারবাজারের সর্বস্বান্ত ৩৩ লাখ পরিবারকে তাদের সহায়-সম্বল ফিরিয়ে দিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারবেন কিনা?
৩. পদ্মা কেলেঙ্কারির নায়কদের পরিচয় প্রকাশ করে তাদের বিচার করতে পারবেন কিনা?
৪. ডেসটিনির ২০ লাখ গ্রাহকের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবেন কিনা?
৫. হলমার্কসহ সব আর্থিক খাতের লুটপাটের বিচার করে লুণ্ঠিত টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনবেন কিনা?
৬. দলের হাইব্রিড নেতা ও নষ্ট বামদের সরিয়ে ত্যাগী-যোগ্য নেতাদের সসম্মানে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা?
৭. দলীয় এমপিদের একচ্ছত্র প্রভাব কমিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করবেন কিনা?
৮. বিরোধী দলের আটক নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিয়ে নিজ দলের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কিনা? সব সন্ত্রাস-দুর্নীতি-খুন-গুমের বিচার করবেন কিনা?
৯. গণধিকৃত এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের অব্যাহতি দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবার জন্য সমানভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারবেন কিনা?
১০. দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকটের সমাধান করে ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করে নির্বাচনী ওয়াদা রক্ষা করবেন কিনা?
১১. অবিলম্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল এনে সংবিধান সংশোধন করবেন কিনা?
আমার উত্তর, আত্দঅহমিকা থাকলে এগুলোর একটিও করতে পারবেন না। তবে দেশ, জনগণ ও নিজ দলের স্বার্থে অহংকার পরিত্যাগ করে একটু বিনয়ী নম্র হলেই এটা করা অসম্ভব কিছু নয়। এতে নিজেদের ছোট ভাবার কিছু নেই। বৃহৎ বৃক্ষ কিন্তু সব সময় একটু ঝুঁকেই থাকে। আবার বৃহৎ প্রাণী ডাইনোসর সভ্যতা ও পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্তও হয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি বা দল কখনোই দেশের মালিক হতে পারে না। দেশের মালিকানা শুধু জনগণের। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে দুর্গ বলতেও কিছু নেই, জনগণের আস্থা হারালে যে কোনো দুর্গ ভেঙে যেতে পারে। ৯০'র পর ক্ষমতার রাজনীতির বারবার পালাবদলে এই অভিন্ন দৃশ্যপট আমাদের লক্ষ করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত হয়ে জনগণ বারবার তাদের নেতিবাচক ভোট দিয়েছে। তবে শাসক দল কখনোই এ পরাজয় থেকে শিক্ষা নেয়নি। জনগণ কী কারণে তাদের ভোট দেয় না তা অনুসন্ধান করে নিজেদের সংশোধনের চেষ্টাও তারা কখনো করে না। এটাই আশ্চর্যের বিষয়। তাই এবারও আওয়ামী লীগ যে এটা থেকে শিক্ষা নেবে না এটা নিশ্চিত। এই সত্য হয়তো আগামীতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হবে। অংশ হয়ে যাবে ইতিহাসের। তবে ইতিহাস অন্যরকমও হওয়া সম্ভব। কেননা আওয়ামী লীগ যদি সংশোধিত হয় তাহলে ইতিহাস তারাই লিখবে। নির্বাচনে হয়তো এবার তারা বিজয়ী হবে না ঠিকই; কিন্তু এতে গণতন্ত্রের বিজয় হবে নিশ্চিতভাবে।
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইল :
বিষয়: রাজনীতি
১৩৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন