গল্পঃ''সৎ জীবনের সন্ধানে''
লিখেছেন লিখেছেন নীল দাদা ১২ জুন, ২০১৪, ১১:২৮:২৪ সকাল
সকালে ঘুম থেকে জেগে মাথায় অর্থের চিন্তা পেয়ে বসলো, বাড়ি থেকে আর খরচ দিবে না জানিয়ে দিয়েছে। বাবার যা রোজগার তাতে সংসার খরচ চালানোই কষ্টকর। ইউরোপের মত ব্যয় সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই।
গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছি আজ ৯ দিন হলো। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবো সাথে কোন কাজ খুঁজে নিবো।
বন্ধুর মেসের বিছানায় শুয়ে অপলক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে কাক দেখেছি আর ভাবছি কাক হলে না জানি কত ভালো হতো। ময়লা আবর্জনা সব খেতে পারতাম। পড়াশুনা চাকরি এতো ঝামেলা পোহাতে হতো না।
কাকটিকে মনে মনে বললাম তুমি রোজ আবর্জনা খাও খারাপ লাগে না। কাকটির উত্তর আমি ময়লা আবর্জনা খাই, আর তোমাদের মানুষদের মনটাই আবর্জনায় পূর্ণ তাতে
কিছু হয় না? কাকের উত্তরে কিছুটা লজ্জিত হলাম।
খেয়ালি মনে কত চিন্তা আসে।
আজকের সকালটা প্রদীপ্ত প্রদীপের ন্যায় ঝিলিক দিচ্ছে। জানালার পর্দায় সকালের বাড়ন্ত রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
খবরের কাগজ নিয়ে বসে গেলাম চাকরির বিজ্ঞপ্তি খুঁজতে। শিক্ষক আবশ্যক, এটাকেই সহজ মনে হলো।
ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে একটি কলা দু-টুকরো পাউরুটি
খেয়ে বেরিয়ে গেলাম।
বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ঠিকানায় পৌঁছালাম, রিসিপশনিস্ট
অল্প সুন্দরি মিষ্টভাষিণী, তার বস অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে নিয়ে গেলো। হ্যান্ডসাম এক ভদ্রলোক বসে আছেন, গায়ের রং দুধে আলতা। হয়তো অল্পের জন্য সুন্দরী নারী না হয়ে পুরুষ হয়েছেন। প্রথমে আমাকে বললো
টিউশনি তো বেশ দামি কয়েকটি ছিলো, মাসে ১৪ থেকে ১৮ হাজার টাকা সম্মানী ছিলো। দুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে।
- এর আগে আপনি কি কোথাও পড়িয়েছেন?
- আমি বললাম হ্যাঁ পড়িয়েছি, দশ বারো জায়গায়।
(এটা ছিলো এই কাজের ক্ষেত্রে প্রথম মিথ্যা কথা। সত্যি হচ্ছে দুটো ছাত্রকে পড়াতাম)
- অঙ্কে কেমন দক্ষ?
- অঙ্কে খুব ভালো পারি, সমস্যা হবে না। (মনে মনে ভাবলাম অঙ্কের নোট কিনে নেবো। আজকালকার পোলাপানের যে জটিল সব অঙ্ক)
- আপনি আজকেই আমাদের অফিসে রেজি. করে ফেলেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সুযোগ পেয়ে যাবেন। আমি ঝটপট ২৫০০ টাকা দিয়ে রেজি. করি। টাকাটা বন্ধুর কাছ থেকে নেই। আমার এখন একটাই কাজ রোজ ঐ অফিসে ফোন করে খোঁজ নেয়া। সাত দিনের ওয়াদা ভঙ্গ তো করলোই রবং ফোন ধরতে তাদের খুব কষ্ট। মনে মনে ভাবলাম টাকাটাই মনে হয় জলে গেলো।
অবশেষে ১৫তম দিনে বিধাতা মুখ তুললেন, ডাক পেয়ে গেলাম। আমি খুশিতে উৎফুল্ল চৌধুরী সেজে হাজির হলাম। বনানীতে একটি বাসার ঠিকানা দিয়ে বললো 'ক্লাস সেভেনের একটি ছেলেকে পড়াতে হবে। সপ্তাহে ৩ দিন ১২ হাজার টাকা
সম্মানী। শুরু হলো প্রথম কর্মজীবন আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। আজ চুলে একটু জেল (জেল আমার না বন্ধুর) মেখে দাড়ি সেভ করে মহামান্য স্যার সেজে ছাত্রের বাড়িতে গেলাম। পথে মসজিদের সামনে আঁতর কেনার ভান করে কিছু আতর
মেখে নিলাম।
(এভাবে আতর মাখা প্রতারণার শামিল। কী করবো কেনার টাকা নাই) ছাত্র বেশ পছন্দ হয়েছে চুলগুলো শজারুর মত। দাঁতগুলো তারে জামিন পার। চারদিন পড়ানোর পর সেই অফিস থেকে মিষ্টভাষিণীর ফোন- জনাব আপনার আর যেতে
হবে না। ছাত্রের অভিভাবক জানিয়েছে আপনার পড়ানো মানসম্মত নয়। মেজাজটা যেমন ক্ষিপ্ত হলো তেমনি কষ্ট লাগলো। খারাপ পড়িয়েছি এটা আমি বিশ্বাস করি
না। পরদিন সকালে গেলাম অফিসে। যেয়ে দেখি তালা বন্ধ, মোবাইল বন্ধ, আরো বিশ বাইশজন অপেক্ষারত।
আর বুঝতে বাকি রইলো না।
মন খারাপ ও অর্থকষ্টে এভাবে ১ মাস কেটে গেলো। হাঁটতে হাঁটতে গুলশান লেকের পাড়ে যেয়ে একটি ছোট ছেলেকে ডাক দিলাম। ওর নাম রুহুল। রুহুল এখানে শীতল পাটি (মাদুর) ভাড়া দেয়, লেকের পাড়ে বসার জন্য। লেকের পাড়ে শুয়ে
পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি পড়া শুরু করি।
এবার পেলাম বিয়ে করে নিউজিল্যান্ডে সেট্ল ভদ্র নামাজি ছেলে চাই। দাড়ি থাকলে অসুবিধা নেই।
আমি বুঝি না দাড়ির সাথে এই বিজ্ঞপ্তির আর বিয়ের কী সম্পর্ক। দাড়িওয়ালা মানুষের কি বিয়ে হয় না?
যাক একটা ভালো খবর পেলাম।
রুহুলকে ডাক দিয়ে বললাম তোমার মাদুরের ভাড়া কত? বললো' - স্যার আপনার জন্যে ১০ টাকা করে।
৩০ টাকা দেন।
- মানে???
- স্যার আপনাকে ৩টি দিয়েছি। উল্টিয়ে দেখেন।
কী আর করা। ২০ টাকা দিয়ে ধমকিয়ে বিদায় করলাম।
এই বয়সে প্রতারণার ট্রেনিং আয়ত্ত করে ফেলেছে।
ইতেমধ্যে মা বাবার সাথে মানসিক দূরত্ব বেড়ে কয়েক ক্রোশ হয়েছে। চিন্তা করলাম এবার আর দেশেই থাকবো না
এই মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশ চলে যাবো।
বাবুই পাখির মত স্বপ্নের জাল শুরু হয়ে গেলো। আমার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক- অতঃপর আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলাম এই চিন্তায়।
পরদিন সকালে ফিটফাট হয়ে রওনা হলাম "জীবনের হাতছানি” নামক ম্যারেজ মিডিয়া অফিসে।
অফিসের সামনে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আর সাইন বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম ''জীবনের হাতছানি'' না হয়ে হতচ্ছাড়া জীবন নাম দিল না কেন।
পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুলের সিঁথি ঠিক করলাম।
অফিসে ঢুকেই আমার চোখ ছানাবড়া। এই তো সেই লোক !!!! ভুল দেখছি না তো?
ঠিকই তো আছে। অর্থাৎ সে-ই অভিজ্ঞ শিক্ষক চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩ মাসের মাথায় অফিসে তালা ঝুলিয়েছিলো।
আমার সামনে পিছে কেউই তো নাই। আজকে ওরে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো। দরকার হলে জেলে যাবো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাষা বুঝে গেল, তাছাড়া প্রতারকরা বিপদ আসলে আগেই বুঝে ফেলে।
এসেই বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো- ভাই কেমন আছেন? আপনাকে ফোন দিতাম।
এই দেখেন আপনার নাম্বার মোবাইলে সেভ করা।
ঐ সুমি ক্যাশ থেকে ভাইয়ের জন্য ৩,০০০ টাকা
নিয়ে এসো।
আমি এতক্ষণ ওর কর্ম দেখে যাচ্ছিলাম। এবার মুখ খুললাম। টাকা পয়সা পরে হবে আগে বলুন আপনার কাহিনী কী?
কেন এইসব করছেন?
যা বলেছে তা এইরূপ- "দেখুন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছি। চাকরির জন্যে এমন কোনো জায়গা
নেই যাই নি। একটি চাকরি যা পেলাম বসের দুর্নীতির কারণে চলে গেলো। ২ মাস জেলও খাটলাম বেহুদা। জেল থেকে বেরিয়ে সিন্ধান্ত নিলাম, আর না-
এবার প্রতারকের জীবন বেছে নেবো। কারণ বেঁচে থাকলে প্রতারিত হতে হবে না হয় প্রতারণা করতে হবে।
শুরু করলাম শিক্ষক নিয়োগ, ম্যারেজ মিডিয়া ও বিদেশে লোক পাঠানো (আদম ব্যাবসা)। আমি এই কাজগুলোর একটিও সঠিকভাবে করি না।
আপনি যে ছেলেকে বনানীতে পড়াতে গেছেন সে আমাদের সাজানো নাটকের অংশ।
যে-ই তাকে পড়াতে যায় দু চার দিনের মাথায় বলে দেই মান সম্মত নয়। এভাবে মাসে ১৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত শিক্ষক বাদ দেয়া হয়। ঐ রেজিস্ট্রেশনের আড়াই হাজার টাকাই লাভ।
এর পরে এটা তিন চার মাস পরে বাদ দিয়ে শুরু করি বিয়ে ব্যবসা। এখানেও আমাদের ঠিক করা কনে রেডি থাকে, বিয়ের আগেই সব ফাইনাল হলে আমাদের চার্জ দিতে হয় ২০,০০০ হাজার টাকা। তারপর বিয়ের আয়োজন করা হয় বানানীর ঐ বাড়িতেই কনের বাবা, মা, ভাই এগুলো সব সাজানো থাকে।
বাসর ঘরেই ঝগড়া ফ্যাসাদ তৈরি করে অভিযুক্ত করা হয় যে- এই স্বামীর সাথে ঘর করা সম্ভব নয়। অসামাজিক লোক হ্যান ত্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে কাজ না হলে হিডেন ক্যামেরায় ছবি তুলে অথবা উত্তম মধ্যম দিয়ে বিদায় নিশ্চিত করা হয়।
এভাবে মাসে তিন থেকে চারটি বিয়ের আয়োজন করতে পারলে আমাদের ফি ও পাত্রীর গহনাসহ আয় হয় ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা।
আর বিদেশের লোক পাঠানোর কথা কি আর বলবো। মাঝে মাঝে দু-একজন মধ্যপ্রাচ্যে মাঝরা ভিসায় পাঠাই। আর হাতিয়ে নেই শত শত লোকের টাকা। আমরা কোন অফিসই চার মাসের বেশি এক জায়গায় রাখি না। ভাই বাঁচতে তো হবে। ভালোভাবে পারি নি তাই এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছি। আপনার পায়ে পড়ি কাউকে জানালে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
খুব শিঘ্রীই ছেড়ে দেব কথা দিচ্ছি। সবই তো আপনাকে খুলে বললাম। এত বড় প্রতারকের সাথে কথা বলার মত আর মানসিকতা রইলো না।
টাকাটা নিয়ে মুহূর্তে বেরিয়ে গেলাম। ... আর একটি কথা ওকে বললাম- প্রতারক কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না ...... তুমিও পারবে না।
এসব মিথ্যাচার প্রতারণার কাহিনী শুনে খুব কষ্ট লাগলো। মানুষ এতো নীচ কেমন করে হয়। প্রতিনিয়ত আমার মত কত মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এই ঢাকার শহরে।
কে রাখে কার খোঁজ। প্রশ্ন জাগে- আচ্ছা এই শহরের সবাই কি প্রতারক? যার সাথে দেখা হয় সেই প্রতারক ছোট বাচ্চা ছেলে রহুল পর্যন্ত, যে ছেলেটিকে পড়িয়েছি সেও? কেউ বাদ যায় না। জানি না- হয়তো কিছু ভালো মানুষ অবশ্যই আছে।
আমি প্রতারকের মধ্যেই ভালোভাবে সত্যসুন্দরের সাথে বাঁচতে চাই, বাঁচতে আমাকে হবেই।
পথিমধ্যে অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম মনের ক্ষতগুলো যেন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে কাদামাটির সাথে মিশে যাচ্ছে............।
অনুভূতি: আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরী অথবা আইন করে আরো স্বচ্ছ বিজ্ঞাপন নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিৎ। কারণ তারা কোন কিছু না জেনে না বুঝে বিজ্ঞাপন পেলেই ছাপিয়ে দেয়। সেটা হোক প্রতারণা বা সঠিক কিছু। এটাকে প্রতারণায় একরকম সহযোগিতা বলা যায়।
বিষয়: সাহিত্য
১২৬৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এতো বাস্তবতা চরম বাস্তবতা।
পড়লাম খুব মনযোগ দিয়ে।
একমত।
ধন্যবাদ দাদু।
জীবন নিংড়ে বের করা কিছু কষ্টানুভুতি
এতো সুন্দর করে জীবন-নাটক উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও অভিবাদন ^^
মন্তব্য করতে লগইন করুন