আল্লাহ্ থাকতে পৃথিবীতে এত দু:খ-কষ্ট কেন?
লিখেছেন লিখেছেন আদনান ১০ আগস্ট, ২০১৩, ০৫:০৪:৪৬ বিকাল
প্রশ্ন ১। আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান এবং পরম করুনাময় হন, তাহলে পৃথিবীতে এত দু:খ-কষ্ট কেন?
উত্তর: প্রথম কথা হলো, পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্ট থাকলেও পৃথিবীতে অনেক আনন্দও আছে। বরং, পৃথিবীতে আনন্দই বেশী, নাহলে অধিকাংশ মানুষ বেঁচে থাকতে চাইত না।
বলুন, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে নিষিদ্ধ করেছে? বলুন, এসব তো ঈমানদারদের জন্য – পার্থিব জীবনে এবং বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে। - সূরা আ’রাফ(৭:৩২)
দ্বিতীয়ত: অনেক সময় এমন কিছু হয় যা আপনার কাছে আপাতঃদৃষ্টিতে কষ্টদায়ক বলে মনে হয়, কিন্তু পরে যেয়ে দেখা যায় ঐ কষ্টের ঘটনাটার জন্যই আপনার জীবনে এমন কোন পরিবর্তন এসেছে যা আপনার জন্য অনেক বেশী উপকারী। আমাদের সবার জীবনেই কম-বেশী এরকম অভিজ্ঞতা আছে। এভাবে, আল্লাহ্ আমাদের বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেন, যাতে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি এবং কঠিনতর পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি।
তিনি (আল্লাহ্) বললেন: আমি যা জানি তোমরা তা জান না। (সূরা বাক্বারাহ্ ২:৩০)।
তৃতীয়ত: এই পৃথিবীটা হলো একটা পরীক্ষার জায়গা। আল্লাহ্ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করছেন। এই পরীক্ষা আনন্দদায়ক হতে পারে, আবার কষ্টেরও হতে পারে। যেমন, আপনার যদি অনেক টাকা-পয়সা থাকে তাহলে আল্লাহ্ আপনাকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করছেন, যে আপনি সেই সম্পদ কিভাবে ব্যয় করবেন। আপনার যদি অনেক মেধা থাকে, তো আল্লাহ্ আপনাকে পরীক্ষা করছেন আপনি কিভাবে সেই মেধাকে ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, আপনার বা আপনার সন্তানের যখন কোন অসুখ হয় তখন আল্লাহ্ আপনার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন। আপনার ভাই-বোন বা পরিচিত কেউ যখন কোন বিপদে পড়ে তখনও আপনার পরীক্ষা হয় আপনি তাকে কিভাবে কতটুকু সাহায্য করছেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআন-উল-কারীমে বলেন:
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের (কাউকে) ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর (কাউকে) ধনেপ্রাণে বা ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করব। আর যারা ধৈর্য ধরে তাদের তুমি সুখবর দাও। (তারাই ধৈর্যশীল) যাদের ওপর কোন বিপদ এলে বলে, ‘(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি’উন, অর্থাৎ) নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তারই দিকে ফিরে যাব’। এদের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে শান্তি ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই সুপথগামী। -সূরা বাক্বারাহ্ (২:১৫৫-১৫৭)
আপনি যখন কোন পরীক্ষা দিতে বসেন, আপনার শিক্ষক যেমন কিছু সহজ প্রশ্ন দেন, আবার কিছু কঠিন প্রশ্নও দেন, আল্লাহ্ও তেমনি মানুষকে পরীক্ষা করেন বিভিন্ন আনন্দদায়ক ও দু:খজনক ঘটনার মাধ্যমে। এই জীবন শুধুই একটা পরীক্ষাকেন্দ্র, পরকালের জীবনই আসল জীবন।
আর পার্থিব জীবন তো ক্রীড়াকৌতুক ছাড়া আর কিছুই নয়; আর সাবধানীদের জন্য পরকালের আবাসই ভালো; তোমরা কি বোঝ না? – (সূরা আন’আম ৬:৩২)
চতুর্থত: আল্লাহ্ তাঁর করুণার মাত্র ১ ভাগ পৃথিবী আর তার সমস্ত কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বাকী ৯৯ ভাগ তিনি তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন যা দিয়ে তিনি কিয়ামতের দিন তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে করুণা করবেন (সহীহ্ বুখারী)। আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি কি পরিমান ক্ষমাশীল ও করুণাময় নিচের হাদিস থেকে তার কিছু নমুনা পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: আল্লাহ্ তোমাদের উপর নিযুক্ত ফেরেশতাদের নির্দেশ করলেন তোমাদের ভাল ও মন্দ কাজ লিখে রাখতে, আর এরপর তিনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে লিখতে হবে। কেউ যদি কোন ভাল কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি না করে, আল্লাহ্র তার জন্য একটি পূর্ণ ভাল কাজের নেকী লিখে রাখেন। কেউ যদি কোন ভাল কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি বাস্তবায়িত করে, আল্লাহ্র তার জন্য ঐ কাজটির যা নেকী তা ১০ থেকে ৭০০ গুণ, এমন কি এর চেয়েও বহু গুণে বৃদ্ধি করে লিখে রাখেন। অন্যদিকে, কেউ যদি কোন খারাপ কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি না করে, আল্লাহ্র তার জন্য একটা পূর্ণ ভাল কাজের নেকী লিখে রাখেন। আর কেউ যদি কোন খারাপ কাজ করার নিয়ত করে এবং এরপর কাজটি বাস্তবায়িত করে, আল্লাহ্র তার জন্য একটি মাত্র গুনাহ্ লিখে রাখেন। (সহীহ্ বুখারী)
প্রশ্ন ২। তারপরো আমি কিছু ব্যাপার মেনে নিতে পারছি না। এই যেমন, কত ছোট্ট শিশুর ক্যান্সার হয়, অথবা বিল্ডিং ধসে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়, কিংবা সুনামিতে কত নিষ্পাপ শিশু মারা যায় – আল্লাহ্ থাকতে এগুলো হয় কিভাবে? আল্লাহ্ কেন ওদেরকে বাঁচান না?
উত্তর: এরকম কেন ঘটে তা তিনটি কারণ/উদাহরন দিয়ে বুঝাচ্ছি।
এক - আমরা মনে করি মারাত্মক কোনও অসুখ বা মৃত্যু মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি – এই ধারণা ঠিক না। মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো জাহান্নামে নিক্ষেপিত হওয়া, আর তাই আল্লাহ্ আমাদের বিভিন্ন কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে সামগ্রিকভাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ করে দেন। আল্লাহ্ হয়ত কারো শিশু সন্তানকে ক্যান্সার এই কারণে দিয়েছেন যে এই সন্তানটি বড় হলে খুব খারাপ মানুষ হয়ে নিজের বাবা-মা সহ অনেক মানুষের ক্ষতি করতো। সূরা কাহফে মুসা(আ) ও খিজির(আ) এর কাহিনীতে আল্লাহ্ এইরকম একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
ঠিক যেমন আপনি যখন আপনার বাচ্চাটিকে টীকা দিতে নিয়ে যান সে কিন্তু অনেক কাঁদতে থাকে, তাও আপনি তাকে জোর করে টীকা দেওয়ান, এমনকি তার জ্বর হতে পারে এটা জানার পরেও আপনি ডাক্তারকে টীকা দিতে বলেন। কেন বলেন? কারণ, আপনি জানেন এই সাময়িক যন্ত্রনা তাকে সারাজীবনের জন্য রোগমুক্ত করবে। একই কারণে, আল্লাহ্ আমাদের উপর বিভিন্ন বিপদ দেন, বিপদের মাধ্যমে তিনি আমাদের গুনাহ মাফ করেন এবং চিরস্থায়ী জান্নাতের জন্য উপযুক্ত করেন।
দুই – আল্লাহ্ অনেক সময় সুনামী, বন্যাসহ নানা দুর্যোগ পাঠিয়ে থাকেন মানুষের অর্জিত পাপের শাস্তি প্রদান করার জন্য । এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্ পাপী জাতিকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করেন, যেমন করেছেন নূহ(আ), লুত(আ) এর সম্প্রদায়কে, আদ জাতিকে, সামুদ জাতিকে। (বিস্তারিত পড়ুন আমার এই লেখায়)
তিন - আমরা শুধু ব্যক্তিগত মঙ্গলের কথা চিন্তা করি, আল্লাহ্ চিন্তা করেন সামগ্রিক মঙ্গলের কথা। আগেই বলেছি আল্লাহ্ ভবিষ্যৎ জানেন, আমরা জানি না (সূরা বাক্বারাহ্ ২:৩০)। আমার কাছে সাময়িক ভাবে যেটা বেদনাদায়ক মনে হয়, সেটা হয়তো আল্লাহ্ সামগ্রিকভাবে মানবজাতির মঙ্গলের জন্য করছেন।
যখন কোথাও সুনামী হয়, অনেক মানুষ মারা যায়, তখন যাদের মধ্যে ঈমানের ছিটে ফোঁটাও আছে তার অনুধাবন করতে পারে যে এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, এর পেছনে ছুটা নিরর্থক, পাথেয় সঞ্চয় করতে হবে পরকালের। এভাবে এক এলাকার মানুষকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্ অন্য এলাকার মানুষদের শিক্ষাও দিতে পারেন। আবার, যে শিশুটি বড় হয়ে পাপ কাজ করে জাহান্নামে যেতো, শিশু বয়সেই সুনামীতে তার মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ্ হয়ত তাকে জান্নাতের জন্য উপযুক্ত করেছেন! জান্নাত পেলে আমরা পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে যেয়ে শুধুই আল্লাহর প্রশংসা করব, অন্যদিকে যে জাহান্নামী হবে তার কাছে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ-উল্লাসই তুচ্ছ মনে হবে!
আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন যে, পুনরুত্থানের দিন এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে পৃথিবীতে আরাম-আয়েশ এবং প্রাচুর্যতার মধ্যে জীবন কাটিয়েছিল কিন্তু এখন সে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। এই লোকটিকে একবার মাত্র জাহান্নামের আগুনে ডুবানো হবে এবং জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও শান্তি বা কোনও সম্পদ পেয়েছিলে? সে উত্তর দিবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব!
এবং এরপর এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে জান্নাতের বাসিন্দা কিন্তু সে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছিলো। এই লোকটিকে জান্নাতে একবার মাত্র ডুবানো হবে এবং তাকে জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও কষ্টের মধ্যে ছিলে? সে বলবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব! আমি দুনিয়াতে কখনোই কোনো কষ্টের সম্মুখীন হইনি বা কোনো দুর্দশায় পড়িনি। – (সহীহ মুসলিম)
লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগ: http://adnanfaisal.wordpress.com
References:
1. Why does God permit suffering on earth – Abdur Raheem Green
2. Understanding tragedies and calamities - Dr. Yasir Qadhi
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন