আমরা রোজা রাখি কেন?

লিখেছেন লিখেছেন আদনান ১২ জুলাই, ২০১৩, ১০:৩৩:৫৮ রাত



ছোটবেলায় রমজান মাস আসলেই মনটা খুশীতে ভরে উঠত, দারুণ দারুণ সব খাবার খাওয়া যাবে, ঈদে নতুন জামা পাওয়া যাবে, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া যাবে – সব মিলিয়ে খালি মজা আর মজা! একজন শিশুর জন্য রোজার সাথে জড়িয়ে থাকা এই উদ্দেশ্যগুলো হয়ত অর্থবহ, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের বড়দের মাঝেও রোজার উদ্দেশ্য হয়ে গেছে খাদ্য-উৎসব করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা আর টিভি দেখা। কিন্তু, আপনার কি মনে হয় – আল্লাহ্‌ আমাদের শুধু এগুলি করার জন্য রোজা রাখতে বলেছেন? অবশ্যই না।

কোথায় যাব না জেনে রাস্তায় বের হলে যেমনি গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না, তেমনি আল্লাহ্‌ আমাদেরকে কেন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা না জেনে রোজা রাখলে আমাদের অন্তরে পরিবর্তন আসবে না। আমরা রমজান মাসে ভালো ভালো খাবার খাবো-খাওয়াবো, ঈদে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারবো, টিভিতে ভালো অনুষ্ঠানও দেখবো, কিন্তু তারো আগে বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেকে প্রশ্ন করব - আল্লাহ্‌ আমাদেরকে রোজা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন কেন?

রোজার উদ্দেশ্য কি?

ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি যে – গরীব মানুষেরা না খেয়ে কত কষ্টে থাকে তা যেন আমরা বুঝতে পারি এর জন্যই রোজা রাখা। এটা বিসমিল্লায় গলদ! না! না! না! এটা মোটেও রোজার মূল উদ্দেশ্য না!!
হ্যাঁ রোজা রাখার একটা সুফল হয়তো এটা যে আপনি না-খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট বুঝতে পারবেন, কিন্তু এটা কখনোই রোজার মূল উদ্দেশ্য না। আপনি যখন গরীব মানুষের কষ্ট বুঝতে পারাকে রোজার মূল উদ্দেশ্য করে ফেলবেন তখন সমস্যা কি? এর সমস্যা হলো আপনি যদি কোন রকমে না খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারেন, তাহলেই আপনি মনে করবেন যে আপনি সফল ভাবে রোজা রেখেছেন! আরে ভাই গরীবের কষ্ট বুঝে গেসি, রোজার উদ্দেশ্য সফল। হয়তো আপনার দিন শুরু হয়েছিল ফজর নামাজ না পড়ে, সকাল কেটেছে যাকে দেখতে পারেন না তার গীবত করে, দুপুর কাটিয়েছেন অফিসের কাজে ফাঁকি মেরে, বিকাল কাটিয়েছেন ইফতারী কিনে, আযান পড়তেই ধুমসে ইফতার খেয়ে ‘ফাটিয়ে ফেলেছেন’ – রোজা তো অবশ্যই সফল! কারণ? ঐ যে, রোজার উদ্দেশ্য ছিলো গরীবের না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝা – ঐ বুঝ তো দিনের বেলা বুঝা হয়ে গেছে!

প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে রোজার উদ্দেশ্য কি?

রোজার উদ্দেশ্য আল্লাহ ‘আযযা ওয়াজাল স্পষ্টভাবে কোরাআনুল কারিমে বলে দিয়েছেন:

হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হলো, যেভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীগনদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। - (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৩)


সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে কেন রোজা রাখতে হুকুম করেছেন তা স্পষ্ট – যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি।

রোজার উদ্দেশ্য ১: তাকওয়া অর্জন করা।

এখন তাহলে জানা দরকার তাকওয়া শব্দের অর্থ কি? তাকওয়া অর্থ হলো আল্লাহ-সচেতনতা (God Consciousness) বা আল্লাহভীতি (God fearness)। আপনি যা ভাবছেন, যা করছেন, যা বলছেন, যা শুনছেন – আল্লাহ তার সবকিছু দেখছেন, শুনছেন, রেকর্ড করে রাখছেন, বিচার দিবসে আপনাকে আপনার গোপন-প্রকাশ্য সব কাজ দেখানো হবে, ভাল-মন্দ সব কাজের প্রতিদান দেয়া হবে – এই চিন্তাগুলো মাথায় রেখে যে কোন কিছু করার নামই তাকওয়া। ব্যাপারটা আসলে খুব ভয়ংকর। আপনি আজ সকালে ফজরের নামাজ পড়েছিলেন কিনা তার জবাব আপনাকে দিতে হবে, খাওয়া শুরুর আগে বিসমিল্লাহ বলেছিলেন কিনা তার জবাব দিতে হবে, অফিসে বা ইউনিভার্সিটিতে আসতে যেতে কোন মেয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে তার জবাব দিতে হবে, কোন বন্ধুর সাথে অন্য কোন বন্ধুর বদনাম করলে তার জবাব দিতে হবে, রিকশাওয়ালাকে অকারণে ধমক দিলে তার জবাব দিতে হবে, অফিসে বসে কাজে ফাঁকি দিলে জবাব দিতে হবে, জবাব দিতে হবে আপনার প্রতিটা কাজের, কথার, চাহনির!

আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যে মানুষ রোজা রেখে মিথ্যা কথা এবং খারাপ কাজ ছাড়তে পারে না, তার না খেয়ে থাকার প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নাই (অর্থাৎ তার রোজা আল্লাহ্‌ কবুল করবেন না)। - (বুখারী)


স্কলারেরা বলেছেন যে এই পৃথিবীটা হলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা একটা রাস্তার মতো যার প্রতি পদে পদে পাপের কাঁটা বিছানো। তাকওয়া মানে হলো এই কাঁটাগুলোকে সর্ন্তপণে এড়িয়ে সঠিক পথে চলা। সঠিক পথ কোন্‌টা? আল্লাহ্‌ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন তা না করা, আর যা করতে আদেশ করেছেন সেটা করাই হলো সঠিক পথ। আল্লাহর এই আদেশ-নিষেধগুলো যে যত বেশী মেনে চলবে, আমরা বলব যে তার তাকওয়া তত বেশী, অর্থাৎ সে তত বেশী মুত্তাকী।

কিন্তু, রোজা রাখার সাথে তাকওয়া অর্জনের সম্পর্ক কি?

রোজাকে আরবীতে ‘সাওম’ বলে, যার অর্থ হলো বিরত থাকা। রোজা রাখলে আমরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেই, এমনকি যখন একা ঘরে থাকি, বাথরুমে থাকি তখনও কিন্তু আমরা খাই না। আমরা খাই না কারণ কেউ না দেখলেও তো আল্লাহ্‌ দেখছে, অর্থাৎ আমরা তাকওয়ার কারণেই রোজার সময় খাই না। এখন দেখুন, এই খাবার খাওয়া কিন্তু আমাদের মৌলিক চাহিদা। কিন্তু, গীবত করা, মেয়েদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা, গান-নাচ দেখা, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, কাজের লোকের সাথে খারাপ ব্যবহার , মানুষের উপকার করে খোঁটা দেয়া – এগুলো একটাও কি আমাদের মৌলিক চাহিদা? না। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন – হে মানুষ! তোমরা যদি তাকওয়ার কারনে তোমার মৌলিক চাহিদা থেকেই বিরত থাকতে পারো, তাহলে যেই কাজগুলো অপশনাল সেগুলো থেকে কেন বিরত থাকতে পারবে না?

আবু হুরায়রা(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: রোজা ঢালস্বরুপ। - (বুখারী)


আবার ভেবে দেখুন, রোজার সময় না খাওয়ার কারণে আমাদের শরীর দুর্বল থাকে। আর দুর্বল শরীরে আমাদের নফসের বা অন্তরের কু-চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আর নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার নামই তো তাকওয়া।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাকওয়া অর্জন করব কিভাবে?

যে কোন পরীক্ষায় পাশ করতে হলেই আগে জানা লাগে পরীক্ষার সিলেবাস কি। ঠিক তেমনি তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করতে হলে আমাদের জানা লাগবে কোন্‌ কাজে আল্লাহ্‌ শাস্তি দিবেন আর কোন্‌ কাজে আল্লাহ্‌ পুরস্কার দিবেন। যেমন আপনি যখন জানবেন নামাজ না পড়লে আপনি কাফের হয়ে যেতে পারেন তখন আপনি ভয়ে নামাজ পড়া শুরু করবেন। যখন জানবেন কবরে লাশ রাখার পর তা দুইদিক থেকে এমনভাবে চাপ দেয় যে এক পাশের পাঁজরের হাড় আরেক পাশের পাঁজরের হাড়ের উপরে উঠে যায়, আর কবরে আজাবের একটা কারণ হলো দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করা, তখন আপনি (পুরুষ হলে) আর দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করবেন না। যখন জানবেন মিথ্যা বললে আপনার চোয়ালের চামড়া আংটা ঢুকিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলা হবে তখন আর মিথ্যা বলবেন না। যখন জানবেন গীবত করলে মৃত মানুষের মাংস হবে আপনার জাহান্নামের খাবার আপনি আর গীবত করবেন না। যেদিন শুনবেন ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে উলংগ করে আগুনে পোড়ানো হবে তখন এই কাজের চিন্তা আর স্বপ্নেও করবেন না। অন্যদিকে যখন জানবেন, প্রতিবার সুবহান আল্লাহ্‌ বললে জান্নাতে আপনার জন্য একটা গাছ লাগানো হবে তখন বেশী করে সুবহান আল্লাহ্‌ বলবেন, যখন জানবেন বাবা-মায়ের সেবা জান্নাতে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় তখন আপনি আপনার পড়াশুনা, চাকরী, ব্যবসার চাইতে বাবা-মায়ের সেবায় বেশী মন দিবেন, যখন জানবেন মানুষকে ক্ষমা করলে আল্লাহ্‌ আপনাকে ক্ষমা করবেন তখন অনায়াসে অন্য মানুষের ভুল ক্ষমা করতে পারবেন। মোদ্দা কথা হলো, তাকওয়া অর্জন করতে হলে আগে লাগবে সঠিক পথ আর ভুল পথকে পার্থক্য করার জ্ঞান। এই জ্ঞান কোথায় পাবেন? এক আয়াত পরেই আল্লাহ্‌ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন:

রমযান মাস, এতে মানবজাতির জন্য পথ-প্রদর্শক (Guidance), সঠিক পথের স্পষ্ট প্রমাণ (proof) এবং সঠিক ও ভুলের পার্থক্য নির্ণয়কারী (a distinction between right and wrong) কোরআন নাজিল করা হয়েছে। অতএব তোমাদের তোমাদের মধ্যে যে কেউ এই মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে। - (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)


সুতরাং কোন্‌ কাজটা ভালো কোন্‌ কাজটা মন্দ, এইটা বুঝার জন্য মুসলমানের মানদন্ড হলো কোরআন। কোরআন শুধু আরবীতে পড়লেই চলবে না, নিজের মাতৃভাষাতেও পড়তে হবে, অনুবাদ পড়তে হবে, ব্যাখা পড়তে হবে, আলেমদের লেকচার শুনতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই আমরা জানতে পারবো আল্লাহর কাছে কোন্‌ কাজটা সঠিক, কোন্‌ কাজটা ভুল। আর আল্লাহর দেয়া মানদন্ড অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার মানেই হলো তাকওয়া অর্জন করা।

রোজার উদ্দেশ্য ২: কোরআন থেকে সঠিক ও ভুল পথের নির্দেশনা নেয়া।

রমজান মাসে কোরআনের এই গুরুত্বের কারণেই আমরা তারাবীহ্‌ এর নামাজে কোরআন খতম করি। কিন্তু, আমরা যেটা করি না সেটা হলো কোরআন থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা, অথচ আল্লাহ্‌ এই উদ্দেশ্যে কোরআন নাজিল করেছেন। আচ্ছা, এই পরামর্শ কি শুধু মুসলমানেরাই গ্রহন করবে? দেখুন তো আরেকবার আল্লাহ্‌ সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে কি বলেছেন? আল্লাহ্‌ বলেছেন কোরআন সমগ্র মানবজাতির পথ-প্রদর্শক! অর্থাৎ, রমজানে এই কোরআন শুধু আমি নিজেই পড়লেই হবে না, আমার আশে পাশের নামাজী, বেনামাজী, হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক, সবাইকে কোরআন পড়ার জন্য বলতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমি মুত্তাকী হলে আল্লাহর লাভ কি?

আল্লাহ্‌ হলেন আল-গণি বা প্রয়োজনমুক্ত, আবার তিনি আর-রাহমান বা পরম দয়ালু। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ভালবাসেন আর তাই তিনি চান আমরা ইহজীবনে শান্তি এবং পরজীবনে জান্নাত পাই । ইহজীবনে শান্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা, তাকওয়া অর্জন করা। যার তাকওয়া নাই তার অন্তরে শান্তি নাই, সে যত পায় তত চায়, তাও তার মন ভরে না। আর যখন মৃত্যু তার কাছে চলে আসে তখন সে গভীর হতাশায় ডুবে যায়, ‘হায় আমি এতকাল কি করলাম!’ বলতে বলতে তার কলজে ফেটে পড়ে। নিজেকে বার বার প্রশ্ন করে, ‘যেই দুনিয়ার পিছনে সারা জীবন দৌড়েছি তাকে ছেড়ে এখন আমি কিভাবে যাবো?’ আল্লাহ্‌ মানুষকে অন্তরের এই ছটফটানি থেকে মুক্তি দিতে চান, এই মুক্তির একমাত্র পথ হলো তাকওয়া অর্জন করা।

আল্লাহ্‌ তো তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তিনি তা চান না। - (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)


হুমম, বোঝা গেল যে আল্লাহ্‌ আমাদের মংগলের জন্যই চান যে আমরা রোজা রাখি, তাকওয়া অর্জন করি। কিন্তু, আল্লাহ্‌ যদি আসলেই আমাদের জন্য জীবনকে সহজ করতে চান, তাহলে কি তিনি রমজান মাসে আমাদের জন্য এমন বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করেছেন, যা আমাদের তাকওয়া অর্জনে সাহায্য করবে?

রমজানের স্পেশাল প্যাকেজ!

রমজানে আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য আছে বিশেষ সুবিধা, স্পেশাল প্যাকেজ। যে শয়তান আপনার জন্মের পর থেকে আপনার কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে আসছে আল্লাহ্‌ সেই শয়তানকে রমজানে শেকল-বন্দি করে রাখেন। কাজেই, রোজার মাসে কোন পাপ করে ফেললে শয়তানকে দোষ দেয়ার কোন উপায় নাই! রোজার মাসে কোনও পাপ করলে সেটা আপনি করেছেন আপনার নিজের অন্তরের কু-চাহিদা থেকেই।

সুসংবাদ আরো আছে। রমজানের মাসে জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়, আর জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তরে এমন অবস্থা তৈরী করেন যে খারাপ কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যায়, আর ভালো কাজ করা সহজ হয়ে যায়।

আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যখন রমজান মাস শুরু হয়, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানকে শেকল-বন্দি করা হয়। - (বুখারী)


আল্লাহ্‌ কেন এমন করেন? আল্লাহ্‌ এরকম করেন যাতে আপনি নিজেকে এই মাসে ট্রেইন-আপ করে নিতে পারেন, বাকী ১১ মাস শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য। আপনি যখন ড্রাইভিং শিখেন তখন যেমন আপনার ইন্সট্রাক্টর আপনাকে এমন রাস্তায় নিয়ে যান যে রাস্তায় গাড়ি, মানুষ নাই – যাতে আপনি ভালো মতো প্র্যাকটিস করতে পারেন আর এরপর লাইসেন্স নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন মেইন রোডে, রমজানও তেমনি আমাদের ট্রেনিং টাইম। আল্লাহ্‌ এক মাস ধরে শয়তানকে আপনার রাস্তা থেকে সরিয়ে রাখেন যাতে আপনি নিজের তাকওয়াকে মজবুত করে নিতে পারেন বাকী ১১ মাস শয়তানের সাথে লড়াই এর জন্য।

রোজার উদ্দেশ্য ৩: সারা বছর শয়তানের সাথে লড়াই করার জন্য নিজেকে ট্রেইন-আপ করা।

ভেবে দেখুন আপনি আপনার ড্রাইভিং ট্রেনিং এর সময় প্যারালাল পার্কিং, ব্যাক-ইন, ড্রাইভ-ইন কোনও ধরনের পার্কিং প্র্যাকটিসই কিন্তু বাদ রাখতে চান না, কারণ ট্রেনিং শেষে পরীক্ষার সময় কোন্‌টা আসবে আপনার তো আর জানা নাই। ঠিক তেমনি রমজান মাসের এই ট্রেনিং টাইমে সব ধরনের ভালো কাজ বেশী বেশী করে করতে হবে, একদম ছোটখাটো খারাপ কাজ, যেমন খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ না বলা, থেকেও বিরত থাকতে হবে। বলা তো যায় না, ট্রেনিং টাইম শেষে শয়তান যখন আবার মুক্তি পাবে তখন সে কোন্‌ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে!

আর তাই রাসূলুল্লাহ(সা) রমজান মাস এলেই ভালো কাজ করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। রাসূলুল্লাহ(সা) এমনিতেই দানশীল ছিলেন, কিন্তু রমজান মাস আসলে তার দানশীলতা ঝোড়ো বাতাসকেও ছাড়িয়ে যেত (বুখারী)। ঝোড়ো বাতাস যেমনি সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমনি ভাবে তিনি তার বাসার সবকিছু ঝেড়ে-ঝুড়ে দান করে দিতেন! রমজান মাসে জিব্রিল(আ) এসে রাসূলুল্লাহ(সা) কে কোরআন শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে রমজানে রাতে অনেক বেশী নামাজ পড়তেন, আর তাঁর পরিবারে সদস্য, সাহাবাদেরকেও পড়তে বলতেন। আর, এর জন্য আমরাও রোজার রাতে তারাবীহ পড়ি। রোজার এই তারাবীহ পড়া হলো সারা বছর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার প্র্যাকটিস। রমজান মাসে যদি আমরা ৮ বা ২০ রাকআত তারাবীহ পড়তে পারি, তাহলে ট্রেনিং শেষে সারা বছর কেন কমপক্ষে দুই-চার রাকআত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারবো না?

রমজানের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে সুন্দর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছেন, এর জন্য আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। তাই আল্লাহ রমজান মাস সংক্রান্ত এই আয়াতটি শেষ করেছেন এভাবে:

এজন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে, এবং তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন তার জন্য তোমরা তাঁর (আল্লাহর) তাকবীর পাঠ করবে, যাতে তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারো। - (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)


আর তাই সারা রমজান মাস রোজার রাখার পর আমরা ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ (হে আল্লাহ্‌ তুমি সবচেয়ে মহান, হে আল্লাহ্‌ তুমি সবচেয়ে মহান) বলতে বলতে ঈদের নামাজ পড়তে যাই, এটা আল্লাহর প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞতার বহি:প্রকাশ। হে আল্লাহ্‌ আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ - তাকওয়া অর্জনের জন্য, শয়তানের সাথে লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য, নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য – তুমি মানুষকে এত সুন্দর একটা মাস দিয়েছো, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ!

আর কোনো বোনাস আছে কি?

আমরা রোজা রাখব আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজনে। কিন্তু পরম করুনাময় আল্লাহ্‌ এই রোজার বিনিময়ে আমাদেরকে অনেক পুরষ্কার, আর পুরষ্কারের উপর পুরষ্কার দিবেন। যেমন, আমরা রমজানের এই গিফটকে কাজে লাগিয়ে অতীতের সব গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারি।

আবু হুরায়রা(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আল্লাহর কাছে পুরষ্কার পাওয়ার উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রোজা রাখবে, আল্লাহ্‌ তাঁর আগের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। (বুখারী, মুসলিম)


তাহলে শর্ত হলো, রোজা রাখতে হবে শুধুই আল্লাহর কাছ থেকে পুরষ্কার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কেউ যদি রোজা রাখে তার বাবা খুশী হবে এই ভেবে, বা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি বলবে এই ভেবে, অথবা বন্ধুরা বা প্রতিবেশীরা ‘রোজাদার’ বলবে ভেবে, বা বাসার সবাই রাখে তাই আমাকেও রাখতে হয় এই ভেবে – তাহলে গুনাহ মাফ হবে না। কারণ, একজনের বাবা/বন্ধুরা হয়তো রোজা রাখলে খুশী হয় আবার আরেকজনের বাবা/বন্ধুরা রোজা রাখলে অখুশী হয়। যার বাবা/বন্ধুরা রোজা রাখলে অখুশী হয় তার কখনো রোজাও রাখা হবে না, তাকওয়াও অর্জন করা হবে না।

রোজাদারেরা বিচার দিবসে ‘রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে (বুখারী)। রাইয়ান শব্দের একটা অর্থ হলো, পানির উৎস। যেহেতু, রোজাদারেরা দুনিয়াতে তৃষ্ণায় কষ্ট পেতে থাকার পরেও শুধু আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার জন্য পানি না খেয়ে ধৈর্য ধরত, তাই সেইদিন আল্লাহ্‌ তাদেরকে পুরষ্কারস্বরুপ নিয়ে যাবেন অনন্ত পানির উৎসের কাছে! আল্লাহ আমাদের সব ভালো কাজের পুরষ্কার ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন, কিন্তু রোজা রাখার পুরষ্কার আল্লাহ্‌ যত গুণ ইচ্ছা ততগুণ বাড়াবেন!

শেষ কথা:

আসুন আমরা সবাই এই রোজায় তাকওয়া অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, তারাবীহ নামাজ পড়ি, অর্থ বুঝে কোরআন পড়ার ও শুনার চেষ্টা করি। আর খুব বেশী বেশী করে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করি। মানুষ মাত্রই পাপী, এই পাপী মানুষদের মাঝে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা বেশী বেশী তাওবাহ করে।

কা’ব ইবনে উজরাহ(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) একবার তাঁর মিম্বরে আরোহন করার সময় প্রতি ধাপ পার হওয়ার সময় বললেন – ‘আমিন’। আমরা রাসূলুল্লাহ(সা) কে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন – আমি যখন মিম্বরে প্রথম ধাপ উঠলাম, জিব্রিল(আ) আমার কাছে আসলেন এবং বললেন – ‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রহমতের মাস রমজান পেল কিন্তু তার পাপগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারলো না’, আর আমি বললাম – ‘আমিন’। - (হাকিম, বায়হাকী)


আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত না করেন যারা রমজান মাস পেল, অথচ এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো, তাওবাহ করলো না এবং নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলো না।

পাদটীকা:

ইসলাম ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস আর অর্থহীন আচার-আচরণের উপর প্রতিষ্ঠিত না। ইসলাম একটি জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম, ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করা প্রত্যেক মানুষের জন্য ফরজ। রমজানে কাজে লাগবে এইরকম কিছু বইয়ের লিঙ্ক নিচে দেয়া হলো।

১। অনলাইনে কোরআনের বহুলভাবে প্রচারিত যে বাংলা অনুবাদগুলো পাওয়া যায় সেগুলোতে কোনও ব্যাখা না থাকায় সাধারণ পাঠকের জন্য এর থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই, আমি অনুরোধ করবো কোরআনের সংক্ষিপ্ত টীকা ও বাংলা উচ্চারণসহ তাজ নূরানী অনুবাদটি পড়ুন। আরো ভালোভাবে কোরআন বুঝতে চাইলে পড়ুন আহসানুল বায়ান

২। তাকওয়া অর্জন করতে চাইলে আপনাকে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে আর বেশী করে করতে হবে ভালো কাজ। কবিরা গুনাহগুলোর তালিকা পাবেন এই বইয়ে আর ভালো কাজের তালিকা পাবেন এই বইয়ে

৩। রমজান সংক্রান্ত বিভিন্ন বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন, কি করলে রোজা ভাঙ্গে, কি করলে ভাঙ্গে না পাবেন এই বইয়ে এবং এই ওয়েবসাইটে

রেফারেন্স:

১। Ramadan, a gift for Muslims by Nouman Ali Khan

২। Virtues of Ramadan – Dr. Yasir Qadhi

-

লেখকঃ আদনান ফায়সাল

মূল লেখার লিঙ্ক: আমরা রোজা রাখি কেন?

বিষয়: বিবিধ

১৪৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File